১
"তোমারি আঁখির মত আকাশের দুটি তারা
চেয়ে থাকে মোর প্রাণে নিশীথে তন্দ্রাহারা ।
সে কি তুমি ? সে কি তুমি ?
ক্ষীণ আঁখি-দ্বীপ জ্বালি’ বাতায়নে জাগি একা
অসীম অন্ধকারে খুঁজি তব পথ-রেখা ,
সহসা দখিন বায়ে চাঁপাবনে জাগে সাড়া
সে কি তুমি ? সে কি তুমি ?
তব স্মৃতি যদি ভুলি ক্ষণ-তরে আন্-কাজে
কেন যেন কাঁদিয়া উঠে আমার বুকের মাঝে ।
সে কি তুমি ? সে কি তুমি ?"
"চিঠি এসেছে"
সুধা হাতের মাঝে চিঠি গুঁজে দিয়ে চলে গেল।
চোখ বুজে তন্ময় হয়ে গান শুনছিলাম, সুধা ব্যাঘাত ঘটালো। চিঠিটা পরে দিলেও হত। তেমন আর্জেন্ট না। আজকাল আর কেউ আর্জেন্ট কাজে চিঠিপত্র পাঠায় না, সোজা ফোন করে। সুধা আজকাল কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। কলেজে যে সুধার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল তার সাথে এ সুধার অনেক তফাৎ।
হাসানের চিঠি, সুদূর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাঠিয়েছে। উঠে যেয়ে মিউজিক প্লেয়ারটা বন্ধ করে এলাম। এরকম ভালোলাগার গানের সাথে হাসানের চিঠি একদমই যায় না। আসলে হাসানের চিঠি কোন গানের সাথেই যায় না। চিঠি খোলার আগেই তিনটে বিষয়ে আমি বেশ নিশ্চিত।
এক, চিঠিতে হালকা কথাবার্তা যেমন "ভালো আছিস, ভাবী কেমন আছে" এই টাইপ কিছু থাকবে না।
দুই, আমেরিকা আর বাংলাদেশের কোন একখানা বৈসাদৃশ্য।
তিন, এটা কিংবা সেটা পাঠিয়ে দিস।
দেশের তুলনা আমার কম্মিনকালেও ভালো লাগে নি। আজও লাগবে না। সব দেশ তার নিজের মতন।
তবুও চিঠি খুলতে হল। না হলে দু চার দিনের ভেতর আরো লম্বা লিম্বা চিঠি এসে হাজির হবে, তার পরে আরো বেশকটা। এই একটা বিষয়ে হাসানের উৎসাহের শেষ নেই। শেষমেশ লাগেজ টাগেজ নিয়ে হাজির হয়ে যেতে পারে। সে জ্বালাতনের থেকে এ জ্বালাতন অনেক বেশি সহনযোগ্য।
বুঝলি আলম, আমেরিকা, যুক্তরাজ্যের মানুষের খুব সহজে সরি বলতে পারে । আমরা বাঙালীরা পারি না । সরি কথাটা
বোঝাতে নানাভাবে চেষ্টা করি, দুঃখী দুঃখী মুখে তাহার সামনে ঘুরে বেড়াই, ইনিয়ে বিনিয়ে ঘুরিয়ে পাল্টিয়ে বেশ বোঝাতে চাই কিন্তু মুখ ফুটে সরি বলতে পারি না । কোথায় যেন বাধো বাধো ঠেকে । একটা ঘটনা শোন তাহলে ক্লিয়ার বুঝতে পারবিআমাদের বাসায় একবার মাইক্রোবাস কেনা হলো, ভাড়ায় চলবে । ড্রাইভার নিয়োগ দেয়া হল । প্রথমদিনই আমি তাকে ড্রাইভার চাচা ডেকে ফেললাম । চাচা কিছুক্ষণ আহত চোখে তাকিয়ে বলল,
"শোনো বাবা আমারে ড্রাইভার বোইলো না, আমার একটা নাম আছে আবেদ তুমি বরং ওইটা ধইরে ডাইকো" চাচার থেকে দ্বীগুন মনখারাপ হলো আমার । আমি নতুন গাড়িতে উঠলাম না বরং সারাদিনে অসংখ্যবার সরি শব্দটা ডায়েরীতে লিখে ফেললাম । এত পাতা ভর্তি হল যে মনে হল মাসখানেকের হোমওয়ার্ক একদিনে করে ফেলেছি । অথচ মুখ ফুটে তাকে সরি বলতে পারলাম না । কি আশ্চর্য !
