অনেক আগের ঘটনা, দুহাজার আটের দিকে হবে।
রুমে একজন দু’জন করে আসছে, জম্পেশ আড্ডা হবে। আমার রুমে তখন একটা নাশীদ (ইসলামী গান) বাজছিলো, “ইয়া আরহামার রাহীমিন...” বেশ জনপ্রিয় একটি গান। এমতবস্থায় রুমে একজন ভাই এলেন, তিনি বেশ ভালো গান গাইতে পারেন। বাংলাদেশে যখন ক্লোজআপ ওয়ানের টর্নেডো বইছে তখন তিনি নাকি ডিষ্ট্রিক লেভেলে শীর্ষস্থান অধিকার করেছিলেন। আসলেই তিনি বেশ ভালো গেয়ে থাকেন। রুমে ঢুকে কিছুক্ষন না যেতেই তিনি বিরক্ত হয়ে বলে উঠলেন “বা_ডা বন্ধ করতো মিজাস খারাপ হয়ে যাচ্ছে” ভাবখানা দেখে মনে হল চরম অনাকাংখিত একটি গান বাজছে, সাথে যারা ছিলেন তাদের অঙ্গভঙ্গি দেখেও মনে হল বেশ খারাপ একটি গান বাজছে যা কিছুতেই বাজা উচিৎ না।
এর কিছুক্ষন পরেই উঁচু ভলিউমে বাংলা ও হিন্দী গানের বন্য বইলো মোবাইল থেকে উফারে এক এক করে। কারোও মিজাজ খারাপ হলনা, বরং সবার মাথা তালে তালে দুলতে লাগলো। যে কান “খিরিক দুয়ার সব বন্ধ করে, দুজনার খেলা হবে......” সইতে পারে, “সবি হবে অগোচরে জানবে না কেহ” সইতে পারে, “মুন্নি বদনাম হোয়ি” এবং “যারা যারা **মি **মি” সইতে পারে এবং সর্বপরি “ইউ অলরেডি নো আই ওয়ানা **** ইউ” সহ সব সইতে পারে কিন্তু “ইয়া আরহামার রাহীমিন...” সইতে পারে না তাদের জন্য আফসোসের আর সিমা থাকে কই?
আমি দেখেছি এরা সঙ্গীতকে যতটা গ্রহণ করে পবিত্র কুরানের আয়াতকে ততোটা সইতে পারে না। সম্ভবত নুমান আলী খানের একটা লেকচারে তাঁকে বলতে শুনেছিলাম “সঙ্গীতের সুর যদি কুরআনের সুরের চেয়ে আপনার হৃদয়কে বেশী মোহিত করে তাহলে বুঝে নিতে হবে যে আপনার ঈমানে ভয়ংকর গলদ রয়েছে”। সত্যি বলতে কি, আমি কিছুতেই এই কথাটার বিপক্ষে একটা খোঁড়া যুক্তিও দাঁড় করাতে পারিনি।
আমাদেরকে আনন্দ দেয়ার কারনে যে সকল গায়ক, নায়ক, লেখক থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আমরা মাথায় তুলে রাখি তারা আমাদের জন্য মূলতঃ কতটুকু অবদান রাখছেন? শুধু আনন্দ প্রদানের কারনে আমরা তাদের মাথায় তুলে নাচি, আমাদের আনন্দিত হওয়ার ফাঁকে যৌনতা ও বেহায়াপনা যে কি ভয়ংকর রুপে সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে তা ও আমাদের গোচরে আসে না। আমাদের অতি মুল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে, আমাদের শিশু-কিশোরদের মগজে এক এক করে যৌনতা, নগ্নতা, ইগো প্রবলেম, লোভ, স্বার্থপরতা, স্বেচ্ছাচারিতা, হিংস্রতা সহ নানান নেতিবাচক গুনাবলীর বীজ বপন হয়ে যাচ্ছে এসব বানিজ্যিক বিনোদনদাতাদের মাধ্যমে। অর্থাৎ আমাদের এই বিনোদন পাবার জন্য আমাদের ব্যয়ের পরিমাণটা এতই বেশী যা অকল্পনীয়।
অথচ আমাদের জীবনের পুরোটাই যার অবদান, এমনকি এই যে আমাদের বিনোদিত হওয়ার শক্তি যিনি দিয়েছেন সেই আল্লাহর বাণী সম্পৃক্ত কথা আমাদের কান সইতে পারবেনা এটা কি কেউ কল্পনা করেছে?
