লাইব্রেরীর সিড়িতে বসে আছে রুদ্র। আজ প্রায় আড়াই বছর পর মনা'র সাথে দেখা হবে। একটা সময় ছিল, প্রতিদিন দুজনের ঘন্টা দুই-তিনেক গল্প না করলে ভাত হজম হতনা। আর দেখা না হওয়াতো অসম্ভব চিন্তা। বসে গল্প করার জন্যে দুজনের পছন্দের জায়গা লাইব্রেরীর সিড়ি। লাইব্রেরীতে যাদের নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল তাদের সকলেরই মুখচেনা ছিল ওরা।
রুদ্র আর মনা একই ইউনিভার্রিটিতে ভিন্ন ভিন্ন ডিপার্টমেন্টে পড়ত। খুব ভাল বন্ধু ছিল তারা। যাকে বলে বেস্ট ফ্রেন্ড। তবে প্রেম ছিল কিনা সেটা পরিস্কার না। প্রেম থাকুক আর না থাকুক, দুজনের প্রতি টানটা খুব বেশিই ছিল। একজনের ভাললাগা-মন্দলাগা, হাসি-কান্নায় শেয়ারিং কেয়ারিংয়ের মাত্রা ছিল অসম্ভব গাঢ়।
গাঢ় বন্ধুত্বের মাঝে একদিন দূরত্ব চলে আসল। অনার্স শেষ করে মাস্টার্স করতে কানাডায় চলে যায় মনা। মনার বাবার খুব ইচ্ছা সে বাইরে মাস্টার্স করুক। তাই বাবার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতেই হচ্ছে, যদিও তার নিজের কোন ইচ্ছাই ছিলনা। দেশ নয়, অাত্মীয় নয়, মনার সবচে বেশি কষ্ট হচ্ছিল রুদ্রকে ছেড়ে যেতে। রুদ্রও মনেপ্রানে চাচ্ছিল মনা না যাক। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারেনি। বলা কী যায়??
যাওয়ার আগে শেষ যেদিন মনার সাথে লাইব্রেরিতে দেখা হয় রুদ্রর, সেদিন ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে মনা বলেছিল, 'যেদিন দেশে ফিরবো সেদিন এয়ারপোর্ট থেকে সোজা এখানে চলে আসব। তখন যেন তোমাকে এখানে বসা পাই।'
তারপর চলে যায় মনা। যাওয়ার পর দুজনেরই দিন কাটতে থাকে বিস্বাদে। ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন, ফেসবুকে চ্যাট, স্কাইপি, যোগাযোগ আছেই। সামনা সামনি প্রকাশ না করলেও আড়ালে দূরত্বের কষ্টটা পেতো দুজনই।
একটা কথা আছে, চোখের আড়াল তো মনের আড়াল। ভার্চুয়াল যোগাযোগ কতদিন?! যোগাযোগ কমতে থাকে। কমতে কমতে একটা সময় আসে, দিনে একবার, তারপর সপ্তাহে একবার, এরপর মাসে একবার। রুদ্র এখানে পড়ালেখা এরপর চাকরি-বাকরিতে ব্যাস্ত হয়ে যায়। মনাও খুজে নেয় নতুন সার্কেল।
গত পড়শু মনা দেশে ফিরেছে। রুদ্র জেনেছে কাল। ফোন দিয়ে বলেছে, আজ দেখা করবে। বিকেলে যেন লাইব্রেরিতে থাকে। খুশিতে আত্মহারা হলেও রুদ্র কষ্ট পাচ্ছিল এই ভেবে, দেশে ফেরার তিনদিন পর দেখা হচ্ছে মনার সাথে। তবে যাই হোক, আড়াই বছর পর মনাকে দেখবে সে। রুদ্রের মনে হচ্ছে, আজ যেন ঈদের দিন।
বিকেলে দেখা হবার কথা থাকলেও সকাল থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। আজ অফিস থেকেও ছুটি নিয়েছে। উত্তেজনায় বিকেলের আগেই চলে এসেছে লাইব্রেরির সিড়িতে। একা একা বসে বসে বারবার ঘড়ি দেখছে। কখন বিকেল হবে...
মনার জন্যে একটা উপহার এনেছে সে। বাবুই পাখির বাসা। গতবছর তাদের বাড়ির তালগাছ থেকে পড়েছিল। হাতে পেয়ে তখনই রুদ্র ঠিক করেছিল, মনা যখন ফিরবে তখন তাকে এটা দিবে সে। এরপর খুব যত্নে রেখেছে সে এটাকে। এক কনা ময়লাও পড়তে দেয়নি। আজ যত্নের উপহার যতনে দেবে সে প্রিয় বন্ধুটিকে। এ যেন চির কাঙ্খিত ক্ষন।
ছয়টা বাজে। মনা বলেছিল চারটার কথা। কিন্তু আসেনি এখনো। সময় যেন যাচ্ছেইনা রুদ্রর। নির্ধারিত সময়ের পরের অপেক্ষাটা অপেক্ষার চাইতেও কঠিন হয়। তবুও দেখা হবে এই খুশিতেই বসে আছে রুদ্র।
সাতটার সময় ফোন আসে। ওপাশ থেকে মনা নম্র সূরে বলল, সরি রুদ্র, আমার আসলে মনে ছিলনা যে তোমার সাথে আজ দেখা করার কথা। মাত্র মনে পড়লো কিন্তু এখনতো আসা সম্ভব না। কানাডার ইউনিভার্সিটির এক বাংলাদেশি ফ্রেন্ডের বাসায় যেতে হবে। না গেলে ও মাইন্ড করবে। তুই বাসায় চলে যা। তোর সাথে সামনের সপ্তাহে দেখা করবো। কাল গ্রামের বাড়িতে যাব। সপ্তাহখানেক থাকবো। মাইন্ড করিসনা,কেমন। বাই।
কোন উত্তর করেনি রুদ্র শুধু শুনেছে। এরপর কিছুক্ষন বসে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে চলে গেছে। যাবার সময় শুধু বাবুইয়ের বাসাটা পায়ে দলে গেছে