somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আহা...জীবন!

১০ ই নভেম্বর, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


৭ই নভেম্বর, ২০১২। ফজরের নামাজ শেষে ঘোষণা এলো, এক ছাত্রভাই ইন্তিকাল করেছেন। দশটা নাগাদ তার নামাজে জানাজা হবে। ঘোষণাটা শুনেই মনে হল অনাকাংখিতভাবে হুট করেই একজন চলে গেল। এরপর থেকেই মনের এক কোনায় সুক্ষ্ম একটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। যেহেতু বিকেল গড়ালেই “ইন্টারন্যাশনাল ড্রেড” এর মিড-টার্ম পরিক্ষা, তাই সেই চিন্তাটাকে আর সামনে আসতে দিলামনা। মনের এক কোণায় চিন্তাটাকে কোনঠাসা করে দিয়ে একপ্রকার তাড়াহুড়ো করেই সিলেবাস শেষ করার যুদ্ধে নামতে হল। বেশ কয়েকটি চ্যাপ্টার, বিদঘুটে সব মডেল আর থিওরী, তার চেয়ে বিদঘুটে সব গ্রাফগুলো। অর্থনীতির এই একটা সমস্যা, না বুঝে একটা লাইনও সামনে বাড়াবার উপায় নেই, না মুখস্থ হবে, না ইনিয়ে বিনিয়ে লেখা যাবে। স্যারগুলোও একাট্টা টাইপের, “প্রশ্নে যা চেয়েছি তাই লিখো, ডোন্ট বিট এরাউন্ড দ্যা বুশ!!” সুতরাং মার্কেটিং এর খাঁজকাটা চাপাবাজী এখানে চলে না। তাই অগত্যা লাইন ধরে ধরে, গ্রাফ দেখে দেখে, বুঝেশুনে এক এক করে চ্যাপ্টারগুলো শেষ করতে হবে। আজীবন লাষ্টটাইমে বদনা হাতে এই দৌড়ঝাঁপের চরম খেসারত দিয়েও শিক্ষা হল না। আজও যথারীতি তাই হল।

পরীক্ষা শেষ হল রাত ন’টা নাগাদ, পরীক্ষার মাঝে অবশ্য মাগরিবের নামাজের ব্রেক পড়লো। জীবনে এই প্রথম দুই খন্ডে ভাগ করে পরীক্ষা দিলাম। একটা প্রশ্নপত্রকে দুইটা ভাগ করা হল, প্রথম অংশের পরীক্ষা শেষে এক্সাম পেপার জমাদিয়ে নামাজের বিরতি, বিরতির পর নতুন প্রশ্নের উপর নতুন খাতায় বাকী অংশের পরীক্ষা। আসলেই অন্যরকম। পরীক্ষা শেষে সময় যত গড়াতে লাগলো সারাদিন কোণঠাসা করে রাখা সেই সূক্ষ্ম চিন্তাটা ক্রমেই স্থূল হয়ে উঠতে লাগলো। চিন্তাটা অমুলক নয় বলেই হয়তো তাতে আবিষ্ট হতে সময় নিল না।

যোহরের নামাজ শেষে মুসাল্লার জানালা দিয়ে বাইরে চোখ গেলো, জানালা থেকে একটু কাছেই কামরাঙ্গা গাছে আটকে গেলো চোখ। ভরদুপুরের ঊষ্ণ বাতাসের তালে নেচে চলছিলো সবুজ পাতারা। চট করে মনে হল, আজ যে ছেলেটা চীরতরে চলে গেলো তার জন্য এই নশ্বর পৃথিবীর কোন কিছুই থেমে নেই। পাতারা তাদের স্বাভবিক প্রাকৃতিক মহিমায় দুলছে, বাতাসেরা বইছে মৃদুমন্দ তালে, এমনকি যেই সবুজ শ্যামল নয়াভিরাম ক্যাম্পাসের একটি কক্ষে ছেলেটির প্রাণবসান হল সেই ক্যম্পাসের রাস্তায়, অলিতে গলীতে ও বারান্দায় নিত্যদিনের মতো ছাত্র-ছাত্রীদের বিচরন মুহুর্তের জন্যও থেমে নেই। একজন সহপাঠীর প্রস্থানের কোন তিল পরিমান চিহ্ন নেই কোথাও। এটাকি আমাদের নুন্যতা, ক্ষুদ্রতা, নগন্যতারই পরিচায়ক?

