স্বপ্ন লজ্জাহীন
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্বপ্ন লজ্জাহীন উপন্যাসটি পড়েছিলাম যখন আমি ক্লাস নাইন বা টেনের ছাত্রী। বইটি পড়ে এতটাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম যে, আমিও সিদ্ধান্ত নিই, জীবনে যদি কখনো প্রেম আসেই, ভালোবাসার মানুষটিকে আমি বিয়ে করব না। আমার ভালোবাসাকে আমি কখনো চাল, ডাল, নুনের নিত্যহিসাবের খাতায় তুলব না। সে থাকবে আমার মনের নীরব, নিভৃত কোণে; শুধু একান্ত আমার অনুভূতি হয়ে। যে অনুভূতি হবে আমার ভীষণ একাকিত্বের নীরব সঙ্গী।
সে দুর্বার সময়ও এল জীবনে আরও কয়েক বছর পর। তার প্রতি কী এক দুর্নিবার আকর্ষণে আমি হারিয়ে ফেললাম নিজেকে। কিছুদিন দেখা না হলেই মনে হতো, পৃথিবীটা কী ভীষণ নিষ্ঠুর! সবকিছু অসহ্য হয়ে যেত। আবার দেখা হলেও অকারণ অভিমানে চোখ ভরে জল আসত। শুধু চোখে চোখ রাখা, কোনো কথা হতো না, কী এক অব্যক্ত অনুভূতি কাজ করত মনে। কে কাকে বেশি ভালোবাসি, তার পরীক্ষা চলত অনবরত। শেষ কবে দেখা হয়েছিল, সেই সঠিক তারিখটি বলতে পারাই ছিল তার পরীক্ষা। ভালোবাসার কোনো পরীক্ষাতেই সে অকৃতকার্য হয়নি। সদম্ভে সে আমাকে হারিয়ে দিয়েছে। প্রেমকে পরিণতি দেওয়ার সময় এল এবার। অথচ তখন আমি আমার চারপাশের বিবাহিত জীবনগুলো দেখে রীতিমতো আতঙ্কিত। সারাক্ষণ শুধু চাওয়া-পাওয়া আর স্বার্থের নিত্যদ্বন্দ্ব। ভালোবাসা সেখানে এক ‘ডেডবডি’। তার অস্তিত্বও স্বীকার করা যায় না আবার তাকে সমাধিস্থও করা যায় না। অথচ আমি আমার হূদয়ের গভীরে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার যে স্বপ্নপুরী বানিয়েছি, সেখানে এমনটার আশঙ্কাও অকল্পনীয়। স্বপ্ন লজ্জাহীন-এর যুক্তি আমার কাছে সংগত মনে হলো। আমি জীবনের কঠিনতম সিদ্ধান্ত নিলাম, তাকে বিয়ে করব না। আমার সবচেয়ে প্রিয় কাঙ্ক্ষিত মানুষটির এতটুকু পরিবর্তন আমার সইবে না। হূদয়ে অনেক রক্ত ঝরল, যন্ত্রণায় আর কষ্টে নীল হলাম দুজন, তবু আমি আমার ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখলাম।
আজ ১৭ বছর পর আমি বুঝতে পারি, কোনো ভুল আমি করিনি। বিবাহিত জীবন মানেই তো পাওয়া না-পাওয়ার চুলচেরা হিসাব। আজ যখন খুব গুরুতর ব্যাপারেও আমার স্বামীটি উদাসীন থাকে, তখন মনে হয় পৃথিবীর কোথাও কোনোখানে একজন কেউ আছে, যে আমার এতটুকু কষ্ট বা যন্ত্রণার খবরে অস্থির হয়ে যাবে। তার বাইরের জগতে না হোক, তার মনের পৃথিবীতে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। এই ভাবনা বা বিশ্বাসটুকু আমার যে কতখানি মানসিক আশ্রয় আর সব দুঃখ-কষ্টকে জয় করে বাঁচার কত বড় যে শক্তি, তা কেবল আমিই উপলব্ধি করতে পারি। আমার মহাব্যস্ত প্রকৌশলী স্বামীর সময় নেই আমার জন্য। কিন্তু আমার যে গভীর রাতের ভীষণ বৃষ্টিতে স্ট্রিট লাইটের আলোয় গাছগুলোর ভিজে যাওয়া দেখতে ইচ্ছে করে! আমি একাই বারান্দায় যাই, বুঝতে পারি, আমার পাশে অদৃশ্য কেউ এসে দাঁড়ায়। আমি তার হাত ধরে বৃষ্টি দেখি। আমার এ স্বপ্ন হয়তো লজ্জাহীন।
মোহনা আরেফিন
মিরপুর, ঢাকা।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




