somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সেটা এক স্বর্গ ছিল~ যা চিরতরে হারিয়ে গেছে #২

১৫ ই আগস্ট, ২০২১ দুপুর ২:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


শ্চিমা বিশ্ব বরাবরই সোভিয়েতের সেই সমাজতান্ত্রিক যুগের নেতিবাচক ধারানা ছড়িয়েছে সারাবিশ্বে; তারা বলেছে,তাদের রাজনৈতিক পদ্ধতি নিয়ে,তাদের কেজিবি নিয়ে। তাদের মান্ধাতা আমলের লড়ঝড়ে অটোমোবাইল, বেঢপ টিভি আর সেই টিভির থেকে বড় আকৃতির রেডিও নিয়ে। তারা রসিকতা করেছে ওদের জীবনযাপন পদ্ধতি নিয়ে- ওদের চাকচিক্যহীন পোষাকাদি নিয়ে, এমনকি সোভিয়েত নাগরিকদের খাদ্যাভাসও ওদের পছন্দ হয়নি। সবচেয়ে বেশী সরব ছিল পশ্চিমা বিশ্ব ওদের বাকস্বাধীনতা নিয়ে- সোভিয়েত সরকার কতৃক টুঁটি চেপে ধরা মিডিয়া ওদেরকে সারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে!
কিন্তু একজন সচেতন প্রাক্তন নাগরিককে জিজ্ঞেস করে দেখুন;সেই সব দিনগুলিতে সোভিয়েত নাগরিকদের সামান্য সামাজিক পার্থক্য থাকলেও ওদের অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রায় ছিলই না বললে চলে।
কিছু কমন ভ্যালু যেমন,বন্ধুত্ব,আন্তরিকতা প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্ক এসব একজন ব্যাক্তি বা পরিবারের জন্য দারুন গুরুত্বপূর্ন। সেইসব সোভিয়েত সমাজে বেশ দাপটের সাথেই উপস্থিত ছিল। সোভিয়েত যুগের বহু মানুষ এখন সেই সব স্মৃতি রোমন্থন করে দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলে। তাদের যৌবনের সেই ঐন্দ্রজালিক সপ্নের ট্রেন তাদেরকে পুঁজিবাদী নামক ভয়ানক স্বার্থপর অর্থনৈতিক সমাজব্যাবস্থার মধ্যে ফেলে রেখে চলে গেছে চিরদিনের জন্য।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
উজবেকিস্থান থেকে আনওয়ার
-জনৈক আনওয়ার,উজবেকিস্থান [আনওয়ারের বয়স তখন ৬০ ছুয়েছে। হাসতে গিয়ে ঝিলিক দিয়ে ওঠা সোনা দিয়ে বাঁধানো দাতের (সোভিয়েত ইউনিয়নে জোলাতাইয়া জুবা বা সোনা দিয়ে দাত বাধানোর প্রচলন ছিল ব্যাপক- বিশেষ করে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে)ছোটখাট গড়নের সেই মানুষটার সাথে মুল লেখকের দেখা হয়েছিল প্যারিসে ২০১১ সালে। সে একজন শিক্ষক তার স্ত্রীও নামকরা এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্রেঞ্জ ভাষার শিক্ষক। সে মুসলিম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে উনিশ’শ নব্বুইয়ে। এখন যদিও সে শুয়োরের মাংসও বর্জন করেছে কিন্তু মদটা খাওয়াটা এখনো চালিয়ে যাচ্ছে। মদের গ্লাস হাতে নিয়ে এখন সে স্মরণ করে প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নে তার ফেলে আসা স্বার্ণালী দিনগুলোর কথা। বর্তমান প্রজন্মের কাছে সে গর্বভরে বুক চেতিয়ে বলে তার সমাজতান্ত্রিক দেশের কথা।]
‘সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ধানের ফলে আমরা অনেক কিছু হারিয়েছি যা আমাদের একটি করুণ পরিস্থিতিতে ফেলেছে। আমি একজন শিক্ষক এবং আমি আপনাকে বলতে পারি যে পরিবর্তনের প্রভাব সত্যিই জনগনের পেশার উপর প্রভাব ফেলে। আজ,আমরা সারা মাসের কাজ শেষে যে নগন্য মজুরি পাই যা একটি পরিবারের নুন্যতম মৌলিক চাহিদার জন্যও যথেষ্ট নয়। আমার বেতন মাসে ৩০০ ডলারের সমান,যা দিয়ে দুই সপ্তাহের বেশী আমার পরিবারের ব্যয় মেটানো সম্ভব নয়। সৌভাগ্যবশত,আমার স্ত্রীও কাজ করে – তার আয় দিয়েই আমাদের বাকি দুই সপ্তাহের সাংসারিক খরচ চলে। তার বেতন মাসে ৪৫০ ডলার। আমাদের একটি মেয়ে আছে,তার বয়স ১৫ বছর।
পূর্বে-সোভিয়েত আমলে,জীবন ছিল একেবারেই ভিন্ন। আমাদের উপযুক্ত মজুরি ছিল যা আমাদের যুক্তিসঙ্গতভাবে বাঁচতে সাহায্য করেছিল;আমরা আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারতাম,একটি গাড়ি ব্যাবহারের সাধ্য ছিল, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড এবং খেলাধুলার জন্য অর্থ প্রদান,একটি দাচা,সোভিয়েতের -এর অন্য দেশে ভ্রমণ ইত্যাদি। কখনও কখনও,সরকারি অনুদান এবং পণ্যের মুল্য ধারনার থেকেও এত কম ছিল যে,আপনি আপনার সেই সল্প বেতন থেকে কিছু অর্থও বাঁচাতে পারতেন।
