somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইম্প্রেশনিস্ট আর্টিস্ট :: এদগার দেগা (Edgar Degas)

০৪ ঠা জুন, ২০১৩ রাত ১০:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


চিত্রকলায় ফ্রান্সের 'ইম্প্রেশনিজম' আন্দোলনের গল্প'টা কোনও উপন্যাস বা সিনেমার চেয়ে কম নাটকীয় না ! মোটামুটি অর্থকষ্টে ভোগা একদল তরুণ ছেলে-মেয়ে হঠাৎ করে এসে হইচই করে সমস্ত ট্র্যাডিশনাল নিয়ম ভাঙতে শুরু করল, আর তারপর পৃথিবীর চিত্রশিল্পের ইতিহাস পাল্টে দিল চিরদিনের মত ! ক্লাসিকাল পুরাণ-কাহিনী বা রুপকথা-নির্ভর পেইন্টিংস ছেড়ে তাদের ছবিতে উঠে আসতে লাগল একদম বাস্তব সব দৃশ্যাবলী; যেই দৃশ্যে সাধারণ জীবনের গল্প আছে, প্রতিদিনের ঘটনাবলীর নিখুঁত বর্ণনা আছে। পেইন্টিংসগুলো হয়ে উঠল সহজ, সুন্দর আর জীবন্ত !


The Orchestra at the Opera: Edgar Degas

ক্লদ মনে', রেনোয়া', কামিল পিসারো, এদুয়ার মানে', এদগার দেগা' - চিত্রশিল্পের ইতিহাসে এখন অবিস্মরণীয় কয়েকটা নাম। ইম্প্রেশনিস্ট আর্টিস্টদের নিয়ে ধারাবাহিক পোস্ট দেয়ার ইচ্ছা আছে, আজকের পর্ব শুরু করছি 'এদগার দেগা'কে দিয়ে। আলো, রং আর সৌন্দর্যের এক অপূর্ব জগতে আপনাকে স্বাগতম জানাচ্ছি।

অধিকাংশ ইম্প্রেশনিস্ট আর্টিস্টের তুলনায় দেগা'র জন্ম মোটামুটি সচ্ছল পরিবারে, ১৮৩৪ সালে। তার বাবা ছিলেন ব্যাংকার। অল্প বয়স থেকেই দেগা'র ছিল পেইন্টিং-এর শখ, স্কুল জীবন শেষ করতে করতেই তিনি তার বাসায় একটা আলাদা আর্ট-স্টুডিও পর্যন্ত বানিয়ে ফেলেন। এরপর 'ইউনিভার্সিটি অফ প্যারিস'-এ আইন অনুষদে ভর্তি হলেও ওদিকে তার খুব একটা আগ্রহ দেখা যায়নি। এর মাঝে (১৮৫৫ সালে) একদিন সাক্ষাৎ পান ঐ সময়ের অন্যতম সেলিব্রেটি আর্টিস্ট Dominique Ingres-এর। পেইন্টিংস বিষয়ে ইঙ্গার্সের দেয়া একটা উপদেশ দেগা পরবর্তী সময়ে কখনও ভুলেননি - "Draw lines, young man, and still more lines, both from life and from memory, and you will become a good artist." ইঙ্গার্স যদি জানতেন - তার সামনের এই শান্ত-শিষ্ট ইয়াংম্যান আরও ক'জনকে নিয়ে একদিন চিত্রশিল্পের ধরনই পাল্টে দিবে !


(সেল্ফ পোর্ট্রেট: এদগার দেগা)

তো ১৮৫৫-তে দেগা ভর্তি হয়ে গেলেন ফ্রান্সের বিখ্যাত "École des Beaux-Arts" (স্কুল অফ ফাইন আর্টস)-এ। পরের বছরই তিনি ইতালী চলে যান, আর বছরতিনেক রেনেঁসা শিল্পীদের প্রচুর পেইন্টিংস কপি করার কাজ করেন। ১৮৫৯-এ দেগা আবার ফ্রান্সে ফিরে আসেন, আর এরও তিন বছর পর লুভর মিউজিয়ামে পরিচিত হন এদুয়ার মানে'র সাথে। ইতিহাসের এক ক্রান্তিলগ্ন। ঠিক ওইসময় আরও চার বন্ধু তখন নিজেদের প্রস্তুত করছিল এক ভিন্ন দৃষ্টিতে এক-পৃথিবী'র গল্পগুলো ক্যানভাসে বেঁধে রাখতে। এই সিরিজ চলতে থাকলে তাদের সবার গল্প আলাদা করে বলব, আশা রাখছি।

