somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাউল ও পল্লীকবি জসীম উদ্দীন-এর একটি গবেষণামূলক অসমাপ্ত গ্রন্থালোচনা!

১২ ই নভেম্বর, ২০২২ সকাল ৯:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


যে কোন ধর্মের বিরুদ্ধে দু’কথা বললেই উগ্রপন্থী কিছু গোষ্ঠী ধর্ম গেল ধর্ম গেল বলে ত্রাহি চিৎকার জুড়ে দিয়ে তাকে নাস্তিক কিংবা ধর্মবিরোধী তকমা জুড়ে দিয়ে প্রাণনাশের হুমকি পর্যন্ত দেয়। আমাদের বাঙলা কিংবা পুরো ভারতবর্ষের মানুষ আজ থেকে শত বৎসর পূর্বে এমন অসুহিষ্ণু ছিলনা মোটেই। সব ধর্মের লোকেরাই যার যার ধর্ম চারণ নিমিত্তে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যার যার কর্মে নিযুক্ত হোত। সেই সময়ে জাত পাত, উঁচু নিচু, শিক্ষিত অশিক্ষিতের ভেদাভেদ থাকলেও ধর্ম নিয়ে কোন ক্যাচাল শোনা যায় নি কখনো।
ভাবুন একবার লালনের মত বাউল/ফকির যদি এই জামানায় তার সেই জাত পাত, পৈতে-ঈমান, কোরান-পুরাণ নিয়ে অমন বাউল গীত যদি এই জামানায় রচনা করতেন তবে প্রথম দফাতেই তার ধড় থেকে গর্দান আলাদা হোত। লালনের বাউল গীত থেকেই আমরা ধারনা করতে পারি সেই সময়কালের ধর্ম সহিষ্ণুতার বাইরের চিত্র!
বাইরে কেন বললাম; কেননা ভিতরের চিত্রটা একটু ভিন্ন ছিল বৈকি! লালন তার সময়কাল থেকে কমপক্ষে দু’শ বছর এগিয়ে ছিল। মন-মনন ও ভাবনায়। তবে আমাদের ভাবার বিষয়; প্রায় অশিক্ষিত লালন এত কিছু জানলেন কোত্থেকে? দেহতত্ত্ব, ধর্মের গূঢ়-তত্ত্ব, শরিয়ার এত বিধি বিধান/মারফতি, গীতা কোরআন বাইবেলে লিখিত বিষয়াদি কিভাবে জানলেন?*

আসুন শুনি এখানে পল্লী কবি জসীম উদ্দীন কি বলেন;
লালন-সাহিত্যের আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য—তদীয় ভাবসংগীতে প্রতিফলিত সমকালীন সমাজচিত্র। সাধকের কর্মভূমি ছেঁউড়িয়া ও তার আশপাশে বহু আলেম-মৌলভি বাস করতেন । লালন-প্রচারিত ধর্মীয় উদারনৈতিক মনোভঙ্গি তৎকালীন আলেম-শাসিত গোঁড়া সমাজ সহনশীল মানসিকতা নিয়ে গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে, তাদের সঙ্গে মানবতার পূজারি কবি লালনের বিরোধ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। কুমারখালী থানার হিজলাবট গ্রামের মুন্সী তুফাজ্জেল হোসেনের সঙ্গে ধর্মীয় ব্যাপারে লালনের বেশ কয়েকবার বাহাছ (তর্কযুদ্ধ) অনুষ্ঠিত হয়। এসব তর্কসভায় শরিয়ত ও মারেফাত নিয়ে বাগবিতণ্ডা চলে । মৌলভি সাহেব লালনকে প্রশ্ন করেছেন। লালনও তাঁকে বহু বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন।
লালনের উক্তি একটু উদ্ধৃত করছি। কি নিশান দেখিলে বুঝি শরিয়ত হাছেল । খোলাশা করিয়া তাহা কহত ফাজেল। আন্দাজী না কহিও বাত, কহ হাদিছ মতে। কবে হবে শরা হাছেল যাব মারুফতে৷”
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, প্রকৃত প্রস্তাবে শরিয়ত তথা ‘শরা’ বলতে কি বুঝায় লালন তাও বর্ণনা করেছেন :
“যদি শরায় কার্য সিদ্ধ হয়,
(তবে) মারফত কেন ধরতে যায়।”

সমাজে শ্রেণীবিভাগ, জাতি বর্ণ গোত্র বিভেদ বড়ই পীড়াদায়ক ছিল। সাধক জাতিত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন :
সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে। লালন বলে, ‘জাতির কি রূপ দেখলাম না এ নজরে’৷৷
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
লালন এখান থেকে জেনেছেন শিখেছেন এবং নতুন নতুন প্রশ্ন করেছেন, চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন এবং পরিশেষে তাদের শিখিয়েছেন। ধর্মের অসাড় বিষয়গুলো সবার সম্মুখে এনেছেন। ধার্মিক লোকেরা হয়তো আহত হয়েছেন ভীষন কষ্ট পেয়েছেন কিন্তু তারা উগ্রপন্থা অনুসরন করেননি। লালনকে বাহাসে ডেকেছেন। যদিও এখানে হিন্ধু ধর্মগুরুদের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি- তবে ধারনা করা যায় যে, তারাও লালনের সাথে নিয়মিত আলোচনা করেছেন। এখানে ছিল একে অপরের প্রতি সম্মান ও ভালবাসা। তেমন করে কাউকে হেয় করার চেষ্টা করেনি। কোন হীন স্বার্থ চরিতার্থের আকংখা ছিল না কারো।

- লালন ফকির। সৌজন্যেঃ গেট বেঙ্গল

বাউল’ নিবন্ধের পূর্ব ইতিহাস ও পল্লীকবি জসীম উদ্দীন
'নক্সী কাঁথার মাঠ' ও 'সোজন বাদিয়ার ঘাট' প্রকাশের মধ্য দিয়েই মূলত জসীম উদ্দীনের কাব্যকীর্তির সমধিক বরণ । অতীতে বাংলা সাহিত্যে পল্লী-তীর্থকামীর সন্ধান মিললেও তাঁর রচনায় পাওয়া যায় গ্রাম-জীবন ও প্রকৃতি-চারণের রূপ উছল চিত্রায়ণ। আর তাতে সময় পরম্পরায় যুক্ত হতে থাকে বিষয়ের বিশ্লেষণধর্মিতা, ভাষার পারিপাট্য, সৌন্দর্যবোধ এবং পরিমার্জনপ্রিয়তার সমুদয় লক্ষণ। সত্যিকার অর্থে গ্রাম্য প্রকৃতির রূপবন্দনায় এই কবির শ্রেষ্ঠত্ব আজ অবধি শীর্ষচূড়া সমান। তা সম্ভব হয়েছিল অন্য এক ইতিহাসের কারণে । প্রথম জীবন থেকেই জসীম উদ্দীন লোকসাহিত্যের সাথে ব্যাপক ও গভীর পরিচিত হওয়ার মানসে দেশের নানা প্রান্ত ঘুরে বেড়িয়েছেন। তাঁর দৃষ্টি যায় মধ্যযুগের চণ্ডীমঙ্গল, বৈষ্ণব পদাবলী, ময়মনসিংহ গীতিকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের প্রচলিত বৈচিত্র্যপূর্ণ পল্লীগীতির দিকেও। ফলে যে-প্রাণৈশ্বর্যের সাক্ষাৎ তিনি পেয়েছিলেন, কবির মৌলিক রচনাকে তা প্লাবিত করেছে বার বার। অন্যদিকে লোকগীতি-গাথার অবদান যে অনস্বীকার্য সেকথা ভেবেই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ স্বর্গীয় দীনেশচন্দ্র সেনের সুপারিশে জসীম উদ্দীনকে পল্লীগীতি সংগ্রাহক নিযুক্ত করা হয়। এ ধারায় তিনি কিন্তু সাধারণ পল্লীগীতি সংগ্রাহক মাত্র ছিলেন না, উচ্চমানের গবেষকের মতো বিরল তত্ত্ব, তথ্য ও রসবোধের অধিকারী পুরুষও হয়ে উঠেছিলেন। 'বাউল' বইটিও সে-প্রান্তেরই এক সংযোজন ।

তবে জসীম উদ্দীন আলোচ্য গ্রন্থে শুধু কয়েকটি গান সংগ্রহই নয়, বাউলদের তাবৎ রহস্য-উদ্ধারেও ব্রতী হয়েছেন যা অনুসন্ধানী পাঠক-পাঠিকার অজস্র প্রশ্নের জবাব দিতে পারে । সুত্রঃ উইকি ও বাউল বই এর ভুমিকা থেকে।

জসিমউদ্দিনের কথায়ঃ আসিয়া ধরা দেয়। কিন্তু আমাদের লেখার মধ্যে এরূপ করিলে চলিবে না।
এখানে আগের কথাই আগে লিখিতে হইবে। সেইজন্য প্রথমেই আমাদের কার্যপ্রণালীর একটা খসড়া প্রস্তুত করিয়া
লইতে হইবে। এই খসড়ার সহিত আমরা কতকগুলি অধ্যায়ের অবতারণা করিব। এবারের কার্যবিবরণীতে যে যে অধ্যায়ে অসম্পূর্ণতা থাকিয়া যাইবে পরবর্তী কার্যবিবরণীতে তাহা সংশোধন করিতে চেষ্টা পাইব।

কিন্তু বিশেষ পরিতাপের বিষয় যে, হয় তিনিএই লেখা শেষ করে যেতে পারেননি, নয়তো পান্ডুলিপির কিছু অংশ হারিয়ে গেছে বা নষ্ট হয়ে গেছে যার ফলে বাঙলা সাহিত্য সহ বিশ্ব সাহিত্যের একটা অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে।



কবি জসিমউদ্দিন তার বাউল বিষয়ক গবেষনা গ্রন্থে যেসব বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করেছেন;

