somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

"গালিবের গজল থেকে" -১

১১ ই জুন, ২০১৩ সকাল ১০:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



সিলেটের চৌহাট্টা পয়েন্টে বইপত্র নামে একটি লাইব্রেরি আছে, যার কালেকশন সত্যি বলতে বিশাল। মাঝে মাঝে বন্ধু আরজু সহ আমরা সেখানে ঢু মারতাম,ছাত্রজীবনে অত বই কেনার টাকাত পকেটে ছিলনা, তাই উল্টেপাল্টে দুচার লাইন পড়ে চলে আসতাম। একদিন হঠাত করে হাতে পড়ল আবু সায়ীদ আইয়ুব এর অনুবাদে "গালিবের গজল থেকে" বই খানা । পাতা উল্টেই ভাল লেগে গেল , তাই কিনে ফেললাম ।গালিবের মোটামুটি বিখ্যাত অনেকগুলো শের এর সংকলন । গজল পরিচিত অর্থে কবিতা নয়, পাঁচ-সাতটি বা পনের কুড়িটি শের এর সমস্টি, যাদের মাঝে ভাবের ঐক্য না থাকাই স্বাভাবিক । সেই সব গজল থেকেই শের গুলো নেয়া। যাই হউক বই খানা প্রায়ই উল্টে পড়ি, রুম মেটদের সাথে শেয়ার করি ছোট ছোট শের। ভাল লাগলে লাল কালি দিয়ে দাগিয়ে রাখি, তখন বইতে যেকোন লাইন ভাল লাগলেই দাগিয়ে রাখার অভ্যেস ছিল ।
বই ধার দেয়ায় আমি খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম না , কারন ছাত্রজীবনে বই কেনাই হত খুব অল্প, আর পোলাপান নিয়ে গেলে ফেরত পাবার সম্ভাবনা ছিল খুবই কম । কিন্তু এক জুনিয়র এমন ভাবে ধরল যে আর না দিয়ে পারলামনা , ফলাফল যা হবার তাই। সে বই আর কোনদিন ফেরত পাওয়া হয়নি । এই বইটার কথা প্রায়ই মাথায় ঘুরতো, সেদিন বেইলী রোডে সাগর পাবলিশার্সে গিয়ে হঠাত করে পেয়ে গেলাম এটি, সাথে আরো মীরের গজলের একটি সংকলন ও পেয়ে গেলাম। এটি যদিও আর কাউকে ধার দেয়ার কোন সম্ভাবনা নেই, তারপরও ভাবলাম নিজের পছন্দের শের গুলো অনলাইনে লিপিবদ্ধ করে রাখি, তাহলে আর হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকবেনা , সেই থেকেই এই লেখা ।
মির্জা নওশা ওরফে আসদুল্লাহ খাঁ গালিব-পারিবারিক নাম মির্জা নওশা মোটেও পছন্দ ছিলনা তার, তাই অসদ কিংবা গালিব ই ব্যবহার করতেন। তের বছর বয়সে এতীম গালিবের সাথে বিবাহ হল দিল্লীর অভিজাত উমরাও বেগমের সাথে, আর তিনি রচনা করলেন- সাত রজব ১২২৫- তারিখে আমার জন্য যাবজ্জীবন কারাবাসের বিধান হল। একটি বেড়ি অর্থাত বীবী আমার পায়ে পড়িয়ে দেয়া হল আর দিল্লী শহরকে কারাগার সাব্যস্ত করে আমাকে সেই কারাগারে নিক্ষেপ করা হল।মুঘল সাম্রাজ্যের বাহাদুর শাহ জফর এর দরবারে তিনি রাজকবি হিসেবে ছিলেন যদিও সারাজীবন অর্থ কস্টে আর নেশায় জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি। অর্থ কস্ট লাঘবের জন্য দিল্লী কলেজে ফারসীর প্রধান অধ্যাপকের পদ খালি হলে বন্ধুদের উতসাহে সেই পদের জন্য দেখা করতে গিয়েছিলেন শিক্ষাসচিব মিঃ টমসনের সঙ্গে পালকি চেপে। পূর্বপরিচিত টমসন সাহেব অন্যদিনের মত এগিয়ে এসে গালিব কে অভ্যর্থনা জানানি বরং চাকরিপ্রার্থীর জন্য নিজের অফিসে অপেক্ষা করছিলেন, আর তাই গালিব ও তার সঙ্ঘে দেখা না করে ফিরে এসে ছিলেন , কারন চাকরি তো এই জন্য নেওয়া যে কিছু সন্মানলাভ হবে, কিন্তু চাকরি হবার আগেই যদি এইভাবে সন্মান লাঘব হয়ে যায় তবে আর তা দিয়ে দরকার কি ? টনটনে আত্মসন্মানবোধ অথচ অন্যদিকে অর্থাভাব আর মদ্যমানের জন্য লাঞ্ছনাও কম সহ্য করেননি ।
উর্দু সাহিত্যের প্রানকেন্দ্র দিল্লী- সাগর সেখান থেকে হাজার মাইল দূরে আর হিমালয়ও কয়েকশত, তাই সমসাময়িক বিশ্ব কবিরা যেখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে লিখেছেন, উর্দু কবিতায় সেটা অনেকাংশে অনুপস্হিত।তাজমহল বাংলার কবিদের ব্যাপকভাবে নাড়া দিলেও একজন উর্দু কবি লিখেছেন- "এক শাহানশাহ্ ,অঢেল ধনভান্ডারের সুযোগ নিয়ে আমাদের মত সামান্য লোকের প্রেমকে উপহাস করেছেন " ! বাগান আর ফুলের বহুল ব্যবহার উর্দু কবিতায় থাকলেও সেটা ইরান তথা পারস্য থেকে কবি পরম্পরায় আমদানী করা ।পর্দাপ্রথার কড়াকড়ির কারনে নিকট আত্মীয়া আর মজুরশ্রেনীর মেয়ে ছাড়া আর কোন নারীর মুখ দেখার সুযোগ না থাকায় প্রেমে পড়ার সুযোগ ও ছিল কম, তাই কবিতায় নারীদের চুল কপাল কপোল চোখের বর্ণনাতেই তারা সীমাবদ্ধ ছিলেন। যতটুকু আছে সেটাও তওয়ায়েফদের (সম্ভবত বাঈজী শ্রেনী) নিয়েই ।এক মজুর শ্রেনীর ডোমনীর সঙ্গেই গালিবের প্রথম নিবিড় প্রেমের অধ্যায় রচিত হয়, যদিও গালিব প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেননি। দুঃখে কস্টে সে ডোমনি গত হলে এরপর থেকে গালিবকে তওয়ায়েফ প্রেমিকই বলা যায়।
স্রষ্টা প্রেম ছিল উর্দু কবিতার আরেকটি দিক, সেখানে রাগ অনুরাগ , কপটতা সব কিছুরই বহিঃপ্রকাশ ছিল। গালিব লিখেন- " ফরিশতাদের লেখার উপর ভর করে আমাকে অন্যায়ভাবে ধরে নিয়ে যাচ্ছে শাস্তি দেবার জন্য, লিখবার সময় আমার পক্ষের লোক কি কেউ সেখানে উপস্হিত ছিল ! '' , স্রষ্টার বিচার ও যেন ফৌজদারি আদালতের বিচার !! ঈশ্বর দর্শন নিয়ে আরেক জায়গায় লিখেছেন- " হে অপরিনামদর্শী হৃদয় আমার, অভিলাষ সংবৃত করো, বন্ধুর রুপের ঔজ্জ্বল্য সহ্য করবার শক্তি তুমি পাবে কোথায় ? '' ।