দেগা'র কথায় ফিরে আসি। ফ্রান্সে ফিরে আসার পর দেগা প্রাথমিকভাবে তার খুব কাছের মানুষদের পোর্ট্রেট আর চেনা জীবনের ছবি আঁকতে থাকেন। দেগা'র পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড, একাডেমিক শিক্ষা, তার ওপর রেনেঁসা আর্টের ওপর দখল - সব মিলিয়ে একজন নিখুঁত ট্র্যাডিশনাল পেইন্টার হওয়ার সমস্ত আভাস তার মাঝে ছিল। কিন্তু কী এক খেয়ালে, সময়ের সাথে সাথে তার চিত্রের রং আর চেহারা রূপ নিচ্ছিল সম্পূর্ণ নতুন আর ইউনিক একটা ফর্মে। ছবিগুলো সব উজ্জ্বল আর সাহসী, বাস্তব আর আনপ্রেডিক্টেবল। ইম্প্রেশনিজমের ওপর BBC'র নির্মিত ডকুমেন্টারী'তে দেগা'র সম্পর্কে বলা হয়েছে - "He was also a genious and quite shockingly ungovernable and adventurous"


(পারিবারিক ছবি: দেগা'র আঁকা তার দাদা'র ছবি)

উদাহরণস্বরূপ, তার 'ঘোড়দৌড়ে'র ছবিগুলোর কথাই বলি। তার আগে বলে রাখি, ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পী'রা ট্র্যাডিশনাল শিল্পীদের মত শুধু স্টুডিওতে বসে কল্পনার উপর রং ছড়াতেন না। তারা যা দেখবেন, তাই আঁকবেন বলে ঠিক করেছিলেন। ফলে সবাইকে হতবাক করে দিয়ে তারা বাক্স-পেটরা হাতে নিয়ে ছবি আঁকার জন্য চলে গেলেন বনে-পাহাড়ে, শহরে-গ্রামে, বরফে-সাগরতীরে। দেগাও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। সেই সময় ফ্রান্সে শহুরে সমাজে নতুন ক্রেজ ছিল 'ঘোড়দৌড়'। নগরবাসীর সমগ্র আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু; স্বাভাবিকভাবেই আমাদের শিল্পীদেরও। যেখানেই প্রাণবন্ত জীবন, সেখানেই ইম্প্রেশনিস্ট'রা ! তবে, দেগা'র বিশেষত্ব হল - তিনি প্রথমবারের মত ঘোড়া'কে আঁকতে চাইলেন নিখুঁত বাস্তব করে। ঘোড়া যেই মুহুর্তে ছুটে, প্রতিটা মুহুর্তের একদম সঠিক মুভমেন্ট কিন্তু আমাদের চোখে ধরা পড়ে না। বরং সবটা মিলে আমরা দেখতে পাই একটা তেজী প্রাণী ছুটে যাচ্ছে। কিন্তু দেগা রেসকোর্সে গিয়ে সাক্ষাৎ পেলেন এক ব্রিটিশ ফটোগ্রাফার Eadweard Muybridge-এর, যিনি ঐ সময় ঘোড়া'র মুভমেন্ট নিয়ে গবেষণা করছিলেন। এক লাইনে অনেকগুলো ক্যামেরা বসিয়ে Muybridge চলমান ঘোড়া'র প্রতিমুহুর্তের স্ন্যাপশট নিচ্ছিলেন, আর যে ছবিগুলো আসল তা রীতিমত অবাক করার মত। সবটা মিলিয়ে ঘোড়া'কে প্রবল তেজস্বী দেখালেও যেকোনও একটা মুহুর্তকে দেখতে গেলে দেখা যায়, ঘোড়া'র মুভমেন্টে সেই Grace নেই !

(


(মাইব্রিজের ফটোগ্রাফি)

আলাদা করে দেখলে প্রতিটা ভঙ্গিমা কেমন দৃষ্টিকটু, যেমনটা আমরা দেখার কথা ভাবি না ! দেগা কল্পনা'র তেজী রূপ বাদ দিয়ে বাস্তব মুভমেন্ট আঁকার পক্ষেই থাকলেন, আর প্রথমবারের মত রেসের এমন কিছু ছবি তৈরি হল সেগুলো অদ্ভূত অথচ বাস্তব !




(দেগা'র আঁকা রেসকোর্সের ছবি)

তবে দেগা'র ছবি মহিমান্বিত হয়ে উঠল যখন থেকে তিনি তার এই ব্যতিক্রম দৃষ্টিভঙ্গি সব-বিষয়ের ছবিতে আনতে শুরু করলেন। এমনকি ন্যুড স্টাডিতেও - মডেলের সৌন্দর্য বা আবেদনময়তা না, দেগা আঁকলেন একদম অড-অ্যাঙ্গেল (Odd Angle) থেকে কিছু ছবি ! এসব দৃশ্য হয়তো সব শিল্পীই দেখেন, কিন্তু কোনও শিল্পীই আঁকেন না !