বাউলদের বিষয়ে বহু তথ্যই আমাদিগকে বাঙলার নানান জেলার নানান গ্রামে ঘুরিয়া সংগ্রহ করিতে হইবে। একখানা পুস্তক পড়িয়া কয়েক ঘণ্টায় যাহা জানা যায়, লোকের মুখে শুনিয়া তাহা জানিতে হইলে বহু সময়ের প্রয়োজন। কিন্তু এই কষ্ট স্বীকার না করিলে কোথাও সংগ্রহের কার্য অগ্রসর হইতে পারে না। বর্তমান প্রবন্ধে আমরা নিম্নলিখিত বিষয়গুলির আলোচনা করিব :
১। বাউলদের বিষয়ে ভ্রান্ত ধারণা।
২। বাউল বলিতে আমরা কাহাদিগকে বুঝি ।
৩। বাউল শব্দের অর্থ ।
৪ । প্রাচীন গ্রন্থাদিতে বাউলদের উল্লেখ।
৫। বাউলধর্মের ইতিহাস ।
৬। নানান সম্প্রদায়ের বাউল—তাহাদের পোশাক-পরিচ্ছদ-রীতিনীতি প্রভৃতি ।
৭। বাউলসঙ্গীতের বিভাগ ।
৮। বাউলসঙ্গীতের বৈশিষ্ট্য ।
৯। বাউলসঙ্গীতের ভাষা।
১০। বাউলসঙ্গীতের উপর হিন্দু, বৌদ্ধ, বৈষ্ণব, মুসলমান ও সুফি প্রভৃতি ধর্মের প্রভাব—মিল।
১১। বাউলসঙ্গীতের তত্ত্ববস্তু ।
১২। বাউলের সুর ও বাউলের নৃত্য।
১৩। বাউলসুরের সহিত রবীন্দ্রনাথের সুরের তুলনা।
১৪ । কবি, জারি, তরজা, তাসমা, গাজীর গান প্রভৃতির উপর বাউলগানের প্রভাব
১৫। বাউলসঙ্গীত সংগ্রহ।
১৬। নানান সম্প্রদায়ের বাউলদের ছবি।


কেন বাউলেরা তাদের ধর্মকথা গোপন রাখে? লিখিত কিছুই রাখে না?

হয়তো এমনই কোনো কারণে বাউলেরা তাহাদের ধর্মকথা গোপন রাখিয়াছে। তাই বাউলেরা বলে,
আপনার ধর্মকথা বলিবে না যথা তথা আপনাকে আপনি হইবে সাবধান।'
চণ্ডীদাসও একদিন এই কথা বলিয়াছিলেন, যাইতে উত্তরে বলিবে দক্ষিণে দাঁড়ায়ে পূরব মুখে।
ইহার কারণও আছে। বাউলেরা অনেকেই লেখাপড়া জানে না। তাই তাহাদের সাধনপ্রণালী বা ধর্মকথা তাহারা কোনো পুস্তকে লিখিয়া রাখিতে পারে নাই। যাহারা সামান্য কিছু লিখিতে প্রয়াস পাইয়াছে দেশের প্রচলিত বাউলেরা তাহাদিগকে ভালো চক্ষে দেখে নাই। ইহার কারণ অসুসন্ধান করিলে জানা যায় যে, হিন্দু-মুসলমান অথবা বৌদ্ধ প্রভৃতি প্রত্যেক সম্প্রাদায়ে নিজ নিজ ধর্ম-প্রবর্তক আছে। আর এইসব ধর্মের লোকেরা একসময়ে রাজশক্তি হাতে পাইয়াছিল। প্রত্যেক ধর্মেরই পশ্চাতে এক-একটা শক্তিশালী সমাজ রহিয়াছে। তাই এইসব ধর্মের লোকেরা আপনাপন ধর্মের কথা বুক ফুলাইয়া সকলের নিকট বলিতে পারে। কিন্তু বাউলদের পশ্চাতে এমন কোনো শক্তিশালী সমাজ ছিল না। হিন্দু মুসলমান উভয় ধর্মের অত্যাচারে ইহারা নিজেদের ধর্মকথা গোপন করিয়া রাখিবার শিক্ষা পাইয়াছে। বিশেষ করিয়া বাউলদের কোনো কোনো সম্প্রদায়ের সাধন-ভজনকার্য গোপনে সম্পন্ন হইয়া থাকে। এইজন্যেই ইহারা সাধারণে ইহা প্রকাশ করিতে অনিচ্ছুক।
কিন্তু একথা হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধেই খাটে। একসময় ধর্মের বড় বড় নেতারা দেশে দেশে ঘুরিয়া অন্য ধর্মাবলম্বীদিগকে বিচারে আহ্বান করিতেন। এই বিচারে তাঁহারা আপন ধর্মকে বড় বলিয়া প্রমাণ করিতেন। শঙ্করাচার্যের দিগ্বিজয় অথবা মহাপ্রভু প্রবোধানন্দ সরস্বতী বা সার্বভৌমের সহিত বিচারের কথা স্মরণীয়। কিন্তু ধর্ম মানুষের প্রাণের সত্তা। ইহার অর্ধেক যুক্তি এবং অর্ধেক আবেগমিশ্রিত অন্ধ বিশ্বাস বা Sentiment । যুক্তিতে হারিয়াও কেহ ধর্ম ছাড়িতে পারে না।
বাউলদের কথা হইতেছে মারফতের ভেদ সিনায় সিনায়। অর্থাৎ আধ্যাত্মিক সাধনার কথা গুরু তাঁর বুক হইতে শিষ্যের বুকে লিখিয়া দিবেন। মুখের কথায় বা কাগজে লিখিত নহে। মুখে এইসব সাধনের কথা বলিতে যাইয়া অনেক সময় বিপত্তি ঘটিয়াছিল। মহাদেব পার্বতীকে এইসব তত্ত্বকথা শুনাইতে ক্ষীরোদ সাগরের এক নির্জন টঙ্গির আশ্রয় লইয়াছিলেন। তথায় মৎস্যরূপ ধরিয়া মীন মোচন্দর তাহা শ্রবণ করিয়াছিলেন। বৌদ্ধ সহজিয়ারাও তাহাদের ধর্মকথা গুরুর মুখ হইতে শুনিয়া শিক্ষা করিত। সুতরাং বাউলদের বিষয়ে কিছু জানিতে হইলে আমাদিগকে বাউলদের মধ্যে যাইয়া তাহাদের সাথে মিশিয়া তাহাদের কথা জানিয়া আসিতে হইবে।
একখানা পুস্তকে যাহা লেখা থাকে তাহাতে পূর্বাপরের সঙ্গতি পাওয়া যায়। তাহাতে আগের কথা আগে এবং পরের কথা পরে লেখা থাকে। যে-কথা লোকের মুখে শুনিয়া সংগ্রহ করিতে হয় তাহার সংগ্রহকার্য এরূপ শৃঙ্খলাসহকারে হইবার উপায় নাই। এখানে অনেক সময় গোড়ার কথারই সন্ধান পাওয়া যায় না, কিন্তু শেষের কথা আপনা হইতেই হাতের কাছে হাজির হয়।

বাউলদের ধর্ম কি?

এ পর্যন্ত বাউলদের লইয়া কোনো বিস্তৃত আলোচনা হয় নাই, H. H. Wilson তাঁহার হিন্দুধর্ম (Hindu Religion) পুস্তকে লিখিয়াছেন, ‘বাউলদের বিষয়ে বেশি কিছু জানা যায় না।'

হোরাস হেম্যান উইলসন ও তার লিখিত বই 'হিন্দুধর্ম'

বর্ণিত হইয়াছে। কিন্তু বাউলধর্ম বৈষ্ণবধর্মের শাখা নহে। ইহা বৌদ্ধ সহজিয়া এবং নাথধর্মের বর্তমান সংস্করণ। সুফিধর্ম আসিয়া ইহাকে কতকটা রূপান্তরিত করিয়াছে। সেকথা পরে বলিব। বাউলদের অর্ধেকেরও বেশি মুসলমান। উপরোক্ত গ্রন্থকারদ্বয় তাহাদের কথা বিবেচনা করেন নাই ।
‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়' গ্রন্থের আর-এক স্থানে লিখিত হইয়াছে, “শুনিতে পাই, এ সম্প্রদায়ের মধ্যে নরমাংস ভোজন ও শবের বস্ত্র সংগ্রহ করিয়া পরিধান করা প্রচলিত আছে।”” অক্ষয়বাবু নিজে এ বিষয়ে কিছু জানিতেন না। মাত্র লোকের মুখে শুনিতে পাইয়াছিলেন। কিন্তু আমরা প্রায় ৪ (চারি) শত বাউলগান পাঠ করিয়াছি। কিন্তু কোনো গানেই নরমাংস ভক্ষণ করার কথা পাই নাই। ময়মনসিংহ, নদীয়া, ঢাকা, ফরিদপুর, যশোর, বীরভূম প্রভৃতি জেলায় কোথায়ও এ-ধরনের বাউল পাওয়া যায় না ।
- আজকাল মাসিকপত্রে কেহ কেহ বাউল লইয়া কিছু-কিছু আলোচনা করিয়াছেন। এসব আলোচনায় যেসব বাউলসঙ্গীত প্রকাশিত হয় তাহার কোনো গানই বাউলদের রচিত নয় বলিয়া মনে হয়। পড়িলেই বোঝা যায় রবীন্দ্রোত্তর কোনো কবি এগুলি রচনা করিয়াছেন । সাধারণ পাঠক রবীন্দ্রনাথের গান শুনিতেই অভ্যস্ত । রবীন্দ্রনাথ তাঁহার ভাষা ও ভাব লইয়া আমাদের মনে একটা বিশিষ্ট স্থান করিয়া লইয়াছেন। এই ধরনের গান হইলে আমাদের সহজে ভালো লাগে। আর যদি কোনো অশিক্ষিত গ্রাম্য কবির গানে রবীন্দ্রনাথের অনুরূপ পদ পাওয়া যায় তবে তো আর কথাই নাই। এই কারণেই আজ ইউরোপ ওমর খৈয়ামের কবিতা লইয়া মাতিয়া উঠিয়াছে । ওমর খৈয়ামের কবিতার সহিত বর্তমান ইউরোপের চিন্তাধারার যোগ আছে ।
এইজন্য উপরোক্ত লেখকদের সংগ্রহের পাশে আমাদের সংগ্রহ দাঁড়াইতেই পারে না। এ-বিষয়ে এত কথা বলিতাম না। কিন্তু নকল বাউলদের প্রভাবে আসল বাউল ঢাকা পড়িলে প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করিতে বড়ই বেগ পাইতে হয়। ~ কবি জসীম উদ্দীন

