আমাদের ছোট বেলার ঈদই ভাল ছিলো। যখন ক্লাস থ্রি ফোরে পড়তাম তখনকার দিনে আমার ঈদ সেলামী ছিলো সর্বোচ্চ ১০টাকা। সেই ১০ টাকা দিয়ে সারাদিন হই হই করার পরেও বাসায় ফিরে পকেটের মধ্যে খানিকটা অর্থ আবিস্কার করতাম। শখের মধ্যে ছিলো পেপসি খাওয়া। মনেপড়ে একই রিকশায় আমি, সাঈদ(জনি), রনি, রাসেল, রাজেশ উঠতাম। সাইজে এতই টুনিপ্যাক ছিলাম যে এক রিকশাতে সাত আটজন ধরে যেত। আমরা যেতাম পার্কে। সেই আমলে পার্ক মানে মাদকের আস্তানা নয়। এরপড়ে যেতাম পুলিশ লাইনের সামনে জনির এক দাদীর বাড়িতে। সেখানে খাওয়া দাওয়া হইচই। সারাদিন পরে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরতাম।
ঈদ মানেই আমাদের কাছে একটা উত্তেজনার মত বিষয়। এই উত্তেজনার একটা বড় অংশ জুড়ে ছিলেন মেজ ভাইজান। আমি বাঘ দেখলেও এত ভয় পাইনা যতটানা এই মানুষটাকে দেখলে পাই। ঈদের সকাল হলেই সুজন ভাই আর আমার আলসেমি শুরু হয়ে যেত। মেজভাইজান একবার হাঁক দিয়ে আবার শুয়ে পড়তেন। শেষে দেখা যেত আমরা তৈরি অথচ ভাইজান বাথরুমে। আমরা ছোট দুইজন জায়নামাজ হাতে মেজ ভাইয়ের পেছন পেছন হাঁটতাম। খুব ভদ্র তখন আমরা; ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানিনা! পারার বান্দরগুলা আমাদের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসত। তারা বুঝত এই সময়ে ইয়ার্কি করা যাবেনা...সামনে এসপি সাহেব! কোন এক ঈদে সব ঈদগাহ্র জামাত শুরু হয়ে গেছে। আমরা দৌড়ালাম বড় ঈদগাহ্র দিকে। যেতেই দেখি নামাজ শেষে সবাই বের হয়ে আসছে। মেজভাইজানের চেহারা হয়েছিলো দেখার মত। আমরা একটু অপেক্ষা করে মিছিলে মিশে গেলাম।
নামাজ শেষে আব্বার কবর জিয়ারতে যেতাম। একটা নিয়ম যার জন্যে প্রায় বছর জুড়ে অপেক্ষা। সেই সময়টা আমাদের তিনভাইয়ের কাছেই চরম আবেগি মুহুর্ত ছিলো। যথারীতি মেজভাইজানই নেতৃত্বে। পরিবারের কিছু ঐতিহ্য থাকতে হয়...কিছু ঐতিহ্য ধরে রাখতে হয়। বড় আপার বিয়ের পরে আমাদের কার্যতালিকায় থাকতো আপার বাসায় যাওয়া। বড় আপার শ্বশুর বাড়িতে আমরা তিন ভাই; আপা ঘাম মুছতে মুছতে সেই বিখ্যাত হাসি নিয়ে আসতেন। খুব সাধারন জীবনে সেটাই ছিলো অসাধারণ মুহুর্ত।
আমাদের তিন ভাইই অপেক্ষা করতাম কখন বাসায় ফিরবো। আম্মা বা দিনার আপা সারাজীবনে কম খিচূরী রান্না করেননি অথচ ঈদের দিনের খিচুরী, গরুর মাংস কিভাবে যেন ওয়ার্ল্ড ফেমাস হয়ে যেত। সেই গরম গরম খিচুরী আর গরুর মাংস পেটে না পড়লে দিনটাই মাটি। দিনার আপা পা লুকানোর চেষ্টা করলেও আমি কিভাবে যেন ঠিকই খুঁজে পেতাম। আমাদের সেই অসাধারোন মুহুর্ত অনেকদিন ছিলো।
বলার মত অর্থবিত্তের অধিকারিণী আমার মা ছিলেন না। আব্বা মারা যাবার সময়ে আমরা ছয় ভাই-বোন সবাই পড়ছি। কেউই আয়ের পথে নেই। সেই একমাত্র উৎস থেকে আসা টাকা দিয়ে কিভাবে আম্মা যেন ম্যাজিক করতেন। আমাদের ঈদ হতো। কোন এক ঈদে মায়ের ম্যাজিকে কাজ করেনি। বড়রা খুব একটা জামা কাপড়ের কথা বলতেন না। তবে আমাদের সর্বশেষ দুইজনের দিকে আম্মার নজর থাকত। পলেষ্টারের শার্ট অথবা গুলিস্থানের ফুটপাথ থেকে কেনা কেডস... আমি উড়ে বেড়াতাম আকাশে বাতাসে। আমার জন্যে নতুন জামা? নতুন জুতো? যাইহোক, এই ঈদে মায়ের হাতে ম্যাজিক কাজ করলো না। হয়ত দেনা জমে গেছে। আম্মা কায়দা করে মেজ ভাইয়ের দুইটা পুরাতন প্যান্ট উলটে দুইটা প্যান্ট বানিয়ে দিলেন। সেই ঈদটা আমার আর সুজন ভাইয়ের জন্যে সবচেয়ে আনন্দের ছিলো।
আমরা সবাই বড় হয়ে গেলাম। মায়ের ম্যাজিক আর প্রয়োজন পরেনা। দুরত্ব বাড়তে লাগল। মেজ ভাইজান কর্মব্যস্ততায় আর কুষ্টিয়া আসতে পারেন না। ঢাকার বাসা রেখে আসা যায়না তাই সুজন ভাইও আসেন না। ঈদের নামাজ ভুলে গেলাম। আসলে ভাল লাগত না। এখনও যাইনা। আমার কাছে সেই সময়গুলো ফিরে আসা খুব জরুরী। মেজ ভাইজানের হাঁকডাক...জায়নামাজ হাতে আমরা ছোট দুইজন...সামনে মেজভাইজান আর পারার বান্দরগুলা আমাদের দেখে মিটমিট করে হাসছে।