somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কালো রেডিও।

২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৪ সকাল ৭:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি আর সুজন ভাই অপেক্ষা করছি দিনার আপার জন্যে । পরিবারের কিছু কিছু ব্যবহারিক জিনিষপত্র থাকে যেটা স্নেহ আর ভালবাসার হাতের ছোঁয়া না পেলে চলেনা। আমরা তাই আমাদের পরিবারের একমাত্র বিনোদন যন্ত্র ঢাউশ আকৃতির কালো রেডিওটা সামনে রেখে পাটি পেতে বারান্দায় বসে আছি । শীতের শুরু শুরু একটা ভাব। হালকা আরাম লাগা রোদ। দুপুরের এই সময়টা সবাই অলস সময় পার করতে চায়। আম্মা রান্না শেষে খেয়ে গোসল করে একটা ঘুম দিয়ে নেন । বড় আপারও এই সময়ে ঘুম চাইই চাই। একমাত্র আমরা তিন ভাই বোন জেগে আছি। বেলা আড়াইটায় শুরু হবে নাটক ‘শার্লক হোমস’! আমরা এই নাটকের বিশাল ভক্ত। না দেখে কিভাবে তারা ভক্ত বানাতে পারতেন তা ভেবে আজকের কাতুকুতু মার্কা নাটক দেখে বুঝে পাইনা । দিনার আপা দুই বেনী করে আমাদের মাঝে আসলেন। আমাদের পরিবারের সবচেয়ে রুপবতী মেয়ে। কোকড়া চুল কায়দা করে বেঁধে সব সময় দিনার আপা টিপ্টপ থাকেন । রুপবতী মেয়েরা সাধারণ ধুরন্ধর শ্রেণীর হয় । দিনার আপা হলেন সরল সোজা চোখের বিশাল বোকা একটি মেয়ে। এই বোকা মেয়েটা যখন আমাদের কালো রেডিওটার মাথায় হাত রাখলো তখনই কোন এক জাদুতে রেডিওটি কথা বলা শুরু করে দিলো ।

- বুঝলে ভায়া ওয়াটসন; আমি বোধহয় রহস্যটা ধরে ফেলেছি।
-কিভাবে?
- ঐ বেটা আগুন্তুকই মনেহচ্ছে খুনি! আমি কিন্তু ওকে ধরবোই।

আমাদের গায়ের রোম দাঁড়িয়ে যায়। তখনও আশেপাশের বাসায় সনির কালার টেলিভিশন এসে গেছে । আমাদের বাসাতে নেই । আমরা টিভিও তেমন একটা দেখিনা । টেলিভিশন দেখে বড়লোকেরা। কারো বাসায় টেলিভিশন থাকা মানেই তারা ধনী লোক। আমরা ধনী নই; আমরা নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর। এখানে কালো রেডিওটা আমাদের সব বিনোদনের খোড়াক।

সেই কালো রেডিও দিনের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মানুষের হাতে থাকত। বেলা বারটার পড়ে সেটি বড় আপার সম্পত্তি । নাজমুল হুদার সেই বিখ্যাত উচ্চারণে, ‘কে তাকে ভালবাসবে, কে তাকে স্নেহ দেবে? এভাবেই এগিয়ে যায় সিনেমার মুল গল্প। নাজমুল হুদার সেই দরাজ কন্ঠ আমাদের পরিবারের সবচেয়ে দীঘল চুলের শ্যাম বালিকা বড় আপার চোখ ভর্তি করে পানি এনে দিতো । কখনও হাসি। কখনও আবেগের লাল-নীল রং। বাংলা চলচ্চিত্রের এমন কোন গানের দুই কলি আপা জানেন না এমন হয়নি। অনেক সময় আমরা মজা করে এক লাইন গেয়ে থামলেই আপা সেটার শেষ করতেন ।

আমি যে যুগের কথা বলছি সে যুগে পঁচিশ পয়সায় কমলার কোয়ার মত চকোলেট পাওয়া যেতো । এক টাকা দিলে পাঁচটা । সারাদিন চুষেও মনেহতো কি যেন খেতে হবে আবারও। আমার পকেটে থাকতো গোটা দুই-তিন; আমি তখন রাজা। সেই যুগে আমাদের পরিবারে একটি কালো রেডিও অনেক গুরুত্বপুর্ণ সম্পত্তি। তার মাঝেমাঝে অসুখ হতো । আমরা সেটা খুলে ভেতরে উন্নত বিশ্বের মত বড় বড় দালানের আদলে ছোট ছোট নানান পার্টস দেখতাম । ভেতরে তেলাপোকার ডিম, ঝুল আর ধুলো পরিস্কার করে দিতেই বেজে উঠতো-
- ‘রেডিও বাংলাদেশ’!!!!
এরপরে একটা টান দিয়ে –‘খুলনা’। ‘টু!!!রুট!!!টুরুরুরুট’।

