পড়ালেখায় সবসময় প্রথম না হলেও মাঝে মাঝে ফার্স্ট বয় কে হারিয়ে দিতাম।এই উৎসাহেই কিনা জানিনা মাঝারি মানের সরকারি চাকরি করা বাবা(সৎ)কষ্ট করে গেলেন সারাটা জীবন।কখনও তার কোন শখ পুরন করতে দেখিনি।ধীরে ধীরে বড় হলাম.... নতুন নতুন স্বপ্ন বুনলাম... স্বপ্নের তালিকায় প্রথমেই ছিল বাবার কপালের চিন্তার ভাঁজ টা সরিয়ে দিয়ে মুখে সত্যিকারের হাসি ফোটানো।ভালই এগোচ্ছিলাম,রেজাল্ট ও ভাল হোল।মনে হোল সপ্নপুরীর দরজায় পৌঁছে গেছি।এবার শুধু চাকরি নামক সোনার হরিণটার নাগাল পেয়ে আমার স্বপ্নপুরীর ভিতরে ঢুকার অপেক্ষা।এই যুগে আর সবাই যতটা কষ্ট করে একটা চাকরির জন্য আমাকে অতটা করতে হয়নি।লবিং ছিল।তবে আমার কষ্ট না হলেও বাবার হয়েছিলো (পরে জানতে পেরেছি)।ঢুকে গেলাম বাংলাদেশের একটা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে । খুব ট্রাই করলাম সৎ থাকতে। হোল না... পারলাম না... শরীর মন দুটোয় ভাসিয়ে দিলাম স্রোতে।এছাড়া উপায় ছিল না.... উপায় থাকে না।যখন জানলাম শুধু ভালো রেজাল্ট ও মামার জোরে কাজ হয়নি, এই চাকরীর জন্য অনেক কস্টে কেনা বাবার শেষ ঠাই জমিটুকু বেচে দিতে হয়েছে।হাত পাততে হয়েছে কাছের দুরের আত্তিয়ের কাছে।এমন কি মা এর গয়না পর্যন্ত বন্দক রাখতে হয়েছিলো।এগুলোর কিছুই আমি জানতাম না।আমি ভেবেছিলাম আমার রেজাল্ট আর মামার জোরে,আর টাকা কিছু লাগলেও খুব সামান্য হবে।বাসা থেকে আমাকে সেরকম-ই জানানো হয়েছিলো।আসলে লেগেছিল ১০ লক্ষ টাকা।আর এই ১০ লক্ষের এক ধাক্কাতেই আমি ভেসে গেলাম... আজও ভাসছি।আমার আজ একটুও লজ্জা করছে না বলতে যে আমি ঘুষ খাই।কারন মাথায় জিদ চেপে গিয়েছিল কমপক্ষে এই ১০ লাখ তো আমাকে তুলতেই হবে।এটা আমার অনৈতিক অধিকার।আস্তে আস্তে শুরু করলাম...মদ এর মত জিনিষ একখান এই ঘুষ। প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও আস্তে আস্তে নেশা ধরিয়ে দেয়।টার্গেট ছিল ১০। কিন্তু এই ১০ তুলতে তুলতে রক্তে এমন ভাবে মিশে গ্যালো ঘুষ খাওয়াটা.....জানিনা কতোতে যেয়ে থামবে। আদৌ থামবে কিনা।আজ যদি ঐ ১০ বাবাকে দিতে না হত তাহলে হয়ত আমার ভিতর এই তাড়নার জন্ম হত না।
আমি জানি সবাই আমাকে ঘুসখোর বলে.... বলুক।যারা আমাকে বানালো তারা আড়ালেই থাকুক।
আমি এখন ঢাকায় থাকি।ভাড়া বাসায়।বাচ্চা দুটো।বউ একটাই।বাসা ভাড়া,সংসার খরচ,বাচ্ছাদের লেখাপড়ার খরচ,সামাজিকতা রক্ষা।আমার যে বেতন তাতে চলবে না।এখন বউ ঝগড়া করে না, বাচ্ছারা বাবাকে ভালবাসে কারন চাওয়ার আগেই তাদের শখ পুরন হয়ে যায়।আত্মীয়স্বজন সমীহ করে- দাওয়াত দিলে দামী গিফট পায়।সবাই স্বার্থলোভী। আজ ঘুষ না খেলে আমি হয়ত অবহেলায় পেতাম।
কিন্তু আমার মনের ভাল অংশটা এখনও এটা ছেড়ে দিতে চায়....দেবোও এমন যদি হয়ঃ
১. আজ থেকে কাওকে চাকরী পেতে ঘুষ দিতে হবে না।
২.ব্যাবসায়ীরা মজুদ করে নিত্যপন্যের দাম বাড়াবেনা।
৩.আমার বাচ্ছার ভর্তি করতে ডোনেশন দিতে হবে না।
৪. বাড়ীওয়ালা ইচ্ছামতো ভাড়া নিবে না।।
৫.কষ্ট করে কেনা এক চিলতে জমি তে একটা টিনের ঘর তুলতে গেলেও চাদা দিতে হবে না।
৬.সরকারী হাসপাতালে স্থানসংকুলান না হওয়ায় প্রাইভেট হাসপাতালে মারা গেলেও আমার লাশ কেউ টাকার কারণে আটকে রাখবে না।
৮.দায়িত্ব পালনে কোন রাজনৈতিক দলের বাধা আসবে না।
৯.কেউ যেন প্যাকেট দিয়ে না বলে যে স্যার এটা শুধু গিফট হিসাবে রাখেন।(আর কারো মত আমার বছরে ৩ বার জন্মদিন বেধে যায় না যে গিফট দিতে হবে।)
১০.আত্মীয় সজন আমার সততা কে সন্মান করবে।
১১.আমি মারা গেলে আমার রেখে যাওয়া পরিবার ভাল থাকবে তার নিশ্চয়তা দেবে সমাজ,সরকার।
আর এগুলা যদি না হয় তাহলে আমার খুব প্রিয় অভিনেতা মোশাররফ করিম এর ভাষাতেই বলতে হবেঃ “ঘুষ খাইতাম না ক্যারে!”
(ইহা কেবলই এক আত্মকাহিনী এই সমাজের কোনো এক ঘুষখোরের)