জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে বলা হতো চলমান বিশ্বকোষ। অর্থশাস্ত্র, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস, শিল্প-সাহিত্য, ধর্ম-সংস্কৃতি এই সবগুলো বিষয় নিয়ে বিশেষজ্ঞের মতামত দেয়ার ক্ষমতা ছিল তাঁর। সমকালীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপীঠসমূহের শ্রেষ্ঠ মনীষীদের অনেকেই একবাক্যে তাঁর মেধা এবং ধী-শক্তির অন্যন্যতা স্বীকার করেছেন। এই নিভৃতচারী, অনাড়ম্বর জ্ঞানসাধক মানুষটি সারাজীবন কোনো গ্রন্থ রচনা করেননি।
তিনি ব্যক্তি মানুষটি কেমন মুষ্টিমেয় অনুরাগীর বাইরে অনেকেরই ধারণা নেই। এই অনুরাগীদের একজন আহমদ ছফা। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের ছাত্র। দীর্ঘ মেলামেশার ফলে প্রফেসর রাজ্জাককে ঘনিষ্ঠভাবে দেখার দুলর্ভ সুযোগ হয়েছে তাঁর। আর সেই অভিজ্ঞতা নিয়েই ছফা লিখেছেন 'যদ্যপি আমার গুরু'। অধ্যাপক রাজ্জাককে নিয়ে খোলামেলা, তীক্ষ্ম, গভীর এবং সরস গ্রন্থ। আহমদ ছফা'র সাথে আলাপচারিতায় নানা বিষয় নিয়ে বলেছেন প্রফেসর রাজ্জাক। আহমদ ছফা প্রানবন্ত ভাষায় সেগুলো উল্লেখ করেছেন 'যদ্যপি আমার গুরু'তে। আমার প্রিয় বই এটি।
আলাপচারিতার দু'একটি প্রসঙ্গ পাঠকদের সাথে শেয়ার করতে চাই।
প্রথম দফায় কবি জসিমউদ্দিন, মোহিতলাল মজুমদার ও নজরুল প্রসঙ্গ।
'.......সবে তিনি বাজার থেকে ফিরে এসেছেন। দুটি বিরাট ঝুরি ভরতি বাজারের সওদা। মাছ, মাংস, তরিতরকারি একে একে ভাতৃবধুর হাতে তুলে দিচ্ছেন। আমাকে দেখে একটু হাসলেন এবং জিগগেস করলেন, মৌলবি আহমদ ছফা, আপনে কখনো মৌলবিবাজার গেছেন?
আমি না-সূচক মাথা নাড়ালাম।
তিনি বললেন, একটা কথা খেয়াল রাখন খুব দরকার। যখন কোনো নতুন জায়গায় যাইবেন, দুইটা বিষয় পয়লা জানার চেষ্টা করবেন। ওই জায়গার মানুষ কী খায়। আর পড়ালেখা কী করে। কাঁচাবাজারে যাইবেন, কী খায় এইডা দেখনের লাইগ্যা। আর বইয়ের দোকানে যাইবেন পড়াশোনা কী করে হেইডা জাননের লাইগ্যা। আমি একবার তুরস্কের বইয়ের দোকানে যাইয়া দেখলাম, বামপন্থী বই আর ধর্মীয় বইপত্র সব দোকানে সাজাইয়া রাখছে। বইয়ের দোকান পরখ করলেই বেবাক সমাজটা কোনদিকে যাইতাছে, হেইডা টের পাওন যায়। আরেকবার কায়রো গিয়া দেখলাম, নীল নদের পাড়ে মজুর শ্রেণীর মানুষেরা বড় বড় গামলা ভরতি কইরা বরবটি জাতীয় ভেজিট্যাবল আরাম কইরা খাইতাছে। .... কী খায়, কী পড়ে এই দুইডা জিনিস না জানলে একটা জাতির কোনো কিছু জানন যায় না।
তিনি বাজার থেকে সবে এসেছেন, এখনও পায়ে প্যাঁক কাদা লেগে রয়েছে। পরনের লুঙ্গিটাও কাদার ছিটে লেগেছে। তিনি বললেন, মৌলবি আহমদ ছফা আপনে একটু বয়েন। আমার সারা গা কুটকুট করতাছে। একটু ধুইয়া আহি। বাথরুমে গিয়ে গোসল সেরে খদ্দরের সাদা পাজামা এং খয়েরি পাঞ্জাবি পরলেন। শরীরটা ভালো করে মোছা হয়নি বলে গোছা দাড়ি থেকে দুএক ফোঁটা পানি ঝরে পড়ছে। চাদর দিয়ে মুছে নিয়ে গুড়গুড়িতে টান দিয়ে বললেন, মৌলবি আহমদ ছফা, ওই যে আপনের বই। তিনি বড় টেবিলটা দেখিযে দিলেন। আমি আমার চারটি বই দেখতে পেলাম্ তিনি ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, একটা কতা মনে রাখন খুব জরুরি। এই যে হবস তাঁর লেভিয়াথান বইতে তিনটা শব্দ 'ন্যাস্টি', 'ব্রুটিস' এবং 'শর্ট' যেভাবে যে অর্থে ব্যবহার করেছেন, তার বদলে বেবাক ডিকশনারি খুঁইজ্যাও আপনে কোনো শব্দ পাইবেন না। যখন গদ্য লিখবেন এই কথাটি সবসময় মনে রাইখেন। আমার বুঝতে বাকি রইলো না, আমার বইতে যে দীর্ঘ আবেগসর্বস্ব বাক্য আমি লিখেছি, সেদিকে তিনি ইঙ্গিত করছেন। আমি ভীষণ শরমিন্দা হয়ে পড়লাম।
.....আপনে জসীমুদ্দীনের লেখাটেখা পড়েন। আমি জবাব দিলাম, এক সময় জসীমুদ্দীন সাহেবের লেখা পড়তাম। এখন আর কোনো আগ্রহ বোধ করিনে।
রাজ্জাক স্যার বললেন, আমি জসীমুদ্দীনের লেখা খুব পছন্দ করি। আপনি কি তাঁর আত্নজীবনী পড়েছেন?
