কলঙ্কের বোঝা
মূলভাবনা-
রিয়াসাদ আজিম শাতিল
দীপংকর দত্ত পার্থ
নাট্যরূপ-
রিয়াসাদ আজিম শাতিল
চরিত্রাবলিঃ
১।আসাদ
২।আসাদের মা (শহীদ জননী)
৩।দবির
৪।ওসমান ফারুকি
৫।বদরুল
৬।সাত্তার
দৃশ্য-১
(১৯৭১ সাল।মে মাস।শহরতলীতে যুদ্ধ শুরু হয়েছে।পল্লীগ্রাম শ্যামপুর এ যুদ্ধ এর আঁচ এখনও লাগেনি।এই গ্রামের এক ছেলের নাম আসাদ।তার পরিবার বলতে শুধু তার মা।হঠাৎ একদিন খবর পাওয়া যায় গ্রামে পাক-সেনার আগমন।সেদিন সন্ধ্য্য চুলার পাশে বসে ছেলেকে মুখে তুলে ভাত খাওয়াচ্ছেন মা।)
মাঃহুনলাম গ্রামে নাকি মিলিটারি ঢুকছে!
আসাদঃআমগো ছাত্তার চাচা তো তাই কইলো।
মাঃহুনছি ওরা নাকি গ্রামের বেবাক পোলাপানগো ধইরা নিয়া যাইতাছে?
আসাদঃকইলেই হইল?আরে আমগো দেশে আইয়া আমগো লগে এই রকম করতে পারে?তুমিও না মা,যা হুনো তাই বিশ্বাস কর।
(দৌড়াতে দৌড়াতে পাশের বাড়ীর দবিরের আগমন)
আসাদঃকী হইছে?এত অস্থির লাগতেছে কেন তোরে?
দবিরঃওই পাড়ায় মিলিটারি আইছে।ওরা নাকি সব জ্বালায় পোড়ায় দিছে।সাত্তার চাচা গ্রামের সব পোলাপানরে ডাকছে।তোমারে আমি নিতে আইলাম।
মাঃসব পোলাপানরে ডাকছে ক্যা?
দবিরঃচাচী যুদ্ধ করন লাগব।দেশ স্বাধীন করন লাগব।
মাঃতা আসাদরে দিয়া তোমগো কি কাম?
দবিরঃচাচী আসাদ ভাই ও আমগো লগে যুদ্ধ করবো।যাইবা না আসাদ ভাই?দেশ স্বাধীন হইব না?
আসাদঃযামু না ক্যা?অবশ্যই যামু।দেশ স্বাধীন হইবই।
মাঃনা।আসাদ যাইব না।দেশের গন্ডগোল দেশের মাথারা থামাইব।ওরে টাইনো না।আমি ওরে যাইতে দিমু না।
(দবির হতাশ ভঙ্গিতে আসাদের দিকে তাকায়।আসাদ কিছুই বলে না।মুখটা নিচু করে দাড়িয়ে থাকে।দবির চলে যায়।)
দৃশ্য-২
(ঘুমিয়ে পরেছে পুরো গ্রাম।ঘুম নেই আসাদের চোখে।হঠাৎ উঠে বসে সে।সিদ্ধান্ত যা নেয়ার নিয়ে ফেলে।মায়ের পায়ে সালাম করে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।চলে যায় সাত্তার চাচার বাড়ী।সেখানে গিয়ে সে অবাক হয়।তার বয়সী চেনা অচেনা ছেলেরা সাত্তার চাচাকে ঘিরে বসে আছে।মনযোগ দিয়ে সবাই শুনছে সাত্তার চাচার কথা। )
সাত্তার চাচাঃআরে তুমি?তোমার মা তোমারে আইতে দিল?
আসাদঃমা জানে না।পলায় আইছি চাচা।দেশ রক্ষা না করতে পারলে কোন মুখে আমরা মা রে “মা” কইয়া ডাকমু?
(সাত্তার চাচা কিছু বলে না।তবে তার মুখের ভাব দেখে বোঝা যায় তার অন্তর ও একই কথা বলে)
সাত্তার চাচাঃএখন কি করতে চাও?
