সাংবাদিক বা সংবাদদাতা englesh: Journalist/reporter বিভিন্ন স্থান, ক্ষেত্র, বিষয় ইত্যাদিকে ঘিরে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংবাদ সংগ্রহসহ বিভিন্ন ধরণের তথ্য সংগ্রহপূর্বক সংবাদ কিংবা প্রতিবেদন রচনা করে সংবাদমাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রেরণ করে থাকেন। পেশাজীবি হিসেবে একজন সাংবাদিকের কাজই হচ্ছে সাংবাদিকতায় সহায়তা করা। বিভিন্ন বয়সের পুরুষ কিংবা নারী সাংবাদিকতাকে অন্যতম মর্যাদাসম্পন্ন পেশারূপে বেছে নিচ্ছেন।
তিনি প্রতিবেদক হিসেবেও চিহ্নিত হয়ে থাকেন। যথাযথ গবেষণালব্ধ তথ্য, লেখনী এবং প্রতিবেদন রচনা করে তিনি গণমাধ্যমে উপস্থাপন করেন। মুদ্রিত মাধ্যমরূপে সংবাদপত্র, সাময়িকী; ইলেকট্রনিক মাধ্যম হিসেবে টেলিভিশন, রেডিও, প্রামাণ্যচিত্র এবং ডিজিটাল মাধ্যমরূপে অনলাইন সাংবাদিকতায় নিজস্ব সংবাদ প্রচার কিংবা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গীতে নিরপেক্ষভাবে প্রতিবেদন উপস্থাপন করে থাকেন। একজন প্রতিবেদক তৃণমূল পর্যায় থেকে তথ্যের উৎসমূল অনুসন্ধান করেন, প্রয়োজনে সাক্ষাৎকার পর্ব গ্রহণ করেন, গবেষণায় সংশ্লিষ্ট থাকেন এবং অবশেষে প্রতিবেদন প্রণয়নে অগ্রসর হন। তথ্যের একীকরণ সাংবাদিকের কাজেরই অংশ, যা কখনো কখনো রিপোর্টিং বা প্রতিবেদন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। বৈপরীত্য চিত্র হিসেবে চাকুরীরত অবস্থায় প্রবন্ধ রচনা এরই অংশবিশেষ।
সামাজিক মর্যাদা
ইউনিভার্সিটি অব জর্জিয়ার হেনরি ডব্লিউ কলেজ অব জার্নালিজম এন্ড ম্যাস কমিউনিকেশন ১৯৯৭ সাল থেকে সাংবাদিকতা এবং গণযোগাযোগ বিষয়ের স্নাতকধারীদের উপর বার্ষিক জরীপ কার্য পরিচালনা করে আসছে। ২০০৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে (পুয়ের্তোরিকোসহ) এ বিষয়ের স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা পূর্ণকালীন চাকুরী হিসেবে ত্রিশ হাজার মার্কিন ডলারের বেতনে সংবাদপত্রশিল্পে প্রবেশ করছে; যা ছিল ২০০৬, ২০০৭ এবং ২০০৮ সালের অনুরূপ।[২]
প্রকারভেদ
সংবাদকর্মী বা সাংবাদিকগণকে কার্যক্ষেত্রে সংবাদপত্র প্রতিনিধি, টেলিভিশন সংবাদদাতা বা বেতার সাংবাদিক ইত্যাদি বিভিন্ন পর্যায়ে বিভাজন ঘটানো হয়েছে। এছাড়াও, অবস্থানের ভিত্তিতেও নামকরণে বিভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। তন্মধ্যে, স্টাফ রিপোর্টার, প্রতিনিধি, সংবাদদাতা ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়। তারা প্রত্যেকেই স্ব-স্ব মাধ্যমের জন্য সত্য ও বস্তুনিষ্ঠতার সাথে ঘটনাবহুল এবং গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ প্রেরণ করেন। উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
