somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এক বীরাঙ্গণার মেয়ের কথা

১৫ ই মার্চ, ২০০৬ ভোর ৪:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমার গভীর আবেগ রয়েছে। আমার সাথে একজন মহান মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় হয়েছিল। খুব চেষ্টা করেছিলাম তাদের জন্য কিছু করার। কিন্তু পারিনি। শুধু তার মেয়েকে উৎসাহ দিয়েছিলাম। বিভিন্ন সময়ে তাদের কথা শুনে মেয়ের জবানিতে লেখাটি তৈরি করেছিলাম। এতে মেয়েটি তার অবস্থান কিছুটা হয়ত বুঝতে পেরেছিল। অনেক দিন তাদের সাথে যোগাযোগ নেই। একজনের পোস্টে দেখলাম, একজন বীরাঙ্গনা রীনার খোঁজ জানতে চেয়েছেন। তখন মনে পড়লো এই লেখাটির কথা। .............

মুক্তিযোদ্ধা মা-বাবার সন্তান আমি!

ছোট বেলায় আমার বাবা বাহুতে ক্ষতচিহ্নের দাগ দেখে জিজ্ঞাসা করতাম, এখানে কি হয়েছিল? বাবা বলতেন, ছোট বেলায় খেলা-ধুলা করতে গিয়ে খোঁচা লেগে ব্যাথা পেয়েছিলাম। অথচ তা ছিল, মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনীর বুলেটের আঘাতের চিহ্ন। আমাদের দরিদ্র সংসারে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মা-বাবা কখনো প্রসঙ্গ তুলতেন না। কিশোরী মনে ভাবতাম, মুক্তিযুদ্ধে বাবার কোনো অবদান নেই। মার অবদানের প্রশ্নই উঠেনা। যখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ছি। আর দশটা মেয়ের মতোই সংগ্রাম করে পড়া-লেখা চালিয়ে যাচ্ছি, দারিদ্র দশা যতটা সম্ভব আড়াল করে সহপাঠীদের সাথে তাল মিলিয়ে চলছি। এটাও এক যুদ্ধ। একদিন আমার বান্ধবীরা সংবাদপত্রের প্রকাশিত একটি খবরের প্রতি দুষ্টি আকর্ষণ করে বললো, তোমার মা একাত্তরে পাকবাহিনীর ক্যাম্পে আটক ছিল? তাদের নেতিবাচক মনোভাবে আমি হতবিহ্বল হলাম। নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছিল না, অথচ, প্রতিবেদনটি অস্বীকার করার উপায় ছিলনা। প্রচলিত সামাজিক অনুভূতি অনুযায়ী নিজের মাকে ঘৃণ্য মনে হচ্ছিল। সমাজতো তাই শিখিয়েছে । কাশ শেষে আমি আর বাসায় ফিরলাম না, রীতিমতো আত্নহত্যার কথা ভাবছিলাম। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত আমাকে এক বান্ধবী তার বাসায় নিয়ে গেলো। তিন দিন পর বাবা আমাকে খুঁজে বের করলেন। বললাম, আমি বাসায় যাবো না। অবশেষে, বাবা-মার কান্নায় আর অতীত স্মৃতিচারণে জানলাম, তারা দুজনই সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। বাবা আট নম্বর সেক্টরের অধীনে ফরিদপুরের রণাঙ্গণে হেমায়েত বাহিনীর তরুণ যোদ্ধা ছিলেন। সে এলাকায় যুদ্ধের প্রথম দিকে সদ্য কৈশোর পার হওয়া হিন্দু পরিবারের মেয়ে আমার মা কানন বালাকে স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগীতায় পাকবাহিনীর ক্যামঙ্ে ধরে নিয়ে যায়। দিনের পর দিন নির্যাতন চলে। এক পর্যায়ে হেমায়েত বাহিনী হিসেবে খ্যাত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল (যে দলে আমার তরুণ বাবাও ছিলেন) সেই ক্যাম্পে আক্রমণ করে শত্রুদের পরাস্ত করে। উদ্ধার পায় আরো অনেক মেয়ের সাথে আমার মা। কিন্তু তার পরিবার তাকে গ্রহণ করেনি। সে ফিরে আসে উদ্ধারকারী মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। জানায়, তার আত্নহত্যা ছাড়া কোনো পথ নেই। সে তাই করতে যাচ্ছে। কিন্তু, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের উৎসাহে তার প্রতিশোধ স্পৃহা জেগে ওঠে। সে তাদের সাথে যোগ দেয়। তাদের সহযোগী হিসেবে রান্না করা, আহত যোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা, অস্ত্র পরিবহন-রক্ষণাবেক্ষন প্রভৃতি কাজের পাশাপাশি, অস্ত্র চালনা শিখে এক পর্যায়ে বিভিন্ন অপারেশনেও অংশ নেয়। কাঙ্খিত স্বাধীনতা অর্জনের পর মা বললেন, স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করলাম তা অর্জিত হলো, এবার আত্নহত্যা করতে হবে। কারণ, আমার যাবার জায়গা নেই। তখন সহযোদ্ধা তরুণ আমার বাবা তাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কমান্ডার ব্যবস্থা করলেন। বাবা তার নাম দিলেন নাজমা বেগম। এবার বাবার কপাল পুড়লো। তার বাবা এবং পরিবারের সদস্যরা বললেন, এই মেয়েকে নিয়ে সংসারে আসতে পারবে না। যদি আসতেই হয়, তাকে ত্যাগ করো। নিজের হাতে স্বাধীন করা নিজ গ্রামে তাদের ঠাঁই হলো না। অজানা গন্তব্যে পা বাড়ালেন নতুন জুটি। 21 বছরের তরুন, 17 বছরের তরুণী। যুদ্ধ বিধ্বস্থ। সহায়সম্বলহীন। অনিশ্চিত চারিদিক। সদ্য স্বাধীন দেশের এক নতুন দম্পতি। আশ্রয় নিলেন বস্তিতে। আগের সব মাটি-চাপা দিয়ে আর দশজন গরিবের মতোই জীবন শুরু করলেন।

