somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শেকলে বাঁধা ময়না

২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ২:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ঘরে ঢুকেই আসিফ চমকে উঠল । ব্যালকনিতে ঝুলানো খাঁচায় ময়না পাখিটি নেই । খাঁচার দরজা খোলা। সে বুঝে উঠতে পারছেনা কি করে এমনটি হল। শায়লাও তাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দরজা খুলেই ভিতরে চলে গেছে।

সে এক দৃষ্টে খাঁচার খোলা দরজা দিয়ে তাকিয়ে আছে। অর্পার কত প্রিয় ছিল এই পাখি । রুপকথার গল্পে কথা বলা তোতা পাখির কথা শুনে মেয়ে বায়না ধরেছিল তাকেও অমন একটা পাখি কিনে দিতে হবে। সে কি কান্নাকাটি মেয়ের। শেষে বাধ্য হয়েই এই ময়না পাখি কিনে এনেছিল সে।

পাখি দেখে মেয়ের উচ্ছাস ছিল দেখার মত। মেয়ের চাওয়া পূরন করে আসিফ ও খুশি হয়েছিল অনেক। কত কথা অর্পার এই পাখি নিয়ে। কবে থেকে কথা বলা শুরু করবে সে নিয়ে তার কত টেনশন।

স্কুল থেকে ফিরার পর এই পাখিই ছিল তার সব কিছু। তাকে খাওয়ানোর আগে এই পাখিটিকে খাওয়াতে হবে, নিয়মিত গোসল করাতে হবে। ইট পাথরের দেয়ালল ঘেরা জীবনে এই পাখিই ছিল মেয়ের খেলার সাথী, কথা বলার সঙ্গী। নিজে নিজেই পাখির সাথে মেয়ে কথা বলে যেত।

স্কুলের গল্প, বাইরে ঘুরে এসে ঘুরার গল্প, সবই হত এই পাখির সাথে। পাখির একটি নামও দিয়েছিল সে "টুনি"। গল্পের বই এ পড়া নাম। সময়ে অসময়ে সে পাখিটির পাশে বসে বলত "আমার নাম টুনি" । হাজার বারের উপরে বলা হয়ে গেছে তার, তবুও পাখিটি এখন পর্যন্ত কোন কথা বলেনি। অর্পার অতি আল্লাদে মাঝে মাঝে সে নিজের স্বরে ডেকে উঠত। আর মেয়ে তার প্রতিবাদ করে বলত, না না, বল- আমার নাম টুনি । টুনি কি আর অত সহজে পোষ মানে। বাসায় যেই আসুক তার একবার টুনির সাথে কথা বলে যেতে হবে। মেয়ের এহেন কান্ডে আসিফ আর শায়লা মজায় পেত। মেয়েত আর তার মত বনে বাঁদারে ঘোরার সুযোগ পাইনি, খোলা আকাশে মুক্ত পাখিও সে দেখেনি এক কাক ছাড়া। এই পাখি নিয়ে মেয়ের সময় কেটে যায় এতেই খুশি তারা।

মজা হত যখন মেয়ের দাদু এসেছিল তখন । দাদী আর নাতনী মিলে সারাক্ষন টুনির সাথে গল্প করত । সে গল্প জুড়ে পুরোটা ছিল আসিফের দুরন্তপনার গল্প। গুলতি নিয়ে পাখি শিকারে বের হবার গল্প। পেপার পড়তে পড়তে সে গল্প শুনে আসিফ ও স্মৃতিকাতর হত। দাদী দেশে বেড়াতে চলে যাবার পর এখন এই পাখিই অর্পার একমাত্র সাথী।

এইসব ভাবতে ভাবতে আসিফ ঘরের ভিতরে ঢুকে। শায়লা টেবিলে ভাত রেডী করছিল। হালকা উচ্চস্বরে আসিফ বলে উঠে, একটা পাখিও দেখে রাখতে পারনা, কি করে কেমন করে পাখিটা উড়ে গেল, কে দরজা খুলে দিল। আমার মেয়ের কত শখের এই পাখি ।

শায়লা একবার আসিফের দিকে তাকাল। শোন সবকিছুতেই না বুঝে হাউকাউ করা তোমার স্বভাব। এ স্বভাব বদলাও। আগে জান তারপর চিল্লাফাল্লা করতে হলে করবা। তোমার মেয়ে নিজেই তার শখের পাখি ছেড়ে দিয়েছে। কাউকে বিনা কারনে আঁটকিয়ে রাখা ঠিকনা, তাই ছেড়ে দিয়েছে। আরও কিছু জানার ইচ্ছা হলে মেয়ে ঘুম থেকে উঠলে সকালে জিজ্ঞাসা করো, এখন হাত মুখ ধুয়ে এসো।