সংবাদ বলতে মুদ্রণজগৎ, সম্প্রচার কেন্দ্র, ইন্টারনেট অথবা তৃতীয় পক্ষের মুখপাত্র কিংবা গণমাধ্যমে উপস্থাপিত বর্তমান ঘটনাপ্রবাহের একগুচ্ছ নির্বাচিত তথ্যের সমষ্টি যা যোগাযোগের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে।[১]
একটি সূত্র দাবী করছে যে, চতুর্দশ শতাব্দীতে নিউ শব্দের বহুবচন হিসেবে নিউজ বা সংবাদ শব্দটি বিশেষভাবে ব্যবহার করা হতো। মধ্যযুগীয় ইংরেজী হিসেবে নিউজ শব্দটির সমার্থক ছিল নিউইজ (newes), ফরাসী শব্দ নোভেলেজ (nouvelles) এবং জার্মান শব্দ নিউয়েজ (neues)।
লোকমুখে 'নিউজ' শব্দটিকে বিশ্লেষণ করা হয় - এন (নর্থ), ই (ঈষ্ট), ডব্লিউ (ওয়েস্ট) এবং এস (সাউথ)।[২]
ইতিহাস
সপ্তদশ শতকের শুরুর দিকে সংবাদপত্রের সূচনা ঘটে। এর পূর্বে সংক্ষিপ্ত সরকারী ঘোষণা বা ইস্তেহার এবং রাজার আজ্ঞা প্রধান প্রধান নগরগুলোতে প্রকাশিত হতো।[৩] প্রথম লিখিতভাবে সংবাদ বা খবরের ব্যবহার মিশরে সু-সংগঠিতভাবে প্রবর্তন হয়েছিল। খ্রীষ্ট-পূর্ব ২৪০০ বছর পূর্বে ফারাও শাসন আমলে বর্তমানকালের জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যম কুরিয়ার সার্ভিসের আদলে রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রসারনের উদ্দেশ্যে ডিক্রী বা আদেশনামা প্রচারের ব্যবস্থা করা হতো।[৪]
প্রাচীন রোমের এক্টা ডিওরনা বা সরকারের তরফে জুলিয়াস সিজার কর্তৃক ঘোষিত ইস্তেহার জনগণের উদ্দেশ্যে তৈরী করতেন। এগুলো ধাতব পদার্থ অথবা পাথরের সাহায্যে জনগণের সম্মুখে প্রচার করা হতো।
চীনের সরকারশাসিত প্রথমদিককার সময়ে সংবাদ শীট আকৃতিতে তৈরী করা হতো। এটি টিপাও নামে পরিচিত ছিল। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দীতে হ্যান রাজবংশের শেষদিককার সময়কালে আদালতের জন্য প্রচারের ব্যবস্থা করা হতো। ৭১৩ থেকে ৭৩৪ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে ত্যাং রাজবংশের আমলে কাইয়ুন জা বাও (আদালতের ইস্তেহার) নামে সরকারীভাবে সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছিল। এটি সিল্কের উপর হস্তলিখিত ছিল। সরকারী কর্মীরাই এটি প্রচারের উদ্দেশ্যে পড়ার জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত ছিল। ১৫৮২ সালে মিং রাজত্বকালের শেষদিকে ব্যক্তিগতভাবে সংবাদ প্রকাশের প্রথম তথ্যসূত্র প্রয়োগের উল্লেখ করা হয়।[৫]
আধুনিক ইউরোপের শুরুর দিকে আন্তঃসীমান্ত এলাকায় পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধিকল্পে তথ্য বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে হস্তলিখিত সংবাদের কাগজ ব্যবহার করা হয়েছিল। ১৫৫৬ সালে ভেনিস প্রজাতন্ত্রীয় সরকার প্রথমবারের মতো মাসিক নটিজি স্ক্রিট প্রকাশ করে। এর মূল্য ছিল এক গেজেটা।[৬]
সংবাদপত্র