আমি বললাম, 'জীবন কথা'র কথা বলছেন স্যার? পড়েছি।
গদ্যটি কেমন?
খুব সুন্দর।
রাজ্জাক সাহেব বললেন, এরকম রচনা সচরাচর দেখা যায় না। তারপর তিনি হুঁকো টানতে টানতে জসীমুদ্দীনের গল্প বলতে আরম্ভ করলেন। একসময় কলকাতায় আমি এবং জসীমুদ্দীন এক বাড়িতে থাকতাম। একদিন জসীমুদ্দীন আমাকে কাপড়চোপড় পইরা তাড়াতাড়ি তৈয়ার অইবার তাগাদা দিতে লাগরেন। আমি জিগাইলাম, কই যাইবার চান। জসীমুদ্দীন কইলেন, এক জায়গায় যাওন লাগব। কাপড়চোপড় পইরা তার লগে হাঁইটা হাঁইটা যখান এ্যাসপ্ল্যানেডে আইলাম, জসীমুদ্দীন ঘাড় চুলকাইয়া কইলেন, কও দেখি এখন কই যাওন যায়? এইরকম কান্ড অনেকবার অইছে। একটুখানি হাসলেন।
কবি জসীমুদ্দীনের প্রসঙ্গ ধরে কবি মোহিতলালের কথা উঠলো। মোহিতলাল মজুমদার পূর্ববাংলার উচ্চারণরীতি বরদাশত করতে পারতেন না। কবি জসীমুদ্দীনের একটা কবিতার বইয়ের নাম ছিল ধান খেত। মোহিতবাবু ব্যঙ্গ করে বলতেন জসীমুদ্দীন ধান খেতো। মোহিতলালের জিভের মধ্যে বিষ আছিল। তাঁর ঠাট্টা রসিকতা এমনভাবে ছড়াইয়া পড়ল জসীমুদ্দীন বেচারার জান যাওনের দশা। একদিন আমি মোহিতবাবুরে চ্যালেঞ্জ কইরা বইলাম। কইলাম, আপনে জসীমুদ্দীনরে এত ঠাট্টা করেন ক্যান্। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যদি জসীমুদ্দীনের উপর এক অধ্যায় লেখা অয়, আপনেরে নিয়া লেখব মাত্র চাইর লাইন।
এরপর রাজ্জাক সাহেব একটি সাম্প্রতিক প্রসঙ্গের অবতারণা করলেন। দ্যাহেন বাংলাদেশ সরকার জসীমুদ্দীনরে কিছু করল না।আমারে আর জয়নুল আবেদিন সাহেবরে মুশকিলে ফেলাইয়া দিছে। আমগো দুইজনেরে ন্যাশনাল প্রফেসর বানাইছে, আর জসীমুদ্দীনরে কিছু বানায় নাই।
আলোচনার একটা পর্যায়ে কাজী নজরুল ইসলামে এসে ঠেকলো। তিনি কীভাবে নজরুলের রচনার সঙ্গে পরিচিত হন, সেই কাহিনী বয়ান করলেন। রাজ্জাক স্যার যা বলছিলেন তার সবটুকু আমি ভুলে বসে আছি। শুধু এটুকু মনে আছে, নজরুলকে ঢাকায় জলসায় তিনি গান গাইতে দেখেছেন। এটাও জানালেন, নজরুল ইসলাম এবং দ্বিজেন্দ্রলাল তনয় দীলিপ রায়ের মধ্যে একটি প্রতিযোগিতার ভাব ছিলো। রাজ্জাক সাহেব জানালেন, কলকাতায় তাঁরা যেখানে থাকতেন, সে জায়গাটা কাননবালার বাড়ির খুব কাছাকাছি ছিল। কাননের বাড়িতে নজরুল ইসলাম পড়ে থাকতেন। উস্তাদ জমীরুদ্দিন এবং কাজী নজরুল ইসলাম মিলে সুরের নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করতেন। কোথাও আড্ডায় মজে গেলে নজরুল ইসলামের দিন রাত খেয়াল থাকতো না। মাঝে মাঝে নজরুরের শাশুড়ি গিরিবালা দেবী এসে কাননের বাড়ি থেকে নজরুলকে ধরে নিয়ে যেতেন।
কাজী নজরুর ইসলামের প্রসঙ্গ উঠলে রাজ্জাক স্যার শিশুর মতো উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতেন। নজরুলের জন্য তাঁর প্রাণে এক গভীর ভালোবাসা সঞ্চিত ছিলো। তিনি প্রায়ই বলতেন, বৈষ্ণব কবিদের পর কোনো গীতিকারই নজরুলের মতো জনচিত্তে অমন আসন লাভ করতে পারেনি। তিনি প্রেমেন মিত্তিরের একটা কবিতার লাইন আবৃত্তি করলেন, বজ্র, বিদ্যুৎ আর ফুল এই তিনে কাজী নজরুল।'