কোনও বিশেষ ভঙ্গিমা বা পোজ না, দেগা'র তুলিতে ধরা পড়তে লাগল মডেলদের স্বাভাবিক এবং জীবন্ত চলাফেরার দৃশ্য !



কিন্তু যে ছবিগুলো'র জন্য দেগা অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন; তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজগুলো ছিলো ব্যালে ডান্সের চিত্রমালা ! নাচঘরের প্রতিটা মুহুর্তকে দেগা দেখেছেন অসাধারণ দৃষ্টি এবং সেন্স দিয়ে। ছবিগুলো দেখলে চোখ ফেরানো যায় না - পুতুলের মত মেয়েগুলো যেন নেচে বেড়াচ্ছে, শূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছে !



আর দেগা'র ইউনিক স্টাইল অনুযায়ী, তিনি এখানেও এমন একটা কাজ করলেন, যা হয়তো অন্য কোনও সাধারণ শিল্পী করতেন না ! স্টেজে স্টার বা প্রধান ড্যান্সারকে বাদ দিয়ে বেশিরভাগ ছবিতে তিনি বরং আঁকতে থাকলেন - সাধারণ ড্যান্সারদের ! অনেকক্ষেত্রে শিক্ষানবীশদের !



তাদের চেষ্টা আর মনোযোগ, দৃঢ়তা আর অভিব্যক্তি - সব এত জীবন্ত ! মেয়েগুলোকে দেগা তার গভীর মমতায় ক্যানভাসে এনে অমর করে গেলেন !



প্রতিটা ছবি যেন জীবন্ত, ছবি'র মানুষগুলো'র অনুভূতি যেন স্পষ্ট পড়ে ফেলা যায় !



রং-এর ক্ষেত্রেও দেগা ইউনিক ! তরল রং আর ব্রাশ-স্ট্রোক না, দেগা ক্যানভাসজুড়ে ছড়িয়ে দিলেন পেস্টাল, যা তার ছবিতে নিয়ে আসল এক অভূতপূর্ব আমেজ ! এমনটা আগে কখনও দেখা যায়নি !



ছবিগুলো'র উজ্জ্বলতা চোখে পড়া'র মত ! সবখানে প্রাণপ্রাচুর্য (এটাই অবশ্য সমস্ত ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীদের ছবি'র মূল ধারা)! BBC'র ওই ডকুমেন্টারী'তে দেগা'র ছবি সম্পর্কে বলা হয়েছিল, "Something glorious and colourful, blurry and intoxicating" -- অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই !



শুধু চিত্রকর্মে নয়, পরে আবিস্কৃত হয়েছে দেগা'র ভাস্কর্য গুণের উদাহরণও ! ১৪ বছর বয়সী এক কিশোরী ড্যান্সারের এক তীব্র ভঙ্গিমা দেগা স্থির করে রেখে গেলেন তার ধাতব কারুকার্যে !



আমি খুব সংক্ষেপে এক মহান শিল্পী এদগার দেগা'র চিত্রকর্মের সাথে প্রাথমিক পরিচয়টুকু করিয়ে দিতে চাইলাম মাত্র। এসব দেগা'র কালজয়ী সব শিল্পকর্মের একটা অংশমাত্র। কালক্রমে রেনোয়া, মনে', পিসারো - তার আর সব সহযোদ্ধা শিল্পীদের গল্পও বলার চেষ্টা করব, যারা সনাতন শিল্পীসমাজের ক্রমাগত টিটকারী/তিরস্কার সত্বেও নিজেদের মত এক পৃথিবী গড়ে গেছেন সমস্ত ট্র্যাডিশনাল নিয়ম ভেঙে। এই পোস্টে শুধু দেগা'র শিল্পকর্ম নিয়ে কথা বললাম, কিন্তু বিরূপ পরিবেশে এই শিল্পীদের সংগ্রাম নিয়ে কিছু বলা হয়নি। সবটা একবারে বলব নাকি? এই আন্দোলনের গল্প নিয়েই একটা পোস্ট দিতে চেষ্টা করব পরে।

নিচের ছবিটা দেখুন? এদগার দেগা'র এক অমর সৃষ্টি দুই হাত বাড়িয়ে আপনাকে ডাকছে রং-ঝলমলে এক উজ্জ্বল জগতে ! ইম্প্রেশনিস্ট'দের পৃথিবীতে আপনাকে স্বাগতম !

১৮টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×