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঐতিহ্যগতভাবেই অধিকাংশ বৃহৎ শহরে সকাল এবং বিকালে সংবাদপত্র প্রকাশিত হতো। প্রচারমাধ্যমের সম্প্রসারণ এবং সংবাদের ক্ষেত্র অসম্ভবরকমভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় অধিকাংশ বিকালের সংবাদপত্রের প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশে কেবলমাত্র সকালেই সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়।
সকালে সংবাদপত্র প্রকাশের ফলে কম ক্ষতি হয়। মূলতঃ সংবাদের গুণগত মান ও দৃষ্টিভঙ্গীই এতে সম্পৃক্ত। সাধারণতঃ সংবাদ ৫টি ডব্লিউ'র উপর ভিত্তি করে তৈরী হয়। হু, হুয়াট, হোয়েন, হোয়ার, হুয়াই ছাড়াও আরও একটি ডব্লিউ (হাউ) রয়েছে। এগুলোকে ভিত্তিমূল হিসেবে ধরে যে-কোন বিষয় বা ঘটনা নিয়ে সংবাদ তৈরী করা সম্ভবপর। এশব্দগুলোর মাধ্যমে সংবাদ অনুসন্ধান কার্যক্রমের পর আর কোন প্রশ্ন বাকী থাকে না। প্রথম পৃষ্ঠায় সাধারণতঃ গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ উপস্থাপন ও তথ্য পরিবেশনকে সবিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। এরফলে ব্যস্ত পাঠকেরা স্বল্প সময়ের মধ্যেই তাদের অভিষ্ট সংবাদের বিষয়বস্তু সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়ে থাকেন।
ক্যাবল নিউজ চ্যানেল হিসেবে বিবিসি নিউজ, ফক্স নিউজ, এমএসএনবিসি, সিএনএন সংবাদের গুরুত্ব অনুসারে প্রচারের ব্যবস্থা করে।
১৬০৫ সালে প্রকাশিত রিলেশন অলার ফুর্নেমেন আন্ড গেডেনঙ্কুরডিগেন হিস্টোরিয়েনকে বিশ্বের ১ম সংবাদপত্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।[৭]
সংবাদ সংস্থা
মূল নিবন্ধ: সংবাদ সংস্থা এবং এজেন্সী ফ্রান্স-প্রেস
পৃথিবীর প্রাচীনতম সংবাদ সংস্থা হিসেবে এজেন্সী ফ্রান্স-প্রেস বা এএফপি'র নাম সর্বজনস্বীকৃত।[৮] এটি ১৮৩৫ সালে ফরাসী অনুবাদক এবং বিজ্ঞাপনী সংস্থার এজেন্ট চার্লস-লুইস হাভাস কর্তৃক এজেন্সী হাভাস নামে প্রতিষ্ঠিত হয়।
মাধ্যম
বর্তমানে সংবাদপত্রে মুদ্রণের জন্য নিউজরুম বা বার্তাকক্ষে ফোন ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি একজন প্রতিবেদক টাইপ করে তার প্রতিবেদন নিউজরুম বা বার্তাকক্ষে প্রেরণের ব্যবস্থা করেন। সাধারণত তারের মাধ্যমে কিংবা হস্তলিখিত সংবাদ নির্দিষ্ট সংস্করণে প্রকাশের জন্য কিংবা অন্যান্য সংবাদের সাথে প্রকাশের জন্য পাঠানো হয়।
সর্বশেষ সংবাদ
আজকাল সর্বশেষ সংবাদ বা ব্রেকিং নিউজ নামে সংবাদের নতুন একটি অংশবিশেষ কিংবা পরিভাষার জন্ম হয়েছে। এটি বাণিজ্যিকভাবে প্রচারণার জন্য ইউনাইটেড স্টেটস্ ক্যাবল নিউজ সার্ভিসে দিন-রাত ২৪ ঘন্টায় প্রকাশিত হয়। স্যাটেলাইট প্রযুক্তির সাহায্যে এ সেবায় বর্তমান ঘটনাপ্রবাহ গ্রাহকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া হয়। এছাড়াও বিখ্যাত সংবাদ সংস্থা বিবিসি সর্বশেষ সংবাদ ই-মেইলের সাহায্যে গ্রাহককে প্রেরণ করে থাকে।
