আমাদের মত ইতিহাস বিমুখ জাতি এই মর্ত্যে আরও আছে কিনা তা রীতিমত গবেষণার বিষয়। নিজের জাতি নিয়ে আমরা এ কারনেই সব সময় হীনমন্যতায় ভুগি। কারন আমরা জানিই না কিছু। প্রাচীন ইতিহাস বাদ। যে ইতিহাসে আছে এই বাঙ্গাল মুল্লুকে বাইরের কোন শাসক কেউ কোন দিন শাসন করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে পারে নাই। এত প্রতাপশালী যে আকবর ছিল তার আমলেও বাংলা ছিল উত্তাল। যাকে শাসন করার জন্য পাঠানো হয়েছে সে এসেই উল্টা বিদ্রোহ করে বসে আছে! বাংলার হাওয়া বাতাসে কিছু আছে না হলে এমন হবে কেন? সে ইতিহসের কথা বাদ রাখতে বললাম কারন অতো আগের না আমরা আমাদের খুব কাছের ৪০ বছরের ইতিহাসই পরম যত্নে ভুলে বসে আছি। আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি একটা প্রজন্ম বড় হয়ে গেছে যাদের বিন্দু মাত্র ধারনা নাই ৭৫ সালে আসলে কি ঘটেছিল, ৭৭ সালে দেশে আসলে কি ঘটে ছিল, ৮১ সালের কি ইতিহাস? এরশাদ আসলে কি করেছিল যে তাকে গন আন্দোলনের মাধ্যমে নামাতে হল? জানার আগ্রহ নাই কিভাবে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা কিভাবে দেশের বাইরে চলে গেলো।খুনিরা তো মুক্তিযোদ্ধা ছিল তারা বঙ্গবন্ধু কে মারল কেন? তারা নাকি মুক্তিযোদ্ধা ছিল? এই তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধের কোন সময় যোগ দিয়েছিল জানার ইচ্ছাও নাই কারো। জানার ইচ্ছা করে না গোলাম আজম দেশের বাইরে কবে গেলো ফিরলই বা কিভাবে? জানতে চায় না কাদের কে দেশদ্রোহীর অপবাদ নিতে হয়েছিল রাজাকারদের বিচার চাওয়ার কারনে। কারা এই অপবাদ দিয়েছিল! আমার জেনারেশনের অর্ধেকেরও ( অর্ধেক বললাম হাতে রেখে, আসলে এর পরিমান আরও অনেক বেশি ) বেশি মানুষ জানে না আসলে কি হয়েছিল এই গত চল্লিশ বছরে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে জানার কোন আগ্রহই নাই কারো। এই বিপুল জনগোষ্ঠী যতটুকু জানে তার বেশির ভাগ জানাই হচ্ছে নিউজ পেপার আর টিভি টক শো। পত্রিকায় একটা তথ্য দিলে তার সঙ্গে যে রেফারেন্স দেওয়া থাকে তার ব্যাপারে কোন আগ্রহ নাই। আর টক শোর বেলায় তো কথাই নাই, যার মনে যা চাচ্ছে তাই বলে যাচ্ছে কেউ কোন রেফারেন্স দিচ্ছে না, কেউ চাচ্ছেও না। এই জ্ঞান নিয়ে নিজের শিকড়ের সন্ধান পাওয়া যাবে? জীবনেও না। তাই সহজেই আমাদের দেশে ইতিহাস বিকৃতি করা যায়। যার যেমন ইচ্ছা ইতিহাস বানিয়ে ফেলা যায়। যেহেতু নিজের কোন ধারনা নাই নিজের জাতির ইতিহাস সম্বন্ধে তাই যে দল কে পছন্দ করি তার নেতারা যা বলছে তাতেই মাথা দুলিয়ে চলছি আমরা।
