বেশ কিছুদিন আগের কথা।লেভেল - ২,টার্ম – ২ এর ক্লাস শেষ।ছুটি চলছিল।দুপুরে ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।ঘুম থেকে উঠতে উঠতে সন্ধ্যা হয়ে যায়।উঠে দেখি আব্বা-আম্মা কেউই বাসায় নেই।আমার বোন আব্বার রুমে বসে বসে টিভি দেখছে।আমার দূরসম্পর্কের এক চাচার বিয়ে।ভাবলাম দুইজন সেখানেই গেছে।আমি আমার রুমে এসে পিসিতে মুভি দেখতে থাকি।মুভি দেখা শেষ করতে করতে রাত ১০টা বেজে যায়।বাইরে হঠাৎ ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়।ডাইনিং রুমে এসে দেখি আব্বা-আম্মা তখনো ফেরেননি।মনে একটু খটকা লাগে।বিয়ের অনুষ্ঠান কাছেই এক জায়গায়।সেখান থেকে ফিরতে তো এতোক্ষণ লাগার কথা না!বোনকে জিজ্ঞেস করি, “আব্বু-আম্মু কোথায় গেছে জানিস?”
“বিয়ে খাইতে যাওয়ার কথা না?”
“ওইখান থেকে আসতে এতোক্ষণ লাগে নাকি?অন্য কোথাও যাওয়ার কথা?”
“জানি না।যখন আসার কথা তখন তো আসবেই।এতো চিন্তা করতেছ কেন?”
মেজাজ খারাপ হয়।বলি,“তোর না পরীক্ষা?যা,পড় গিয়া,সারাদিন তো দেখলাম শুধু টিভি দেখতে।
সে পিত্তি জ্বালানো একটা হাসি দেয়।মেজাজ খারাপ করে আমার রুমে চলে আসি।আব্বাকে ফোন করি।কিন্তু ওপাশ থেকে জবাব আসে, “আপনি যে নম্বরে ডায়াল করেছেন,তাতে এই মূহুর্তে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না।অনুগ্রহ করে কিছুক্ষণ পর আবার ডায়াল করুন।”এবার গাড়ির ড্রাইভারকে ফোন করি।কিন্তু ড্রাইভারও কিছু বলতে পারে না, “স্যার তো অনেক আগেই গাড়ি ছাইড়া দিছে।
আমারে বলছে চলে যাইতে।”শেষে আম্মাকে ফোন করি। “হ্যালো,কোথায় তোমরা?”
“আমি তো বাসায়।”
“বাসায় মানে?”
“বাসায় মানে বাসায়।আমার রুমে।”
দৌড়ে আম্মার রুমে যাই।দেখি আমার বোন আম্মার ফোনটা রিসিভ করে কথা বলছে।ধরে দুইটা চড় মারার ইচ্ছেটা অনেক কষ্টে দমন করি।
ঘড়ির দিকে তাকাই।সাড়ে ১০টা।একটু দুশ্চিন্তা হতে থাকে।সামান্য একটা বিষয় নিয়ে সকালে আব্বার সাথে একটু রাগারাগি হয়।এখন সেটা নিয়ে খারাপ লাগতে থাকে।১১টা বাজলে দুশ্চিন্তার মাত্রা আরো বেড়ে যায়।কি করব বুঝে উঠতে পারি না।আগের অনেক কথা মনে পড়তে থাকে।মনে করতে থাকি ছোটবেলায় রাঙামাটিতে থাকার সময় আব্বার হাতে হাত ধরে আদিবাসীদের বাজারে যাওয়ার কথা,সিলেটে থাকার সময় কলোনীতে সাইকেল চালানোর সময় আব্বার পাশে পাশে দৌড়ানোর কথা,এসএসসি দেয়ার পরে আব্বার পাশে বসে ড্রাইভিং শেখার কথা (যদিও আমার অনিচ্ছার কারণে সে শিক্ষা এক সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হয় না),৪-৫ বছর বয়সে আম্মার কাছে অ,আ,abcd,১২৩ শেখার কথা,চুল বড় হলেই আব্বার ধমক, “চুলগুলা তো একেবারে মালিঙ্গার মতো হয়ে গেছে,যাও,কাটায় আসো”, আব্বার সাথে একসাথে ক্রিকেটে আব্বার প্রিয় দল পাকিস্তান আর আমার প্রিয় দল শ্রীলঙ্কার খেলা দেখা আর দুই দলের পক্ষে-বিপক্ষে জমে ওঠা তর্ক-বিতর্কের কথা,আমি একটা হাঁচি দিলেই আব্বা-আম্মার অস্থির হয়ে ওঠার কথা,আম্মার কাছে চা বানানো শেখার কথা (এটাও আমার অনিচ্ছার কারণে স্থগিত হয়ে যায়),অসুস্থ অবস্থাতেও আমার জন্য আম্মার চা বানানোর কথা।এখনো যে কোন বিষয়ে সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট পাই আব্বা-আম্মার কাছ থেকেই।যে কোন দুঃসময়ে এখনো আব্বা-আম্মাই আমার সবচেয়ে বড় আশ্রয়।