আর এখানে সেদিন কি হল শোন, "অফিস আওয়ারে বস সবার সামনে ডেকে অযথা গালাগাল করলো। আবার যেদিন বুঝতে পারলো অন্যের দোষে শুধু শুধু আমায় গালাগাল করেছে সেদিন একগাদা ফুল এনে সরি বলল। আমি এদের সরি বলার কায়দায় মুগ্ধ, স্রেফ আস্টোনিসড। তোকে একটা গোপন কথা বলি, তোর ভাবিকে কায়দা করে রাগিয়ে দিয়ে সরি বলার প্লান করেছি। অবশ্য তোর একটু সাহায্য নেব। শোন তুই কালকেই হুমায়ুন আহমেদের "জনম জনম" বইটা পাঠা, সাথে তোরও একটা বই (তোর লেখালিখি কেমন চলছে?)। তোর ভাবি আবার তেনার বড় ফ্যান, একেবারে তোদের বাড়ির পুরোনো আমলের ফ্যানটার মত। সেটা এখোনো আছে তো নাকি? এখানে আবার সে বই নেই। ক ডলার পাঠাবো জানাস।
হাসান
চিঠিটা শেষ করামাত্রই কঠিন দীর্ঘশ্বাস বুক চিরে বেরোল। আমেরিকানদের এ সরি বলার স্বভাব আগে থেকেই জানা। প্রচণ্ড বিরক্তিকর। কথায় কথায় সরি বলে এরা সরির গুরুত্বটাই হারিয়ে ফেলছে। অথচ সুধার মান ভাঙাতে পুরো ক্যাম্পাসের সামনে সরি বলতে যেয়ে আটকে গেছি, সুধা সেটা বুঝে ফেলে হাতের একরাশ রজনীগন্ধা আর কার্ড নিয়ে চলে যাবার সময় মুখ ফিরিয়ে হেসে আমায় সে লজ্জা থেকে মুক্ত করেছে। এরকম বেশ কবার ই ঘটেছে। এভাবে বুঝে নেবার মাঝের ভালবাসাটুকু আমাদেত থেকে ভালো বোধহয় কেউ জানে না। হাসানেও জানবে না, তার জানার কথাও নয়।
"তোমার চা"
চট করে চা নামিয়ে চলে যেতে ধরে থেমে গেল সুধা। আলম তন্ময় হয়ে লিখছে। ক্যাম্পাসে সুধার সবথেকে প্রিয় মুহূর্ত ছিল সেটা। সুধা অপেক্ষা করত। আজ বিরক্ত লাগছে। আলম ঠিক সেদিনকের মতন ই আছে। প্রতিটা শব্দে ভালবাসছে। সুধা বদলেছে। সুধার শব্দের প্রতি কোন টান নেই, শব্দের ভালোবাসায় বন্দি হবার ইচ্ছে নেই। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। আলম হয়ত শব্দের মাঝে তাকে নিয়ে সেখানে ভিজছে। সুধার ভালোলাগছে না। ইচ্ছে করছে আলমকে টেনে নিয়ে গিয়ে বর্তমানে বাচতে। ইচ্ছে করছে প্রতিটি রোমকুপে আলমকে অনুভব করতে। অথচ আলমকে এ চেয়ার থেকে টেনে তোলে কার সাধ্যি। সুধা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে জানালার সামনে থমকে দাঁড়ায়। তার চোখের কোণে নির্বাক অশ্রু বাসা বাধে।
০২.