পৃথিবীর বিভিন্ন শহর বা দেশে যে ঘটনাগুলো প্রতিটি মুহূর্তে ঘটছে তা প্রাপ্তিসাপেক্ষে দ্রুত প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। এতে রেডিও বা বেতার, টেলিভিশন, মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেট প্রযুক্তির সহায়তা নেয়া হয়।
সংবাদপত্র জাতির দর্পন। আর সাংবাদিকেরা জাতির বিবেক। সে হিসেবে একটি অন্যের পরিপূরক। সংবাদপত্র ছাড়া যেমনি সাংবাদিক কল্পনা করা যায় না, তেমনি সাংবাদিক ছাড়া সংবাদপত্রের কল্পনা করা যায় না। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ও সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখা বা এদেশের উন্নয়নের জন্য সংবাদপত্রের ভূমিক অপরিসীম।
সমাজ বিনির্মাণে একজন সাংবাদিক বা সংবাদপত্র তৃতীয় নয়ন হিসেবে কাজ করে। তাই সাংবাদিকতা পেশাকে অনেকেই খুব সম্মানের চোখে দেখেন। জাতির ক্রান্তিলগ্নে জাতিকে প্রান্তিক করে তোলতে সাংবাদিকরা বা সংবাদপত্র অনন্য ভূমিকা পালন করে। সাংবাদিকদের কলমের লিখনিতে ফুটে ওঠে সমাজের পুরো চিত্র। সংবাদপত্রের মাধ্যমে এক নজরে পুরো সমাজের চিত্র দেখা মিলে। রাতদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে থাকেন সাংবাদিকরা। কিন্ত যাদের নিয়ে আমাদের এত বলাবলি ও গর্ব তাদের জীবন, জীবিকা ও সুখ- দুঃখ নিয়ে কি কেউ এক বার ভেবে দেখেছি?
সংবাদপত্রকে আবার বলা হয় ফোর্থ স্টেইট। তাই এ মাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। যুগে যুগে বিভিন্ন দেশে এক নায়ক তন্ত্রের কবলে পড়ে সংবাদপত্র তার স্বাধীনতা হারিয়েছে। রাষ্ট্র ও সরকার বাহিনীর সদস্যদের হাতে লাঞ্চিত হয়েছে সংবাদিকরা। আমাদের দেশেও স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ের সরকারও কিন্তু দেশের প্রায় সবকটি পত্রিকা বন্ধ করে দিয়ে তাদের সমর্থনপুষ্ট ৪ টি পত্রিকা রেখেছিল। তথাপি সংবাদপত্রের যাত্রা থেমে যায়নি। বরণ নন্দিত আসরে সংবাদ পত্র দেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে। সংবাদপত্রের ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ কিন্তু আমাদের দেশে বিরল নয়।
যুগের পরিবর্তনের কারণে আজ অনেকাংশে এ পেশার পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে এ পেশার সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে অসংখ্য সংবাদকর্মী। আধুনিক বিশ্বে রেডিও, স্যাটেলাইট টিভি ও অনলাইন পত্রিকা থাকা সত্ত্বেও সংবাদপত্রের অনেক চাহিদা। এর কারণ হচ্ছে হাত বাড়ালেই সংবাদপত্র অতি সহজে পাওয়া যায়। সংবাদপত্রের মধ্যে সংবাদের ব্যাপকতা, বিশ্লেষণধর্মী সংবাদ এবং নানা মত ও পথের সমাহার। তাই সংবাদ প্রেমি কানুষ সংবাদ পত্রকে সকালের নাস্তার মত মনে করেন।
সংবাদ পত্রের রয়েছে এক বিশাল লক্ষ ও উদ্দেশ্য। কোন ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীর মহৎ উদ্দেশ্য সফল করার জন্য সংবাদপত্রের জন্ম হয়নি। বরণ কোন মহৎ উদ্দেশ্য থেকেই সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার জন্ম। আর কোন সংবাদপত্র যদি এর বিপরীত উদ্দেশ্য হাছিল করতে চেষ্টা করে তাহলে এর পথচলা ব্যাহত হবে। তাই এর পথচলা যেমন কঠিন তেমন দূর্গম।