সমাজমুখী কবি ছিলেননা গালিব, কাব্যের উপজীব্য তার নিজের সুখ দুঃখ, ভাগ্যের উত্থান-পতন। ঈশ্বরের উদাসীনতা তিনি সইতে পারছিলেননা, নিজের দুঃখ কস্টকে ঈশ্বরের নিষ্ঠুরতা জ্ঞান করেছিলেন তিনি- " আমি কি এমন জ্ঞানী ছিলাম, কোন গুনেই বা সেরা ছিলাম / আকারনে আসমান আমার শত্রু হল '' । ঈশ্বরের অনুকম্পা কে না চায়- "না চাইতেই যদি দেন তিনি তো তার স্বাদই আলাদা; সেই ভিখারী শ্রেষ্ঠ, হাত পাতার অভ্যেস হয়নি যার " ।
ব্যর্থতার সাক্ষ্যই গালিবের জীবনে প্রচুর, এই ব্যর্থতা তার জীবনকে কিঞ্চিত অসুন্দর এবং কাব্যকে অতিশয় সুন্দর করেছে। কর্মী মানুষের জন্য তাই গালিবের শের- " জিজ্ঞাসা করলাম, একটি ধূলিকনার পক্ষে সূর্য পর্যন্ত পৌঁছানো কি সম্ভব ? সে বলল 'অসম্ভব প্রায়' / জিজ্ঞাসা করলাম ,'তবুও কি আমি চেস্টা করে যাবো'? সে বললো 'তাই সঙ্গত ' '' ।