আম্মা সেই রেডিওর জন্যে পোষাক বানিয়ে দিয়েছিলেন । খুব কায়দা করে বানানো সেই পোষাকে শুধু কালো রংয়ের মাইক আর টিউনার কাঁটা দেখা যেতো । আমরা ঘুরিয়ে এই অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে চলে যেতাম । সেই কালো রেডিও দিয়েই বাংলাদেশ ক্রিকেটকে চেনা। আকরাম খান, বুলবুল, আতাহার আলী, পাইলটকে চেনা। পুরটা আইসিসির খেলা এক কাতে শুয়ে রেডিওতে শুনেছি ।

একে একে সব পুরনো হয়ে গেলো। বিল্ডিং পুরনো হলো, যৌবনা আমগাছ বৃদ্ধ হলো আর বার্ধ্যকে মারা গেলো পেয়ারা গাছ। পাশের বাসার মল-মুত্রের এসিডিও ক্রিয়ায় আমাদের সুন্দরী সবুজ পুকুরের চেহারা পুরে হলো কালো । তার পাড়ে পাড়ে বিশাল বোকা হৃদয়ের ‘গুই টাকি’ মাছ গুলোকে অবাক চোখে মরে ভেসে থাকতে দেখা গেলো। মাছ রাঙ্গার ত্রাহি চিৎকারের অভিশাপ আম গাছের পাতায় পাতায় প্রতিধ্বনিত হয়ে করুণ বিউগলের মত বাজতে লাগলো। আমাদের কালো রেডিওর প্রয়োজনও ফুরিয়ে আসলো। গুরত্বের অত্যাচারে এক সময় তার ঠাই হলো পরিত্যাক্ত ঘরে। একদিন সেখান থেকেও সেটি কিভাবে কোথায় যেন হারিয়ে গেলো । প্রায় দুই বছর পড়ে দেশে যেয়ে মনেমনে খুঁজেছি। কোথাও পেলাম না। পেলে হয়ত তার মাথায় হাত বুলিয়ে সেই সময়ে ফিরে যেতে চাইতাম।

পুনঃশ্চঃ আমাদের বাসাতে এখন রঙ্গিন টিভি এসেছে । নিম্নমধ্যবিত্তদের পরিবারে আধুনিক একটি বিনোদন যন্ত্র আসা মানে সেটি বহিঃর্বিশ্বে বিলুপ্তির পথে । আমাদের অবস্থা ঠিক সেরকম না। আম্মা বুঝে শুনে ভাল টিভি কিনেছেন। সে টিভির বয়স হয়েছে । একটি চ্যানেলে সব কিছু সাদা তো আরেকটিতে গোলাপী। নায়িকা সবুজ রংয়ের আর নায়ক ধুসর বর্ণের । আম্মা মহাবিরক্ত হয়ে রাইসাকে ডাক দেন।

-‘রাইসা’, টিভিটা দেখতো কি হলো। রিমঝিম মনেহয় রিমট টিপে এই অবস্থা করেছে।
- জি নানা দেখছি।

ছিপছিপে রাইসা আমাদের পরিবারের পরবর্তী জেনারেশনের প্রথম মেয়ে । বাতাস এলে যাকে আমরা ঘরে আটকে রাখি; পাছে উড়িয়ে নিয়ে না যায় । রাইসা হাসিমুখে টিভির মাথায় হাত রাখলো। একটা ম্যাজিকের মত জি সিনেমার সব ময়দা মাখা অভিনেত্রী-অভিনেতারা তাদের আসল চেহারা ফিরে পেলেন
কালো রেডিও।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৪ সকাল ৮:০৮
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ঋণ মুক্তির দোয়া

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪৯



একদিন রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববিতে প্রবেশ করে আনসারি একজন লোককে দেখতে পেলেন, যার নাম আবু উমামা। রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘আবু উমামা! ব্যাপার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×