পৃথিবীর যে কোন মানুষের জানার আগ্রহ চিরন্তন। দৈনন্দিন ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রবাহ ও তার খবর তুলে ধরে সংবাদপত্র মানুষের এ আগ্রহের নিবৃত্তি ঘটনায়। সমাজ বা দেশের পুরো চিত্র জাতীর সামনে তুলে ধরে। কিন্তু এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রতিটি সংবাদকর্মীকে কী অক্লান্ত পরিশ্রম ও ত্যাগ শিকার করতে হয় তা আমাদের সমাজের অনেকেরই অজানা।
প্রথম অবস্থায় যদিও নিতান্ত শখের বশে অনেকে এ পেশায় প্রবেশ করে কিন্তু ক্রমে ক্রমে একজন সাংবাদিককে বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশের মোকাবেলা করতে হয় তীক্ষ্ম বুদ্ধি, প্রখর মেধা আর সীমাহীন সাহসিকতার সঙ্গে।
যে কারণে সমাজের চোর, ডাকাত, মাস্তান, টাউট, বাটপার, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, খুনী, ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবারি, দখলদার ও অবৈধ ব্যবসায়ীরা সাংবাদিক সমাজকে ভালো চোখে দেখতে পারে না। তারা প্রতিনিয়ত সাংবাদিক সমাজের পিছনে লেগেই থাকে। এমনকি এসব কাজের সাথে যারা জড়িয়ে যায় তারাও সাংবাদিকদেরকে শত্রু ভাবে। তাই সাংবাদিককে অনেক ক্ষেত্রে নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়। আতঙ্কে থাকতে হয় সব সময়। এসব প্রতিকূলতা মোকাবেলা করেই একজন সাংবাদিক অক্লান্তভাবে তার দায়িত্ব পালন করে যায়।
অনেকেই এ পেশায় আসনে অনেক আশা আর আকাঙ্খা নিয়ে। কিন্তু কিছুদিন পেশাটি পার করার পর সকল আশা আর আকাঙ্খা ভেয়ে যায় এ পেশার লোকজনের। সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার সাংবাদিকরা অনেক প্রতিবন্ধকতার মাঝে নিরলসভাবে দায়িত্ব পালন করলেও ব্যক্তিজীবন কাটে সীমাহীন অবহেলা আর নিষ্পেষণে। নিত্যদিনের অমানুষিক পরিশ্রমের মাধ্যমে যে কলম সৈনিকরা মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তোলেন, তাদের দুর্দশা দেখার জন্য কেউ এগিয়ে আসেন না। বরণ একটু বিপদ আপদ হলেই সকলে তাদেরকে আরো কঠিন বিপদের মধ্যে ঠেলে দেন। কঠিন পরিশ্রম ও কর্মের প্রতি নিষ্ঠাবান সৎ সাংবাদিকদের আর্থিক বিষয়টি কেউ খেয়াল করেন না। আবার অনেক সময় জাতি শত্রুতা আক্রোশে পড়ের সৎ সাংবাদিকরা। বলাই বাহুল্য আমাদের সমাজে বর্তমানে হলুদ সাংবাদিক কিংবা ভুয়া সাংবাদিকদের দাপটই অনেক বেশি। তাদের যন্ত্রনায় বেঁছে থাকাটাও অনেক সময় মহা দয়া হয়ে পড়ে। তাই সাংবাদিকতা পেশাটির কখনো পরিবর্তন হয় না। যখন কারো চরিত্র পরিবর্তন হয় তখন সে আর সাংবাদিক থাকে না। দেশের অস্তিত্ব রক্ষায় সংবাদপত্রের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। কিন্তু একুশ শতকের শুরুতেও দেখা যায় সাংবাদিকদের চরম নিরাপত্তাহীনতার মাঝে দায়িত্ব পালন আর বসবাস করতে হচ্ছে।