দুনিয়ার এই ভয়ানক উজাড় মজলিসে প্রদীপের মতো আমি
প্রেমের শিখাকেই আমার সর্বস্ব জ্ঞান করলাম।



সর্বনাশের স্ফুলিঙ্গ তুমি, মানুষের ঘর উজাড় করতে একাই কম কিসে ?
তুমি যার বন্ধু হলে, আকাশ আবার তারও শত্রু হতে চায় কেন ?



খুশির কী আছে ক্ষেতের উপর যদি একশবারও মেঘ আসে
আমি তো জানি এখন থেকেই বিদ্যুত খুঁজছে আমার ধানের গোলার ঠিকান । ।



আমি কী এমন জ্ঞানী ছিলাম, কোন গুনেই বা সেরা ছিলাম,
অকারনে, গালিব, আসমান আমার শত্রু হল ।



আকাশের দিকে তাকালে তার কথাই মনে আসে, আসাদ,
তার নিষ্ঠুরতায় আমি যে দেখেছি বিধাতার নিষ্ঠুরতার আদল।


প্রেমের নিষ্ঠুরতাকে ভয় করিনা , কিন্তু আসাদ;
যে হৃদয় নিয়ে গর্ব ছিল, সে হৃদয় আর নেই । ।


সে মিলন আর সে বিচ্ছেদ কোথায়?
সেই রাত, দিন , মাস, বতসর কোথায় ?


পেয়েছিলাম বিশেষ একজনের রুপের ধ্যানে-
মনের সেই সরসতা আজ কোথায় ?


প্রেমের উপর জোর খাটে না, এ সেই আগুন , গালিব,
যা জ্বালালে জ্বলে না, নেভালে নেভে না । ।

১০
আপনার উদাসীনতা সকল সীমা ছাড়িয়ে গেছে; হে মহীয়সী রানী, আর কতোদিন
আমি শোনাবো হৃদয়ের কথা, আর আপনি বলবেন কী ?

১১
হে ঈশ্বর , তিনি বোঝেননি, বুঝবেনওনা আমার কথা;
দাও তাঁকে অন্য হৃদয়, যদি আমাকে অন্য ভাষা না দাও । ।

১২
কেমন করে কাটবে বর্ষার অন্ধকার রাত্রিগুলি;
আমার চোখ যে তারা গুনতেই অভ্যস্ত হয়ে আছে , হায় ।।

১৩
প্রত্যেকটি লালহ্ ও গোলাপ ফিরে-ফিরে আমার মনকে টানছে;
অথচ আমি বেরিয়েছি শত ফুলবন দেখার পাথেয় নিয়ে ।।

১৪
ফুলবাগিচার রুপ দেখতে চাই, আবার ফুল তুলেও চাই-
হে বসন্তের স্রষ্টা, আমার মন পাপী । ।

১৫
মনে প'ড়ে যায় কতো অতৃপ্ত বাসনার ক্ষতচিহ্ন বুকে রয়েছে;
হে ঈশ্বর , আমার কাছ থেকে পাপের হিসাব চেয়ো না ।।

১৬
পাপ করে যে সুখ ভোগ করেছি তার জন্য যদি শাস্তি ধার্য থাকে, তবে হে ঈশ্বর,
আমার না করা পাপের হাহাকারও কিছু সাধুবাদ পাক তোমার কাছে । ।


উতসর্গ : সামু ব্লগের শের সম্রাট মোস্তফা কামাল ভাইকে ।
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×