somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সরকারী কর্মকর্তাদের চাকুরী যেন সেকেলের জমিদারী প্রথার ডিজিটাল ভার্সন।

২৭ শে আগস্ট, ২০১৯ সকাল ১০:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অল্প কয়েকদিন আগের ঘটনা। গত জুলাই ২৫, ২০১৯ তারিখে একজন যুগ্ন সচিবের গাড়ীর অপেক্ষায় ফেরী পার হতে তিন ঘন্টা দেরী হওয়ায় অ্যাম্বুলেন্সে থাকা নড়াইলের কালিয়া এলাকায় মোটরসাইকেল দূর্ঘটনায় আহত তিতাস ঘোষের মৃত্যু হয়েছে। খুলনা থেকে লাইফ সাপোর্ট অ্যাম্বুলেন্সে তিতাসকে নেয়া হচ্ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তিতাস আর ঢাকা মেডিকেল কলেজে পৌছাতে পারেনি। ফেরীতেই তার মৃত্যু হয়। এমন ঘটনা এদেশে অহরহ ঘটলেও খুব নগন্য সংখ্যক ঘটনাই ফলাও করে প্রচার হয়, যার মধ্যে একটি ঘটনা তিতাসের মৃত্যু। গত কয়েক বছর ধরেই ছোট ছোট অনেক ঘটনাই আমার মত আমজনতার নজড়ে এসেছিল। ছোট ছোট ঘটনা বলছি এজন্য যে, উক্ত ঘটনাগুলোতে কারো মৃত্যু হয়নি। তবে তিতাসের এ মৃত্যু ছোট ছোট ঘটনা গুলোরই চুড়ান্ত ফল। আসলে আমরা এমন এক দেশে জন্মেছি, যেখানে প্রাণ বিসর্জন ব্যাতিত অন্যায়ের কার্যত কারো টনক নড়ে না।

সম্প্রতি সরকারী কর্মকর্তাদের নিয়ে পত্রিকায় ছোট ছোট ঘটনার শিরোনামগুলো ছিল এরকম- ’স্যার না বলায় চটে গেলেন পাবনার বেড়া উপজেলার ইউএনও’, ’বসতে চাওয়ায় আইনজীবীকে ভ্রাম্যমান আদালত বসিয়ে সাজা দিলেন বীরগঞ্জের এসিল্যান্ড’, ’দিদি ডাকায় লাথি দিয়ে দোকানীর মাছ ফেলে দিলেন এসিল্যান্ড’, ইউএনও’র স্ত্রীর মোবাইল তুলতে ছয় সদস্যের ডুবুরী দল’, ’ডাক্তারকে স্যার না বলায় সাংবদিকের সাাথে অসৈাজন্যমুলক আচরন’, ’এসিল্যান্ডকে স্যার না বলায় সাংবাদিক নাজেহাল’, ’স্যার না বলায় মোটর আরোহীকে হেনস্থা’, ’ডাক্তারকে আপু বলায় রোগীর স্বজনদের পিটিয়ে আহত’। প্রশ্ন হতে পারে- তিতাসের মৃত্যুর সাথে সরকারী কর্মকর্তদের স্যার/ আপু বলা বা না বলার কি সম্পর্ক? আপাত দৃষ্টিতে কোন সম্পর্ক নেই। তিতাসের মৃত্যু হয়েছে ফেরী দেরী করার কারনে, আর উল্লেখিত শিরোনামগুলো ছিল সম্মান প্রাপ্যতা বা ক্ষমতা প্রদর্শন সম্পর্কীত। তবে একটি বিন্দুতে ঘটে যাওয়া বা পত্রিকায় শিরোনাম হওয়া উল্লেখিত ঘটনাগুলো এবং তিতাসের মৃত্যুর ঘটনার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। সকল ঘটনাগুলোই একই সূত্রে গাথা এবং এর পিছনে রয়েছে সরকারী কর্মকর্তাদের দাম্ভিকতা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার। পত্রিকায় শিরোনাম হোক বা নাহোক, এ ধরনের দাম্ভিকতা এবং ক্ষমতার অপব্যবহারগুলো যদি সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দায়ী ব্যাক্তিকে বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করানো হত, তবে তিতাসকে বহনকারী ফেরীটি কোন সরকারী কর্মকর্তার ফোনে দেরী করত না বা কোন সরকারী কর্মকর্তাও তার ক্ষমতা জাহির করার জন্য সে না পৌছানো পর্যন্ত ফেরী ঘাটে বসিয়ে রাখার দুঃসাহস দেখাতেন না।