স্বাধীনতার পর থেকে অনেক সরকার বাংলাদেশ নামক এই দেশটাকে শাসন করেছে বিভিন্ন শাসক গোষ্ঠি। শুধু শাসনই করেছে দেশের সাধারণ জনগণের নিরাপত্তার ব্যাপারটা ভাবেনি ভালো করে। তাই অনেক রাষ্ট্রপ্রধান ও রাষ্ট্রের নায়করাও বলে থাকেন কারো বেড় রুমের নিরাপত্তার দায়িত্ব তাদের নয়। জাতির বিবেক সাংবাদিকরা নিরাপত্তার অভাবে স্বাধীন ভাবে সাংবাদিকতা করতে ও সত্য ঘটনা লিখতে পারছেন না। সত্যকে সত্য বলা যাবে না। সন্ত্রাস করা যাবে, কিন্তু তা লিখা যাবে না।
বর্তমান সময়ে অনেক স্যাটেলাইট চ্যানেল ও প্রিন্ট মিডিয়ার সৃষ্টি হয়ে মফস্বল সাংবাদিকেরা আজ রাজনৈতিক আক্রোশের শিকার হচ্ছেন। আর এজন্য মিডিয়াগুলোর দলীয় করণ অন্যতম। মফস্বল সাংবাদিকেরা যে এলাকায় চাকরী করেন সে এলাকায় ঐ চ্যানেল কিংবা পত্রিকার সমর্থন পুষ্ট ব্যক্তিদের তাবেদারি না করলে অনেক সময় হারাতে হয় চাকরি। শিকার হতে হয় হিংশ্র আক্রমণের।
সত্য লিখতে গিয়ে আজ পর্যন্ত অনেক সাংবাদিককে নির্মমভাবে দুষ্কৃতিকারীদের হাতে জীবন দিতে হয়েছে। একজন নির্ভীক সাংবাদিক কখনো সত্যকে পাশ কাটিয়ে মিথ্যার আবরণ দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করতে পারে না। একজন সাংবাদিক যখন একটি সত্য সংবাদ লেখেন তখন ভাবেন না সে দেশের প্রচলিত আইন তার পেছনে আছে কিনা। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তার সাথে থাক বা না থাক ঠিকই নির্ভীক সাংবাদিকরা লিখে যান। আর লিখে যাওয়াটাই তাদের একমাত্র ধর্ম। তাই অনেক সময় সাংবাদিকরা নির্যাতিত হচ্ছে, খুন হচ্ছে, ঘুম হচ্ছেন, হামলার ঘটনাও ঘটছে প্রতিনিয়ত। এমনকি কারাবরণও করতে হচ্ছে অনেককে।
সবচেয়ে করুণ অবস্থায় দিনাতিপাত করতে হয় আমাদের মফস্বল সাংবাদিকদের। তাদের জীবনযাত্রা কতটা অসহায় আর দৈন্যে ভরা তা শুধু ভুক্তভোগীরাই উপলব্ধি করতে পারেন। ঢাকা কিংবা মফস্বলের বাইরে যারা থাকেন তারা এর কোন কিছুই অনুভব করতে পারেন না। এ পেশার মানুষদের কাছে সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্খার শেষ নেই। সাংবাদিকরাও চেষ্টা করেন তাদের সাধ্য আনুযায়ী লেখনীর মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন অনিয়ম-অসঙ্গতি ও দুঃখী মানুষের জীবন চিত্র তুলে ধরে মানুষের সে আশা আকাঙ্খা পূরণ করতে। কিন্তু কে পূরণ করবে সাংবাদিকদের আশা আর আকাঙ্খা? এ বিষয়টি আমরা কেউ ভাবি না। ভাবার চেষ্টাও করিনা একবার।