আলম ঠিক করেছে এবার ইন্টারনেট, মেইল চালাচালি ভালোমত শিখে নিবে। মোট কথা, কম্পিউটার চালানো শিখবে। একটা ডেস্কটপ কম্পিউটার কিনতে হবে। এর পিছনে অনেক কারণ আছে – তন্মন্ধ্যে, প্রধান যে কারণ সেটা হচ্ছে – লেখালিখির জন্য। বই প্রকাশক থেকে শুরু করে পত্রিকার প্রকাশক পর্যন্ত এখন খুব বিরক্ত হয় হাতেলেখা পান্ডুলিপি দেখলে। আর আলমের লেখা তেমন চকচকে ঝকঝকে চমৎকারও নয় বরং, প্যাঁচানো হাতের লেখা এবং তারমাঝে কাটাকাটি প্রচুর। মাঝখানে, কাটকাটি এড়াতে সে পেন্সিল দিয়ে লেখা শুরু করেছিল – কিন্তু, বেশিদিন এই নতুন অভ্যাস ধরে রাখতে পারেনি। পেন্সিলের কালি ঘষা লাগলেই লেপ্টে যায়, আর মুছামুছি করতে যেয়ে লেখার গতি কমে যায় – এমন সব নানা খোঁড়া যুক্তি দ্বারা নিজের মনকে বুঝ দিয়ে আলম পুনরায় তার পুরনো কলমধরা অভ্যাসে ফিরে যায়। কিন্তু, পরিস্থিতি যে দাঁড়িয়েছে, এখন সাধের বলপয়েন্ট কলমকেও বিদায় জানাতে হবে।
হাসানের জন্য কুরিয়ারটা জমা দিয়ে ডিএইচএলের অফিস থেকে বের হয়ে আসলো আলম। কম্পিউটার শেখার পর ইন্টারনেট ব্যবহারটা ভালোমত আয়ত্তে আনতে পারলে হাসানের সাথে ইমেইলেই যোগাযোগ রাখা যাবে। এত কষ্ট করে চিঠি চালাচালির প্যারাটা দূর হবে – তাছাড়া এখন এভাবে বিদেশে চিঠি চালাচালির যুগ আছে নাকি! যুগ অনেক পাল্টেছে, গতিশীল হয়েছে। আলম নেহায়েত গ্রাম থেকে উঠে এসেছে বলেই এখনো যুগের সাথে ঠিকমত অভ্যস্ত হতে পারেনি – সেকালেই পড়ে আছে। আলম কিশোরগঞ্জের নিজের গ্রামেই উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ে। এরপর ঢাকায় পাড়ি জমায় – তিতুমীর কলেজে বাংলা বিভাগে অনার্সে ভর্তি হয়। স্কুল থেকেই গল্পের বইয়ের পোকা ছিল আলম – শখের বসে টুকটাক লেখালিখিও তখন থেকেই। ঢাকায় এসে সেই লেখালিখির আরেকটু বিকাশ ঘটলো। আলমের চিত্তাকর্ষী লেখাগুলো বিভিন্ন পত্রিকা, ম্যাগাজিন লুফে নিলো। সেখানে বেশ নিয়মিতই ছাপার হরফে দেখা যেতে থাকলো আলমের গল্পগুলো। তার লেখায় কখনো উঠে আসলো শহুরে মানুষের যান্ত্রিক জীবন ও অলীক স্বপ্ন ছোয়ার গল্প, আবার কখনোবা ফুটে উঠতে থাকলো গ্রামীণ একান্নবর্তী পরিবারের সুখ-দুঃখের রোজনামচা। ছাপার হরফে গভীর আবেগমাখা সেসব গল্প পড়ে সুধা নামের আলমের এক সহপাঠিণী আলমের প্রেমে পড়ে গেল। আলমও তাকে ফিরিয়ে দিলো না – তাদের টোনাটুনির গল্প শুরু হলো এভাবেই।
আলম হাঁটতে হাঁটতে আজিমপুর এসে পড়েছে। ভাবছে এক প্রকাশকের সাথে দেখা করে যাবে কিনা – তার কাছ থেকে কিছু টাকা এডভান্স নিয়ে রাখতে পারলে ভালো হবে। বর্তমানে হাতের অবস্থা বিশেষ ভালো না আলমের। গন্তব্য স্থির করতে করতে আযান দিয়ে দিলো। আলম তার হাতের ঘড়ির দিকে তাকালো। দুপুর একটা বাজে – যোহরের আযান দিচ্ছে। অনেক দিন নামাজ পড়া হয়না। সামনেই মসজিদ – নামাজটা পড়ে ফেলা যায় নাকি? তারপর নাহয় প্রকাশনী যাওয়া যাবে? আপাতত নামাজ পড়ার লক্ষ্যেই আলম মসজিদের দিকে পা বাড়ালো।