বাউল

বাউল শব্দের অর্থ পাগল। এই অর্থ হইতে অনেকের মনে ধারণা হইয়াছে, তাহারা সকলেই ভাবের পাগল। মনের আনন্দে তাহারা একতারার সুরে সুরে গান গাহিয়া বেড়ায়। এইরূপ ‘ভাবে ডগমগ' হইয়া গান করাটাকে দুএক সম্প্রদায়ের বাউলেরা ভালোবাসিলেও সব সম্প্রাদায়ের বাউল তাহা করে না।
পূর্ববঙ্গের শানাল ফকির, গনি ফকির ও মাইজভাণ্ডারের সম্প্রদায় অনেকটা এই ভাবের বাউল। কিন্তু সাধারণত বাউলেরা ভাবের গাগল নয়। তাহারা জ্ঞানী দার্শনিক। তাই তাহাদের গানের ভিতর কবিত্বের চাইতে তত্ত্বকথাই বেশি থাকে। ‘কিরাতাৰ্জ্জুনীয়’ নাটকের মধ্যে দুএক জায়গায় উচ্চাঙ্গের কবিতা আছে, কিন্তু সেই কবিত্বের লোভে যদি কেহ ‘কিরাতাৰ্জ্জুনীয়' পড়েন তবে তিনি নিশ্চয়ই ঠকিবেন।
কোনো কোনো বাউলগানে কবিত্ব থাকিলেও কবিত্বের জন্যেই বাউলগানগুলি রচিত হয় নাই। যে-বাউলগানে যত তত্ত্বকথা আছে সেই গানই বাউলসামাজে তত আদৃত হয়। নিজেদের গোপন সাধনপ্রণালীর কথা আকার-ইঙ্গিতে লোকের মধ্যে প্রচার করিবার উদ্দেশ্যেই বাউলরা গান রচনা করিয়া থাকে।

H. H.Risley The tribes and castes of Bengal লিখিয়াছেন “



'বাওলা একটি শব্দ যার মধ্যে রয়েছে বেশ যা বৈষ্ণবদের প্রধান সংস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া প্রধানত নিম্নবর্ণ থেকে কিছু ভ্রান্তপথধারী অসম্মানজনক ভিক্ষাজীবী। মহান বৈষ্ণব গুরুদের মেনে তারা নিজেদেরকে নিত্য, চৈতন্য এবং হরিদাস বাওল বলে থাকেন। ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা এবং সামাজিকতা পালনের বিষয়ে একে অপরের থেকে আলাদা। বাওল সম্প্রদায় বৈষ্ণব মন্দিরে তীর্থযাত্রাকে একটি পবিত্র দায়িত্ব বলে মনে করে।"
‘বাওলা একটি শব্দ যার মধ্যে রয়েছে বেশ যা বৈষ্ণবদের প্রধান সংস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া প্রধানত নিম্নবর্ণ থেকে কিছু ভ্রান্তপথধারী অসম্মানজনক ভিক্ষাজীবী। মহান বৈষ্ণব গুরুদের মেনে তারা নিজেদেরকে নিত্য, চৈতন্য এবং হরিদাস বাওল বলে থাকেন। ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা এবং সামাজিকতা পালনের বিষয়ে একে অপরের থেকে আলাদা। বাওল সম্প্রদায় বৈষ্ণব মন্দিরে তীর্থযাত্রাকে একটি পবিত্র দায়িত্ব বলে মনে করে।"
রিসলি সাহেব বাউলদিগকে বৈষ্ণবধর্মের একটি শাখা মনে করিয়াছেন। উপরের নিত্য, চৈতন্য প্রভৃতি নামগুলি হইতে মনে হয় বাউল বলিতে তিনি শুধু হিন্দু বাউলদিগকেই মনে করিয়াছেন। ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়' গ্রন্থেও বাউলধর্মকে বৈষ্ণবধর্মেরই একটি শাখা বলিয়াই অনুমান করা হয়।* ইংরেজী থেকে অনুবাদ

বাউলদের বিষয়ে ভ্রান্ত ধারণা

“বাউলদের সহিত আধুনিককালের শিক্ষিত বাঙালির পরিচয় রবীন্দ্রনাথের থিয়েটারে সাজা বাউলদের মারফত অথবা কবির রচিত বাউলসুরের গানগুলির ভিতর দিয়া। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের থিয়েটারের বাউল সাজা বাউল—প্রকৃত বাউলদের সহিত ইহাদের কোনো সম্পর্ক নাই। মুক্তধারার ধনঞ্জয় বৈরাগীর কিংবা শারদ উৎসবের দাদাঠাকুরের বাউলের দলের সন্ধানে যদি কেহ সারাটি বাঙলাদেশও ঘোরেন তবে তিনি নিরাশ হইবেন, এ বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নাই। রবীন্দ্রনাথের রচিত বাউলসুরের গানগুলির অনুরূপ সুরও বাঙলাদেশে ক্বচিৎ দেখা যায়। এ-বিষয়ে আমরা কবিকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। কবি বলিলেন, “আমি তো ভালোমতো তাহাদের সুর শিখিবার অবসর পাই নাই। তাহাদের প্রচলিত সুরের একটা আমেজ আমার মনের মধ্যে থাকিয়া যাইত। তারপর আমার মনের সুরের সাথে যোগ হইয়া একটা-কিছু তৈরি হইত।" এ-বিষয়ে আমরা পরে আলোচনা করিব।
অক্ষয়কুমার মৈত্র মহাশয় তাঁহার 'ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রাদায়ে র একস্থানে লিখিয়াছেন, “তাহারা (বাউলেরা) কহেন, লোকে ঐ চারিটি চন্দ্রকে অর্থাৎ শোণিত, শুক্র, মল, মূত্র এই চারিটি দেহনির্গত পদার্থকে পিতার ঔরস ও মাতার গর্ভ হইতে প্রাপ্ত হইয়া থাকে, অতএব উহাদিগকে পরিত্যাগ না করিয়া পুনরায় শরীরমধ্যে গ্রহণ করা কর্তব্য”। বিশ্বকোষেও বাউলদের সাধন-বিষয়ে এরূপ কথা বলা হইয়াছে। ‘গৃহস্থ' পত্রিকায় নলিনীরঞ্জন পণ্ডিত মহাশয়ও ইহাই বলিয়াছেন। কিন্তু সমস্ত বাউলের বিষয়ে
বাউলদের অনুরূপ এক ধর্মগোষ্ঠী কলন্দর সম্প্রদায়ের উল্লেখ করিয়াছেন । শুধুমাত্র একখানা উড়িয়া গ্রন্থে সম্প্রদায় অর্থে দুই স্থানে বাউলি শব্দের প্রয়োগ দেখা যায়'
সুতরাং, বাউলদের ইতিহাস খুঁজিতে যাইয়া বাউল সম্প্রদায়ের নামে কোনো সম্প্রদায়বিশেষের ইতিহাস খুঁজিলেই আমাদের চলিবে না। তবে বাউল নামে পরিচিত সম্প্রদায়ের ইতিহাস যতদূর সম্ভব আমরা খুঁজিয়া দেখিব
এখন কথা উঠিতে পারে, এই ধরনের ফকিরেরা যখন বিভিন্ন জেলায় এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে পরিচিত তখন আমাদের প্রবন্ধের নাম বাউল রাখিলাম কেন? এই কেনর উত্তর আমরা দিতেছি।
—রবীন্দ্রসাহিত্যের কৃপায় বাউল শব্দটি আজকাল বঙ্গদেশে খুব পরিচিত
এবং বাউল বলিতে আমরা উপরোক্ত বিভিন্ন নামধারী সম্প্রদায়কেই বুঝিয়া থাকি । তাই আমাদের প্রবন্ধের নাম বাউল রাখিলাম ।
বাউলদের ইতিহাস খুঁজিতে হইলে বাউল সম্প্রদায় নামে কোনো সম্প্রদায়ের ইতিহাস খুঁজিলেই আমাদের চলিবে না। নানান স্থানের বাউলদের যাহা বৈশিষ্ট্য, সেই বৈশিষ্ট্যের ইতিহাস বাহির করিতে পারিলেই আমাদের পরিশ্রম সার্থক বলিয়া মনে করিব । /সাধারণত বাউল বলিতে আমরা ইহাদিগকেই বুঝিব :
১. যাহারা গুরুবাদ মানে।
২. মানুষভজনে যাহাদের আস্থা আছে।
৩. প্রচলিত হিন্দু-মুসলমানের ধর্মপদ্ধতি যাহারা সূক্ষ্ম যুক্তির সাহায্যে সমালোচনা করিয়া গলদ বাহির করে ।
৪. যাহাদের গান দেহতত্ত্বপ্রধান।
৫. যাহারা প্রচলিত সমাজশাসন ও নিয়মকানুন মানে না ।
৬. যাহারা আপন ধর্মকথা গোপন রাখিতে চায়।
৭. যাহারা প্রকৃতি লইয়া সাধনা করে ।
৮. যাহারা যৌনতত্ত্ব লইয়া আলোচনা করে ।
৯. যাহাদের গানে বাউলের সুর ।
১০. যাহারা আলখেল্লা পরিধান করে।

• মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল হইতে ‘বাতুলতন্ত্র' এবং ‘মহা বাতুলতন্ত্র' নামে দুইখানি প্রাচীন সহজিয়া পুঁথি সংগ্রহ করিয়াছেন। ~কবি জসীম উদ্দীন


