(আমি আমার জীবনে একজন মহাত্মার সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়েছিলাম। তার সাথে আমার অনেক কথোপকথন হয়েছিল। সেখান থেকেই একটি আলোচনা একটু বিস্তারিত আকারে লিখে রেখে দিলাম)
মানুষ যখন মরে যায়, তখন তার ভাগ্য বা নিয়তি বলে কিছু থাকে না। ধর্মীয় মতে, নিয়তি অবশ্য আছে কিন্তু তার কোন প্রমাণ আমরা এখনও পাইনি। তাছাড়া যে মানুষটা মারা গেল, সে স্বর্গ বা নরক যেখানেই যাক না কেন, আমাদের এই পার্থিব জীবনের উপর তার আর কোন প্রভাব নেই। বৈজ্ঞানিকভাবে মাটির সাথে তার মিশে যাওয়া দেহ বা পুড়ে যাওয়ার পর পরিবর্তিত উপাদানের কোন প্রভাব আমাদের এই পৃথিবীর উপর থাকলেও আমাদের সাথে তার প্রত্যক্ষ কোন যোগাযোগ নেই। আবার হয়তোবা তার রচনাবলী, আবিষ্কার, মতামত, উপদেশ আমাদের জীবনে পরোক্ষভাবে প্রভাব ফেলতে পারে কিন্তু মৃত ব্যক্তির নিজের কোন ভাগ্য বা নিয়তি বলে আর কিছু থাকে না বা থাকলেও তা আমাদের গোচরের বাইরে।
তাহলে ভাগ্য বা নিয়তি শুধুমাত্র জীবিত প্রাণীর বেলাতেই প্রযোজ্য। আমরা অনেকেই মনে করি ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত যেমন - কপালের লিখন, যায় না খণ্ডন। আবার আমরা অনেকেই মনে করি যে, আমাদের ভাগ্য আমরাই তৈরি করি। আসলে ভাগ্য বা নিয়তি কি? ভাগ্য কি দেখা যায়? আমরা যদি ভাগ্যকে দেখতে চাই বা দর্শনযোগ্য করে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই, তাহলে এটাকে কতগুলো ক্রিয়া ছাড়া কিছুই বলতে পারিনা। ধরা যাক, আমি রাস্তায় হঠাৎ করেই এক কোটি টাকার একটি ব্যাগ পেলাম। আমি যখন টাকার ব্যাগটি তুলে নিলাম তখন এটি একটি ক্রিয়া। রাস্তায় কেউ টাকার ব্যাগটি ফেলে রেখেও একটি ক্রিয়াই করেছে। এই ক্রিয়াই হল ভাগ্য। রাস্তায় টাকার ব্যাগ কেউ সজ্ঞানে বা ভুলে ফেলে না রাখলে আমি পেতাম না বা আমি টাকার ব্যাগ রাস্তা থেকে গোপনে তুলে না নিলে ব্যাগটি আমার হোত না। তাহলে ভাগ্য বা নিয়তি ক্রিয়ার মাধ্যমেই প্রকাশ পায়।
তাহলে ক্রিয়া কি? ক্রিয়া কেন ঘটে? পৃথিবীর সবকিছুই কর্ম বা ক্রিয়া। একটি ক্রিয়া আবার আরেকটি ক্রিয়া ঘটায়। আমি ফেসবুকে বা পত্রিকার পাতায় হতাহতের সংবাদ পড়ি বলেই আমার মন খারাপ হয়, আহত হই, তারপরে আমি আমার ক্ষোভকে নানাভাবে প্রকাশ করি। যদি আমি সংবাদ না পড়তাম, তাহলে মন খারাপ হোত না, মনের ক্ষোভকে প্রকাশ করার দরকারও হোত না। আবার একটু বড় আওতায় বলা যায়, আমি খাওয়া-দাওয়া করি বলেই বর্জ্য ত্যাগ করতে হয়। আবার একজনের ক্রিয়া অন্যজনকে (অন্যজনের ক্রিয়াকে) প্রভাবিত করতে পারে বা অন্যের (অন্যের ক্রিয়া) দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। যেমন ধরা যাক, আমি অফিস শেষে