আসাদঃচাচা আপনের দলে যোগ দিবার চাই।যুদ্ধ কইরা দেশ স্বাধীন করবার চাই।আমারে আপনের দলে লইয়্যা লন চাচা।
দৃশ্য-৩
(নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে রাজাকার ওসমান ও তার চামচা বদরুল।দুর থেকে স্টীমারের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।)
বদরুলঃওস্তাদ,অই যে উনাদের আসার আওয়াজ পাওয়া যায়।
ওস্তাদঃউনারা আইয়া পড়ছে,আমগো আর কোন চিন্তা নাই।দেশের সব গন্ডগোল উনারা থামায় ফেলবেন।নাফরমান মালাউনগো লগে যে সব মুসলমান পোলারা লাফালাফি করতেছে ওগোও একটা শাস্তি হওয়া দরকার।
(পাড়ে এসে স্টীমার থামে।পাকিস্তানী কিছু সেনা স্টীমার থেকে নামে।পাক-দলনেতা সবার সামনে হাঁটে)
পাক-দলনেতাঃওসমান কৌন হ্যা?
ওসমানঃহুজুর আমি ওসমান হু।
পাক-দলনেতাঃঠিক হ্যা।ইস গাঁও ম্যা কই মুক্তি হ্যা?
ওসমানঃকুছ কুছ হ্যা।আপনে চিন্তা মাত করবেন।ওগোরে আমিই দেইখা নিতে পারমু।
পাক-দলনেতাঃওকে।হাম শুনা হ্যায় ইস গাঁও ম্যা খুবসুরাত আওরাত আছে।
ওসমানঃহুজুর,রাতেই সব দেখতে পারবেন।খালি আপনে পছন্দ কইরা দিবেন।বাকী কাজ আমার।এখন চলেন যাই।
দৃশ্য-৪
(রাইফেল কাঁধে মায়ের সাথে দেখা করতে এসেছে আসাদ।দুজনের চোখেই পানি।)
মাঃবাবা,কেমন আছিস?আমারে একলা ফালাইয়া তুই ক্যান চইলা গেলি?এবার আর তোরে যাইতে দিমু না।
আসাদঃমা,তুমি আমার মা,কিন্তু এই দেশ বেবাক মানুষের মা।সেই মা রে আমরা কেমনে পাকিস্তানীদের হাতে তুইলা দিমু?
মাঃআমি কিছু জানিনা,শুধু জানি এবার আর তরে আমি যাইতে দিমু না।
(দরজা ভাঙ্গার আওয়াজ পাওয়া যায়।ওসমানের সাথে চার মিলিটারী আসাদ এর সামনে আসে।)
ওসমানঃএইতো সোনার চাঁদ পিতলা ঘুঘু তোমারে পাইছি।যুদ্ধ করবা?দেশ স্বাধীন করবা?
মাঃআমার ছেলেডারে তোমরা মাইরো না।দোহাই লাগে তোমগো,মাইরো না।ও আর যুদ্ধে যাইব না।
ওসমানঃতাইলে ক,পাক সার জমিন সাদ বাদ।(পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত)
আসাদঃনা কমু না।জীবন থাকতে কখনই কমু না।
ওসমানঃকবিনা মানে?(মিলিটারীদের দিকে তাকিয়ে)-স্যার এ মুক্তি হ্যা।
(গুলির শব্দ পাওয়া যায়।আসাদের নিথর দেহ পরে থাকে।মা যেন পাথর হয়ে যায়।তার চোখে কোন জল নেই।)
দৃশ্য-৫
(২০১১ সাল।রাস্তা দিয়ে বিভ্রান্ত চোখে ভিক্ষা করছে আশি বছরের এক মহিলা।চোখে ভালো দেখে না।ইনি আসাদের মা।শহীদ জননী।সে এক নুরানি চেহারার লোকের কাছে ভিক্ষা চাইতে গেলো।সে বাংলাদেশের একজন এম,পি।পুলিস মহিলাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল।মহিলা চোখে ভালো দেখলে ঠিক ই বুঝতে পারত নুরানি চেহারার লোকটি ওসমান ফারুকি।তার ছেলের হত্যাকারী।শ্যামপুরের সেই রাজাকার ওসমান।)
নেপথ্যেঃযার সন্তান দেশের জন্য জীবন দিয়েছে,জাতি তাকে কিছুই দিতে পারেনি।কিন্তু তার সন্তানের হত্যাকারীকে জাতি তাদের মাথা হিসাবে মেনে নিয়েছে।চল্লিশ বছর পর হয়তবা এটাই আমাদের দেখার ছিল।নাম না জানা কত আসাদের মা শহরের রাস্তার অলিগলিতে ভিক্ষা করে,তা আমাদের জানা নেই।কিন্তু এতটুকু জানি,জাতি হিসাবে এর চেয়ে বেশি লজ্জা আর হতে পারেনা।চল্লিশ বছর ধরে এই কলঙ্কের বোঝা নিয়ে আমরা ঘুরছি।আর কতকাল এই কলঙ্ক নিয়ে আমাদের ঘুরতে হবে?

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