০৩।
সুধা বুকশেলফ থেকে একটা বই হাতে নিয়েছে। বইয়ের প্রচ্ছদের রঙ নীল – সেখানে একটা মৎসকন্যা মৃদু হাসি নিয়ে পাথরের উপর বসে আছে। পাথরের চারপাশ ঘিরে রেখেছে নীল রঙা সমুদ্র। মৎসকন্যার গায়ের রঙ রূপালী, চুলের রঙ বাদামী, চুলগুলো কোঁকড়া। মৎসকন্যার ছবির পাশেই বড় বড় করে বইয়ের নাম লিখা – ঊর্মিকে খুঁজবো বলে। তার নিচে একটু ছোট হরফে আলমের নাম লিখা – বখতিয়ার আলম। এটা আলমের পুরো নাম না, লেখক নাম। আলমের সার্টিফিকেট নাম – মোহাম্মদ বখতিয়ার উদ্দীন আলম। লেখক অনুকূল একটা ভাব আনতে আলম নিজের নামের অর্ধেক অংশ ছেঁটে ফেলে ‘বখতিয়ার আলম’ করেছে। দু’পৃষ্ঠা পড়া শেষ হতেই রান্নাঘর থেকে প্রেশারকুকারের সিটির আওয়াজ শোনা গেল। সুধা মনে মনে প্রেশারকুকারের সিটির সংখ্যা হিসাব করা শুরু করলো। একটা সিটি পড়লো কেবল – সাত নাম্বার সিটি পড়লে প্রেশারকুকার চুলা থেকে নামিয়ে রাখতে হবে। প্রেশারকুকারে গরুর মাংস চড়িয়ে দিয়েছে সুধা। আবার বইয়ের মাঝে ডুবে গেল সে।
এটা আলমের এবারের বইমেলায় বের হওয়া উপন্যাস। একটা সময় আলমের লেখা সব উপন্যাসের পান্ডুলিপি সর্বপ্রথম পড়তো সুধা। পড়ার পর নিজের অভিব্যক্তি, মতামত ব্যক্ত করতো আর আলম মন দিয়ে শুনতো সেগুলো। এখন আলমের আর সেসবের সময় হয় না – অনেক চাপে থাকে সে। নির্দিষ্ট সময়ের মাঝে বেশক’টা পান্ডুলিপি জমা দিতে হয় তার – তাই পান্ডুলিপির সর্বপ্রথম পাঠক প্রকাশকই হয়। সুধা মাঝেমাঝে চিন্তা করে – আলমের ব্যস্ততা তার সেই প্রথম স্থান কেড়ে নিয়েছে নাকি আসলে তার অভিব্যক্তি ও মতামত গুরুত্ব হারিয়েছে! সঠিক কারণটা বের করতে পারে না সে। তিন নাম্বার সিটি পড়লো – মনেমনে গুণছে সুধা।
উপন্যাসটার কেন্দ্রীয় চরিত্র একটা মেয়ে। মেয়েটার নাম ঊর্মি। পঞ্চম পৃষ্ঠায় এসে বোঝা গেল – ঊর্মির একজন চাহনেওয়ালা আছে, নাম হারূন। ঊর্মি একটা এনজিওতে চাকরি করে, হারূন তার সহকর্মী সেখানে। তারা দুজনেই কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা-ক্যাম্পে কর্মরত। দুজনের মাঝেই আছে উষ্ণ বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক। হারূন উর্মির প্রতি নিজের ভালোবাসা সরাসরি প্রকাশ করতে পারেনা, ওদিকে ঊর্মিও টের পায়না হারূনের অনুভূতি। মেয়েদের নাকি তৃতীয় নয়ন আছে, যে নয়নে ছেলেদের সব মতি-গতি, হাব-ভাবই দৃষ্টিগোচর হয় – এমনটা শুনেছিল হারূন। কিন্তু ঊর্মির তৃতীয় নয়নে মনে হয় ছানি পড়েছে, তাই হারূনের ছায়াও ধরতে পারে না সে নয়ন – চিন্তা করে হারূন।