খুব আফসোস হয় এমন মানুষদের জন্য, যাদের দিনে একবার গান না শুনলে চলেই না, অথচ তারা মাসের পর মাস কুরআন ছুঁয়েই দেখে না, যারা পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা গল্প ও উপন্যাস পড়ে কাটিয়ে দেয়, অথচ ইসলামকে জানতেমাসের পর মাস কোন বইয়ের একপাতাও পড়ে না, যারা দিনের পর দিন আড্ডা দিয়ে সময় পার করে দেয় অথচ দ্বীনের আলোচনায় একটি ঘন্টাও দিতে যাদের মনে চায় না। মনে মনে প্রশ্ন জাগে, প্রশ্নটি মনে আসতেই ভয়ে এবং দুঃখে কেঁপে উঠি -- এরাই কি তারা যাদের ব্যপারে আল্লাহ বলেছেন “তাদের হৃদয়ে রোগ আছে, আল্লাহ সে রোগ আরো বেশী বাড়িয়ে দিয়েছেন”? [১] আল্লাহ সে রোগ কেন বাড়িয়ে দিয়েছেন? এর কারন নিশ্চই তারা জেনেও আল্লাহর বাণীকে এড়িয়ে চলে, তারা আল্লাহর বাণী সর্বোত্তম জেনেও তা গ্রহন না করে নিকৃষ্টতম জিনিস গুলোকে আঁকড়ে ধরে থাকে। আর যারা অসুস্থ হয়েও সজ্ঞানে নিরাময়কারী ঔষধকে প্রত্যাখ্যান করে তাদের রোগ বাড়িয়ে না দেয়াটাই কি জুলুম নয়? আর আল্লাহ কেন জুলুম করবেন? এভাবে যখন ভাবি তখন আবার প্রশ্ন জাগে আল্লাহ কি এদের কথাই বলেছেন “এরাই হিদায়াতের বিনিময়ে গোমরাহী কিনে নিয়েছে, কিন্তু এ সওদাটি তাদের জন্য লাভজনক নয় এবং এরা মোটেই সঠিক পথে অবস্থান করছে না"। [২]
মুসলিম সমাজের সদস্য হিসেবে আমরা সবাই ঘুরে ফিরেই বার বার এভাবে কুরআন, হাদীস এবং দ্বীনের জ্ঞান থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে রাখার পরিণাম শুনে থাকি। এছাড়াও নামাজ ছেড়ে দেয়া, প্রেম-ভালোবাসার নামে অবৈধ সম্পর্ক মেইনটেইন করার ভয়াবহ শাস্তির কথা জানি। কিন্তু তার পরেও অসংখ্য মানুষ ক্রমাগতভাবে এসব কাজ করে যাচ্ছি। শুধু তাই নয়, আমাদের মাঝে এতটুকুও অপরাধবোধ জাগ্রত হয় না। এদিকে একালের প্রজন্মের মাঝে কোরান পড়তে না পারাটার হার প্রায় শতভাগ, যখন ওরা বলে যে ওরা কোরান পড়তে পারে না তখন ভাব দেখে মনে হয় যেন বিশ্ব জয় করা হয়ে গেছে। নতুন প্রজন্মের এই অধঃপতনের দায় ভার কারা নিবে?
কিভাবে আমাদের সময় কাটে? দেরি করে ঘুমুতে যাওয়া আর বেলা করে ঘুম থেকে ওঠা এখন হালের ফ্যাশন। তার পর কানে হেড ফোন লাগিয়ে শিক্ষাঙ্গনে ছুটে চলা, আড্ডা, গল্প, ক্লাস, ঘুরাঘুরি আর রোমাঞ্চকর যত আনুষ্ঠানিকতা সেরে ঘরে ফিরে মুভি বা টিভি দেখা, ইন্টারনেটের মোহে ডুবে যাওয়া, এফএম রেডিওতে কান লাগিয়ে বসে থাকা, ফোনে অনর্গল কথা বলা, এভাবে ঠিক শেষ রাতে ঘুমুতে যাওয়া। যার অবধারিত ফল হল ফজরের নামাজটা ছুটে যাওয়া। এভাবে দিনের চব্বিশটা ঘন্টার সিংহভাগ যখন বিনোদনের পেছনেই ব্যয় হল তখন স্রষ্টার জন্য কতটুকু সময় আমরা বাঁচাতে পেরে থাকি? এভাবে সারাটা জীবন যখন আমরা আল্লাহকে এড়িয়ে চলা হল। তারপর হঠাৎ বিপদে পড়ে শুরু হল “আল্লাহ বাঁচাও”। তার পর ক্রমাগত অভিযোগ “আল্লাহতো দোয়া কবুল করেন না!” অথচ আল্লাহ নিজেই শিখিয়ে দিয়েছেন “ধৈর্য্য ও নামায সহকারে সাহায্য নাও, নিঃসন্দেহে নামায বড়ই কঠিন কাজ ”। [৩] প্রশ্ন হল যে কোরান কে এড়িয়ে সঙ্গীতে ব্যাতিব্যাস্ত হয় সে কি করে জানবে যে আল্লাহর কাছ থেকে সাহায্য নেবার পদ্ধতিটা কি?
আসলে আমরা কোথায় আছি, কি করছি? কিসের পেছনে ছুটছি? আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য কিসে নিবদ্ধ হয়ে আছে? মোটকথা আমরা কার আকাশে উড়ছি? আমরা কি সরল পথের পানে ছুটছি? আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য কি শুধুই ক্যারিয়ার নাকি [ক্যারিয়ার+আখিরাত] ? প্রশ্নগুলোর সোজা-সাপ্টা উত্তর নিয়ে বিস্তর ভাবনার দরকার আছে। তাছাড়া যদি ছন্নছাড়া এজীবনে আমরা শুধু পাপের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়েই থাকি, পংকিলতার আকাশে উড়োউড়ি করে যদি আমাদের জীবন প্রদীপ পড়ন্ত বিকেলে এসে যায় তাহলে আল্লাহ প্রদত্ত সুনির্মল আকাশে তথা আল্লাহর পথে ফিরতে যে বড্ড দেরী হয়ে যাবে।
তখন না হবে ফেরা আর না হবে আফসোসের সময়। কারণ, সাবধান বাণীতো দেয়াই আছে -- “যে ব্যক্তিই পাপ করবে এবং পাপের জালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়বে সে-ই জাহান্নামী হবে এবং জাহান্নামের আগুনে পুড়তে থাকবে চিরকাল"। [৪]
রেফারেন্সঃ
[১] সুরা বাকারাহ, আয়াত ১০
[২] সূরা বাকারাহ, আয়াত ১৬
[৩] সূরা বাকারাহ, আয়াত ৪৫
[৪] সূরা বাকারাহ, আয়াত ৮১
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ স্বপ্নচারী
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা নভেম্বর, ২০১২ রাত ৮:৩৪