এভাবেই ক্ষনে ক্ষনে সেই ক্ষুদ্র চিন্তাটা দিনভর মনের গহীন থেকে তার অবস্থানের কথা জানান দিচ্ছিলো, সেজন্যই হয়তো দুপুরে খাওয়ার সময় মজা করে বলেই ফেলেছিলাম। এমন যদি হতো, মানুষ মরবে না! কিন্তু যাদের এই পৃথিবীকে আর ভাললাগবেনা তাদের জন্য পৃথিবী ত্যাগের সুযোগ থাকবে। কিন্তু সেটাতো কিছুতেই হবার নয়। একসপ্তাহও পেরোয়নি, আমার দূরসম্পর্কের হলেও অনেকটা কাছেরই এক নানী মরে গেলেন। শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়েছিলো বৈকি, কিন্তু শত হলেও বুড়ো মানুষ, রোগে ভুগছিলেন, কঠিন বাস্তবতা হলেও সত্য যে তিনি যে চলে যাবেন সেটা ধারণাতেই ছিলো। কিন্তু আজ যে ছেলেটা চলে গেলো তার চলে যাওয়া নিয়ে কেউ কি ঘুণাক্ষরেও ভেবেছিলো? সত্যি বলতে কি, কেন যেন আজকের এই স্বল্প বয়সী ছেলেটি আমার অপরিচিত হলেও তার মৃত্যু নিয়েই বেশ মনভাবনা চলছে আমার মনে।

এমন স্বল্প বয়সের একজন, যার এখনও শিক্ষাজীবনই শেষ হয়নি, তাকে ঘিরে কতজনের কত স্বপ্ন থাকে। বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন কতজনের কত রকমের স্বপ্ন! তাঁকে ঘীরে তার জীবনের একান্ত স্বপ্নগুলোই বা বাদ যাবে কেন, এর পাশাপাশি কতরকম প্রতিশ্রুতি, দেনা-পাওনা, মান-অভিমান, ভালোবাসা আর পরিকল্পনা আরও কত কি! এতো এতো কিছু!! এর সবটুকু একমুহুর্তেই নিঃশেষ হয়ে গেল। এই ছেলেটি ক্লাসে না গেলে স্যার তাঁকে ওয়ার্নিং লেটার দিতেন, তার পরেও না এলে বার লেটার ধরিয়ে দিতেন, কোন কারনে কোন কাজে উপস্থিত না হলে এলাহী কান্ড ঘটে যেতো, এমন যেনো তাঁকে ছাড়া কতকিছু অসম্ভব, কিন্তু এখন তার বিনা নোটিসের হঠাৎ অন্তর্ধানে এগুলো কিছুই থেমে থাকবে না। দুনিয়ার এতটুকু ক্ষতি বা লাভ হবে না। এমনকি মা-বাবা ও নিকটাত্মীয়দের শোকটাও ক্ষনিকের জন্য এসে উবে যাবে একেবারেই। এর পর আবার সবকিছুই স্বাভাবিক, যেন এমন কেউ কোনদিন ছিলও না। আমিও যদি এভাবে চলে যাই কোন দিন, খুব ভিন্ন কিছু কি হবে? এখানেই আমি আমার ক্ষুদ্রত্বকে ছুঁতে পেরেছি। আমি শুধু ক্ষুদ্রই নই, নগন্য ও।

এই যদি হবে আমাদের জীবন, যার থাকা না থাকায় আল্টিমেটলি কিছুই যায় আসে না, তাহলে এই প্রশ্নটি কি একেবারেই অমুলক যে তাহলে কেন আমাদের এতো আয়োজন করে ধরনীর বুকে আসা? এবং কেনই বা এভাবে নির্বিকার ভাবে হঠৎ চলে যাওয়া? উদ্দেশ্যহীনতার কোন অন্ত থাকে না, কিন্তু আমাদেরতো অন্ত আছে, তাহলে আমাদের জীবনের উদ্দেশ্যটা কি? এত কিছু কেনইবা শুধু শুধু হবে? তাছাড়া জীবনের উপসংহারের যদি কোন আগাম বার্তা না থাকে, তাহলে আর কতটুকুইবা বাকী আছে আমাদের?

আমি জানিনা, ঠিক কবে চলে যেতে হবে, জানিনা কতটুকু সময় বাকী আছে, তবে এটুকু জানি যে আমার এভাবে এতো আয়োজন করে আসা, এতো এতো মহাসমারোহে জীবনযাপন করা এমনি এমনি হতে পারে না। এত এলাহি কারবারের সমাপ্তি শুধুমাত্র শ্বাস-প্রশ্বাসের ইতির কারণে মুহুর্তের মধ্যেই অর্থহীন হতে পারে না। জীবিত “আমি”র এতো গুরুত্ব মৃত্যুর কারণে হঠাৎই কেন এভাবে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ব তার পেছনে আমি যুক্তির দেখা পাই না। মুদ্রার এপিঠ থাকলে ওপিঠ থাকতেই হবে। মুদ্রার ওপিঠ দেখা না হলে এর অস্তিত্ব প্রশ্নের সম্মুখীন না হয়ে বরং ব্যাক্তির দার্শনিক ব্যর্থতাই মুখ্য হওয়া উচিৎ। তাই আমি ওপারের জীবনের সুখকামনায় একত্ববাদের প্রতি আস্থা রাখি। আর সেই অদ্বিতীয়ের সতর্কবানী তে বার বার আঁতকে উঠি “হে ঈমানদারগণ ! তোমরা যথাযথভাবে আল্লাহকে ভয় করো৷ মুসলিম থাকা অবস্থায় ছাড়া যেন তোমাদের মৃত্যু না হয়”। [১] বিশ্বাসের পরেই যে আত্মসমর্পনের কথা বলা হয়েছে তা কি আমি করতে পেরেছি? আমি কি সমর্পিত হতে পেরেছি সেই সত্ত্বার তরে? আমি বুঝতে পারি না। তবে সেই সত্বার ডাকে কতটুকু সাড়া আমি দিয়েছি তার মাঝেই হয়তো সমর্পিত হওয়ার নিগূঢ় ব্যাপারটা নিহিত আছে।