সাংবাদিকরা পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগাতে চান সমাজে। এজন্য তাদের প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয় প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জীবননাশের হুমকিও আসে। আবার অনেক সময় অকাতরে জীবনকেও দিয়ে দিতে হয় সাংবাদিকদেরকে। ঢাকার বাইরে যারা সাংবাদিকতা করেন তাদের অধিকাংশেরই অবস্থাটা এ রকম যেন ‘ঘরের খেয়ে বনের মেষ তাড়ানো’। জেলা ও থানা পর্যায়ের সাংবাদিকরা প্রথমদিকে শখের বশে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। যারা ভালোবেসে ফেলেন তারা নেশায় আসক্ত হয়ে যান। নেশার মোহে জীবনের অন্য পেশার বয়স ও সুযোগ থেকে দূরে সরে যান। সেখান থেকে আর ফিরে আসার পথ থাকে না। যখন সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেয়া হয় তখন একজন মফস্বল সাংবাদিক হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেন কতটা যন্ত্রণা রয়েছে এ পেশায়। এ পেশার লোকদের সমাজে কদর আছে, প্রশাসন সমীহ করে, ভয় করে পুলিশ। কিন্তু নিজ ঘরে গেলেই শুরু হয় বুকের ভেতর ব্যথা। কারণ ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়।
সমাজের আট-দশটি পরিবারের মতো একজন মফস্বল সাংবাদিকের সংসার চালাতে যে পয়সার প্রয়োজন তা তিনি পাচ্ছেন না। অনেক প্রতিষ্ঠানের সমস্যার সমাধান হয়েছে। তারা নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়াতেও কার্পণ্য করেননি। কিন্তু তাদের ব্যক্তিজীবন কতটা সমৃদ্ধ হয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাব দেয়ার যেন কেউ নেই। বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের অনেকেই সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নিচ্ছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা আছে অনেক। আছে আবার জীবনের ঝুঁকিও। মফস্বলে যেসব স্থানীয় ও আঞ্চলিক পত্রিকা বের হচ্ছে তাদের স্টাফদের যে বেতন দেয়া হয় তা খুবই সামান্য, উল্লেখ করার মতো নয়। ঢাকার শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি দৈনিক শুধু মফস্বল সাংবাদিকদের সম্মানী দিচ্ছে। তাও নগন্য। আবার নগণ্য এ সম্মানীটুকুনও উঠিয়ে আনতে শিকার হতে হয় অনেক হয়রানি। অনেক পত্রিকার বিল আনতে গিয়ে সাংবাদিকদের মাসের পর মাস ধর্না দিতে হচ্ছে।
পত্রিকার মালিকরাও কোনোদিন মফস্বল শহরের সাংবাদিকদের দুঃখ-কষ্ট বোঝার চেষ্টা করেননি। তারা শুধু পত্রিকার একটি আইডি কার্ড ধরে দিয়ে সাংবাদিকদেরকে পাঠিয়ে দেন মফস্বলে। মফস্বল সাংবাদিকদেরকে কোন বেতন কিংবা ভাতা না দেয়ার মানে এই নয় কি যে তারা অন্যের কাছ থেকে চাঁদাবাজি কিংবা ছেয়ে নিজের খোরাক জোগাড় করবে। ঠিক এই যদি হয় আমাদের মফস্বলের অনেক সাংবাদিকরা তা পারে না। চোখের লজ্জা, কিংবা নিজের ইমেজ বা ব্যক্তিত্ব রক্ষার কারণে নীরবে এ সমস্যা ভোগ করতে হয় তাদেরকে। আমাদের পত্রিকা মালিকেরা যারা পত্রিকাকে নিজেদের ব্যবসার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন, আয় করছেন কোটি কোট টাকা তারা কি একবারও মফস্বল সাংবাদিকদের কথা ভেবেছেন? এদের জন্য তাদের কি একটুও সহানুভূতি হয়না?