বাউল সম্প্রদায়ের ইতিহাস

বাউলদের ইতিহাস জানা খুবই সহজ হইত যদি আমরা বাউলদের উত্তর গুরুর তালিকার উপর আস্থা স্থাপন করিতে পারিতাম। প্রত্যেক বাউলের নিকট, বিশেষ করিয়া প্রত্যেক মহান্ত বাউলের নিকট এক-একখানা পূর্বগুরুর তালিকা থাকে। কেহ কেহ এই তালিকা মুখস্থ করিয়া রাখে। আবার কেহ কেহ কাগজে লিখিয়া রাখে। এই প্রকারের তালিকাগুলির আলোচনা করিলে আমরা দেখিতে পাই, হিন্দু বাউলেরা যেমন গৌরাঙ্গদেবকে তাহাদের আদিগুরু বলিয়া গ্রহণ করে, মুসলমান বাউলেরা তেমনই হজরত মোহাম্মদকে (সাঃ) তাহাদের আদিগুরু বলিয়া প্রচার করে। নিম্নে আমরা একজন মুসলমান ফকিরের পুস্তকে লিখিত তাহাদের পূর্বগুরুদের নামের তালিকা প্রকাশ করিলাম ।
এ অধীন মেছের সার পির খোসাল দরবেশ হয়। তেনার পির পাটুসা দেওয়ান জান পরিচয় ॥ পাটুসা পিরের পির জয়নুচ্ছাদেকিন তেনার পির জান হজরত আবদুর রহিম ॥ জানিবে তেনার পির বড় দস্তগির তেনার পির রহমাতুল্লা কেতাবে জিকির ॥ আব্দুল্লা ক্রোয়ানাল হোসেন মুরিদ করে তারে তান পির সানুর মকদুম জান বেরাদরে ॥ হজরত সাহাকাজি সেক তান পির হয় জাহেদ বিন জাহেদ তান পির জানিবে নিশ্চয় ॥
জেলায় মারফতি গান' বা মুর্শিদা গান' কহে। কোথাও কোথাও এই গান মহজনি গদ নামে অভিহিত। বগুড়া জেলায় এই গানকে দেহতত্ত্ব গান বলে।
বাউলদেরও বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন নাম। সাঁই, গোঁসাই, ফকির, গায়েন, খ্যাপা, মুরশিদ, মীর প্রভৃতি নানান নামে ইহারা পরিচিত। অথচ সকল জেলায় ইহারা একই প্রকার গান গাহিয়া থাকে। বস্তুত বাউল শব্দের সহিত আমরা যতটা পরিচিত গ্রাম্য গায়কেরা ততটা পরিচিত নয়। পালন ফকির অসংখ্য গান রচনা করিয়া গিয়াছেন। তাঁর একটি গানেও বাউল শব্দের প্রয়োগ পাওয়া যায় না। লালনের সমসাময়িক পাঞ্জুশাহ্, লালনের গুরু সিরাজ সাঁই, প্রসিদ্ধ পদকর্তা যাদু বিন্দু, ফরিদপুরের মেছেরশাহ্, তিনু ফকির, ছলিম চাঁন্দ—ইঁহাদের গানে সারা বাংলাদেশ মুখরিত। কিন্তু ইঁহাদের কারও গানে আমরা বাউল শব্দের প্রয়োগ দেখিতে পাই নাই। পদের নিম্নে ভণিতায় নামের আগে ইঁহারা কাঙাল, ফকির, অধীন, অধম প্রভৃতি শব্দ প্রয়োগ করিয়াছেন। কিন্তু বাউল বলিয়া নিজদিগকে পরিচয় দেন নাই ।
পশ্চিমবঙ্গের এক-আধটি সম্প্রদায় হয়তো বাউল বলিয়া নিজেদের পরিচয় প্রদান করে। নানা জেলায় ইহারা নানান নামে পরিচিত হইলেও ইহারা একই সম্প্রদায়ের লোক ।
প্রাচীন বঙ্গসাহিত্যের যতদূর আমরা খবর রাখি তার কোথাও সম্প্রদায় অর্থে বাউল শব্দটি ব্যবহৃত হয় নাই। কবিকঙ্কন চণ্ডী এবং বৈষ্ণব চরিতকারগণের গ্রন্থে তদানীন্তন বহু ধর্মসম্প্রদায়ের উল্লেখ আছে। কিন্তু তাঁহারা কেহই বাউল সম্প্রদায়ের উল্লেখ করেন নাই। অথচ কবিকঙ্কন
মারফতি—সুফিদের প্রবর্তিত শরিয়ত, হকিকত, তরিকত প্রভৃতি পন্থের একটি পন্থ। মারফতে যাহারা সাধনা করে তাহারা সাধারণ লৌকিক ধর্মপদ্ধতি গ্রহণ করে না। স্থূল, প্রবর্তক, সাধন, সিদ্ধিপন্থার সাথে উপরের পন্থাগুলি তুলনীয়। যে-গানে মারফতের পন্থের নির্দেশ আছে সই গানকে মারফতি গান বলে ।
দেখিয়া পাঠকেরা অভিযোগ করেন, ওদের মতো ভালো গান তোমরা সংগ্রহ করিতে পার নাই। এইজন্য এতগুলি কথা এখানে বলিতে হইল ৷
এখানে আর-একটি কথার অবতারণা করিব। আমাদের দেশের সমাজজীবন অতীব সঙ্কীর্ণ। ছুতমার্গের বেড়া রচনা করিয়া জাগতিক জীবনে আমরা শ্রেণীগতভাবে একে অপর হইতে পৃথক হইয়া আছি। কিন্তু ধর্মজীবনে আমরা এরূপ নই। ধর্মের দিক দিয়া ভারতবর্ষের মতো উদার জাতি নাই বলিলেও চলে। যখনই কোনো নূতন ধর্মমত আমাদের দেশে আবির্ভূত হইয়াছে তখনই তাহা প্রাচীন ধর্মের অঙ্গীভূত করিয়া লওয়া হইয়াছে। এখানে গীতার সর্বধর্ম সমন্বয়ের চেষ্টা স্মরণীয়। বুদ্ধ, যিনি ভগবানকে পর্যন্ত স্বীকার করিলেন না তিনিও আমাদের দেশে দশাবতারের মধ্যে একজন অবতার হইয়া পূজা পাইতেছেন। হরিদাস মুসলমান ছিলেন। বৈষ্ণবেরা তাঁহাকে লইয়া পঙক্তিভোজন করেন নাই। হয়তো সেকালের কোনো বৈষ্ণবের ভোজগৃহে তিনি প্রবেশ করিলে রীতিমতো গঙ্গাজল ও গোবরের প্রয়োজন হইত । শ্রীবাসের গৃহে যেদিন মহাপ্রভু বিষ্ণু খট্টায় উঠিয়া বসিয়া সকল ভক্তকে বর দিয়াছিলেন সেদিন হরিদাস ঘরের বাহিরে ছিলেন । অথচ সমস্ত বৈষ্ণবের সাথে ধর্মজীবন যাপন করিতে তাঁর কোনো অসুবিধা হয় নাই। বাঙলাদেশের গোঁড়া বৈষ্ণবেরা যতটা ছুতমার্গ মানে এতটা বোধহয় আর কোনো সম্প্রদায় মানে না। অথচ এই বৈষ্ণবদের ‘বাওয়ান্ন’ ভোজন' ‘নিরানব্বুই’ ভোজন প্রভৃতি যেসব উৎসব অনুষ্ঠিত হয় তাহাতে আর আর সব বৈষ্ণব মহান্তের সহিত হরিদাসেরও একটা ভোগ প্রদান করা হইয়া থাকে। আমরা পরে দেখাইব গোটা মুসলমান ধর্মটি বাউলদের হাতে আসিয়া কী করিয়া তাহাদের পূর্বধর্মের বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যমঙ্গল একটি পরিষ্কার গৃহে ছোট ছোট হাঁড়িতে প্রত্যেক মহান্তের জন্য ভোজ্য জিনিসের ভোগ দেওয়া হয়। যদি বাওয়ান্ন ভোজন উৎসব তবে প্রত্যেক হাঁড়িতে বাওয়ান্ন প্রকারের ভোজ্য জিনিস দিতে হইবে। এবং এরূপ বাওয়ান্নটি হাঁড়ি বাওয়ান্নজন মহান্তের জন্য রাখিতে হইবে। এইভাবে কোথাও কোথাও তিনশত মহান্তের ভোগ দেওয়া হয় ।
অশিক্ষিত গ্রাম্য মুসলমানেরা মাঝে মাঝে এখানে আসিয়া ভক্তি নিবেদন করে।

কলন্দরিহ সম্প্রদায়ের বাংলা পুস্তকগুলিও খাঁটি ইসলাম ধর্মানুমোদিত নয়। ইহা হইতে আমাদের মনে হয় বাঙলাদেশের অধিকাংশ মুসলমানই সুফিসাধকদের দ্বারা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হইয়াছিল। এইসব সুফিসাধকেরা বাংলাদেশের মুসলমানদিগকে খাঁটি মুসলমান ধর্ম শিক্ষা দিতে পারে নাই । বাংলাদেশের লোক খুব সহজেই সাধু, সন্ন্যাসী, ফকির দরবেশের ভক্ত হইয়া পড়ে। অসংখ্য মুসলমান দরবেশ ও ফকির আসিয়া এই দেশের নানা স্থানে আশ্রম স্থাপন করিয়াছেন আর দলেদলে অন্য ধর্মাবলম্বীরা তাঁহাদের নিকট দীক্ষা গ্রহণ করিয়াছে। শেখ শুভোদয়া পুস্তকে আমরা দেখিতে পাই, শেখ একজন ঐন্দ্রজালিক ফকির! দলে দলে হিন্দুরা আসিয়া তাঁহার চরণতলে পতিত হইতেছে। তখনকার বৌদ্ধ সহজিয়াদের ধর্মের সহিত সুফিসাধকদের অনেকটা যোগ ছিল ।

