একপ্রকার সন্ত্রাসী কায়দায় রাফসানের আব্বার কাছ থেকে আগের দুই মাসের বেতন আদায় করলাম। আজব চিড়িয়া গোছের মানুষ। প্রথম যেদিন পড়াতে গেলাম সেদিন ছাত্রের থেকে বাপের আগ্রহ বেশি।
- কোথায় পড়েন?
- খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।
- কুন সাবযেক্ট?
- এগ্রোটেকনলজী।
- সেটা আবার কোন সাবযেক্ট? কি পড়ায় তাতে?
- এগ্রোনোমি, বায়োটেকনোলজী, বায়োকেমিষ্ট্রি, ষ্ট্যাটিস্টিক্স, সয়েল সাইন্স, !!!!
এক নিঃশ্বাসে বলে গেলাম।
- বুঝলাম না কিছুই!
- আপনার বুঝার কথা না। চার বছর পড়ে অনেক বাঘা ছাত্রও বুঝেনা আর আপনিতো কেবল শুনলেন।
- তা আপনি কি ওকে ঠিক মত পড়াতে পারবেন?
- আজকেতো শুরু করলাম মাত্র! আজকেই জিজ্ঞাসা করলেন? তবে আজকেই সিলেবাস শেষ করে দিবো?
- না মানে কইলাম আর কি! আগের টীচার পারেনাই। এজন্যে আপনাকে ডাকা।
- আগের টীচারের গল্প আমাকে বলে লাভ নেই। আমি আমার মত পড়াই।
বুঝলাম কঠিন চিড়িয়া ছাত্রের বাপ। আমি তাকে একটা লিষ্ট ধরিয়ে দিলাম। সেখানে আমার চাহিদা এবং কিছু জিনিষের কথা লেখা।
- এত্তগুলা খাতা কেনো? আর একদিন পর একদিন কেনো পড়াবেন?
- আমি কারো কথা শুনে পড়াই না আংকেল। আপনার না পোষালে বলেন। চলে যাই।
- না না ঠিক আছে। আমি কিনে দেবো।
- জি ধন্যবাদ। মাসের পাঁচ তারিখে বেতন দিয়ে দেবেন। আর এখন আপনি যেতে পারেন। আমি ওকে পড়ানো শুরু করি।
ছাত্রের বাপ গজ গজ করতে করতে চলে গেলো। আমি ছাত্রের দিকে তাকালাম। ছিপেছিপে ফর্সা একটি ছেলে।
-তোমার নাম ?
- রাফসান।
- গুড। কি কি পড়তে চাও?
- ম্যাথ, হায়ার ম্যাথ, পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, বায়োলজি।
- ওকে গুড। আমি রুটিন করে দেবো আর আমরা সেভাবেই এগোতে থাকব।
একদিন পড়ে আবার ছাত্রের বাসাতে। যথারীতি ছাত্রের অতিউৎসাহী পিতা বসে আছেন ছাত্রের চেয়ারে। রাফসান বিছানায় বসে ঝিমাচ্ছে।
- আসসালামুআলাইকুম চাচা। ভালো আছেন?
- ওলাইকুম। দেরী করলেন যে?
- আমি ঠিক সময়মত এসেছি। চাচী চাবি খুঁজে পাচ্ছিলেন না তাই গেট দেরীতে খুলেছেন।
- আরো আগে আসবেন। একটু পাঞ্চুয়াল হোন।
- সরি আংকেল, আমিতো রুপসা ট্রেন চালাতে আসিনি। এসেছি ছাত্র পড়াতে। বেটার আপনি দশমিনিট আগে গেট ওপেন করে রাখবেন।
প্যারাটা একটু বেশিই হয়ে গেলো। উনি চোখ কুতকুতে করে আমার দিকে তাকালেন। যেন চোখের ভেতরে গরম সয়াবিন তেলে আমাকে ভেজে খাচ্ছেন। আমি আবার সুযোগ নিলাম ভোজ্য হবার।
- আপনি রোজ রোজ এভাবে ওর চেয়ারে বসে থাকবেন না। আমি পছন্দ করিনা। আপনার কথা থাকলে আমাকে কল দেবেন অথবা পড়ানো শেষ হলে আমাকে জানাবেন। আমি এগুলো পছন্দ করিনা।
- ওকে ওকে বুঝছি।
আংকেল চলে গেলেন। রাফসান উঠে এসে চেয়ারে বসলো। ছাত্রের চোখে-মুখে বিরক্তির ছাপ।
- স্যার কিছু মনে করবেন না। উনি মানুষটাই এমন। ঘ্যান ঘ্যান করতেই থাকে।
- ইটস ওকে। দেখাও তোমার হোম ওয়ার্ক।
এক অংক পাঁচবার করে করতে হবে। এক প্রশ্ন পড়ে মুখস্ত করে পাঁচবার লেখতে হবে। পড়ার বাপও মুখস্ত হয়ে যাবে।
-স্যার, পদার্থ প্রশ্ন দুইটা লিখেছি। পাঁচবার লেখতে যেয়ে হাত ব্যাথা হয়ে গেছে। কমালে হয়না?
- উহু, বেটার সময় নাও। দেখে লেখছো নাকি দেখে লেখছো?
- যে টেকনিক আবিস্কার করছেন স্যার, আমার আব্বাও দুইটা প্রশ্নের উত্তর মুখস্ত করে ফেলেছে।
আমি হেসে ফেললাম। খুব কঠিন সময়ে পাওয়া টীউশনি এটা। একেবারে অন্ন সংস্থানের বিষয় জড়িত। খাজা হলের ক্যান্টিনের দেলোয়ার মামা প্রতিদিন ঠিক মশারির ভেতরে ঢোকার সময়ে ডাক দেন।
- সুফল মামা আছেন? সাড়ে সাতশো হয়ে গেলো। টাকাটা দেবেন না?
সাব্বির আমার দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকে। সেও আমার কাছে টাকা পায়। তবে অংকটা আমরা দুইজনেই ভুলে গেছি। আমি আস্তে করে পেছনের বারান্দায় চলে যাই। হলের পেছনের এই জায়গায় বড় বড় আকাশ ছোয়া গাছের সারি। একটা ঠান্ডা বাতাস গায়ে এসে লাগে। আজকে বোধহয় পুর্ণিমা। গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে জোছনার আলো। হাত বাড়িয়ে ধরতে গেলাম; ফসকে বের হয়ে গেলো। হুমায়ূন স্যারের থিওরীর মত যদি জোছনা গিলে খাওয়া যেত? রাতে খাওয়া হয়নি। খিদে পেলে যদি জোছনা খাওয়া যেত তাহলে বাকির ফোল্ডারের সংখ্যাগুলো বড় হতোনা।
চলবে!!
গৃহশিক্ষক।