একজন মানুষ যদি কখনো সূর্যমুখী ফুল হয়ে যায়, তাহলে কেমন হবে জিনিসটা? তার কাজ কি হবে তখন? সারাক্ষণ সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকা?
ভাবছেন কি উল্টাপাল্টা বলছি? মানুষ আবার ফুল হবে কীভাবে! আর ভাই, সত্যিকারে তো বলছি না, অভিনয় তো করতে পারে নাকি? মানুষ হয়ে যদি কেও সূর্যমুখী ফুলের ক্যারেকটারে অভিনয় করে, আর সেটাই যদি হয় কোন মানুষের জীবনে প্রথম মঞ্চে দাঁড়িয়ে অভিনয় করা অনেক দর্শকের সামনে, তখন কেমন হবে বিষয়টা?
যেই বয়সে মানুষের অভিনয় সম্পর্কে জ্ঞান খুবই কম থাকে, সেই নয় বছর বয়সেই তিনি মঞ্চে দাঁড়িয়েছিলেন। যদিও ক্যারেকটার ছিল সূর্যমুখী ফুল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, কিন্তু তাতেও তার কোন অবহেলা ছিল না। যদিও সূর্যমুখী ফুলের সাথে তার পার্থক্য একটাই ছিল- সূর্যমুখী ফুল সূর্যের দিকে মুখ করে তাকিয়ে থাকে, আর নয় বছরের সেই বালক তাকিয়ে ছিলেন দর্শকের দিকে, বুকের ভেতরে চাপা উত্তেজনা নিয়ে যা তিনি প্রকাশ করতে পারছিলেন না- কারণ মানুষ কথা বললেও সূর্যমুখী ফুল কথা বলে না এটা ততদিনে তার বোঝা হয়ে গিয়েছিল।
বাবা আর্মড ফোরস এর অস্ত্র তৈরির কারখানায় কাজ করতেন। সরকারী চাকরি, কয়েকমাস বা কয়েকবছর পর পরই পোস্টিং। এরফলে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরার আর বিভিন্ন বিচিত্র মানুষের সাথে মেলামেশার সাথে সুযোগ হয়েছিল তার (তার অভিনীত ক্যারেকটারগুলোর মতই )। গ্রাজুয়েশন এর পর্ব শেষ করেছিলেন ফিজিক্স বা পদার্থবিজ্ঞান নামক খটমটে এক বিষয়ে। কিন্তু খটমটে বিষয়ে পাশ করা সেই ছেলের মন পড়ে ছিল নয় বছর বয়সে অভিনয় করা সেই মঞ্চের পাটাতনে। সিদ্ধান্ত নিলেন, অভিনয়কেই নিজের জীবনের অস্তিত্ব বানাবেন। কিন্তু এমন সময়ে তিনি এই সিদ্ধান্ত নিলেন, যেই সময়ে ডক্টর বা ইঞ্জিনিয়ার না হলে বা না হওয়ার সিদ্ধান্ত না নিলে- ছেলেমেয়েদের নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা মুশকিল হয়ে যেত।
তিনি কারো কথাই আমলে নিলেন না, বাবা মা আর প্রতিবেশীদের চোখ রাঙ্গানি বা ধমক- কোন কিছুকেই তিনি পাত্তা দিলেন না। ফিজিক্স থেকে পড়াশুনা করে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বিদেশে গিয়ে অর্থ উপার্জনের লোভ দেখিয়েও কাজ হয়নি। সুতরাং- ব্যাক টু দ্যা থিয়েটার। জানতেন এখানে কাজের আনন্দ পাবেন, নিজের পছন্দের কাজটা করতে পারবেন নিজের মত করে- কিন্তু পয়সাটাও যে আসবে না সেভাবে- সেটাও জানতেন, সেটা জেনেশুনেই তিনি এই লাইনে এসেছিলেন। বন্ধুদের সাথে একটা ছোট বাসায় থাকতেন, রেলস্টেশনের পাশে, যেখানে তিন মিনিট পর পর ট্রেন চলাচল করত। থিয়েটার জিনিসটা তাকে অনেক হেল্প করেছিল, আরেকটা জিনিস বেশ হেল্প করেছিল তাকে, সেটা হল তার বন্ধুদের সাথে গ্রুপ রিডিং এর অভ্যাস। বন্ধুরা বই পড়ত, তারপরে সেটা নিয়ে গ্রুপ স্টাডি করত- এভাবে একজনের পড়া হলে বাকিদের আর সেই বই পড়া লাগত না, গ্রুপ স্টাডির মাধ্যমে সব জেনে নিতেন। এভাবেই বিশ্বের বিভিন্ন বিখ্যাত বই তার পড়া হয়ে যায়। রাশিয়ান সাহিত্যের প্রতি তার বিশেষ ভাললাগা আছে। প্রিয় লেখকের তালিকায় কাফকাকে এগিয়ে রাখেন।