আমার ওপর সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস মনে হয় আমার আব্বা-আম্মারই।এখনো মনে পড়ে বুয়েট এ্যাডমিশন টেস্টে মন খারাপ করে আমার ভুলগুলোর কথা একটা একটা করে বলার পরে আব্বার সেই কথা, “আরে,এতো মন খারাপ করতেছ কেন?তুমি যেটা পার নাই সেটা আর বাকি সবাই পারবে এটা ভাবার তো কোন কারণ নাই।তুমি যেটা পার নাই সেটা অনেকেই পারে নাই।”চান্স পাওয়ার পরে আনন্দের আতিশয্যে আব্বা আমাকে কোলেই তুলে ফেলেন (এই অসম্ভব কাজটা কিভাবে করলেন সেটা আব্বাই বলতে পারবেন)।রাত ১২ টার সময়ই আব্বা সবাইকে ফোন করতে শুরু করেন।আমার চাইতে তার আনন্দ ছিল কয়েকগুণ বেশি।এখনো সহকর্মী আর বন্ধুদের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার সময় আব্বার মুখে ফুটে ওঠে গর্বের হাসি।
সকালের ঘটনার জন্য এখন নিজের উপরে মেজাজ খারাপ হতে থাকে।মনে মনে ঠিক করে ফেলি আব্বা বাসায় আসার সাথে সাথে আব্বাকে জড়িয়ে ধরে স্যরি বলে ফেলব।আর কখোনো আব্বার সাথে কোন বিষয়ে রাগারাগি করব না।
আবারো ঘড়ির দিকে তাকাই।সাড়ে ১১টা।এবার আশংকা রীতিমতো আতঙ্কে রূপ নেয়।মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা শুরু করি যাতে আব্বা-আম্মা নিরাপদে বাড়ি ফিরে আসে।বিভিন্ন রকমের উল্টা-পাল্টা দুশ্চিন্তা ভর করতে থাকে মনের মধ্যে।মামা-চাচাদের বাসায় ফোন করব বলে ঠিক করি।
আর দশ মিনিট পরে দরজার কলিংবেল বেজে ওঠে।দৌড়ে যাই দরজা খোলার জন্য।যা ভেবেছিলাম তাই।আব্বা-আম্মা দরজা দিয়ে বাসায় প্রবেশ করলেন।ডাইনিং রুমে বসতেই প্রশ্ন করা শুরু করলাম,
“কোথায় ছিলা এতক্ষণ?”
“তোমার আন্টির শরীর খারাপ।তাই একটু দেখে আসলাম।”
“আমাকে বলবা না?”
“সকালে তো বললাম।”
আমি ভেবে দেখলাম,তাই তো!সকালেই আম্মার সাথে খালার অসুস্থতা নিয়ে কথা হয়।
“এত দেরি করলা কেন আসতে?”
“এই বৃষ্টির মধ্যে কেমনে আসব?”
দেখলাম যে এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে আসলেই বাসায় আসা সম্ভব ছিল না।
“আব্বু, তোমার ফোন বন্ধ কেন?”
“টেলিটকের নেটওয়ার্কের সমস্যা হয়তো।”
“আম্মু, তুমি ফোন বাসায় ফেলে গেলা কেন?”
“ফোন সাথে নিতে মনে ছিল না।”
“কিন্তু তোমরা গাড়ি নিয়া গেলা না কেন?ড্রাইভার কিছু বলতে পারে না।”
“তোমার আন্টির বাসায় আসার পরে গাড়ি রেখে কি হবে?”
আমি দেখলাম,ঠিকই তো!ড্রাইভারকে আমি তো জিজ্ঞেসই করিনি আব্বা কোথায় আসার পর গাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন।
“কিন্তু বাসায় একটা ফোন করে বলবা তো কোথায় আছ?”
“ফোন ঠিক হইছে?”
আমার মনে পরল ২ দিন ধরে ফোন ডেড।আব্বা-আম্মাকে রেহাই দিই।আমার বোনের কাছে দৌড়ে যাই।
“তুই জানতি যে আব্বু-আম্মু আন্টির বাসায় আছে?”
“হুঁ।”
“তাইলে আমাকে বললি না কেন?”
“তোমার চেহারাটা দেখে মজা লাগতেছিল।”
এখন একটু আগের অবস্থাটা চিন্তা করে হাসি পায়।মনে মনে যা যা ঠিক করেছিলাম তার কিছুই করা হয় না।আব্বাকে জড়িয়ে ধরা হয় না।স্যরিও বলা হয় না।
ওইদিন আব্বার সাথে আর কোনদিন রাগারাগি করব না ঠিক করলেও এখনো আব্বার সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে খুনসুটি,রাগারাগি হয়।আব্বাকে স্যরিও বলা হয় না।যদিও পরে আবার দুইজনের স্বাভাবিক হতেও সময় লাগে না।আব্বা-আম্মাই আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু।এখনো ওইদিনের কথা মনে পরলে হাসি পায়।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মে, ২০১০ রাত ৯:৫৪