চশমাটা খুলে রাখে মুস্তাকীম। চোখ টনটন করছে। দুহাতে চোখ রগড়ায়। টানা চারঘন্টা খেলছে ও।
কম্পিউটার বন্ধ করে অন্যকিছু করার কথা ভাবল এবার। কিন্তু কি করা যায় সেটাই মাথায় আসছেনা।
আম্মু এখনও অফিস থেকে ফিরেনি। ছটা বেজে গেছে। ওদিকে রাস্তায় ককটেল ফোটা শুরু হয়েছে। ট্যানারিতে চাঁদাবাজির দখল নিয়ে মাঝে মাঝেই এখানকার দুটো গ্র“পের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, ককটেল চার্জ, গোলাগুলি হয়।
মুস্তাকীমদের বাসাটা নীচতলায়। একদিন একটা ককটেল ঠিক ওদের বারান্দায় এসে ফুটেছিল। বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিল ও।
আরেকদিন ওদের ড্রইং রুমে একটা ছেলে দৌড়ে এসে ঢুকল। ঢূকেই ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। বারান্দায় টেনিস বল নিয়ে একা একাই খেলছিল মুস্তাকীম; ও বাইরে রয়ে গেল।
আম্মু অফিসে ছিল। বুয়া দরজা খুলে ওকে তাড়াতাড়ি বাসার ভেতরে নিয়ে নিল।
ছোটমামার মতো বিশ পঁচিশ বছর বয়সী ছেলেটা বুয়ার পা জড়িয়ে ধরে বলল- ‘আমাকে বাঁচান’- ‘আমাকে বাঁচান’ ওরা আমাকে পেলে মেরে ফেলবে- ‘আমাকে বাঁচান’।
বুয়া বলল, -‘ঠিক আছে খাটের তলে ঢুইকা পড়েন।’
এমন সময় দরজায় ধাক্কার পর ধাক্কা পড়তে থাকল।
বুয়া বলল কে?
- কথা আছে খোলেন।
- বাসায় কেউ নাই। আমি খোলতে পারমুনা।
লোকটা তবুও ধাক্কাতে থাকল।
বুয়া দরজার পাশের জানালাটা খুলে দিল, মুস্তাকীম বুয়ার পেছনে দাঁড়িয়ে।
তিন চারজন ছেলে জানালার সামনে এসে ভীড় করল! একজনের হাতে একটা ছুরি অন্য দুজনের হাতে দু’টা পিস্তল।
- ‘এদিকে আমাদের মতো একটা ছেলে আসতে দেখেছেন?
- ‘আমি দেখমু কেমনে? আমিত বাসার ভিতরে।
- এই বাবু তুমি দেখেছ?
কি বলবে ঠিক করতে না পেরে চুপচাপ ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে মুস্তাকীম।
আর কিছু না বলে একজন আরেক জনের দিকে চোখের ইশারা ক’রে দ্রুত রাস্তার দিকে ছুটে যায় ওরা।
মুস্তাকীম ধরেছিল বুয়াকে- ‘তুমি মিথ্যে কথা বললে কেন? মিথ্যা না বলে অন্যভাবেওতো বলতে পারতে।
রেগে যায় বুয়া- ‘আমার মাতায় অত বুদ্ধি নাই, তোমার মতো লেহাপড়াতো করি নাই।’
মুস্তাকীম সোফায় বসে পড়ে আর আগন্তুক খাটের নীচেই শুয়ে আছে।
কেমন যেন একটা থমথমে আতংকে চুপচাপ বসে থাকে সবাই। ছেলেগুলো যদি আবার ফিরে আসে? যদি বলে দরজা খোল আমরা দেখব তখন!