কালে যখন আপনি ঘুম থেকে উঠবেন তখন থেকেই আপনি কীভাবে অর্থ উপার্জন করবেন তা নিয়ে ভাববেন ... বিশ্বাস করুন, আপনি যদি একজন শিক্ষককে এখন জিজ্ঞাসা করেন যে, তিনি শেষবার কবে থিয়েটারে গিয়েছিলেন,আমি নিশ্চিত যে তিনি "কোন উপায় নেই এবং হাতে সময় নেই" উত্তর দিবেন। সোভিয়েত যুগে,সবাই আমাদের কাজকে এতটা সম্মান করত যে,যখন আমরা তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতাম তখন তরুণরা আমাদের অনুসরন করতে চাইত- তারা ভবিষ্যতে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিতে চাইত।
আমরা সত্যিই আমাদের কাজ উপভোগ করেছি,কারণ তখন এই পেশা যেমন সম্মানজনক ছিল তেমন ছিল আনন্দময়। আমাদের বিশেষ একটা সুনাম ছিল। কিন্তু আজ,আমরা যে সমস্ত পরিবর্তনের সম্মুখীন হচ্ছি,শিক্ষাদান এখন আর সম্মানজনক পেশা নয়। যদি আপনি তরুণদের জিজ্ঞাসা করেন যে তারা ভবিষ্যতে কী করতে চায়?তাহলে খুব কম তরুন এই পেশায় আসার কথা বলবে। তারা বলবে যে, তারা আইনজীবী,ব্যাংকার,ব্যবসায়ী ইত্যাদি হিসাবে কাজ করতে চায়।
বশ্যই,কে সেই কাজটি করতে চায় যা আপনাকে আপনার মৌলিক চাহিদার পুরনের জন্য যথেষ্ঠ নয়। সেই পেশাটি ভীষণ লজ্জাজনক হয়ে ওঠে এবং চরম অসম্মানজনক হয় তখুনি, যখন শিক্ষকেরা অর্থের অভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হতে বাধ্য হন: তারা শিক্ষার্থীদের কাছে অবৈধ অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন সুযোগ করে দেয়। তাদের এইসকল কর্মকান্ডের জন্য জন্য,শিক্ষার্থীরা জানে যে তারা তাদের গ্রেড,অনুপস্থিত ক্লাস কিনতে পারে এবং অর্থের বিনিময়ে তারা ডিপ্লোমাও পেতে পারে।
তারা পড়াশোনা করতে চায় না,তারা সহজে টাকা পাওয়ার কথা ভাবে।এই ধরনের সিস্টেম নিয়ে আমরা কোথায় যাব? আমি কখনো কল্পনাও করিনি যে একদিন আমি আমার শিক্ষকতা পেশার সাথে একইরকম পরিস্থিতিতে পড়ব। আমি চেয়েছিলাম আমার মেয়েও শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিবে ,কিন্তু শেষবার যখন আমি তাকে তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম তখন সে উত্তর দিল যে সে ডাক্তার হতে চায়। পরে অনুধাবন করলাম এই সময়ের জন্য সে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। "
ই উজবেক শিক্ষকের ভয়ঙ্কর কষ্টকর অনুভূতি,যার সব কর্তৃত্ব এবং মর্যাদা হারিয়েছেন- সেটা প্রমাণ করে যে,একটি আরামদায়ক,রাষ্ট্র-শাসিত অতীতের জন্য কতটা গভীরভাবে বদ্ধমূল নস্টালজিয়া রয়ে গেছে। সোভিয়েতে তাদের বয়স এবং অভিজ্ঞতা যাই হোক না কেন,’সাবেক সোভিয়েত শিক্ষকরা’ মূলত সেই সময়ের ভালো দিকগুলো ধরে রা্খার চেষ্টা করছে। সমাজতন্ত্র নির্মাণের জন্য গভীরভাবে নিবেদিত কাজটি সোভিয়েত যুগে তেমন ফল দেয়নি এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে সামাজিক ও নৈতিক উভয়ই দুর্দশায় ফেলেছে,যা জনসেবা কাঠামোর ব্যর্থতা প্রদর্শন করে। আনওয়ারের মত আরো বহু লোকের মধ্যে দারিদ্রতার এই অনুভূতি কোন কাল্পনিক বিষয় নয়,বরং একটি অনিশ্চিত দিনের মুখোমুখি হওয়ার ফলাফল এবং পূর্ববর্তী উন্নত জীবনের আদর্শ চিত্র যার ফলাফল ছিল সোভিয়েত রাষ্ট্র গ্যারান্টার এবং রক্ষক।
সোভিয়েত আমলের এই নস্টালজিয়া মধ্য এশিয়ার বয়স্কদের কথোপকথনে প্রায় সর্বব্যাপী। একটি গৌরবময় অতীতের কষ্টকর পরিণতির এই বিষন্ন অনুভূতি মধ্য এশিয়ার পাশাপাশি ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি প্রাক্তন ইউএসএসআর-এর অন্যান্য অঞ্চলেও উপস্থিত হয়েছিল। এই বিশৃঙ্খলা -কমিউনিস্ট ব্যবস্থার পতনের পর থেকে গভীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটের ফলাফল। ফেলে আসা সোনালী অতীতের স্মৃতি এখন বেশিরভাগ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সাথে যুক্ত,পেরেস্ত্রোইকার সময় সমৃদ্ধ একটি ক্ষুদ্র শ্রেণী ছাড়া।

আগের পর্বের জন্যঃ Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০২১ বিকাল ৩:৫৭
২১টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×