বড় বুবুর বিয়ে।ছোট চাচা ঢাকা থেকে বাড়ি আসবেন।আমাদেরকে চিঠিতে করে জানালেন যে আমরা যাতে আড়ং থেকে উনাকে এগিয়ে নিয়ে আসি।বর্ষাকাল চারদিকে থৈথৈ পানি।রাস্তাঘাট সব তলিয়ে গেছে।নৌকা ছাড়া আড়ং থেকে আসার উপায় নেই।আমি তখন অনেক ছোট।বয়স ১০-১২।তো আব্বা পাশের বাড়ির খলিল আর আমার মেঝো ফুফুর ছেলে ইকবালকে বললেন চাচাকে নিয়ে আসার জন্য। খলিল আর ইকবাল ছাড়াও আমাদের সাথে আরো একজন ছিল উনার নাম মনে করতে পারছি না।চান্নিপসর রাত।ফুরফুরে বাতাস।আমার খুব ভালো লাগছিল।খলিল সম্পর্কে আমার চাচা হতো।উনি সবসময় একটা বাঁশি লুঙ্গির পেছনে লুকিয়ে রাখতেন।বাঁশি ভালো বাঁজাতেন বলে উনার একটা সুনাম ছিল।কেউ কেউ বলত উনি বাঁশি বাঁজিয়ে নাকি আকাশের পরী নামাতে পারতেন।যাই হোক আমি কখনো দেখিনি।
আমরা নাও নিয়ে রওনা দিলাম মাণিকনগর আড়ং এর উদ্দেশ্যে।ওখানে যেতে হলে প্রথমে ছোট গাঙ্ তারপর মেঘনা পেরিয়ে যেতে হয়।মেঘনার নাম শুনলেই আমার ভয় ভয় করতো ।আমার বাবার একবার ৫০০ মণ পাট সহকারে আমাদের বিশাল ডিঙ্গি নাও মেঘনায় ডুবে যায়।তারপর থেকে বাবা জীবনে আর কিছুতেই সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন নি।বাবা পুঁজি উদ্ধারের জন্য একদল লোককে বলেছিল নাও টা উঠিয়ে দিলে বাবা নাও টা তাদের কে দিয়ে দিবে আর বাবাকে পাটগুলো দিতে হবে।চুক্তি মত নাও উঠানো হয়েছিল।কিন্ত্ত ভাগ্যের নির্মম পরিহাস নাওটা ওদেরকে দিয়ে দিতে হয়েছিল বিনিময়ে আব্বা যে পাট পেলেন তা কোন কাজে আসেনি।পলি কাদায় মাখমাখি হয়ে পাট সব নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
আমি এই মেঘনাকে প্রচন্ড ভয় পেতাম।কী বড় বড় ঢেউ।যেন ভেতর থেকে ভয়ে প্রাণ বেরিয়ে আসবে। বর্ষাকালে মেঘনার যেন কূল কিনারা নেই।যতদূর দেখা যায় জল আর জল।পাল তোলা হরেক রকমের নাও ,স্টিমার।
ইলিশ ধরার নাও গুলো দেখে আমার খুব ভয় হতো আমি ভেবে অবাক হতাম এত ছোট নাও নিয়ে এত বড় বড় ঢেউয়ের মধ্যে তারা মাছ ধরতো কিভাবে?নাও গুলো ডুবু ডুবে যেন ভেসে উঠত।চাপিলা মাছ ধরার খড় জালে চাপিলা মাছ চিকচিক করতো।
যাই হোক আমাদের নৌকা ছোট নদী পেরিয়ে বড় গাঙ অর্থাৎ মেঘনায় এসে পড়েছে ।আমাদেরকে সাড়ে তিন মাইল মেঘনা পাড়ি দিয়ে আবার ফিরে আসতে হবে।আহা! মেঘনার কী রূপ।কী তার ঢেউ!কোথাও কোন বাড়ি ঘর দেখা যায় না।যেন জলের মরুভূমি।চারদিকে ফকফকা জ্যোৎস্না।পাগল হয়ে যাবার মত জ্যোৎস্না।খলিল কাকা কথা নেই বার্তা নেই বাঁশিতে দিলেন ফুঁ।আমারা সবাই তাজ্জব বনে গেলাম।বাঁশির সেই সুর যেন আকাশ বাতাশ কাঁপিয়ে দূর থেকে দূরে আরো দূরে ছড়িয়ে যাচ্ছে ।কোথাও কোন প্রতিধ্বনি নেই।সব কিছু নিরব নিথর।মাঝে মাঝে বৈঠার ছপাং ছপাং শব্দ।বাঁশির সুরে যেন চান্দের সব কিরণ এক সাথে নেমে আসছে।সবার্ মুখ আমরা স্পষ্ট দেখতে পেলাম।কারো মুখে কোন রা নেই।বাঁশির বিরহী সুর সবাইকে বোবা বানিয়ে দিয়েছে।মনে হচ্ছিল এ যেন বাঁশি নয় কোন করুণ বিরহীর অঝর কান্না।হায় মেঘনা!ঢেউ যেন উথাল পাথাল ।ঢেউয়ের বুকে ধূসর জ্যোৎস্না উছলিয়ে পিছলিয়ে পড়ছে।প্রতিটি ঢেউ ঢেউয়ে একটা করে সুন্দর চাঁদ।আঁকাবাঁকা।কি সুন্দর বাতাশ ফুরফুরে।
সেদিন আড়ং এ গিয়ে চাচাকে পাইনি।বাড়িতে এসে দেখি তিনি ভাড়া নাও নিয়ে আমাদের আগেই চলে এসেছেন।তাই আমাদের কে আবারও একই পথ একই ভাবে একই সুরে ফিরতে হয়।জীবন কি সুন্দর ছিল।আহা জীবন কত সুন্দর ছিল।
এখন কোথায় জীবন?জীবন এখন কোথায়? কোথায় জীবন এখন?
কোন উত্তর পাইনা।কোন সুর শুনিনা।কোন ঢেউ দেখিনা।জলস্নাত বাতাশে স্নিগ্ধ হতে পারিনা।