বাসায় এসে আমার স্ত্রীকে বললাম, রাতের খাবার তৈরি কর বা টেবিলে দাও। আমি আমার স্ত্রীকে রাতের খাবার দিতে অনুরোধ (অনেকে আদেশও করতে পারেন) করলাম। আমি আমার স্ত্রীকে রাতের খাবার তৈরি করার অনুরোধ করে একটি ক্রিয়া ঘটালাম। ধরা যাক, আমার স্ত্রী আমাকে ভালোবেসে গদগদ হয়ে রাতের খাবার তৈরি করা শুরু করে দিল বা টেবিলে খাবার সাজানো শুরু করে দিল। আমার স্ত্রীও একটি ক্রিয়া করছে (ঝগড়া করেও ক্রিয়া ঘটানো সম্ভব!) । তাহলে একজনের একটি ক্রিয়া দ্বারা আরেকজন মানুষের আরেকটি ক্রিয়া তৈরি হচ্ছে অর্থাৎ দুটি ক্রিয়া হচ্ছে দুটি মানুষের মধ্যে। মানুষ চাইলেই শুধুমাত্র নিজের ক্রিয়ার মাঝে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। আরেকজন মানুষ, পরিবেশ ইত্যাদি দ্বারা নিজের ক্রিয়া প্রভাবিত হবেই বা অন্যকে প্রভাবিত করবেই। ঠিক যেন, “ইনসেপশন” মুভিটির মতো। আমি একটি স্বপ্ন তৈরি করলাম এবং ভাবলাম যে, স্বপ্নটি যেভাবে তৈরি করেছি সেভাবেই চলবে। কিন্তু স্বপ্নটি সেভাবে নাও চলতে পারে, আমার স্বপ্নের মাঝে আমাকে না জানিয়েই অন্যের তৈরি করা একটি স্বপ্ন চলে আসতে পারে বা আসবে। এটাকেই কি আরেকভাবে ভাগ্য বলা যায় না? ধরা যাক, আমি সকাল ৭ টায় অফিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। স্বাভাবিক ট্রাফিক থাকলে আমি ৪৫ মিনিটে অফিসে পৌঁছে যাব। মাঝপথে দেখি বিরাট একটি চেইন এক্সিডেন্ট এবং একারণে হেভি ট্রাফিক। ট্রাফিকের জন্য একঘণ্টা দেরী হয়ে গেল অর্থাৎ আমি অফিসে গিয়ে পৌঁছালাম ৮-৪৫-এ। ওইদিকে আবার আমার এক কলিগের প্রমোশনের কারণে সবাইকে তাঁর ব্রেকফাস্ট করানোর কথা ছিল এবং সময় দেয়া ছিল ৮-টায়। ট্রাফিকের কারণে আমার অফিস দেরী, ব্রেকফার্স্ট পার্টিতে অনুপস্থিতি। আমি বলতে পারি, এটা আমার ভাগ্য। আমার ভাগ্যে ওই দিন অফিস লেট হওয়া ছিল, পার্টি ছিল না। কী দেখা যাচ্ছে? অন্যের ক্রিয়া (এক্সিডেন্ট) দ্বারা আমার ভাগ্য তৈরি হল। তাই ভাগ্য বলে কিছু নেই। ভাগ্য অপ্রত্যাশিত কিছু ক্রিয়ার ফলাফল ছাড়া কিছুই নয়। এটা ভালো ও খারাপ দুই-ই হতে পারে।
গৌতম বুদ্ধ বলেছেন জীবন দুঃখময়। দুঃখময় জীবন থেকে নির্বান প্রাপ্তির কথা তিনি বলে গিয়েছেন। বেশীর ভাগ সাধু-সন্ন্যাসীরা বলেছেন বা বলে থাকেন যে, জীবন মায়াময়। সবকিছুই মায়ার খেলা। ইসলাম ও খৃষ্ঠান ধর্ম ইহজগতকে ক্ষণস্থায়ী ও পরজগতকে আসল জগত বলেছে। গীতায় বলা আছে ফলাফলে আসক্তিবিহীন কর্মের কথা। সন্ন্যাসীরা অহং, লোভ, ঈর্ষা, মিথ্যা, অসততা ইত্যাদিকেই মায়া বলেন। বুদ্ধও অষ্টমার্গের কথা বলেছেন। এসবকে দূর করতে হবে, এসব দূর করতে পারলেই মোক্ষপ্রাপ্তি বা নির্বানলাভ হবে। সাধু-সন্ন্যাসীরা আবার নারীকেও মায়া বলেন!