আজকের এ ডিজিটাল যুগে সবার হাতে হাতেই স্মার্ট ফোন। এ স্মার্ট ফোনের বদৌলতেই আমাদের কিছু কিছু ঘটনা সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়। আবার কাকতালীয়ভাবে কোন সাংবাদিকের উপস্থিতিও আমাদের এ জানার পরিধি আরও বাড়িয়ে দেয়। তারপরেও আমি মনে করি, সোস্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া এবং কাকতালীয়ভাবে সাংবাদিকের উপস্থিতির ফলে যতগুলো ঘটনা আমাদের নজড়ে আসে, তা মোট ঘটনার তুলনায় নিতান্তই নগন্য। এমনও অনেক ঘটনা আছে, যেগুলো লজ্জা বা ভবিষ্যত সম্ভাব্য বিপদ এড়াতে ভুক্তভোগী নিজেই এড়িয়ে যায়। যাদের প্রতিনিয়ত পেশাগত কাজে বিভিন্ন সরকারী দপ্তরে ধরনা দিতে হয়, সকল ক্ষমতার মালিক নামে খ্যাত ’জনগন’ সরকারী দপ্তরে কতটা অসহায় এবং নির্লজ্জতার শিকার হতে হয়, তার সঠিক সংখ্যাটা কেবল তারাই সহজে অনুমান করতে পারবেন। সাধারন জনগনের পক্ষে সরকারী কর্মকর্তাদের স্যার / ম্যাডাম না বলাতো কল্পনাতীত। আমি বড়, আমি-ই সেরা বা উত্তম, অন্যেরা সব অধম, আমি ক্ষমতাধর, অন্যেরা ক্ষমতাহীন, আমি রাজা, অন্যেরা প্রজা সরকারি কর্মকর্তাগন তাদের মনে এমন ধারনাই লালন করে, ফলে তারা ধরা কে শরা জ্ঞান করতে ভয় পায় না।

১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর সংবিধান বিলের উপর ভাষন প্রদানকালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন-’কেউ যদি বলেন গণতান্ত্রিক মৌলিক অধিকার নাই, আমি বলব, সাড়ে সাত কোটি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে যদি গুটি কয়েক লোকের অধিকার হরণ করতে হয়, তা করতেই হবে। কেউ কেউ বলেছেন যে, সরকারি কর্মচারীদের অধিকার খর্ব করা হয়েছে। তাঁরা অন্য দেশের শাসনতন্ত্রও পড়–ন। সরকারি কর্মচারীরা একটি আলাদা জাতি নয়। তাঁরা আমাদের বাপ, আমাদের ভাই। তাঁরা ডিফারেন্ট ক্লাস নয়। ইংরেজ আমলে আইসিএস, আইপিএসদের প্রোটেকশন দেয়া হত। সেই প্রোটেকশন পাকিস্তান আমলেও দেয়া হত। আমলাতন্ত্রের সেই প্রোটেকশন এ আঘাত করেছি-অন্য জায়গায় আঘাত করিনি। এ ক্লাস রাখতে চাইনা। কারন শোষনহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাই, ক্লাসলেস সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করতে চাই।’ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সেই ক্লাসলেস সমাজ আজ কোথায়? আদৌ কি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তার মনে লালন করা সেই সমাজ? কথায় কথায় আমরা তার আদর্শের কথা বলি। আমরা অনেকেই নিজেকে তার আদর্শের সৈনিক বলে দাবী করি। স্বয়ই তার কন্যাই কি পেরেছেন বা চেষ্ঠা করেছেন যুগ যুগ ধরে গড়ে ওঠা আমাদের সেই ক্লাসকে ভেঙ্গে দিতে? তবে হ্যা সরকারী কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে মাঝে মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সরকারী কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে ভাষন প্রদনকালে বলতে শুনি-’সরকারী কর্মকর্তাগন জনগনের শাসক নন, জনগনের সেবক। জনগনের করের টাকায় তাদের বেতন ভাতা আসে। তাই আপনাদের দায়িত্ব হচ্ছে জনগনের সেবা দেয়া।’ প্রধানমন্ত্রী এসব কথা মাঝে মধ্যে বললেও এখন পর্যন্ত তাকে কখনো তা বাস্তবায়নে কোন দিক নির্দেশনা দিতে দেখা যায় নি।