সিনেমাতে তার জন্য প্রবেশ করা বেশ কঠিন ছিল, এই কারণেই টিভি সিরিয়াল দিয়ে শুরু করলেন পথচলা। তখনকার টিভি সিরিয়ালগুলো এখনকার মত একবার শুরু হলে অনন্তকাল ধরে চলতেই থাকত না- সেগুলো ছিল এক ঘণ্টার মত। পাঁচ ছয়দিন একটা ক্যারেকটারের সাথে থেকে সেটাকে দূরে সরিয়ে পরের সপ্তাহেই আবার আরেকটা ক্যারেকটারে জড়িয়ে যাওয়া, সেই ক্যারেকটারে ডুবে যাওয়া। এভাবে প্রচুর কাজ করলেন টিভি তে, অবশেষে একদিন চান্স পেলেন টিভি তে। খুব ছোট একটা রোল, কিন্তু নিজের কাজটা ঠিকমতোই করলেন তিনি। Naseem নামের সেই সিনেমাটা রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেলেও, তিনি থেকে গেলেন চোখের আড়ালে। এরপরে করলেন The Bhopal Express, Chhal এর মত আরও সিনেমা, পাশাপাশি টিভি তে কাজ চলছিল। ২০০৩ সালে অনুরাগ কাশ্যাপ নামের নিজের মত একরোখা আর ঘাড়তেড়া একজন পরিচালক কে খুঁজে পেলেন খুঁজছিলেন যিনি তার প্রথম সিনেমার জন্য সম্পূর্ণ নতুন কাওকে খুঁজছিলেন অভিনেতা হিসেবে। অনুরাগের সেই সিনেমাতে তিনি প্রধান চরিত্রে অভিনয় করলেন। ভাগ্য খারাপ তার, Paanch নামের সেই সিনেমা আজও রিলিজ পায় নি অফিশিয়ালি- যদিও ইউটিউব এ সিনেমাটির লিকড ভার্শন পাওয়া যায় একই বছর মুক্তি পাওয়া Hazaaron Khwaishein Aisi আর পরের বছর সেই একরোখা পরিচালক অনুরাগের ব্ল্যাক ফ্রাইডে তে তার দারুণ অভিনয় দিয়ে তিনি সবার নজরে আসেন। তবে ২০০৫ এ রামগোপাল ভারমার সরকার সিনেমাতে তার রোলের পরে তাকে সবাই একনামে চিনতে শুরু করে, এরপরে তাকে আর কখনো বলতে হয়নি- হাই, আমি কে কে মেনন, আমি পেশায় একজন অভিনেতা।
জি হ্যাঁ, এতক্ষণ যেই মানুষটার কথা বলছিলাম, তার নাম কে কে মেনন। একেবারেই অদ্ভুত রকমের ক্যারেকটারে যার জুড়ি মেলা ভার, যাকে তুলনা করা হয় নাসিরুদ্দিন শাহ্, ইরফান খান লেভেলের অভিনেতাদের সাথে। কর্পোরেট, লাইফ ইন আ মেট্রো, হানিমুন ট্র্যাভেলস প্রাইভেট লিমিটেড, Shaurya, মুম্বাই মেরি জান, ভেজা ফ্রাই টু, গুলাল , হুক ইয়া ক্রুক, সঙ্কট সিটি, ভিন্ডি বাজার, শাহিদ এর মত সিনেমাতে তিনি যেমন আছেন, আবার তিনিই আছে লাফাঙ্গে পারিন্দে, বেবি, হায়দার, বোম্বে ভেলভেট এর মত সিনেমাতে। হায়দার এর জন্য নিজের অভিনয় জীবনের প্রথম ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
রেলস্টেশনে পাশে ঘুমিয়ে থাকা সময়কালকে নিজের জীবনের সংগ্রাম বলতে নারাজ তিনি। "এটা এমন কোন ব্যাপার না, আমি জেনেশুনেই এখানে এসেছিলাম, আমি প্রস্তুত ছিলাম এমন পরিবেশের জন্য। আর আমার চেয়েও অনেক খারাপ অবস্থায় মানুষ থাকে, আমার চেয়েও বেশি পরিশ্রম করা সাধারণ মানুষ আমার আশেপাশে এবং আমার ইন্ডাস্ট্রিতেই আছে। সবার জীবনেই এগুলো কম বেশি থাকে, এগুলো নিয়ে খুব বেশি কথা বলা পছন্দ করি না আমি।" তিনি আরও বলেন "নিজের অভিনেতা পরিচয় নিয়েই আমি খুশি, স্টার হওয়ার কোন ইচ্ছা আমার নাই এবং সেই ক্ষমতাও সম্ভবত আমার নাই। স্টার চাইলে অনেকেই অনেকভাবে হতে পারে, তবে অভিনেতা সবাই হতে পারে না, এটা আপনার ভিতরে থাকতে হবে যাকে বলে built in. আমার দেশের প্রধান সমস্যা হচ্ছে- এখানে সবাই অভিনেতা হতে চায়, কিন্তু সমস্যা হলে সবার ভেতরে অভিনয়ের সেই সত্ত্বাটা থাকে না, আর সেটা না থাকলে আপনি যতই পরিশ্রম করেন না, যতই রেলস্টেশনের পাশে ঘুমান না কেন- লাভ নেই। আর একটা কথায় আমি বিশ্বাস করি- an actor is born, a star is made, star can't be born"
সত্যজিতের ফেলুদা ক্যারেক্টারের কথা তো সবার মাথায় গেঁথে যাওয়ার কথা সৌমিত্র চক্রবর্তী বা সব্যসাচী চক্রবর্তী বা হালের আবিরের কল্যাণে। হলিউড এর গোয়েন্দা হিসেবে বেনেডিকট বা রবার্ট ডাউনি জুনিয়র তো আছেই। তবে Rahasya নামক এই বছর মুক্তি পাওয়া বলিউড সিনেমা দেখার পর থেকে আমার মনে হচ্ছে, বলিউড এ কোনোদিন ফেলুদা রিমেক হলে ফেলুদা ক্যারেক্টারে কে কে মেননের চেয়ে ভাল আর কাওকে মানাবে না।
শুভ জন্মদিন কে কে মেনন, জন্মদিনের অনেক শুভেচ্ছা এক ভক্তের পক্ষ থেকে