প্রফেশনভিত্তিক ট্রাইবালিজম খুব ভয়ংকর জিনিস। যার চক্করে পড়ে অপার বাংলায় ডাক্তারদের নিয়ে নচিকেতা যে গানটা গেয়েছিলেন তার জন্য তাকে ৪০ দিন জেল খাটতে হয়েছিল বলে শুনেছিলাম। সম্প্রতি মোশাররফ করিমের হাই প্রেসার ০২ নামক একটি নাটকের জন্য তার বিরুদ্ধে ৫০ কোটি টাকার একটা মানহানীর মামলা দায়ের করা হয়েছে। কারণ তিনি উকিল চরিত্র (কাল্পনিক) কে নেতিবাচকভাবে দেখিয়েছেন।
যা নিয়ে উকিল সম্প্রদায়ের ভিতর তুলকালাম কান্ড ঘটে গেছে । গ্রুপে গ্রুপে পক্ষে বিপক্ষে তুমুল আলোচনা সমালোচনা চলছে। আমি বৃহত্তর উকিল সম্প্রদায়ের তুচ্ছ এক সদস্য হিসেবে এবং বিনোদন জগতের একজন নিয়মিত ভোক্তা হিসেবে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা দায়িত্ব হয়ে দাড়িয়েছে।
আসলে উকিলকে নেতিবাচক চরিত্রে দেখানো যেন বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। পশ্চিমা বিশ্বে উকিলকে কম পচানো হয় না। ডেভিলস অ্যাডভোকেট বা স্যুটের মত টিভি সিরিজগুলো দেখলেই বুঝবেন। ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্টে জনি এলএল.বি. আমরা সবাই দেখেছি। আমরা বাংলাদেশের মানুষ জন্ম থেকেই উকিল সম্পর্কে নেগেটিভ ধারণা নিয়ে বড় হয়েছি। যার জন্য প্রতি শুক্রবার বিটিভিতে নায়ককে বিচারের কাঠগড়ায় নাস্তানাবুদ করা উকিল চরিত্রের ব্যক্তিটিকে দোষ দেওয়াটা অস্বাভাবিক নিশ্চয় নয়। এইভাবে পুরো একটা জেনারেশন গড়ে উঠেছে উকিল সম্পর্কে বাজে একটা ধারণা নিয়ে।
এখন আসি মোশাররফ করিমের নাটকটা নিয়ে। এই নাটকের মুল বিষয় হলো দুইজন টাউট যার উকালতি সনদ না থাকা সত্ত্বেও গাউন গায়ে উকিল পরিচয় দিয়ে মামলা নিচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে নেতিবাচক চরিত্রে উকিলকে দেখানো হয়েছে৷ নাটকে কিছু কিছু বিষয় এমন যে যা খুবই দৃষ্টি কটু ও যেকোন উকিলের বিরক্তির উদ্রেক ঘটাবে৷ ব্যস এতটুকুতে ঠুকে দেওয়া হল মানহানীর ধারা। শুরু হয়ে গেল সাধারণ মানুষের ভিতর উকিলের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার। এমনিতেই উকিলদের উপর জনসাধারণ ক্ষ্যাপা। আগুনে যেন অক্সিজেন সিলিন্ডার ফেলা হলো! বলে রাখা ভালো 'আইন জানা' কোন সুপার পাওয়ারের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। এখন এই পাওয়ারের মিস ইউজ হলে জনগণ ক্ষেপে উঠা বিচিত্র কিছু নয়। এমনিতেই উকিলদের বাড়িওয়ালারা ভাড়া দিতে চায় না।
এর আগে জনগণ পড়েছিল ডাক্তারদের নিয়ে । এরপর পুলিশ। এবার লিস্টে এলো উকিলরা। কমেন্টগুলো পড়া যায় না। গা জ্বালা করে। এত কমেন্টের মতো মধ্যে একটা কমন কমেন্ট হলো- কেন তারা (উকিল) বিবেক জলাঞ্জলি দিয়ে আসামীর পক্ষে লড়ে?' মূল বিষয়ের বাহিরে হলেও এটা নিয়ে কিছু কথা না বলে পারছি না। সাধারণ মানুষ যেটা জানে না সেটা হল প্রতিটা মানুষ নিজের আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকারী। যার জন্য উকিল লাগে। আসামী যদি কোন উকিল দিতে না পারে তাহলে স্বয়ং সংবিধান উকিল নিয়োগ দিবে। এছাড়া অপরাধ প্রমানিত না হওয়া পর্যন্ত আইনের চোখে প্রতিটা মানুষ নিরাপরাধ৷
যাইহোক পয়েন্ট থেকে সরে এসেছি। এই মানহানীর মামলাটি প্রফেশনভিত্তিক ট্রাইবালিজমের বহিঃপ্রকাশ মাত্র৷ সমস্যা হলো এইভাবে সব যদি প্রফেশনভিত্তিক ট্রাইবালিজমের শিকার হয় একটা দেশের শিল্প চর্চা রুদ্ধ হয়ে যাবে। পুলিশ, ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার কারো বিরুদ্ধে কোন কিছু যেন বলা যাবে না। কারণ সব প্রফেশনের ভালো খারাপ আছে। এইজন্য ভবিষ্যৎ ঝামেলা এড়াতে প্রতিটা নাটক/সিনেমায় শুরুতে Disclaimer দিয়ে বলা হয় 'এই সিনেমা/ নাটকের সকল চরিত্র কাল্পনিক । বাস্তব কোন চরিত্রের সাথে অভিনীত চরিত্রসমূহের কোন প্রকার সম্পৃক্ততা নেই।'
যাইহোক এই মানহানীর মামলার জন্য প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ স্যারের একটি ঘটনা শেয়ার করে লিখাটা শেষ করছি।
হুমায়ূন আহমেদ স্যারের কোথাও কেউ নেই নাটকের কথা আমরা সবাই জানি। জানি তার বাসার উপর জনগণের হামলা, মিছিল, মিটিং ইত্যাদি। যেটা কেউ জানে না সেটা হলো এই নাটকের জন্য হুমায়ূন আহমেদ স্যারকে আদালতে আসতে হয়েছিল। কারণ ২০ জন উকিল তার নামে মানহানীর মামলা করেছিলেন বাকের ভাইয়ের উকিলকে খারাপ দেখিয়েছিলেন বলে। ঐ মামলাটি খারিজ হয়। কারণ হিসেবে হুমায়ূন আহমেদ স্যারের অকাট্য যুক্তি। তিনি বলেছিলেন ঐ নাটকে একজন অত্যন্ত সৎ একজন আইনজীবী ছিলেন মুনার উকিল। ঐ ২০ জন উকিল তার সাথে নিজেদের তুলনা না করে খারাপ জনের সাথে তুলনা করল কেন?
এখানেও একই যুক্তি চলে আসে। আজকে হয়তো মোশাররফ করিম এর বিপক্ষে কোন একজন উকিল হয়তো দাড়ালো কিন্তু তার পক্ষে দাড়ানোর মত উকিলেরও অভাব হবে না। বাকিটা বিজ্ঞ আদালতের বিবেচনার বিষয়।
শান্তনু চৌধুরী শান্তু
তথ্যসূত্র - ইন্টারনেট জগত
মুনার ছবিটি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুলাই, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:১৪