জাতি আজ দুটি শ্রেনীতে বিভক্ত- একদল শোষক, আরেকদল শোষিত। এ শোষক শ্রেনী কিন্তু একদিনে এদেশে প্রতিষ্ঠা পায়নি। এ শোষক শ্রেনী তথা দাম্ভিক সরকারী কর্মকর্তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে ক্ষমতাসীনগন। যখন যে দল ক্ষমতায় ছিল, সে-ই চেষ্ঠা করেছে সরকারী কর্মকর্তাদের সহানুভুতি পাওয়ার। কেননা সরকারী কর্মকর্তাগন পক্ষে না থাকলেতো অবৈধ/ বৈধ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা দুষ্কর। এ সহজ বিষয়টি অনুধাবন করতে কোন রাজনৈতিক দলই ভুল করেনি। ক্ষমতা আমার চাই-ই চাই। স্বাধীনতা উত্তর এদেশটিতে রাজনীতিক দলগুলো কেবলই ক্ষমতায় যাওয়ার প্রতিযোগীতায় মত্ত ছিল এবং এখনও তা বিরাজমান। কে কিভাবে ক্ষমতায় যাবে, কে পক্ষে থাকলে অবৈধভাবে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা যাবে বা কাকে কোথায় বসালে গনতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে নিজেদের পক্ষে ব্যালট ব্যাক্স ভরতে সুবিধা হবে, কেবল তার-ই প্রতিযোগিতা। এমন একটি দেশের জন্য কি এদেশের ত্রিশ লক্ষ লোক শহীদ হয়েছিল? আজকে সোস্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া সরকারী কর্মকর্তাদের দাম্ভিকতার জন্য দায়ী কে? সরকারী কর্মকর্তাদের পক্ষে রাখা বা তাদের রক্ষা করার জন্যই আইন প্রনেতাগন কর্তৃক এদেশের যত আইন। তারা যেন মহামানব, তাদের বিচার করা যাবে না। সরল বিশ্বাসে তারা যা-ই করবেন সবই মেনে নিতে হবে, শত অন্যায় করলেও তাদের সাময়িক বরখাস্ত হবে, চাকুরী যাবে না। এ যেন জমিদারী প্রথার ডিজিটাল ভার্সন। এ অঘোষিত জমিদারী প্রথাই, শোষক শ্রেনী তৈরীর মুল কারন।

বাংলাশের সংবিধান বলে সরকারী কর্মকর্তাগন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, আর সাধারন জনগন এ প্রজাতন্ত্রের মালিক। কিন্তু বাস্তবতা ঠিক উল্টো। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরাই এখন প্রজাতন্ত্রের মালিক হিসাবে আর্ভিভুত হয়ে প্রজাতন্ত্রের প্রকৃত মালিক ’জনগন’কে শোষন করছে। এ অবস্থা আর চলতে দেয়া যায় না। তবে এ সংস্কৃতি পরিবর্তন করতে হলে আগে প্রয়োজন এদেশের গনতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠা করা। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, এদেশে যে গনতন্ত্র চলছে, তাকে গনতন্ত্র বললে ’গনতন্ত্র” নামক শব্দটির অবমাননাই হবে হয়ত। দেশে যদি সত্যিকারের গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়, সরকারী কর্মকর্তাগন আর নিজেকে উচ্চ শ্রেনীর লোক হিসাবে ভাবার সাহস পাবে না। তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসাবেই প্রজাতন্ত্রের প্রকৃত মালিকদের সাথে ব্যবহার করবে বলে আমি আশাবাদী।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০১৯ সকাল ১০:০৩
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তীব্র তাপদাহ চলছে : আমরা কি মানবিক হতে পেরেছি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৯

তীব্র তাপদাহ চলছে : আমরা কি মানবিক হতে পেরেছি ???



আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির মুখে আছি,
আমাদেরও যার যার অবস্হান থেকে করণীয় ছিল অনেক ।
বলা হয়ে থাকে গাছ না কেটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্যবহারে বংশের পরিচয় নয় ব্যক্তিক পরিচয়।

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৫

১ম ধাপঃ

দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে কত মানুষের সাথে দেখা হয়। মানুষের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য আসলেই লুকিয়ে রাখে। এভাবেই চলাফেরা করে। মানুষের আভিজাত্য বৈশিষ্ট্য তার বৈশিষ্ট্য। সময়ের সাথে সাথে কেউ কেউ সম্পূর্ণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×