এই অবস্থা সৃষ্টির প্রধান কারন হচ্ছে বই না পড়া। বই পড়া যে আশংকাজনক ভাবে কমে গেছে তা বোধহয় আমাদের কর্তা ব্যাক্তিদের মাথায় এখনও ঢুকে নাই। বই পড়ার লোক নাই আর ইতিহাস পড়ার লোকতো আরও নাই। একটা সময় পর্যন্ত দেখছি পাবলিক লাইব্রেরিতে মানুষ বই পড়ছে, বই নিয়ে বাড়ি যাচ্ছে কিন্তু দিন দিনই এর সংখ্যা কমে আসছে। যত দিন যাচ্ছে ততোই কমে আসছে। জানার জন্য পড়া এখন বোধহয় বাংলাদেশে আর নাই, যতটুকু আছে তা হচ্ছে চাকরির জন্য পড়া। চাকরি প্রত্যাশিতদের ভিড়ে লাইব্রেরীতে জায়গা পাওয়া মুশকিল। যাদের এক সময় পড়ার অভ্যাস ছিল তারাও এখন পড়ে না। বললে বলে সময় পায় না বা চাকরির পড়াশোনা নিয়ে ব্যাস্ত!! হাসি আসে শুনে। এরা ভাত খাওয়ার সময় পায় তো? কিংবা ঘুমানোর? চকচকে কাঠের বুক সেলফ আছে তাতে ঝকঝকে বই আছে কিন্তু পড়ার কেউ নাই! এদের সাথেই বই চালাচালি করে বই পড়তাম এক সময় কিন্তু হায়! এখন শুধু চালাই আছে চালাচালি আর হয় না, মানে আমি খালি বই দিয়েই যাই বই আর কারো কাছ থেকে নিয়ে পড়তে পারি না। বই না পড়া বা ইতিহাস বই না পড়ার কারনেই আজকে কেউ কেউ ত্রিশ লক্ষ না তিন লক্ষ শহীদ হয়েছিল বলে প্রশ্ন তুলতে পারে। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ চায় নাই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিল ধরনের মন্তব্য করার সাহস করে। সাহস পায় কারন যারা বলে তারা জানে এদের যা বলা যাবে তাই বিশ্বাস করবে। যে উনার বিপক্ষে সে কিছু না জেনেই এর বিরোধিতা করবে আর যে উনার পক্ষে, আবার জিগায়...। ইতিহাস কে নিজের মত করে বলেই দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছে। মানুষ এদের কে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। এই ইতিহাসবিদরাই এতদিন পড়িয়েছে শেখ কামাল ব্যাংক ডাকাত ছিল, মেজর ডালিমের বউ কে তুলে নিয়ে গেছে ধরনের কথা। আর আমাদের ইতিহাস বিমুখ জাতি তাই বিশ্বাস করে আসছি। যে ব্যাংক ডাকাতির কথা বলা হয় সে ব্যাপারে পরের দিন পত্রিকাতে কি লেখা হয়েছিল বা যে সাংবাদিক নিউজ করে ছিলেন সে তার বইয়ে কি বলে গেছেন তা একটু দেখার সময় আমাদের হয় না। একটু খোঁজ নিয়ে দেখি নাই যে বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে মেজর ডালিমের বউকে তুলে নিয়ে গেছে বলে প্রচার করা হয়েছে সেই বিয়েতে আদৌ তিনি গিয়েছিলেন কিনা? বা এই ব্যাপারে মেজর ডালিম তার নিজের বইয়ে কি লিখে গেছেন। বই পড়ার সময় কই আমাদের!
যাই হোক, যেটা বলছিলাম ইতিহাস জানবে কিভাবে যেখানে বই পড়ার মানুষই কমে যাচ্ছে দিনদিন।বই মেলায় কত মানুষ বই কেনে আর কত মানুষ ধুলা বাড়াতে যায় তা একটা প্রশ্নই বটে। তবে যত বই বিক্রি হয় ততো বই যে পড়া হয় না সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই। তা না হলে দেশে এত অন্ধকার থাকে? গত বই মেলার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের এক সাক্ষাৎকার শুনছিলাম। সেখানে তিনি বলেছেন ‘এখনকার জেনারেশন বই পড়ে না, যে কয়জন পড়ে বলে মনে হয় তাদের বেশিরভাগ যত না পড়ে তারচেয়ে ভান করে বেশি।’ বর্তমান সময় সম্পর্কে এটাই মনে হয় এক্কেবারে খাটি কথা ।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:৩০