যেই ওপারের জীবনে আমাদের যেতেই হবে সেই জীবন সম্পর্কে মহানের এই বিবরণ আমাকে ভীত করে তোলে “কিন্তু সেদিন কি অবস্থা হবে, যেদিন আমি তাদের একত্র করবো, যেদিনটির আসা একেবারেই অবধারিত, সেদিন প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার উপার্জনের পুরোপুরি প্রতিদান দেয়া হবে এবং কারো ওপর জুলুম করা হবে না" [২]। আমি কি উপার্জন করেছি? কি হতে যাচ্ছে আমার ফলাফল? আত্মসমালোচনায় ব্রত হলে আমি যে আর ঠাঁই পাই না। তার পরেও কিভাবে মুয়াজ্জিনের ডাক শুনেও ল্যাপটপের স্ক্রীনে মুভির দিকে চোখ আটকে থাকে! কিভাবে কুরানের আলোচনা ছেড়ে মেতে থাকি গানে!! আমি ক্ষমার দরিয়া চাই হে আল্লাহ! হে আমাদের রব!! অবশ্যি তুমি সমগ্র মানব জাতিকে একদিন একত্রে সমবেত করবে, যে দিনটির আগমনের ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই৷ তুমি কখনো ওয়াদা থেকে বিচ্যুত হও না।’’[৩]

সবশেষে একটা ভয়ংকর বাতিকের কথা কিছুতেই ভোলা যাচ্ছে না, ঐযে লাষ্ট টাইমে এসে হুলুস্থুল করে কোনমতে প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষার হলে যাওয়ার যে অভ্যেসটা, সেটা কি পরকালের জন্য প্রস্তুতির ক্ষেত্রেও বলবৎ রইবে? অর্থাৎ আল্লাহর ডাকে সাড়া দিতে দিতে কি শেষ পর্যন্ত কি জীবনের অন্তিম মুহুর্তে এসে ঠেকবো? টিপিক্যাল বাঙ্গালী মুসলিমের মতো বুড়ো বয়সে এসে ধার্মিক বনে যাওয়া?

♥ রাব্বানা আতিনা ফিদ্ দুনিয়া হাসানা, ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানা, ওয়াকিন’আজাবান্ নার। ♥

রেফারেন্সঃ
[১] আলে ইমরান, আয়াত ১০২
[২] আলে ইমরান, আয়াত ২৫
[৩] আলে ইমরান, আয়াত ৯


বানান শংশোধনির জন্য কৃতজ্ঞতাঃ স্বপ্নচারী
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অণু থ্রিলারঃ পরিচয়

লিখেছেন আমি তুমি আমরা, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৭


ছবিঃ Bing AI এর সাহায্যে প্রস্তুতকৃত

১৯৪৬ কিংবা ১৯৪৭ সাল।
দাবানলের মত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে।
যে যেভাবে পারছে, নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। একটাই লক্ষ্য সবার-যদি কোনভাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পেইন্টেড লেডিস অফ সান ফ্রান্সিসকো - ছবি ব্লগ

লিখেছেন শোভন শামস, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:১৯

"পেইন্টেড লেডিস অফ সান ফ্রান্সিসকো", কিংবা "পোস্টকার্ড রো" বা "সেভেন সিস্টারস" নামে পরিচিত, বাড়িগুলো। এটা সান ফ্রান্সিসকোর আলামো স্কোয়ার, স্টেইনার স্ট্রিটে অবস্থিত রঙিন ভিক্টোরিয়ান বাড়ির একটি সারি। বহু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিরোনামহীন দুটি গল্প

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৫

গল্প ১।
এখন আর দুপুরে দামী হোটেলে খাই না, দাম এবং খাদ্যমানের জন্য। মোটামুটি এক/দেড়শ টাকা প্লাস বয়দের কিছু টিপস (এটা আমার জন্য ফিক্সড হয়েছে ১০টাকা, ঈদ চাদে বেশি হয়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

এশিয়ান র‍্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান !!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:২০

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।তালিকায় ভারতের ৪০, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজত্ব আল্লাহ দিলে রাষ্ট্রে দ্বীন কায়েম আমাদেরকে করতে হবে কেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:০৬



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) কেড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×