~সুফিধর্মকে যদি আমরা বিশেষ করিয়া অনুধাবন করি তবে ইহার মধ্যে বৌদ্ধ, গ্রীক ও ইসলাম ধর্মের প্রভাব লক্ষ করিতে পারি।
• বুখারার সৈয়দ বংশজাদ মখদুম জাহানিয়া বুখারি একজন বিখ্যাত পরিব্রাজক ছিলেন। তিনি ভারত ও ভারতের বাহিরে তখনকার বহু সুফিকেন্দ্র পরিদর্শন করেন। তিনি বাংলাদেশেও আসিয়াছিলেন। এই সময়ে তিনি চিশতিয়া সাধক আলাউদ্দিনের মৃত্যুর পর তাঁহার জানাজা করেন। তিনি আলাউদ্দিনের পুত্রকে খোদাতত্ত্ব শিক্ষাদান করেন।

(হজরত জাহানিয়ান ইয়েমেন, ফিলিস্তিন, ইরাক, সিরিয়া, ইরান, ট্রান্সজর্ডান, খোরাসান এবং ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান সহ বহু দেশ ভ্রমণ করে জাহাঙ্গশত (বিশ্ব ভ্রমণকারী) উপাধি অর্জন করেন। তিনি অবশ্যই চীন, মঙ্গোলিয়া এবং সিলন ভ্রমণ করেছেন। তাঁর বহু ভ্রমণের সময়, তিনি একাই ৩০০ জনের বেশি সাধুর সংস্পর্শে আসেন।
তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, ভ্রমণ একজন ব্যক্তির আধ্যাত্মিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয়, কারণ ভ্রমন মানুষকে প্রকৃতির সাথে সংযোগ করতে এবং ঈশ্বরের সৃষ্টিকে উপলব্ধি করার সুযোগ করে দেয়। তিনি আরও বিশ্বাস করতেন যে ভ্রমনের সময় যে প্রতবন্ধকতা ও অসুবিধাগুলি সম্মুখীন হতে হয় তা একজন ব্যক্তিকে জীবনের ক্লেশগুলির প্রতি উদাসীন করে তোলে যা তাদের সৃষ্টিকর্তার প্রতি আস্থা এবং বিশ্বাসকে শক্তিশালী করে।
হজরত জাহানিয়ানের বেশিরভাগ যাত্রা হয়েছিল সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলকের শাসনামলে। হজরত জাহানিয়ান সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক, সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলকের চাচাতো ভাই এবং উত্তরসূরির শাসনামলে উচে অনেক সময় অতিবাহিত করেন এবং সুলতানের ধর্মীয় নীতিকে প্রভাবিত করেন। তিনি বেশ কয়েকবার দিল্লী সফর করেন।
*) ~কবি জসীম উদ্দীন


শ্রীহট্ট(বর্তমান সিলেট) ও সুফি শাহজালাল

শ্রীহট্টের শাহজালালের নাম শোনে নাই এমন লোক বোধহয় বাঙলাদেশে খুবই কম আছে। পূর্ববঙ্গের অনেক স্থানে এখনও নীল কবুতরগুলিকে শাহজালালের কবুতর বলিয়া গ্রাম্য লোকেরা হত্যা করে না। এই শাহজালাল সুহরাওয়ার্দীয় সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন।
তদানীন্তন শ্রীহট্টের হিন্দুরাজা গৌরগোবিন্দের অমানুষিক অত্যাচারে বুরহানউদ্দিন নামে কোনো মুসলমান অত্যাচারিত হইয়া গৌড়ের সুলতানের শরণাপন্ন হন। সুলতান বিরাট সৈন্যবাহিনীসহ সিকান্দর ঘাসিকে শ্রীহট্টে প্রেরণ করেন। এই সৈন্যদলের সহিত শাহজালালও যুদ্ধ করিয়াছিলেন বলিয়া কথিত। এই যুদ্ধে শ্রীহট্টের রাজা পরাজিত হইলে এই স্থান মুসলমানদের হস্তগত হয়। শাহজালাল তাঁহার পরবর্তী জীবন চারে ব্যয় করেন। ইবনে বতুতা তাঁহার ধর্মপ্রচার সম্বন্ধে বলেন, “এই পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীরা তাঁহার (শাহজালালের) কাছ হইতে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা লাভ করেন। করিয়াছিলেন।” এবং এজন্যই তিনি তাহাদের মধ্যে বাস। ~কবি জসীম উদ্দীন

সুফি শেখ ফরিদ ও ফরিদপুর

হার পর চিন্তিয়া সম্প্রদায়ের সাধকেরা বাঙলাদেশে প্রবেশ করেন। শেখ ফরিদ বাংলার সর্বপ্রথম চিন্তিয়া সাধক বলিয়া মনে হয়। তাঁহার সময়কাল ১১৭৬ হইতে ১২৬৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। প্রবাদ আছে যে, তিনি ফরিদপুর ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিশেষভাবে তাঁহার প্রভাব বিস্তার করিয়াছিলেন। ফরিদপুরে এই সাধকের কবর আছে। তাঁহাকে লইয়া ফরিদপুর অঞ্চলে নানাপ্রকার জনপ্রবাদ শোনা যায়। কেহ কেহ বলেন এই সাধক দিল্লি হইতে একবার ফরিদপুর আসিয়াছিলেন। তিনি যে-স্থানে বসিয়াছিলেন সেই স্থানে পরবর্তীকালে তাঁহার একটি নকল কবর রচিত হইয়াছে। প্রকৃত প্রস্তাবে তিনি এখানে দেহত্যাগ করেন নাই। মৌলভী এনামুল হক সাহেব লিখিয়াছেন, ফরিদপুরে শেখ ফরিদের একটি দরগাহ আছে। কিন্তু তাহা ভুল। ফরিদপুরের কাছারির উত্তর-পূর্ব কোণে সুপ্রসিদ্ধ যশোর রোডের পার্শ্বে এই ফকিরের একটি কবর আছে। এই জেলার নিম্নশ্রেণীর মুসলমানেরা মাঝে মাঝে এই কবরে আসিয়া মানত করিয়া যায়। কেহ কেহ এই কবরের নিকট মুরগি জবাই করে। শিক্ষিত মুসলমানরা এই কবরের প্রতি কোনোপ্রকারের শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন না।
অনেকের ধারণা শেখ ফরিদ আগে একজন ডাকাতের সর্দার ছিলেন। দিল্লি রাস্তার ধারে যেখানে তাঁহার নকল কবর রচিত আছে সেই স্থানে এই ফকিরের আস্তানা ছিল। পথিকদিগকে আতিথ্যে ভুলাইয়া তিনি তাহাদের সর্বস্ব লুণ্ঠন করিতেন। ফরিদপুরের শিক্ষিত জনসাধারণ কী ছোট কী বড় কেহই এই কবরকে বড় একটা শ্রদ্ধার চক্ষে দেখেন না। মাঝে মাঝে সুদূর পল্লীগ্রাম হইতে দুএকজন মুসলমান ফকির আসিয়া এই কবরের পার্শ্বে ধুনি জ্বালাইয়া আসন করিয়া বসে। তখন কিছুদিন এখানে গাঁজা ও তামাকু সেবনের উৎসব পড়িয়া যায়। চতুষ্পার্শ্বের গ্রাম হইতে বাউলেরা আসিয়া একতারা বাজাইয়া বিচারগান গাহিয়া থাকে। বটতলার পুস্তকের দোকানে ফরিদের যে-পুঁথি পাওয়া যায় তাহাতে বর্ণিত শেখ ফরিদের জীবন বিবরণীর সহিত দস্যু রত্নাকরের জীবনের কাহিনীর সাদৃশ্য আছে। শেখ ফরিদের নাম হইতেই ফরিদপুর জেলার নামকরণ করা হইয়াছে। মৌঃ এনামুল হক সাহেব লিখিয়াছেন, “প্রকাশ ফরিদপুর শহর শেখ ফরিদ পত্তন করিয়াছিলেন।” তাহা ভুল। এই শহর ইংরাজ আমলের রচনা। মুসলমান আমলে এই জেলার নাম ছিল ফরিদাবাদ। রাজধানী বর্তমান স্থানে ছিল না।
প্রেসিডেন্সি বিভাগের নানা স্থানের মুসলমানেরা এখনও শেখ ফরিদের শিরনি মানত করিয়া থাকে। চট্টগ্রাম শহরের নিকটবর্তী দশমা নামক নির্ঝরিণীর তীরে শেখ ফরিদ অনেক দিন সাধনা করিয়াছিলেন বলিয়া প্রকাশ। এই ঝরনার জল হিন্দু-মুসলমানেরা অতি পবিত্র বলিয়া ব্যবহার করিয়া থাকেন।
এইভাবে নানা শাখার সুফিসাধক বঙ্গদেশে প্রবেশ করিয়া ধর্মপ্রচার করিয়াছিলেন। তাহার মধ্যে খাজা মইনউদ্দিন চিশতির শিষ্য আবদুল্লা কিরমানি শায়খ, আলাউল হক্ক, নুরউদ্দিন কুতবই আলম প্রভৃতি সুফি সাধকগণের নাম করা যাইতে পারে। **
চিশতিয়াদের পরে কলন্দরিয়াহ সম্প্রদায় বাংলাদেশে প্রবেশ করিয়াছিলেন। এই সম্প্রদায়ের সাধকদের মধ্যে শাহ শফিউদ্দিনের নাম
হবে। সাধকগণ তাই শুরু করেন দেহ-বিশ্লেষণ, যা থেকে তাঁরা লাভ করেন এক অমূল্য সম্পদ।

