আমি আর সুজন ভাই অপেক্ষা করছি দিনার আপার জন্যে । পরিবারের কিছু কিছু ব্যবহারিক জিনিষপত্র থাকে যেটা স্নেহ আর ভালবাসার হাতের ছোঁয়া না পেলে চলেনা। আমরা তাই আমাদের পরিবারের একমাত্র বিনোদন যন্ত্র ঢাউশ আকৃতির কালো রেডিওটা সামনে রেখে পাটি পেতে বারান্দায় বসে আছি । শীতের শুরু শুরু একটা ভাব। হালকা আরাম লাগা রোদ। দুপুরের এই সময়টা সবাই অলস সময় পার করতে চায়। আম্মা রান্না শেষে খেয়ে গোসল করে একটা ঘুম দিয়ে নেন । বড় আপারও এই সময়ে ঘুম চাইই চাই। একমাত্র আমরা তিন ভাই বোন জেগে আছি। বেলা আড়াইটায় শুরু হবে নাটক ‘শার্লক হোমস’! আমরা এই নাটকের বিশাল ভক্ত। না দেখে কিভাবে তারা ভক্ত বানাতে পারতেন তা ভেবে আজকের কাতুকুতু মার্কা নাটক দেখে বুঝে পাইনা । দিনার আপা দুই বেনী করে আমাদের মাঝে আসলেন। আমাদের পরিবারের সবচেয়ে রুপবতী মেয়ে। কোকড়া চুল কায়দা করে বেঁধে সব সময় দিনার আপা টিপ্টপ থাকেন । রুপবতী মেয়েরা সাধারণ ধুরন্ধর শ্রেণীর হয় । দিনার আপা হলেন সরল সোজা চোখের বিশাল বোকা একটি মেয়ে। এই বোকা মেয়েটা যখন আমাদের কালো রেডিওটার মাথায় হাত রাখলো তখনই কোন এক জাদুতে রেডিওটি কথা বলা শুরু করে দিলো ।
- বুঝলে ভায়া ওয়াটসন; আমি বোধহয় রহস্যটা ধরে ফেলেছি।
-কিভাবে?
- ঐ বেটা আগুন্তুকই মনেহচ্ছে খুনি! আমি কিন্তু ওকে ধরবোই।
আমাদের গায়ের রোম দাঁড়িয়ে যায়। তখনও আশেপাশের বাসায় সনির কালার টেলিভিশন এসে গেছে । আমাদের বাসাতে নেই । আমরা টিভিও তেমন একটা দেখিনা । টেলিভিশন দেখে বড়লোকেরা। কারো বাসায় টেলিভিশন থাকা মানেই তারা ধনী লোক। আমরা ধনী নই; আমরা নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর। এখানে কালো রেডিওটা আমাদের সব বিনোদনের খোড়াক।
সেই কালো রেডিও দিনের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মানুষের হাতে থাকত। বেলা বারটার পড়ে সেটি বড় আপার সম্পত্তি । নাজমুল হুদার সেই বিখ্যাত উচ্চারণে, ‘কে তাকে ভালবাসবে, কে তাকে স্নেহ দেবে? এভাবেই এগিয়ে যায় সিনেমার মুল গল্প। নাজমুল হুদার সেই দরাজ কন্ঠ আমাদের পরিবারের সবচেয়ে দীঘল চুলের শ্যাম বালিকা বড় আপার চোখ ভর্তি করে পানি এনে দিতো । কখনও হাসি। কখনও আবেগের লাল-নীল রং। বাংলা চলচ্চিত্রের এমন কোন গানের দুই কলি আপা জানেন না এমন হয়নি। অনেক সময় আমরা মজা করে এক লাইন গেয়ে থামলেই আপা সেটার শেষ করতেন ।
আমি যে যুগের কথা বলছি সে যুগে পঁচিশ পয়সায় কমলার কোয়ার মত চকোলেট পাওয়া যেতো । এক টাকা দিলে পাঁচটা । সারাদিন চুষেও মনেহতো কি যেন খেতে হবে আবারও। আমার পকেটে থাকতো গোটা দুই-তিন; আমি তখন রাজা। সেই যুগে আমাদের পরিবারে একটি কালো রেডিও অনেক গুরুত্বপুর্ণ সম্পত্তি। তার মাঝেমাঝে অসুখ হতো । আমরা সেটা খুলে ভেতরে উন্নত বিশ্বের মত বড় বড় দালানের আদলে ছোট ছোট নানান পার্টস দেখতাম । ভেতরে তেলাপোকার ডিম, ঝুল আর ধুলো পরিস্কার করে দিতেই বেজে উঠতো-
- ‘রেডিও বাংলাদেশ’!!!!