সুধার উপন্যাসটা পড়তে ভালোই লাগছে – আলম যে থ্রিলার ঘরানার উপন্যাস লেখা ধরেছে জানতো না সে। আলমের লেখার চৌম্বকত্বও আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। প্রেশারকুকারের পাঁচ নাম্বার সিটি পড়লো – বই পড়তে পড়তে এক কান খাড়া করে শুনছে সুধা। নবম পৃষ্ঠায় এসে পড়েছে সে – এ পৃষ্ঠায় এসে ঊর্মি মেয়েটা হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গেলো। পুলিশ, র্যাব সবাই ওকে খুঁজতে তৎপর – কিন্তু কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছেনা ওর। হারূনও নাওয়া-খাওয়া ভুলে ঊর্মির খোঁজে নেমে পড়েছে – ও খুঁজছে একাই। পড়তে পড়তে সুধার রোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে উত্তেজনায় – উত্তেজনা বেশি সহ্য করতে পারেনা সে। প্রেশারকুকারের ছয় নাম্বার সিটি পড়লো। ছোটবেলা থেকে উপন্যাসের উত্তেজনাকে সহ্যশীল করে নিতে একটা পদ্ধতি অবলম্বন করে সুধা – এখন সে সেটাই করবে। বইয়ের শেষের তৃতীয় পৃষ্ঠা খুলে বসলো সুধা – উপন্যাসের শেষটা জেনে নিলেই উত্তেজনার পারদ নেমে যাবে। পড়ায় মন দিলো সে। ঊর্মিকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যায় রোহিঙ্গাক্যাম্পের কিছু শরণার্থী। বান্দরবানের নির্জন এক পাহাড়ের গায়ে আস্তানা গাঁড়ে তারা। মুক্তিপণ হিসেবে তাদের দাবি ছিল নগদ এককোটি টাকা আর একে৪৭, এম৪ এসাল্টগান ও রিমোট এক্সপ্লোসিভে সজ্জিত তিনটি বাক্স। তাদের এমন অবান্তর ধ্বংসাত্বক আবদার কেউ মেনে নেয়নি। হারূনের জোগাড় করা তথ্যের ভিত্তিতে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও র্যাবের যৌথ অভিযানে পাকড়াও হয় কিডন্যাপারদের তিনজন আর মারা পড়ে পাঁচজন। ঊর্মিকে উদ্ভার করা হয় আহত অবস্থায়। কিডন্যাপারদের নির্যাতনে ঊর্মির মস্তিষ্ক আঘাতপ্রাপ্ত হয়। ওকে হাসপাতালে ভর্তির পর জানা যায় ওর স্মৃতির একাংশ চিরতরে হারিয়ে গেছে – যে অংশে ছিল ওর বড়বেলা অর্থাৎ যৌবনকাল। হাইস্কুলপড়ুয়া কিশোরীর স্মৃতি নিয়ে হাসপাতালের বেডে চোখমুদে শুয়ে আছে যুবতী ঊর্মি। মাথায় সাদা একটা ব্যান্ডেজ প্যাঁচানো; ওর রোদেপোড়া শ্যামলামুখটা শুকিয়ে চিমষে গেছে। ওকে ঘিরে বসে আছে ওর পরিবারের উদ্দিগ্ন আত্মীয়-স্বজন। হারূন রুমের জানালা দিয়ে ঊর্মিকে দেখছে। একটা চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে সে – ঊর্মিকে বিয়ে করবে সে।