আলোক সাঁই ও এর গুঢ় তত্ত্ব

কিরি মতে আর এক তত্ত্ব ‘আলেক সাঁই'। অনেক গবেষকের মতে আরবি ‘আলাক' শব্দ থেকে 'আলেক' শব্দের উৎপত্তি। 'আলাক' মানে বীর্য। সুতরাং লালনশাহী ফকির বসম্প্রদায়ের ‘আলেক সাঁই' আসলে তাঁদের ‘বীর্য প্রভু'। এ থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, ফকির সম্প্রদায়ের লোকেরা বুঝি 'বীর্য'কে প্ৰভু জ্ঞানে পূজা করে। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে তা নয়।
'আলেক সাঁই' শব্দের অর্থ—‘অলক্ষ্য স্বামী'। খোদাতালার অনন্ত নাম, আর অসংখ্য সাধকের অনন্ত সাধনা এবং অনন্ত সম্বোধন। আমি লালন শাহের জীবনী ও সাধনা নিয়ে ক্ষেত্রানুসন্ধানে কুষ্টিয়া-যশোরের বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমণ করেছি। অসংখ্য লালনপন্থী সাধকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। লালনের সাক্ষাৎ-শিষ্য ভোলাই শাহ্র সাথেও বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। ১৩ পরবর্তী সময়ে লালনের উত্তরসূরি সাধক পাঞ্জু শাহের পুত্র রফিউদ্দীন খোন্দকারের সঙ্গে গভীরভাবে মিলিত হয়েছি। তাঁদের কাছ থেকে যা জেনেছি, তা থেকে বলতে পারি যে, সর্বক্ষণ এক ও অদ্বিতীয় স্রষ্টার স্মরণ এবং ভজন সাধনই ছিল লালনের মূল লক্ষ্য। তা ছাড়া আমি হাজার ফকিরের সম্মেলন দেখেছি। তাঁরা সারিবদ্ধভাবে যখন খাদ্যবস্তু নিয়ে বসেন, তখন সমবেতভাবে ‘আল্লাহ-আলেক' উচ্চারণ করেন। তারপর আহার শুরু হয়। তাই ‘আলেক’ বলতে যে আল্লাহকে বুঝায় এ কথা নতুন করে আর বলার দরকার নেই ।
আমার ক্ষেত্রানুসন্ধানের অভিজ্ঞতা থেকেই তা পরিষ্কার হয়েছে। লালন-গীতিতে ব্যবহৃত ‘আলেক সাঁই' শব্দটির সমার্থক হিসেবে 'মনের মানুষ’ ‘অচিন পাখি’ ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার আছে। কৌতূহলের ব্যাপার এই যে, লালনের এই গান থেকেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনদেবতা'র প্রেরণা লাভ করেছিলেন বলে লন্ডনে প্রদত্ত তাঁর বিখ্যাত হিবার্ট বক্তৃতায় উল্লেখ করেন। শুধু তাই নয়, তিনি লালনের 'খাঁচার ভিতর অচিন পাখি' শীর্ষক গানটির অংশবিশেষ অনুবাদ করেও লালনদর্শনের প্রতি শ্রদ্ধানিবেদন করেন। লালনশাহী বাউল সুর তাঁকে কতখানি প্রভাবিত করেছিল এসব তারই যথার্থ প্রমাণ। এখানে রবীন্দ্রনাথের ভাষণের একাংশ উদ্ধৃত করছি :
‘এই লোকেরা তাদের গান গেয়ে ঘুরে বেড়ায়, যার মধ্যে একটি আমি বহু বছর আগে আমার রাস্তার পাশের জানালা থেকে শুনেছিলাম, প্রথম দুটি বিচরণ লাইন আমার মনে গেঁথেছিল।
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে –যায়
তারে ধরতে পারলে মন বেড়ী দিতাম পাখির পা’য়!!

"These people roam about singing their songs, one of which I heard years ago from my roadside window, the first two lines roaming inscribed in my mind.
Nobody can tell whence the bird unknown
Comes into my cage and goes out.
I could feign put round its feet the fetter of my mind. Could I but capture him.


সুফি ও বৌদ্ধের সম্মিলনঃ

সুফিসাধকদের সহিত এদেশের বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মিলনের সেতুপথ পূর্ব হইতেই রচিত হইয়াছিল। তাই মুসলমানেরা এদেশে আসিলে দলেদলে বৌদ্ধভাবাপন্ন হিন্দুদের ইসলাম ধর্মগ্রহণে বিশেষ অন্তরায় উপস্থিত হইল না। আমরা পূর্বেই ইঙ্গিত করিয়াছি হিন্দুধর্মের গোঁড়ামি ও ছুৎমার্গ তাহাদের ইসলামগ্রহণের পথ আগেই কতকটা সুগম করিয়া রাখিয়াছিল ।
বৌদ্ধদের মধ্যে যাহারা মুসলমান ধর্ম গ্রহণ না করিল তাহারা হিন্দুসমাজের অন্ত্যজ জাতি হইয়া রহিল। ~কবি জসীম উদ্দীন

নাথ সম্প্রদায়

নাথ সম্প্রদায়-এর উত্থান ও এর চমকঃ

মুসলমান আগমনের বহুপূর্বে বৌদ্ধধর্মের পাশাপাশি নাথসম্প্রদায়ের উদ্ভব হইয়াছিল। মধ্যএশিয়া হইতে শরহ নামক একজন প্রতিভাশালী সাধুপুরুষ ভারতবর্ষে আগমন করেন। ইনি ভারতবর্ষে আসিয়া বিপুল যশোলাভ করেন। ইনি যে-স্থান হইতে আগমন করেন সেখানে একটি বিচিত্র ধর্মভাব প্রচলিত ছিল। সকলেই বুঝিত ভগবানের সৃষ্টি বিচিত্র। সৃষ্টিতত্ত্ব অর্থাৎ জীবন কেমন করিয়া সংসারে আগমন করিল, সঙ্গে সঙ্গে জগৎ কেমন করিয়া উদ্ভূত হইল এই সমস্ত ব্যাপার লইয়া সৃষ্টির মূল কী
তাহাই এই স্থানের কয়েকজন অধিবাসী জানিবার চেষ্টা করেন। ফলে প্রতিপন্ন হয় যে, স্ত্রী এবং পুরুষ ব্যতীত সৃষ্টি সম্ভব নয়। এই স্ত্রী-পুরুষের সংঘটনে জগৎ-ব্যাপার হইয়াছে। ইঁহারা কী সম্প্রদায় ছিলেন তাহা জানিবার উপায় নাই। তবে কয়েকটি ছিন্নপত্র হার্নলি প্রভৃতি পণ্ডিত আবিষ্কার করিয়াছেন ।
এই সমস্ত ছিন্নপত্র হইতে এশিয়া মাইনরের ধর্মমত কিঞ্চিৎ জানিবার সুযোগ হইয়াছে। শরহ ইঁহাদেরই নিকট হইতে এই অদ্ভুত ধর্মতত্ত্বের নিগূঢ় ব্যাপার গ্রহণ করিয়া ভারতবর্ষে প্রচার আরম্ভ করেন। ইহারই ফলে ভারতবর্ষের মধ্যে নানা সম্প্রদায়ের ব্যক্তি শরহের মতবাদ কথঞ্চিৎ গ্রহণ করিয়া আপনাদের ধর্মমতের সহিত তাহা মিশাইয়া দেয়। এশিয়া মাইনরের এই ধর্মমতে দৈন্যকে, বিনয়কে খুব উচ্চ স্থান দেওয়া হইয়াছে । শরহ তদনুসারে যে-ধর্মমত প্রবর্তন করেন তাহার একটি প্রধান শিক্ষা হইল এই যে, বিনয়ের ন্যায় ধর্ম নাই। মানুষ যত বাহিরে দীনভাব অবলম্বন করিবে ভিতরে সে ততই সম্পন্ন হইতে পারিবে। হৃদয়ের মধ্যে স্ত্রী-পুরুষের সৃষ্টির সূচনা, চিন্তা ও ধ্যান আনিতে হইবে। ভারতের বড় বড় পণ্ডিত তাঁহার শিষ্য হইলেন ।

একায়ন মতঃ

ই সময়ে আর-একটি মত বেশ প্রচলিত ছিল। তাহার নাম একায়ন মত। এই একায়ন মতের উপর পঞ্চরান মতের প্রভাব যথেষ্ট ছিল। পঞ্চরান মতে সৃষ্টিতত্ত্ব-ব্যাপার অতি জটিলভাবে আলোচিত। এখানেও পুরুষ-স্ত্রী সংযোগে সৃষ্টির একটা প্রক্রিয়া বর্ণিত হইয়াছে । পঞ্চরান মত হইতে শাক্ত মতের সূচনা হয় । ইহাতেও এইরূপ সৃষ্টিতত্ত্ব। টীকাভাষ্যকারেরা একটা আবরণ দিয়া এই তত্ত্বের একটা দার্শনিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু শরহের নিকট অনেককেই মস্তক অবনত করিতে হইয়াছে। তিনি পরবর্তী যুগের হেরুক বজ্রভাবের একটা আশ্চর্যজনক পরিকল্পনা করিয়া মানবমনে বিপুল আনন্দের স্রোত বহাইয়াছেন। বৌদ্ধদের বজ্রযান, মন্ত্রযান মতবাদের মধ্যেও এই অদ্ভুত মত প্রবেশ করিয়াছে, কিন্তু এত ধীরে, এত নীরবে যে, সহসা তাহার সন্ধান পাওয়া যায় না। খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতক পর্যন্ত ভারতের ধর্মমত, বিশেষত উত্তর ভারতের ধর্মমত পর্যালোচনা করিলে এই সমস্ত উক্তির সার্থকতা প্রমাণ করিতে পারা যায়।

বৈষ্ণব সম্প্রদায়-উইকি

বৈষ্ণব সম্প্রদায়ঃ(বরিশাল থেকে বৈষ্ণবের উত্থান- ভারত উপমহাদেশ থেকে বিশ্বজয়)