ব্রঞ্জের গহনার ফেরিওয়ালার পেশা বেছে নিলেন বাবা।

এরপর ভুলে যাওয়া পর্ব সামনে চলে এলো। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত আমরা তিন ভাই এক বোন মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় জীবন পার করছি। তাদের সহযোদ্ধা, কমান্ডার এবং শুভাকাঙখীরা আমাদের নতুনভাবে উদ্ধুদ্ধ করলেন। আমাদের মা লক্ষ মায়ের মধ্যে সেরা। আমাদের বাবা লক্ষ বাবার মধ্যে সেরা। এমন বাবা-মায়ের সন্তান হওয়া পরম গৌরবের। এখন আমাদের উপলব্ধিও তাই। আমরা দরিদ্রো তো কি হয়েছে? মা-বাবা কোনো বৈষয়িক লাভের জন্য যুদ্ধ করেন নি। তখনকার রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের মনে স্বাধীনতাই ছিল একমাত্র চিন্তা। স্বাধীনতার পর তাদের পরিচয় স্বাধীন দেশের নাগরিক। এটুকুই তাদের সুখ। কারা স্বাধীনতার সুফল ভোগ করে কোটিপতি হয়েছে, তা উপেক্ষা করে যাওয়াই তাদের জন্য শ্রেয়। এরপর নানা পর্যায় পাড়ি দিয়ে মা-বাবা মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হলেন। ভাতা পাওয়া শুরু করলেন। রাষ্ট্রের দেওয়া এই সামান্য ভাতাই আমাদের সংসারে বড় সান্তনা হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে। আমরা লেখা-পড়া করে বড় হওয়া স্বপ্ন দেখছিলাম। স্বপ্ন দেখেছি, একটা পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করলে রাষ্ট্র আমাদেরকে আরো সুবিধা দেবে। আমরা আরো প্রতিষ্ঠিত হতে পারবো। মুক্তিযোদ্ধা মা-বাবার বার্ধক্যে শুধু সন্তান হিসেবে নয়, নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ-প্রজন্মের দুজন সদস্যকে কিছুটা স্বস্তি দিতে সক্ষম হবো, এটুকুই স্বপ্ন। তা হলো না।

নতুন সরকার মতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা বাতিল হলো। নতুন তালিকার উদ্যোগ নেওয়া হলো। আমাদের মা-বাবার ভাতা বন্ধ হয়ে গেল। থেমে গেল আমাদের স্বপ্নের জাল বোনা। আমরা গরীব থেকে আরো গরীব হলাম। ভগ্ন দেহ-মন নিয়ে বাবার পরিশ্রম আরো বেড়ে গেল। মা গার্মেন্টস ঝুট বাছাইয়ের কষ্টকর কাজ বেছে নিলেন। শুধুই তাদের সন্তানদের পেটের ভাত জোটানোর জন্য। এই ভাত কি আমাদের মুখে যেতে চায়? তবুও খুড়িয়ে খুড়িয়ে জীবনকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি অবিরাম। উচ্চ-মাধ্যমিক শ্রেণীতে পড়ছি। সম্পূর্ণ করতে পারবো কি-না জানি না। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মা-বাবার তালিকাভুক্তির জন্য বাবা ফেরি করার পাশাপাশি সরকারি অফিসগুলোতে ধর্না দিচ্ছেন। তাদের তালিকাভুক্তি চূড়ান্ত হতে এখনো কিছু পর্যায় বাকী রয়েছে, কিন্তু যতো দেরী হচ্ছে ততই আমাদের কষ্ট বাড়ছে। আমাদের জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সরকার তথা মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুরোধ, দ্রুত আমার মা-বাবা নাজমা বেগম ও মোশারেফ শেখের বিষয়টি ফয়সালা করে বকেয়াসহ স্থগিত ভাতা চালু করুন। আমরা কৃতজ্ঞ থাকবো। -সোনিয়া, মিরপুর, ঢাকা
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মার্চ, ২০০৬ ভোর ৫:০৮
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×