প্রেশারকুকারের সাত নাম্বার সিটি পড়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগে; আট নাম্বারটা পড়লো এবার। উপন্যাসের শেষটা পড়ে খুব ভালো লাগছে সুধার – উত্তেজনার পারদ নিচে নেমে গেছে ওর। বইটা বুকশেলফে ঢুকিয়ে রেখে রান্নাঘরে ছুটলো সে। একটা সিটি অতিরিক্ত পড়েছে – প্রেশারকুকারটা চুলা থেকে নামিয়ে রাখতে হবে এক্ষণি।
০৪।
আলম হাঁটতে হাঁটতে শাহবাগে এসে পৌঁছেছে। বিকাল সাড়ে ৪টা বাজে – রোদের ধাঁচ কমছে ধীরে-ধীরে। ঠিক কাঁটায় কাঁটায় বিকেল ৫টা বাজলেই রোদের তেজ একদম পড়ে যাবে। রোদটা হয়ে যাবে সোনালী এবং মিষ্টি – জুলাইয়ের রোদের বৈশিষ্ট্য এটা। মাথাটা ঘুরছে আলমের – দুপুরভর কড়া রোদ মাথায় নিয়ে হাঁটার ফল এটা। কপাল দিয়ে ঘাম ঝরছে অনবরত; হাফহাতা শার্টটা ঘামে ভিজে চুপচুপ করছে। আধাঘন্টা হচ্ছে – প্রজাপতি প্রকাশনীর প্রকাশক সেলিম খানের বাসা থেকে বের হয়ে হাঁটা দিয়েছে সে। সেলিম সাহেবের বাসায় এসির বাতাসে যতটুকু ঠান্ডা হয়েছিল সে, বাইরে রোদের মধ্যে পাঁচমিনিট হেঁটেই তা ঘাম দিয়ে বরফগলার মত ঝড়ে পড়েছে। মনটা বেজার হয়ে আছে আলমের। বেজার মন নিয়ে ছয় নাম্বার বাসের জন্য অপেক্ষা করছে সে। সেলিম সাহেব এডভান্স কোন টাকা দেননি বরং আল্টিমেটাম বেঁধে দিয়েছেন – দু’দিনের মধ্যে পান্ডুলিপি জমা দিতে হবে নাহলে, এবছর আর হচ্ছে না সেটা প্রকাশ করা। বাসায় যেয়েই লিখতে বসতে হবে – উপন্যাসটার কাহিনী অর্ধেকে এসে থমকে আছে। আজ সারারাত, কাল সারাদিন লিখে শেষ করতে হবে বাকি অর্ধেকটা। লেখার চাপে বেশ কিছুদিন হচ্ছে সুধার সাথে কথা বলার সুযোগ হয়ে উঠছেনা আলমের। গতপরশু হাসানের চিঠিটা দেয়ার সময় খুব আহত দেখাচ্ছিল সুধাকে – লক্ষ্য করেছে আলম। পান্ডুলিপির কাজটা শেষ করে সুধাকে সময় দিতে হবে, অনেক কষ্ট পাচ্ছে মেয়েটা। সুধাকে নিজের বর্তমান অবস্থাটাও খুলে বলবে – ঠিক করেছে আলম। বছর দু’য়েক আগের জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা লেখক বখতিয়ার আলম অনেকাংশেই তার জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। পাঠককুলের উর্ধ্বমুখী চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে আলম। তার সাম্প্রতিককালের সব লেখা একই-টাইপ হয়ে যাচ্ছে; ঐ ঘুরে-ফিরে একই পরিসমাপ্তি! লেখায় ভিন্নতা আনতে এক বছর হলো থ্রিলার লিখা শুরু করেছে আলম। কাহিনীগুলোয় নতুনত্ব আনতে একাকী চিন্তারজগতে ডুবে থাকতে হচ্ছে রাতভর। প্রকাশনীর প্রকাশকরা বইবিক্রির নিম্নগামী গ্রাফে খুব নাখোশ আলমের উপর – তারা চাপ বাড়িয়ে চলেছে ক্রমশ। আলম শুধু অপেক্ষায় আছে একটা হিট উপন্যাসের জন্য – এর জন্যই এত মেহনত। একটা উপন্যাস হিট করলেই আলম তার পায়ের তলে হারিয়ে যাওয়া জমিন ফিরে পাবে; নির্ঘুম রাতগুলোকে আলিঙ্গন করবে সার্থকতা!
