বর্তমান ছাত্ররাজনীতি হচ্ছে ক্ষমতার সহায়ক একধরনের লাঠিয়াল বাহিনী। কিন্ত তা একদিনে হয়ে উঠেনি। স্বাধীনতার সমসাময়িক উত্তরকালে ছাত্রলীগ এবং ছাত্রইউনিয়নই ছিল প্রধান ছাত্রসংগঠন। নব্বইয়ের দশকে এসে ছাত্রইউনিয়ন ছাত্রদের কাছে তার আবেদন হারায়।কিন্ত জন্মের পর থেকেই ছাত্রলীগ ছাত্রসমাজের কাছে সমানভাবে আবেদন রেখে চলছে, যদিও তা এখন প্রশ্নের মুখে। এর মূল কারণ যতটা না এর কর্মসূচী, তার থেকে বেশী নেতা নির্বাচনে এর সাংগঠনিক পদ্ধতির কারণে। ছাত্রসমস্যা কেন্দ্রীক ছাত্ররাজনীতি বাংলাদেশে সবসময় অবহেলিত। এই লেখায় সংক্ষেপে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির উত্তানপতনের সময়সুচি এবং এর মূল কারণ উপস্হাপন করার চেষ্টা করবঃ
১) স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ছাত্রলীগই প্রধান সংগঠন হিসাবে থেকে যায়। মূলত আমার বিবেচনায়, ছাত্রলীগ তথা ছাত্রসমাজের আবেগকে ধারণ করে বংগবন্ধু বাংলার স্বাধীকার আন্দোলনকে বেগবান করেন ১৯৬৮ এর পরবর্তীকালে। স্বাধীনতার পর নেতৃত্বদানকারী ছাত্রসংগঠন হিসাবে ছাত্রলীগই থাকবে তাই স্বাভাবিক। এ সময়ে ছাত্রইউনিয়নের আবেদন কিছুটা কমে আসে মূলত তারা ছাত্রলীগের অপকর্মের বিরুদ্ধে বলিষ্ট কোন ভূমিকা রাখতে না পারার কারণে।
২) ছাত্রলীগ ভেংগে জাসদ ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার পর নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত জাসদ ছাত্রলীগ আধিপত্ত বিস্তার করে - তারা মূলতঃ ছাত্রলীগ বিরোধী ফ্রন্ট হিসাবেই কাজ করে। তাদের বৈপ্লবিক কর্মসূচি এবং সন্ধার সময়ে মশাল মিছিল ছাত্রদের মাঝে একধরনের আবেদন তৈরি করে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাথে তারা বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বসস্ত্র দ্বন্ধে লিপ্ত হয়। এবং অনেক স্হানেই তারা প্রধান ছাত্র সংগঠন হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে।
৩) কিন্তু ছাত্রদল প্রতিষ্ঠার পর জাসদ ছাত্রলীগের অনেকেই ছাত্রদলে যোগদান করে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বিপরীতে জাসদ ছাত্রলীগের শক্তি কমতে থাকে, এবং বিভিন্ন স্হানে এরা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের হাতে মার খেয়ে ক্ষয়িস্নু হতে থাকে।
৪) আশির দশকের মাঝামাঝিতে ছাত্রদল প্রভাব বিস্তার শুরু করে। মূলত জাসদ ছাত্রলীগের ব্যার্থতাই ছাত্রদলের উত্তানকে ত্বরান্বিত করে। আশির দশকের শেষ এবং নব্বইয়ের শুরুতে ছাত্রদল প্রধান ছাত্রসংগঠন হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে। এ সময়ে ছাত্রশিবির ছাত্ররাজনীতিতে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস পায়।
৫) স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের পর নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে জাতীয় রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধ একটি প্রধান ইস্যু হিসাবে আবির্ভুত হয়। বিভিন্ন স্হানে ছা্ত্রলীগ, ছাত্রমৈত্রি এবং ছাত্রইউনিয়নের সাথে ছাত্রশিবিরের নিয়মিত সংঘর্ষ হতে থাকে। ১৯৯৬ সালে সরকার পরিবর্তনের পর ছাত্রদলের আবেদন কমতে থাকে। মূলত তারা সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে তারা পিছুহঠে।
৬) একানব্বইয়ের পর থেকেই ছাত্ররাজনীতি অর্থ-ভিত্ত আর রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠার প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠে। এ সময় থেকে ছাত্ররাজনীতি ছাত্রদের সমস্যা সমাধানে পুরোপুরি ব্যার্থ হয়।
৭) ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ছাত্রশিবির বিভিন্ন স্হানে প্রতিকূল পরিবেশে নিজেদের অবস্হান ধরে রাখে।
৮) ২০০১-২০০৬ এ সময়ে ছাত্রদল এবং শিবির নিজেদের অবস্হানকে আরও শক্তিশালী করে। সম্ভবত ছাত্রশিবির এ সময়ে দ্বিতীয় প্রধান ছাত্রসংগঠন হিসাবে নিজেদের দাড় করায়।
৯) ২০০৭ সাল থেকে ছাত্রলীগ পুনরায় নিজেদেরকে প্রধান সংগঠন হিসাবে দাড় করায়, এবং বিভিন্ন স্হান থেকে ছাত্রদলকে বিতাড়িত করে। এ সময়ে ছাত্রশিবিরের সাথে ছাত্রলীগের স্বসস্ত্র সংঘর্ষ হতে থাকে।
১০) ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর ছাত্রদল ছাত্ররাজনীতি থেকে অনকেটাই বিতাড়িত হয়। ছাত্রশিবির অনেকটাই আন্ডারগ্রাউন্ড সংগঠনে পরিণত হয়। ছাত্রলীগ লাঠিয়াল বাহিনী হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে, যেখানে আধিপত্তবাদী, অর্থ উপার্জন, চাঁদাবাজী এবং টেন্ডারবাজীই মূল ইস্যু।
বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতি অতিমাত্রায় জাতীয় রাজনীতি কেন্দ্রিক। ছাত্ররাজনীতি ছা্ত্রসমস্যা নিয়ে খুব কমই কাজ করেছে। ছাত্ররাজনীতির প্রধান কর্মসূচী কখনই ছাত্রদের সমস্যার সমাধান ছিলনা। এটিও বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির মাফিয়া হয়ে উঠার কারণ।