কিন্তু এই সকল মায়া কীভাবে ত্যাগ করা যাবে, সেসম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কেউ কিছু বলে যাননি (একটা অভ্যাস জোর করে ছেড়ে দিলেই ত্যাগ করা হয় না, আকাঙ্ক্ষা সেখানে থেকেই যায়), যদিওবা ত্যাগ করা যায় ও ত্যাগ করে মোক্ষ বা নির্বান লাভ করা যায়, সেই মোক্ষ বা নির্বান কেমন, কী তার প্রকৃতি - তাও বলে যাননি। নারীকে মায়া বলার যৌক্তিক কোন কারণও তারা দিতে পারেননি। আবার কেয়ামত-পরবর্তী পরজগত সম্পর্কেও আমার খুব একটা আগ্রহ নেই কারণ সেই জগত আমার কাছে প্রমানহীন ধোঁয়াশা ছাড়া আর কিছুই নয়।
তাহলে নির্বান বা নির্ভানা কি? ফলাফলে আসক্তিহীন কর্ম কি সম্ভব? একটি ক্রিয়া ঘটানো হয় একটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই, প্রতিটা ক্রিয়ার একটা ফলাফল থাকবেই। আবার, ফলাফলে আসক্তি না রেখে কর্ম করলেই কি কর্মের ফলাফলকে এড়ানো যাবে? আমি পরীক্ষাকক্ষে গেলাম। পরীক্ষা দিলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, পাশ-ফেল নিয়ে আমি চিন্তা করবো না। পাশ-ফেইল নিয়ে চিন্তা না থাকলে পরীক্ষা দেয়াটাই অর্থহীন হয়ে যায়। ধরা যাক, ফলাফলে আসক্তি না রেখেই পরীক্ষা দিলাম। ফলাফলে আসক্তি না থাকলেও পাস-ফেইলের একটা প্রভাব আছে। পরবর্তী শ্রেণীতে উন্নীত হওয়া বা চাকুরী পাওয়া-না পাওয়া পাশ-ফেইলের উপর নির্ভরশীল। ধরা যাক, আমার পরীক্ষা, পাশ-ফেইলের কোন বালাই নেই। আমি সন্ন্যাস জীবন-যাপন করি। সেখানেও কিন্তু আমার ক্রিয়া আছে। আমাকে খাওয়া-দাওয়া করতে হবে, মলমূত্র ত্যাগ করতে হবে। খাওয়া-দাওয়া যোগাড়ে একটি ক্রিয়া আছে, মলমূত্র ত্যাগেও ক্রিয়া আছে। আবার সন্ন্যাস জীবনে আমি অন্যের একটি ক্রিয়া যেমন ধ্যান প্রক্রিয়া শিখি। ধ্যানের ফলাফলে আমার আসক্তি আছে।