আসিফ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। মেয়ে তার নিজ ইচ্ছাতেই পাখিটিকে ছেড়ে দিয়েছে , কি কারনে সে কিছু বুঝতে পারলনা। বেডরূমে গিয়ে দেখে মেয়ে ঘুমাচ্ছে। পরীর মত লাগছে মেয়েকে হালকা ডিম লাইটের আলোয়।
সে আর এ নিয়ে কথা বাড়ালনা।

সকালে মেয়ের ডাকে ঘুম ভাঙ্গল তার। বাবাকে জড়িয়ে ধরে অর্পা বলল , বাবা আমি টুনিকে ছেড়ে দিয়েছি । ঘুম জড়ানো কন্ঠে সে জানতে চাইল কেন মা, তুমি না ওকে কথা বলা শিখাবে। না বাবা এটা ঠিক না। কাউকে জোড় করে অন্যের ভাষা শেখানো ঠিক না। ও তাতে খুব কষ্ট পেত। ও কিছু বলতে পারতনা, তাই মাঝে মাঝে নিজের মত করে চিৎকার করত। স্কুলে মিস যখন ২১ শে ফেব্রুয়ারির কথা বলেছে আমার তখনই মনে হয়েছে টুনিকে জোড় করে আমাদের ভাষা শেখানো ঠিক হবেনা। আর কাউকে বন্দী করাও ঠিক না। তাই বাসায় এসে ওকে ছেড়ে দিয়েছি।

আসিফত মেয়ের কথায় হতবাক। এতটুকু মেয়ে বলে কি, তার চোখ থেকে ঘুম উধাও। জানতে চাইল স্কুলে মিস কি বলেছে।

অর্পা বলে চলে, মিস বলেছে- পাকিস্তানীরা আমাদের উপর জোড় করে বলেছিল ওদের ভাষায় কথা বলতে হবে। আমাদের দেশের মানুষ ওদের কথা শুনেনি। সবাই রাস্তায় নেমে এসেছিল। ওরা গুলি করে। আমাদের সালাম বরকতরা গুলি খেয়ে শহীদ হয়। তারপর ওরা বাধ্য হয় আমাদেরকে আমাদের ভাষায় কথা বলতে দিতে । আমাদের জয় হয়, আমরা বাংলায় , আমাদের ভাষায় কথা বলতে পারি এখন। ওরা খুব শয়তান ছিল, কথায় কথায় আমাদেরকে আঁটকে রাখতে চাইত, কস্ট দিত। তাই একদিন আমরা কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ওদের সাথে যুদ্ধ করি। আমাদের অনেকে শহীদ হয়, অনেক ক্ষতি হয় আমাদের। তারপর আমরা আমাদের একটা দেশ পাই। মিস বলেছেন এই কথা বলতে না দেয়ার কারনেই আমরা রাস্তায় নেমে আসি, আর ধীরে ধীরে স্বাধীনতা আসে, আমরা একটা নিজের দেশ বাংলাদেশ পেয়েছি এই ভাবে।

আসিফ মুগ্ধ চোখে মেয়ের কথা শোনে। আসিফ কে ডাকতে এসে শায়লাও চুপ করে মেয়ের কথা শুনে যায়।

অর্পা বলে চলে, টুনির বন্ধুরাত কেউ ওর সাথে নেই, তাই ও কিছু বলতে পারেনা , মাঝে মাঝে নিজের মনে চিৎকার করে। এজন্য ওকে ছেড়ে দিয়েছি। কাউকে জোড় করে অন্যের ভাষা শেখানো ঠিকনা, তাই না বাবা। ওকে ওর মত, ওর বন্ধুদের সাথে , বাবা মার সাথে থাকতে দেয়া ভাল তাই না বাবা।

আসিফ নিজেও কখনও অমন করে ভেবেছে কিনা সে জানেনা। মেয়ের এই বোধদয়ে, মেয়ের এই মমত্ববোধে তার চোখ আদ্র হয়ে উঠে। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আসিফ বলে উঠে তুমি খুব ভাল কাজ করেছ মামনি। খুব , খুবই ভাল কাজ, কাউকে জোড় করে অন্যের ভাষা শেখানো ঠিকনা, কাউকে বিনা কারনে বন্দী করে রাখা উচিৎ না। মেয়েকে বুকের গভীরে চেপে ধরে আসিফ পরম মমতায়।

ওয়ার্ডোবে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো শায়লা এক দৃষ্টে চেয়ে থাকে বাবা আর মেয়ের দিকে , ভাবছে সে ও গিয়ে জড়িয়ে ধরবে কিনা মেয়েকে !
৪৭টি মন্তব্য ৪০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×