নেকেই জানেন যে, বরিশালের চেঁদো হইতে একটি সম্প্রদায় আপনার প্রভুত্ব বিস্তার করিতে করিতে নেপাল পর্যন্ত গমন করে। ইহারা বর্তমান সময়ে নাথসম্প্রদায় নামে পরিচিত। একদিকে ভগবৎ ও শাক্তসম্প্রদায় বিষ্ণু মতাবলম্বী বহু সহস্র লোক সংগ্রহ করিল। ইহারা পরযুগে বৈষ্ণব নামে প্রখ্যাত হইয়াছে। খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতকের শেষ পর্যন্ত ইহাদের প্রাচীন মতের প্রতিপত্তি দেখিতে পাওয়া যায়। এই বৈষ্ণবধর্মের প্রবল প্লাবনে প্রায় অর্ধ ভারত ভাসিয়া গেল। মহাপ্রভু মাটির মাদল বাজাইয়া বঙ্গদেশকে পাগল করিলেন। তিনি আচণ্ডালে হরিনাম বিতরণ করিতে লাগিলেন । নিম্নশ্রেণীর প্রায় সকল হিন্দু তাঁহার চরণতলে প্রণত হইল। যে-সকল বৌদ্ধ ভিক্ষু হিন্দুসমাজের অন্ত্যজ জাতি হইয়া সমাজের নিম্নস্তরে কাটাইতে ছিল তাহারা মহাপ্রভুর ভক্ত হইল। মহাপ্রভু নারীজাতির স্পর্শ হইতে দূরে থাকিতে তাঁহার শিষ্যদিগকে উপদেশ দিতেন। কিন্তু নিত্যানন্দের অনুরোধে পরবর্তী জীবনে তিনি শিষ্যদের বিবাহে কোনো আপত্তি করেন নাই। নিত্যানন্দ দুই বিবাহ করেন। তবুও এ-বিষয়ে মহাপ্রভুর প্রতিবাদের কোনো পরিচয় আমরা পাই না । বরঞ্চ “নিত্যানন্দের বিবাহ তিনি সমর্থন করিয়াছিলেন বলিয়াই প্রকাশ। তিনি বলিতেন নিত্যানন্দ মুক্তপুরুষ, কোনোকিছুতেই তাঁহার পাপ স্পর্শে না । ”
নিত্যানন্দই অসংখ্য বৌদ্ধকে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত করেন। তাহার ফলে বৌদ্ধ সহজিয়াদের তান্ত্রিক সাধনপ্রণালী ধীরে ধীরে বৈষ্ণবধর্মে প্রবেশ করে। বৈষ্ণবেরাও প্রকৃতি লইয়া সাধন করিতে লাগিল। ইহাতে গোঁড়া বৈষ্ণবসমাজ ভীষণ চটিয়া গেল ।
১৮ শতাব্দীর প্রথম অর্ধভাগে নবাব আলিবর্দি খাঁর উচ্চকর্মচারীদের মধ্যস্থতায় সহজিয়াদের সহিত গোঁড়া বৈষ্ণবদের এক তর্কযুদ্ধ হয়। ইহাতে বারাণসী, জয়পুর ও বাঙলাদেশের বহুস্থান হইতে বড় বড় বৈষ্ণব আসিয়া যোগদান করেন। এই তর্কযুদ্ধে সহজিয়া বৈষ্ণবদেরই জিত হইয়াছিল।
সহজিয়া বৈষ্ণবদের বিষয়ে শ্রদ্ধাস্পদ মণীন্দ্রমোহন বসু মহাশয় তাঁহার ‘Chaitanya Shahajia Cult’ গ্রন্থে বিশেষভাবে আলোচনা করিয়াছেন। আমাদের ধারণা বর্তমান বাউলসম্প্রদায় এই বৈষ্ণব সহজিয়াদের নিকটতম গোষ্ঠী। বৌদ্ধ সহজিয়া ও নাথ সহজিয়ারা তাহাদের প্রপিতামহ।
(১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে আন্তর্জাতিক স্তরে বৈষ্ণব দর্শনের প্রসারে বিশেষ ভূমিকা নিয়ে আসছে গৌড়ীয় বৈষ্ণব শাখাটি। মুখ্যত, ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নদীয়া জেলার অন্তর্গত নবদ্বীপ গ্রামে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর হাত ধরেই এই গৌড়ীয় বৈষ্ণব শাখাটির প্রচলন। চৈতন্য মহাপ্রভুর ভাবধারাকে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ ইসকন "হরে কৃষ্ণ" আন্দোলন জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে ভৌগোলিক প্রসার ঘটিয়ে সম্পাদন করছে। বহু বিদেশিও এই নবদ্বীপে এসে সমগ্র বিশ্বে বৈষ্ণব দর্শনের প্রচারের জন্য অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে চলেছেন। এছাড়াও অতি সম্প্রতি অন্যান্য বৈষ্ণব সংগঠনও পাশ্চাত্যে ধর্মপ্রচারের কাজ শুরু করেছে।*)

ন্যাড়া বীরভদ্র

ন্যাড়া সম্প্রদায় :

নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্র ন্যাড়াসম্প্রদায়ের প্রবর্তন করেন বলিয়া জনশ্রুতি আছে। তিনি নাকি ঢাকা অঞ্চলে অনেক অলৌকিক শক্তি প্রদর্শনপূর্বক ন্যাড়া মত সংস্থাপন করেন। কেহ কেহ বলেন, নিত্যানন্দের ত্যাজ্যপুত্র হইয়া তিনি বীরভূমে যাইয়া বাস করিতে থাকেন।
অক্ষয়কুমার মৈত্র মহাশয়ের 'ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়' গ্রন্থে উক্ত হইয়াছে যে, ন্যাড়াসম্প্রদায়ের বাউলদের কেহ কেহ নানা বর্ণের চীরসমূহ একত্র করিয়া আলখেল্লা প্রস্তুত করে। ইহার নাম চিন্তাকন্থা । শুনিতে পাই প্রকৃতিসাধনসংক্রান্ত কোনো কোনো গুহ্য পদার্থে কোনো কোনো চীর রঞ্জিত করা হয়। আমরা কিন্তু এই ধরনের কন্থা পরিহিত কোনো বাউলই দেখিতে পাই নাই। মৈত্র মহাশয় যে-সময়ে এই গ্রন্থের মালমশলা সংগ্রহ করেন হয়তো তখন এরূপ বাউলের অস্তিত্ব ছিল।

দরবেশ সম্প্রদায়ঃ

চৈতন্যদেবের অল্পকাল পরে বাউলদের আর-একটি শাখা দরবেশ সম্প্রদায়ের আবির্ভাব হয়। সনাতন গোস্বামী এই সম্প্রদায়ের প্রবর্তক বলিয়া প্রবাদ আছে। পূর্বে তিনি মুসলমান ছিলেন। তাঁহার পোশাক পরিচ্ছদও নাকি দরবেশের মতো ছিল। তাই তাঁহার শিষ্যরা তাঁহার পোশাকের অনুসরণ করে ৷
এই তর্কযুদ্ধের সময় নবাব আলিবর্দিকে বৈষ্ণবদের লিখিত একখানা দরখাস্ত শ্রদ্ধেয় দীনেশবাবু তাঁহারই গ্রন্থে উদ্ধৃত করিয়াছেন।
(বাউল ও দরবেশের বলিয়া থাকেন যে, সনাতন গোস্বামী যে সময় দরবেশের রুপে ভ্রমণ করেন তৎকালে ঐ মতগুলি প্রচার করেন। শ্রীনিত্যানন্দানুগ শ্রী বীরভদ্রকে নেড়া ও সাঁইয়েরা প্রবর্তক বুলি পরিচয় দেন। সহজিয়া বৈষ্ণবগণ শ্রীরূপ গোস্বামীর সঙ্গে মিরাবা মলন উদ্দেশ করিয়া আপনাদের কদৰ্য্যমত সংস্থাপন করেন।
যেহেতু সাঁই, বাউল, দরদেশ ইঁহারা সকলেই নিরাকার ও চরমে নিৰ্বিশেষ মতটাকে আদর করেন। মুক্তি লাভ করিলে জীবের কৃষ্ণদাস্য থাকিবে না, বরং জীব স্বয়ং কৃষ্ণ হইয়া পড়িবেন, এরূপ অনেক পদ তাঁহারা গান করিয়া থাকেন। নিগম কল্পতরু, শরণটীকা, রাগবর্ত্ম চন্দ্রিকা প্রভৃতি অনেকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অশুদ্ধ বাঙ্গালা সংস্কৃতযুক্ত পুস্তক তাঁহারা রচনা করিয়া গোপনে রাখিয়া থাকেন। ঐ সকল পুস্তক গুলি তাঁহারা সাধারণকে পড়িতে দেন না। আমরা অনেক কষ্টে সংগ্রহ করিয়া পড়িয়াছিলাম। যাহা হউক বাউল দরবেশী মত যে অদ্বৈতবাদ ইহাতে সন্দেহ নাই। অতএব ঐ মত সম্পূর্ণ রূপে বৈষ্ণব বিরুদ্ধ। উপাসনা কার্য্যও তাঁহাদের নিতান্ত অবৈষ্ণব। বৈষ্ণবের মতে স্ত্রীসঙ্গ-প্রবৃত্তি নিতান্ত অহিতকর। যে পৰ্য্যন্ত ঐ প্রবৃত্তিটা সাধাক-হৃদয় পরিত্যাগ করে নাই, সে পর্যন্ত দেহ যাত্রা নির্বাহের জন্য বর্ণাশ্রম ধর্ম আশ্রয় করিয়া বিবাহিত স্ত্রী স্বীকার করাতে দোষ নাই। বিবাহিত স্ত্রী স্বীকার করিয়া সাধক গৃহী বৈষ্ণব নাম প্রাপ্ত হয়।– লেখা সুত্রঃ সাজ্জানা তোশানী

সনাতন গোস্বামী



জন্ম

নাতন গোস্বামী আনুমানিক ১৪৮৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন৷ তাঁর জন্মস্থান নিয়ে তাঁর জীবনীকারদের মধ্যে বিতর্ক আছে৷ একটি মত অনুযায়ী তাঁর জন্ম অধুনা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নৈহাটিতে৷ বাংলার নিরিখে এই নৈহাটিই তাঁদের আদিবাস৷ অন্যান্য পণ্ডিতদের মতে, তাঁর জন্ম পূর্ববঙ্গের (অধুনা বাংলাদেশ) যশোর জেলার ফতেপুরে বা বাকলা-চন্দ্রদ্বীপে৷ তবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে তাঁর জন্ম বাংলার সীমানার মধ্যেই হয়েছিল৷