আসলে ফলাফলে আসক্তিহীন কর্ম নয়, ক্রিয়া থেকে দূরে থাকাই হল নির্বান বা নির্ভানা। আমি যদি কোন ক্রিয়া না করি, তাহলে আমার দ্বারা আরেকটি ক্রিয়া হবে না। নির্বান পেতে হলে ক্রিয়াকে বন্ধ/ত্যাগ করতে হবে। শুধুমাত্র আমি ক্রিয়া না করলেই হবে না, আমাকে অন্যের ক্রিয়া থেকেও দূরে থাকতে হবে। আমি যদি রাস্তায় হেঁটে যাই ও একজনকে একটি গাড়িতে করে চলতে দেখি, তাহলে আমার মধ্যে একটি হাহাকার বা ঈর্ষা তৈরি হতে পারে। আমি রাস্তায় গিয়ে হাঁটলাম মানে একটি ক্রিয়া ঘটালাম, সাথে সাথে অন্য ক্রিয়াগুলি আমার ক্রিয়াকে প্রভাবিত করা শুরু করে দিল। আবার সেই “ইনসেপসন” মুভির মতো। আমার স্বপ্নের সাথে অন্যের স্বপ্ন অপ্রত্যাশিতভাবেই ধাক্কা খেয়ে যায়, আর তার ফলাফল আমাকে বা তাঁকে ভোগ করতেই হয়। তাহলে পুরোপুরি নির্বান বলতে কিছু নেই। বুদ্ধ যতদিন বোধিবৃক্ষের নীচে ছিলেন, ঠিক ততদিনই নির্ভানায় ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল,পার্থিব সংসারক্রিয়া থেকে দূরে থাকা। আবার এটা শতভাগ নির্বান ছিল না কারণ তখনো তাকে আহারাদি ক্রিয়া অর্থাৎ আহার গ্রহণ করতে হয়েছে, মল-মূত্র ত্যাগ করতে হয়েছে। তবে বুদ্ধ অতিভোজন বা স্বল্পভোজন পরিহার করে প্রয়োজনীয় আহারক্রিয়া বেছে নিয়েছিলেন। কাজেই বলা যায়, আমি-আমরা আংশিক নির্বান লাভ করতে পারি যেমন আমি ফেসবুকে না গিয়ে ফেসবুক থেকে নির্বান লাভ করতে পারি কিন্তু ইমেইলের আসক্তি আমার মাঝে থাকতেই পারে। ঈর্ষা থেকে নির্বান পেলেও অহং আমার মাঝে থাকতেই পারে। কাজেই, ঈর্ষা, লোভ, অহং, দুঃখ ইত্যাদি ত্যাগ নয়, বরং যেসকল ক্রিয়াসমূহ আমাদের মাঝে এসব তৈরি করে, সেসব ক্রিয়া থেকে দূরে থাকতে পারলেই ঈর্ষা, লোভ, অহং, দুঃখবোধ ইত্যাদি থেকে মুক্তি সম্ভব।
ভাগ্য বা নির্বান নয়, ক্রিয়া বা কর্মই হচ্ছে “কারণ” ও সবকিছুর মূল রহস্য। কর্মফল বা কর্মফলে আসক্তি রোধ নয়, ক্রিয়াকে রোধ করতে হবে। ক্রিয়াই মূল।
** আচ্ছা, যে ক্রিয়াগুলো এইসব ঈর্ষা, লোভ, অহং,পরশ্রীকাতরতা, দুঃখবোধ ইত্যাদির হেতু, সে ক্রিয়াগুলো থেকে কি দূরে থাকা সম্ভব? সম্ভব হলেও কতোটা কঠিন? এটার জন্য প্রথমে বের করতে হবে ক্রিয়াগুলি কী কী, কেমন? ক্রিয়াগুলির স্ট্রাকচারাল ম্যাপিং কি? ক্রিয়াগুলি কি আইসোমরফিক? আইসোমরফিক হলে কিসের ভিত্তিতে আইসোমরফিক? এটা নির্ধারণ করা সম্ভব হলে তো কাজটা কঠিন নয়! এটা নিয়ে লিখবো পরবর্তীতে।