প্রায় আধঘন্টা পর খাটের নীচ থেকে বেরিয়ে এসেছিল ছেলেটা। তারপর দরজা খুলে বাসার পেছনের ওয়াল টপকে চলে গিয়েছিল।
চোখের ব্যাথায় শেষ পর্যন্ত কম্পিউটার বন্ধ করে মুস্তাকীম। চোখে ঠাণ্ডা পানি দিল অনেকক্ষণ। তারপÍ চোখ বন্ধকরে শুয়ে পড়ল ও।
রাস্তায় ককটেল ফুটছে। আর থেমে থেমে গুলিও হচ্ছে। ছ’টা বাজে। আম্মুর অফিস থেকে ফেরার সময় এটা। গোলাগুলির ভেতর দিয়ে আম্মু কেমন ক’রে গলিতে ঢুকবে চিন্তিত হয় মুস্তাকীম। দুপুরে দুধ-টোস্ট খেয়েছে আম্মু এলে ভাত খাবে বলে অপেক্ষা করছে।
দরজা খুলে বারান্দায় এসে বসে ও। আম্মু হয়তো এক্ষুনি এসে পড়বে।
রাস্তায় ভীষন হৈ-হল্লা আর চীৎকার শোনা যাচ্ছে।
গেটের ছোট দরোজাটা খুলে বাইরে তাকায় মুস্তাকীম। হন্তদন্ত হয়ে ওকে ধাক্কা দিয়ে গেটের ভেতর ঢোকে। কয়েকজন ছেলে। একপাশে ছিটকে পড়ে যায় ও। ঢুকেই ওরা ভেতর থেকে গেট আটকে দেয়। মোট চার জন।
একজনের হাতে একটা বড় পিস্তল।
আরেকজনের হাতে পুলিশদের বন্ধুকের চে’ ছোট একটা বন্দুক।
ভেতরে ঢুকে ওরা ছোট্ট বাগানটার মাঝখানের খালি জায়গাটুকুতে দাঁড়াল। বড় গেটটার সবগুলো হুড়কা আটকে দিয়ে ছোট গেটটাঁ খোলা রাখল।
আরো দুজন ঢুকল। রাস্তার দিকে চোখ রেখে ওরা গেটেই দাঁড়িয়ে থাকল।
একজন বলল- এই পি”্চি কোন ক্লাশে পড় তুমি?
- সেভেনে।
-ভাল
বারান্দায় এসে বসল একজন। তার হাতে পিস্তল। মুস্তাকীম হাত বাড়িয়ে দিলো
- একটু দেখতে দিবেন?
না ছোট ভাই দেয়া যাবেনা। ফুল লোড।
তারপর কি মনে করে সেফটি লক অন করে পিস্তলটা দিল মুস্তাকীমের হাতে।
হাতে পেয়ে পিস্তুলটা উল্টে পাল্টে দেখল ও। ছোটমামা কিছুদিন আগে ওকে যে খেলনা পিস্তলটা কিনে দিয়েছিল সেটার সাথে বেশ মিল আছে।
তবে এটা ইস্পাতের বানানো আর ভীষণ ভারী কিন্তু ওরটা মোটা প্লাস্টিকের। ওর বন্দুকের গুলিগুলোও প্লাস্টিকের।
আসল পিস্তুলটার গুলি গুলো দেখতে ইচ্ছে করছে মুস্তাকীমের।
- একটা গুলি দেখাবেন?
বুলেট কেস খুলে দুটো গুলি বের করে দেখাল ওকে ছোট মামার মতো ছেলেটা।
কার থেকে গুলি করলে কেমন শব্দ হয় শুনতে ইচ্ছে করল মুস্তাকীমের।
- ওই ওয়ালটায় একটা গুলি করেনতো কেমন শব্দ হয় শুনি।
অঁৎকে ওঠে ছেলেটা। -‘না না এখন শব্দ করা যাবেনা। তাহলে ওপাশ থেকে ওরাও ফয়ার শুরু করবে। আমাদের কাছে খুব বেশী গুলি নেই
গেটের কাছের ছেলে দুটো, একটা ছেলেকে টেনে হিঁচড়ে গেটের ভিতরে ঢুকিয়ে ছোট গেটটাও বন্ধ করে দিল।
তারপর সবাই মিলে মারতে আরম্ভ করল। চীৎকার করে কাঁদতে থাকল ছেলেটা। রুমাল ঢুকিয়ে দিল ওরা ওর মুখের ভেতর। অন্যদিকে তাকিয়ে থাকল মুস্তাকীম।
চোখ ছল ছল করছে মুস্তাকীমের। একজন মানুষের কান্নার অধিকারটুকুও কেড়ে নেবার চরমতম নিষ্ঠুরতায় ভীষণ দু:খ পেল ও। ছেলেটার ঠোঁট, কপাল, হাত থেকে রক্ত ঝরতে শুরু করেছে।
মুস্তাকীম ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকল ওদের দিকে। ঘরে ভাল লাগছিলনা বলে ও একটু বাইরে এসেছিল। ওর কাছাকাছি বসে থাকা ছেলেটা ওকে অভয় দিল তুমি ভয় পেয়োনা তোমাকে কিছু করবেনা।
- ওকে এভাবে মারল কেন?
