সেকালে বাউলদের গান হতো।আজও হয়।গ্রামে গ্রামে।শীতে -হেমন্তে শুরু বাউল গানের উৎসব,ওয়াজ নসিহত,বিভিন্ন মাঝারের বার্ষিক ওরস।কেননা শীতকালে ঝড়-বৃষ্টির উৎপাত নেই।কোথাও গান হবে শুনলে দল বেঁধে চলে যেতাম সেসব আসরে।
শাহপুর থেকে শাহবাজপুর,নারায়নপুর থেকে রসুলপুর,লহড়ী থেকে নাসিড়াবাদ,শ্যামগ্রাম থেকে শ্রীরামপুর উত্তর-দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম যেখানেই হোক।মনে পড়ে সেদিনের কথা। শ্যামগ্রাম থেকে আসর শেষ করে বাড়ি ফিরছি।সদ্য আমন কাটা শেষ নারাময় ফসলের মাঠ।নারাময় ফসলের মাঠ সোনার বিছানা যেন।চারদিকে শুধু রূপোলী হাসি।সোনা রূপা মিশেল যেন সোপালী জমিন।কুয়াশা তখনো বেশ করে পড়েনি।বাতাশ ছিলো।দূরগ্রামের ছায়ার মত ছবি দেখা যায়।আর আমি তখন পূর্ণ যুবক। ওসব বাউল গানের আসরে প্রায়ই সিদ্ধপুরুষেরদল সিদ্ধি বিক্রি করতেন এখন আজকাল করেন কিনা আমি ঠিক বলতে পারব না।সে রাতে আমি কি সেবন করেছিলাম কিছুটা?না ।মনে করতে পারছি না।হতেও পারো। হয়তোবা না।যাই হোক আমি ফিরছিলাম শীত কিংবা হেমন্তের মাঝামাঝি কোন সময়ের এক পূর্ণচন্দ্রিমার রাতে।সে রাতে বাতাস ছিলো ফুরফুরে।মাথার চুল লম্বা থাকায় চুলগুলোও উড়ছিলো।খদ্দরের ভারি পাঞ্জাবী,পায়জামা পড়েছিলাম। মন জুড়ে ভাল লাগা।চারদিকটা খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে পথ চলা।একটা শেয়াল আমাকে দেখে পালিয়ে গেল।রাত বিহারে বেরিয়েছে ইঁদুরের দল।চারদিকে কুটকুট খুটখুট।কোথাও আকাশে ধুমকেতু জ্বলে ওঠে।পথ চলছিলাম আর ভাবছিলাম সামনে ছোট নদীটা পার হবার পরেই মাইল খানেক পথ তারপরেই আমার গ্রাম।আমার ঘর। ওখানে অনেক আরাম আর ওম।সারারাতের ক্লান্তি যেন পেয়ে বসেছে।নদী পেরোলাম।হাঁটি আর ভাবি আর একটু। এইতো সামান্যদূরে আমার ঘর।বাঁকা যে উঁচু আলটা আছে ওটা পেরোলেই ...।রাস্তা ফুরায় না। কি করি একদিকে ক্লান্তি অন্যদিকে একটা কেমন কেমন ..কোথায় যাচ্ছি?রাস্তা এতদূর হবে কেনো?হিসেব মিলাতে যাই।আমি শ্যামগ্রাম থেকে ফিরছি।আমার হাতের বামে শাহবাজপুর ডানে ফাকা অনেকদূর কিন্ত্ত কিছুটা সামনে এগুলেই ডানে পড়বে লহরী -আমার সামনে আমার গ্রাম আর পেছনে ফেলে এসেছি শ্যামগ্রাম।আমি শুধু সামনে এগুবো ফাঁকা মাঠ ধরে।ঠিকইতো আছে।ভুলটা কোথায়? আবার হাঁটি।এবার এসেই পড়লাম।ওইতো দেখা যায়।কেমন কালো মতন ভুতুরে গ্রাম রাতে থমকে দাঁড়িয়ে আছে ।নিস্তব্ধ।গ্রামের কাছাকাছি যত আসি ততই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস অজান্তেই ।আহ আজ অনেক ক্লান্ত।আরেক্টো পরেই আজকের মত ক্ষান্ত দেব।গ্রমটিতে ডুকেই আমার কেমন যেন একটা চিন্তায় পেয়ে বসলো চারদিক কেমন কেমন।আরে এতক্ষণ আমি তাহলে কোথায় আসলাম?ধূর ।মেজাজটা বিগড়ে গেল।সবকিছু এলোমেলো আর অপরিচিত।অবশেষে একটা বাড়ি গিয়ে ঢুকে দেখে টেখে একটা ঘরের দরোজায় কড়া নাড়ি।ডাক দিই -আছেন কেউ বাড়িতে?।কোন সাড়া নেই।আবার ডাক দিই আছেন কেউ?কোন শব্দ নেই। আরে বাবা কোথায় এলাম স্বপনে নাতো।সব যেন কেমন সেই রূপকথার নিঝুম পল্লী।এবার আরো জোরে।কিন্ত্ত নিজের কণ্ঠ শুনে নিজেই বুঝতে পারছিলাম আমি কতটা বিভ্রান্ত ,আতংকিত,বিরক্ত এবং ক্লান্ত।এবার নিজেকে একটু সুস্থির রেখে আবার ডাকি-আছেন কেউ?কোন শব্দ নেই দেখেঘুরে ফিরে চারদিকটা একটু বুঝতে চেষ্টা করি।হঠাৎ ঘরের চৌকাঠের নিচে মৃদু আলোরেখা দেখি।কিছুটা আশা জাগে। মনে হয় কূল পেলাম বুঝি।আবার ডাকি -শুনছেন আমি একটু বিপদে পড়েছি এটা কোন গ্রাম?কাঠের দরোজা সেকেলে অনেক ভারি হতো দরোজা খুলতে গেলেই কেমন কুৎকুৎ আওয়াজ হতো।দরোজা খুলার সাথে সাথেই হারিকেনের মৃদু আলোয় চোখ ধাধিয়ে ওঠে।প্রথমে তাকাতেই যেন কষ্ট হচ্ছিলো।চোখে হাত রেখে তাকাই। দেখি এক শ্যামল নারী।রক্তিম চোখ। হারিকেন ধরে আছে।গাল বেয়ে পড়ছে ঘাম। কিছুটা উৎকট গন্ধ এসে নাকে লাগে।কিছুটা বিরক্তির আভাস ভেসে ভেসে আমার বিভ্রান্ত চোখ দেখে আবার কেমন যেন কোমল একটা দৃষ্টি জাগে।এটা কোন গ্রাম?আমি বোধয় পথ ভুল করছি।গলা ঝেড়ে তিনি বললেন এটা ......।আমি এতক্ষণ কোথায় হাঁটলাম।ধ্যাৎ মনটা বিষিয়ে উঠলো।আমাকে দিক নির্দেশনা দিলো আমি আমার গন্তব্যে কিভাবে পৌছাব।বিদায় নিয়ে আবার সেই মাঠ।রাত প্রায় শেষের দিকে।কোথাও কোথাও আজানের জন্য মসজিদের মুয়াজ্জিনেরা গলা হাঁকারি দিচ্ছেন।এবার আমি ঠিক পৌছাবো ।এবার ভুল হবে না।এবার চারদিকটা আরো পরিষ্কার আরো স্বচ্ছ।আবার হাঁটা শুরু করি।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২ রাত ৯:৪১