তখন আমার বয়স কম।বাবার সাথে বাউল গানের আসরে যেতাম ।বর্ষাকাল
হলে বেশি মজা হত।বাড়ির চারদিকে থৈথৈ পানি।মাইলের পর মাইল জলজফসলের মাঠ।অনেকদূরের গ্রাম।একটা কথা জানিয়ে রাখি-আমাদের বর্ষাকাল দুইমাসের না।কমকরে হলেও চার মাসের।এই চার মাস বাড়ির চারদিকে পানি থাকে।অনেক গ্রামের মানুষ যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়াতে নৌকা ছাড়া বর্ষাকালে প্রায় অচল।একবাড়ি থেকে আরেক বাড়ি যাবেন তো নৌকা,হাটে যাবেন তাও নৌকা।এক একটা বাড়ি যেন এক একটা দ্বীপ।আর এই সময়টাকে আমরা বলতাম বর্ষাকাল।বর্ষাকাল শেষ হলে বাকি সময়টাকে বলতাম সুদিন।আপনারা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন বর্ষাকালটা আমাদের জন্য কত কষ্টের ছিল?আর বন্যা বলতাম তখনই যখন
বাড়ি পর্যন্ত পানিতে তলিয়ে যেত,ঘরে পানি উঠত।মাচা পেতে রাতে শুতে হত।এর আগে বর্ষাকাল।তো আমি বাবার সাথে বাউল গানের আসরে যেতাম।আমাদের নৌকাতে করে।একজন লোক নৌকা বেয়ে নিয়ে যেত।
বাকিরা মিলে নৌকাতে গানের জজবা তুলতেন।কয়েকজন থাকতেন বাদক,কয়েকজন গায়ক।গান গাইতে গাইতে দূর গ্রামের কোন একপীরের বাড়িতে বাউল গান,আধ্যাত্বিক,দেহতত্বের গান শুনতে যেতাম।আমার কাছে পীরের বাড়িতে যে গান শুনতাম তার চেয়ে আমরা নৌকায় যে গান গাইতাম তা বেশি ভালোলাগতো।চারদিকে জল।জলের মাঠ।এই জলের মাঠ পেরিয়ে আমাদের গানের সুর ছড়িয়ে যেত।সে সুর হয়ত দূর গাঁয়ের কোন এক গৃহ বঁধুর হৃদয়ে নাড়া দিত।চারদিকে মাঝেমাঝে জ্যোৎস্না হত।দারুণ পাগল করা জ্যোৎস্না।হায়রে জ্যোৎস্না।নদীর ছোট ঢেউয়ের মাঝে যেন এক একটা চাঁদ ভেসে বেড়াত।আমাদের নৌকার যে বাঁশরিয়া থাকতো আমি সবসময় তার কাছাকাছি বসতে চাইতাম।গানের মাঝেমাঝে বাঁশরীর সুর জ্যোৎস্নাকে যেন আরো আরো কাছে নিয়ে আসতো,নামিয়ে দিত ।এভাবে গানের সুরে গন্তব্যে ।গন্তব্যে শুরু হত আরেক মজার গান।একের পর এক বিখ্যাত সব বাউল শিল্পী গান গেয়ে যেতেন।
এই বয়সে এসে দুই একটা গান শুধু মনে করতে পারছি
যেমন-বাঁশি বাজাও বংশীওয়ালা ,ঐ মধুর সুরে।
কিংবা -মা'লো মা ঝিলো ঝি করলাম কি সে রঙ্গে ভাঙ্গা নৌকা বাইতে আইলাম গাঙ্গে।এমন অনেক গান ছিল।গানের আসর শেষ হলে পীর (যদিও পীর লোকটাকে আমার পছন্দ হতোনা)বাবাজীর আশীর্বাদ নিয়ে ফিরে আসতাম।ফেরার পথে আবার সেই গান।গানে গানে গন্তব্য থেকে ফেরা।
আমার জ্যোৎস্না ধরার লেখা চলতেই থাকবে।যদিও সবলেখা জ্যোৎস্না বিষয়ক হবেনা।স্মৃতিগুলো আমার কাছে জ্যোৎস্নার মতই সুন্দর,জ্যোৎস্নার মতই পাগল করে টানে।
লেখার কোন ধারাবাহিকতা থাকবেনা।যখন যেটা মনে আসবে সেটাই লিখব ভাবছি।