- তুমি ছোট মানুষ বুঝবা না। বড় ভাইদের কথা না শুনলে এভাবে সাইজ দিতে হয়।
ছোট গেটে নক হচ্ছে। একজন গিয়ে গেটটা একটু ফাঁক করে দেখল কে এসেছে; তারপর সরে দাঁড়াল।
মুস্তাকীম দেখল আম্মু এসেছে। আম্মু চারদিকে একবার নজর বুলিয়ে মুস্তাকীমের হাত ধ’রে সোজা বাসায় ঢুকে দরজা আটকে দিলেন।
আম্মুর চেহারা ভীষণ রাগী রাগী। বুয়াকে বকলেন খুব
-দরজা খোলা ছিল কেন
মুস্তাকীম বাইরে কেন বুয়া ?
বুয়া কাচুমাচু হয়ে বলল- ‘আম্মা আমার কুনু দুষ নাই। গুসুল করতাছিলাম- হবায় বার অইছি, ভাইয়ায় কুনসুমায় বার অইছে আমি টেরও পাই নাই।
দরজায় নক হচ্ছে। বুয়া আরো বকা খাওয়া থেকে বেঁচে গেল।
দরজা খুলতে চলে গেল বুয়া। আশংকিত হয়ে উঠল মুস্তাকীম। আম্মু এবার ওকেই বলবে। কিন্তু না আম্মু রেগে ওর ঠিক উল্টো দিকে তাকিয়ে আছে। সম্ভবত: আম্মু খুব বেশী রেগে গেছে।
ভয়ে বই-খাতা টেনে পড়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলে মুস্তাকীম।
ছোটমামা এসে ঘরে ঢোকে।
হাতে পটেটো চিপ্স।
চিপস্টা ওকে দিয়ে বসল মামা। আম্মু এবার মুখ ফিরাল।
- চিপস্ কেন ওর জন্য এক প্যকেট বুলেট নিয়ে আসতি, তাই খেত।
একটু অবাক হয়ে আম্মুর কথা শোনে মামা। বাসায় ঢুকে কি দৃশ্য দেখেছিলেন এবার তার বর্ণনা দেয় আম্মু।
মামা বললেন- আমি দেখে এলাম ওরা চলে যাচ্ছে।
- ‘এবার বলতো কি করি।’ রাগ ক্ষোভ মেশানো কণ্ঠে বলেন আম্মু।
- তুমি বাড়িওয়ালাকে বলো ওনার গেটের ভেতর উনি এসব হতে দিচ্ছেন কেন? নিজে বন্ধ করতে না পারলে পুলিশ ডাকছেন না কেন?
- দেখি এখনই গিয়ে বলে আসি।
তিনতলায় বাড়িওয়ালার বাসায় যাবার জন্য বেরিয়ে যায় আম্মু।
চিপস্ খেতে শুরু করে মুস্তাকীম। টি’ভি অন করে কার্টুন দেখতে থাকে মনোযোগ দিয়ে।
কিছুক্ষুণ পর বাড়ীওয়ালার বাসা থেকে ফিরে এলেন আম্মু। মুখ থমথমে।মামা জানতে চানÑ
- কি কথা হলো আপা?