বাস এসে গেছে – ছুটে যেয়ে হুড়মুড়িয়ে বাসে উঠছে মানুষ। আলম অন্যমনষ্ক হয়ে চিন্তা করছিল, তাই বাসের আসাটা টের পেল একটু দেরিতে। ততক্ষণে বাসের দরজায় বিশাল ভিড় লেগে গেছে মানুষের। আলম এগিয়ে গেল সেই ভিড়ের দিকে – কোনমতে ভিড়ের ফাঁকফোকর দিয়ে চেপ্টা হয়ে উঠে যেতে হবে বাসে। আলম ভিড় ঠেলে বাসের কাছাকাছি পৌঁছাতেই বাস টান দিল ড্রাইভার। দরজায় হেল্পারের সাথে দু’জন ঝুলতে ঝুলতে উঠে গেল। আলম বাসের সাথেসাথে খানিক দৌড় লাগিয়ে দরজার হ্যান্ডেল ধরে ডান পা-টা উঠিয়ে দিয়েছে দরজার পাটাতনে। আরেকটা পা উঠিয়ে দিতে যাবে, এমন সময় দরজার সামনে থাকা একজনের কনুই লেগে হ্যান্ডেলধরা হাতটা ফসকে গেল তার। চলন্ত বাস থেকে পড়ে যেতে যেতে আলমের চোখের সামনে হঠাৎ ভেসে উঠলো সুধার আহত হওয়া মুখ। আলমের কানে আসা আশেপাশের মানুষের চিৎকারগুলো একমূহুর্তের মাঝে ভোঁভোঁ শব্দে রূপান্তরিত হলো। তারপর মাথার মাঝে দপ করে একটা ব্যথা উঁকি দিয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়লো। চারপাশটা গ্রাস করে নিল ঘন অন্ধকার।
০৫।
সুধা ঢাকা মেডিকেলের মর্গে দাঁড়িয়ে আছে। পুরো শরীর কাঁপছে তার। সামনে স্ট্রেচারের উপর একটা মাথা থেঁতলে যাওয়া লাশ শুয়ে আছে। আলমের লাশ। সুধা শুধু একবার ফুঁপে উঠে জ্ঞান হারালো – পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নার্স সুধার ঢলে পড়া শরীর জাপটে ধরে সামলালো। আলমকে আর বলা হয়ে উঠলো না সুধার যে সে একমাসের অন্তসত্ত্বা।
০৬।
একুশে বইমেলার এগারোতম দিন আজ। ফেব্রুয়ারীর শীত-শীত আবহাওয়া ঠেলে আকাশ থেকে বিকেলের সোনারঙা মিষ্টি রোদ ঠিকরে পড়ছে। অনাবিল প্রকাশনীর স্টলের সামনে পাঠকদের উপচে পড়া ভিড়। জনপ্রিয় বখতিয়ার সিরিজের নতুন বই প্রকাশ পাচ্ছে আজকে। মোড়ক উন্মোচনের জন্য খানিক আগে স্টলে এসে উপস্থিত হয়েছে স্বয়ং লেখক – হারূন-উর-রশিদ। বর্তমানে দেশের সেরা থ্রিলার রাইটার মানা হয় তাকে। অল্প বয়সেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠেছে হারূন-উর-রশিদ – প্রতিষ্ঠা করেছে বখতিয়ার নামের এক তুমুল পাঠকপ্রিয় গোয়েন্দা-চরিত্র। তার উপস্থিতিকে কেন্দ্র করেই স্টলঘিরে উপচে পড়েছে পাঠক-সম্প্রদয়ের ভিড়। মোড়ক উন্মোচনের পরও বেশ কিছুক্ষণ সময় থেকে অটোগ্রাফ-শিকারীদের বইয়ে অটোগ্রাফ দিবে সে।
খানিক দূর থেকে স্টলের সামনে জটলাবাঁধা ভিড়ের দিকে তাকিয়ে আছে এক বয়ষ্ক ভদ্রলোক। মাথায় সুবিশাল টাক, গাল-ভর্তি শুভ্র-সাদা লম্বা দাড়ি। ভদ্রলোকের নাম হাসান মাহমুদ। চোখ থেকে মোটা ফ্রেমের চশমাটা খুলে নিয়ে রুমাল দিয়ে মুছতে মুছতে ভাবছেন তিনি – আলমের ছেলেটা দেখতে অবিকল তার মতই হয়েছে। চশমাটা আবার চোখে দিয়ে স্টলের ভিড়ের দিকে এগোতে থাকলেন তিনি – একটা বই কিনবেন হারূনের। নিজের মনকে প্রশ্ন করলেন তিনি – আচ্ছা, ছেলেটার লেখাতেও কি আলমের লেখার ছাপ পাওয়া যাবে?
শাহরিয়ার বিশাল ও মুস্তাকীম মোর্শেদ