কিংবা মফস্বল শহরে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেয়াটা যে কতটা কষ্টদায়ক ও তিক্ততাপূর্ণ তা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কেউ বুঝবে না। কেননা এখানে কেউ বড় অন্যায় কিংবা দূর্নীতি করে থাকলেও মফস্বল সাংবাদিকরা তার খবর প্রকাশে অনেক প্রতিবন্ধকতার শিকার হন। যার বিরুদ্ধে লেখাটি প্রকাশ করবেন তার সাথে তো সব সময় দেখা হবে। কথা হবে। কিংবা আত্মীয়তার কারণেও অনেক সময় এসব বিষয় এড়িয়ে যেতে হয় মফস্বল সাংবাদিকদেরকে। রাজনৈতিক সংবাদ তো আরো ভয়াবহ ঝুকি। এসব কারণে অনেক সময় অনেক মফস্বল সাংবাদিক নির্যাতিত হন। নির্যাতনের সেব ঘটনায় বিচার পান না কখনো।
তবে হ্যাঁ, যারা সাংবাদিকতাকে সাইন বোর্ড হিসেবে নিচ্ছেন তারা ভালোই আছেন। কোনরূপ পত্রিকা একটি বের কারার অনুমতি নিয়ে মাঝে মধ্যে দু’একটি সংখ্যা বের করে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে বুঝ দিয়েই তারা বিভিন্ন কর্মকাণ্ড শুরু করেন। আবার অনেক পত্রিকার সম্পাদক ঢাকা থেকে রেজিস্ট্রেশন নাম্বার নিয়ে বিভিন্ন উপজেলায় সংবাদকর্মী নিয়োগ দেয়া হবে বলে অন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন চাপিয়ে দরখাস্ত আহ্বান করেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অনেক তরুণ ও বেকার যুবক আবেদন করেন সংবাদকর্মী হওয়ার জন্য। তখন তাদের অনেকের থেকে কিছু উৎকোচ নিয়ে একটি কার্ড ধরিয়ে দিয়ে পাঠিয়ে দেন ওদের নিজের এলাকায়। এর পর সে সব সাংবাদিকদের সাথে ঐ পত্রিকাটির আর দেখা মিলেনা। তারা এ কার্ডটি দেখিয়ে শুরু করেন বিভিন্ন অপকর্ম। যাকে বলা হয় হলুদ সাংবাদিকতা। এসব সম্পাদকরা কালো টাকাকে সাদা করা অথবা তার অন্য ব্যবসাকে সমৃদ্ধ করার জন্য এ পেশায় এসে পেশাটিকে কলুষিত করেছেন। এসব কার্ডধারী সাংবাদিকরা বর্তমানে অর্থের কাছে বিকিয়ে যাচ্ছেন অথবা ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ অর্থ পাচ্ছেন। এজন্য সমালোচনার পাত্র হচ্ছি সবাই। এ হলুদ সাংবাদিকতার জন্য মালিক পক্ষকেও দায়ী করা যায়। সাংবাদিকদের অবদানকে স্বীকার করতে হবে, তাদের অবস্থার পরিবর্তনে সরকারকে ভূমিকা রাখতে হবে। দিতে হবে তাদের ন্যায্য অধিকার। তবেই পরিবর্তন হবে আমাদের সমাজের। নয়তো জাতি হিসেবে আমাদের দৈন্যতাই ফুটে উঠবে।