- কি আর হবে? আমার কথা শুনে বলল ওরা কতক্ষণইবা ছিল- আমাদেরতো কিছু করছেনা। ওদের কাজ করে ওরা চলে গ্যাছে- ওদের কাজের দায় দায়িত্ব ওদের। খামাখা আমরা ঝামেলায় জড়িয়ে লাভ কি?- এসব করতে গেলে পুলিশ ডাকতে হয়- না হয় অন্য মাস্তানদের ডাকতে হয়- ঘুষ ছাড়া পুলিশ কাজ করবেনা- আমাদের থেকে ঘুষ নেয়ার দুদিন বাদেই ওদের থেকে ঘুষ খেয়ে আবার ওদের পক্ষেই কাজ করবে তখন মাস্তানদের ঠেকাবে কে? নানা যন্ত্রণা আর সমস্যা করতে থাকবে। তখন প্রটেকশন পেতে হলে প্রতি সপ্তাহে পুলিশকে ঘুষ দিয়ে যেতে হবে। এত ঝামেলা কে করে? এইসব আর কি।
আম্মুর কথাগুলো শুনে খুব দু:খ হলো মুস্তাকীমের। ওর মনে হলো আহা: পুলিশেরা যদি ঘুষ না খেয়েই কাজ করত।
এমনি সময় হঠাৎ টিভির দিকে দৃষ্টি গেল আম্মুর। একটা ইংরেজী ড্রামা সিরিয়াল চলছে।
- টিভি ছাড়ল কে? কি দেখছিস তোরা এটা । আমিতো মুস্তাকীমকে বেছে বেছে প্রোগ্রাম দেখতে দেই । আজে-বাজে অনুষ্ঠান দেখতে দেয়া আর বাচ্চাকে ফোঁটা ফোঁটা বিষখাওয়ানো সমান কথা।শরীরের জন্য যেমন পুষ্টিকর খাবার দরকার তেমনি মনের জন্যওতো ভালো চিন্তা ভাবনা দরকার তাইনা?
স’রি আপা, আমি আর মুস্তাকীমতো গল্প করছিলাম। কখন ওই সিরিয়াল শুরু হয়েছে খেয়ালই করিনি।
মামা টিভি অফ করে দিল।
আবার প্রচণ্ড শব্দে একটা ককটেল ফুটল রাস্তায়।
মুস্তাকীমের আব্বুর বাসায় ফেরার সময় হয়ে গেছে। ভাবনা হচ্ছে সবার। কোন গণ্ডগোলের মধ্যে না আবার পড়ে যান উনি।
মামা প্রস্তাব করে- এত গণ্ডগোল এখানে, বাসাটা চেঞ্জ করে অন্য কোন এলাকায় চলে যাওতো আপা।
অনেকদিনতো কোন গণ্ডগোল হয়নি। এই ধর বছর খানেক আগে একবার হয়েছিল। ভেবেছিলাম আর হবেনা। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে লাগাতার গন্ডগোল হচ্ছে। বাসাটা চেঞ্জ করতে হবে দেখছি।
আরো কয়েকটা ককটেল ফুটে পরপর। আশংকিত মনে বসে থাকে সবাই। আব্বু কেমন ক’রে বাসায় আসবে চিন্তায় পড়ে যায় মুস্তাকীমও। মন খারাপ করেই ও জানতে চায়।
- কোথায় বাসা নেবে আম্মু?
- এখনই কি করে বলি। তোমার স্কুলের কাছাকাছি কোথাও হয়তো।
বুয়াও খুব খুশী হয়ে যায়।
- ‘হ আম্মা এই বাসাডা বদলাইয়াই ফালান। এইসব বোমাবাজি, গোলাগুলি বালা লাগেনা। কইলজাতক হুগাইয়া যায়।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই নিরাপদে বাসায় ফিরেন আব্বু। স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে ওরা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসা বদলের কথা ভাবে সবাই।
রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ে মুস্তাকীম।
শুয়ে শুয়ে সুখ স্বপ্ন দেখে ও। ‘নিরাপদ একটা বাসা যেখানে আর গুলি বোমার আতংক থাকবে না । আব্বু- আম্মুর অফিস থেকে ফেরার সময় হলে ওকে আর ভয়- দুশ্চিন্তায় ভুগতে হবেনা।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে অক্টোবর, ২০১০ দুপুর ১:১৫