এরপরে একটা টান দিয়ে –‘খুলনা’। ‘টু!!!রুট!!!টুরুরুরুট’।
আম্মা সেই রেডিওর জন্যে পোষাক বানিয়ে দিয়েছিলেন । খুব কায়দা করে বানানো সেই পোষাকে শুধু কালো রংয়ের মাইক আর টিউনার কাঁটা দেখা যেতো । আমরা ঘুরিয়ে এই অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে চলে যেতাম । সেই কালো রেডিও দিয়েই বাংলাদেশ ক্রিকেটকে চেনা। আকরাম খান, বুলবুল, আতাহার আলী, পাইলটকে চেনা। পুরটা আইসিসির খেলা এক কাতে শুয়ে রেডিওতে শুনেছি ।
একে একে সব পুরনো হয়ে গেলো। বিল্ডিং পুরনো হলো, যৌবনা আমগাছ বৃদ্ধ হলো আর বার্ধ্যকে মারা গেলো পেয়ারা গাছ। পাশের বাসার মল-মুত্রের এসিডিও ক্রিয়ায় আমাদের সুন্দরী সবুজ পুকুরের চেহারা পুরে হলো কালো । তার পাড়ে পাড়ে বিশাল বোকা হৃদয়ের ‘গুই টাকি’ মাছ গুলোকে অবাক চোখে মরে ভেসে থাকতে দেখা গেলো। মাছ রাঙ্গার ত্রাহি চিৎকারের অভিশাপ আম গাছের পাতায় পাতায় প্রতিধ্বনিত হয়ে করুণ বিউগলের মত বাজতে লাগলো। আমাদের কালো রেডিওর প্রয়োজনও ফুরিয়ে আসলো। গুরত্বের অত্যাচারে এক সময় তার ঠাই হলো পরিত্যাক্ত ঘরে। একদিন সেখান থেকেও সেটি কিভাবে কোথায় যেন হারিয়ে গেলো । প্রায় দুই বছর পড়ে দেশে যেয়ে মনেমনে খুঁজেছি। কোথাও পেলাম না। পেলে হয়ত তার মাথায় হাত বুলিয়ে সেই সময়ে ফিরে যেতে চাইতাম।
পুনঃশ্চঃ আমাদের বাসাতে এখন রঙ্গিন টিভি এসেছে । নিম্নমধ্যবিত্তদের পরিবারে আধুনিক একটি বিনোদন যন্ত্র আসা মানে সেটি বহিঃর্বিশ্বে বিলুপ্তির পথে । আমাদের অবস্থা ঠিক সেরকম না। আম্মা বুঝে শুনে ভাল টিভি কিনেছেন। সে টিভির বয়স হয়েছে । একটি চ্যানেলে সব কিছু সাদা তো আরেকটিতে গোলাপী। নায়িকা সবুজ রংয়ের আর নায়ক ধুসর বর্ণের । আম্মা মহাবিরক্ত হয়ে রাইসাকে ডাক দেন।
-‘রাইসা’, টিভিটা দেখতো কি হলো। রিমঝিম মনেহয় রিমট টিপে এই অবস্থা করেছে।
- জি নানা দেখছি।
ছিপছিপে রাইসা আমাদের পরিবারের পরবর্তী জেনারেশনের প্রথম মেয়ে । বাতাস এলে যাকে আমরা ঘরে আটকে রাখি; পাছে উড়িয়ে নিয়ে না যায় । রাইসা হাসিমুখে টিভির মাথায় হাত রাখলো। একটা ম্যাজিকের মত জি সিনেমার সব ময়দা মাখা অভিনেত্রী-অভিনেতারা তাদের আসল চেহারা ফিরে পেলেন
কালো রেডিও।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৪ সকাল ৮:০৮