শৈশবকাল

তাঁর পিতার নাম ছিল মুকুন্দ, তিনি ছিলেন গৌড়ের সুলতান জালালুদ্দিন ফতে শাহ (রাজত্বকাল-১৪৮১-১৪৮৭) এর ব্যক্তিগত সচিব। সনাতন গোস্বামী ছিলেন মুকুন্দের জ্যেষ্ঠ সন্তান, তাঁর ছোট ভাইয়েরা হলেন যথাক্রমে শ্রীরূপ গোস্বামী এবং শ্রীবল্লভ (অনুপম) গোস্বামী। বলা হয় সনাতন গোস্বামীর পূর্বনাম ছিল অমর এবং শ্রীরূপ গোস্বামীর পূর্বনাম ছিল সন্তোষ। সনাতন ও তাঁর ভাই দুজনেই তৎকালীন প্রথিতযশা ন্যায়শাস্ত্রবিদ বাসুদেব সার্বভৌম ভট্টাচার্যের কাছে ন্যায় ও বেদান্তের পাঠ গ্রহণ করেছিলেন। তাঁরা সার্বভৌমের ভ্রাতা মধসূদন বিদ্যাবাচস্পতির কাছেও শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। এই মধসূদন বিদ্যাবাচস্পতির কাছেই সনাতন গোস্বামী অতি শৈশবেই দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন।
তাঁদের পিতৃবিয়োগের পর শ্রী সনাতন গোস্বামী খানিকটা বাধ্য হয়েই বাংলার তৎকালীন নতুন শাসক আলাউদ্দিন হুশেন শাহের দরবারে শাকর মল্লিক (ট্রেজারার) পদে আসীন হন, এবং শ্রী রূপ গোস্বামী বৃত হন দবীর-ই-খাস (ব্যক্তিগত সচিব) পদে।

চৈতন্যদেবের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ

শ্রী রূপ এবং সনাতন গোস্বামীর বাস ছিল গৌড়ের রামকেলিতে। ১৫১৩ সালেই আসে সেই শুভক্ষণ৷ রামকেলির পূণ্যভূমিতেই পূজ্যপাদ শ্রী শ্রী মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের সাথে সনাতন এবং অন্য দুই ভাইয়ের ঘটে প্রথম সাক্ষাৎকার। প্রথম সাক্ষাৎকারের পরেই মহাপ্রভু এই তিন ভাইয়ের নামকরণ করেন যথাক্রমে সনাতন, রূপ এবং অনুপম। মহাপ্রভুর সাথে এই অভূতপূর্ব যোগাযোগের পরেই তিন ভাই সিদ্ধান্ত নেন যে তারা শ্রী চৈতন্যদেবের শিষ্যত্ব গ্রহণ করবেন। এ বিশ্ব চরাচরে কৃষ্ণ প্রেম বিতরণ ও ভগবৎ দর্শন প্রচারে বাকী জীবন অতিবাহিত করবেন এবং শ্রী চৈতন্যদেবের প্রব্রজ্যার অনুগামী হবেন।
রূপ গোস্বামীর পদত্যাগপত্র অতি সহজেই সুলতানের দরবারে গৃহীত হল, তিনি চাকুরি জীবন থেকে পেলেন মুক্তি। কিন্ত গোল বাধলো সনাতনকে ঘিরে। তার দেওয়া পদত্যাগপত্র সুলতানের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হল। তিনি শারীরিক অসুস্থতার কথা বলে দপ্তরে আসা বন্ধ করলেন। এরপর সুলতান তার ব্যক্তিগত চিকিৎসককে পাঠান সনাতনের চিকিৎসার জন্য, তারা পরীক্ষা করে সুলতানকে ফিরে এসে বলেন সনাতন সম্পূর্ণরূপে সুস্থ।
এবার সুলতান নিজেই উপস্থিত হলেন সনাতনের বাসগৃহে, তাকে আপ্রাণ বোঝাবার চেষ্টা করলেন পুনরায় সরকারি কাজে মনোনিবেশ এবং রাজকার্যে সহায়তা করার জন্য। এছাড়া অতি শীঘ্রই তিনি প্রতিবেশী রাজ্য ওড়িষার বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করবেন সেখানে সনাতনের মতো একজন স্থিতধী, প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্বের সুপরামর্শ অত্যন্ত জরুরী। কিন্ত বিধি বাম। সনাতন তার সিদ্ধান্তে অনড়, তিনি চাকুরি জীবন থেকে মুক্তি চান। ব্যর্থ মনোরথ হয়ে সম্রাট হুশেন শাহকে ফিরতে হল খালি হাতেই। এর পরিণতি হিসেবে সম্রাট হুশেন শাহ সনাতনকে কারারুদ্ধ করলেন।
গরাদের অন্তরালেই সনাতনের নিস্তরঙ্গ জীবন কাটে। হঠাৎ রূপ গোস্বামীর একটি চিঠি সনাতনের হাতে এল, তার মর্মার্থ এই- চৈতন্য মহাপ্রভু পুরীধাম থেকে বৃন্দাবনের পথে রওনা দিয়েছেন, রূপ ও অনুপম বৃন্দাবনে তার সাথে মিলিত হতে চান। সনাতনের দেহ মন উদ্বেলিত হয়ে উঠলো, তাকে আপৎকালীন খরচের জন্য রূপ যে গচ্ছিত অর্থ রেখেছিল তিনি পত্রপাঠ সেই অর্থ কারা আধিকারিককে উৎকোচ দিয়ে অনতিবিলম্বে গঙ্গা পার হয়ে বৃন্দাবন অভিমুখে চলে গেলেন চৈতন্যদেবের সাথে সাক্ষাৎকারের উদ্দেশ্যে। তথ্য সুত্রঃ উইকি
রূপ ও সনাতনের শাস্ত্রজ্ঞান ছিল অপরিসীম। উভয় ভ্রাতা ৪০ বছরের বেশি মথুরা, বৃন্দাবন ও কাশীধামে ধর্ম সাধনা ও শাস্ত্র চর্চায় অতিবাহিত করেন। তারা যেমন পন্ডিত তেমনি সর্বত্যাগী বৈষ্ণব ভক্ত সন্যাসী ছিলেন। তারা কাশীধামে শ্রীচৈতন্যদেবের কৃপা লাভ করেন। জ্ঞান ও ভক্তির অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছিল রুপ-সনাতনের ভক্তি গ্রন্থ রচনায়। বৃন্দাবনের আচার্য পদে রূপ ও সনাতকে বরণ করা হয়েছিল।
গ্রন্থ রচনা

নাতন শেষ জীবনে বৈষ্ণব তোষণী নামে এক বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন। তাদের ভ্রাতুপুষ্প শ্রীজবি গোস্বামী তাদের নির্দেশে ঐ গ্রন্থের সংক্ষেপ করে নামকরণ করেন ‘লঘু তোষণী’ । লঘু তোষণী হতে রূপ ও সনাতনের বংশ পরিচয় পাওয়া যায়। তারা বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের গৌরব। তথ্যসূত্র: সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস


তবে এই দরবেশ মুলত; সেই উচ্চমার্গীয় আদ্ধাত্যবাদের সেই মুসলিম সুফি- দরবেশ। নীচের এই খবরটি পড়লে কিছু ধারনা আসবে এদের ব্যাপারে;
দরবেশের দরবারে বাউল ফকিরদের গান মেলা লেখা সুত্রঃ বাংলাএক্সপি ও অন্যান্য মিডিয়া

কর সংক্রান্তি উপলক্ষে বীরভূমের অজয় নদের তীরে হয় জয়দেব কেন্দুলি মেলা। একসময় প্রচুর পরিমাণ বাউলরা এই মেলায় এসে গান গাইতেন। যে কারণে এই মেলাকে বাউল মেলাও বলা হয়ে থাকে। এই জয়দেব মেলা শেষে চিরাচরিত প্রথা মেনে পরবর্তী তিন দিনের জন্য দুবরাজপুরের পাহাড়েশ্বরের পাশে থাকা দরবেশ পাড়াতে বাউল, ফকির, সাধু ও বৈষ্ণব এসে জমায়েত হয়। রীতি মেনে বিগত ৫৫০ বছর ধরে এই বাউল, ফকিরি ও লোকগীতির আসর অনুষ্ঠান হয়ে আসছে।
বীরভূমের দুবরাজপুরের পাহাড়েশ্বর বা মামাভাগ্নে পাহাড়ের পাশেই রয়েছে দরবেশ পাড়া। এই দরবেশ পাড়াতেই রয়েছে সাধক পুরুষ অটল বিহারী দরবেশের সমাধি। রীতি মেনে অর্থাৎ সাধক পুরুষ অটল বিহারী দরবেশের সমাধিস্থলে প্রতিবছর মাঘ মাসের ৩ থেকে ৫ তারিখ পর্যন্ত এই তিনদিন বসে বাউল গানের আসর। আর এই বাউল গানের আসরে অংশগ্রহণ করেন অজস্র বাউল শিল্পীরা। এই বাউল শিল্পীদের অংশগ্রহণে এই শহরে বাউলের আসরের সাথে জয়দেব মেলার রয়েছে সাদৃশ্য।
জয়দেব মেলা থেকে এই দরবেশ বাবার আখড়ায় আসার জন্য সাধুসন্ত, আউল, বাউল, সাঁই, দরবেশদের নিমন্ত্রণ জানানো হয় জয়দেব মেলা প্রাঙ্গণের আখড়ায় আখড়ায়। আর সেই নিমন্ত্রণ পেয়েই সাধুসন্ত, আউল, বাউল, সাঁই, দরবেশরা বীরভূমের পাহাড়েশ্বরের পাশে থাকা দরবেশে চলে আসেন। জয়দেব মেলা সমাপ্তির পর জয়দেব মেলা প্রাঙ্গণ থেকে বাউল গানকে সঙ্গী করে এই সমস্ত মানুষেরা জমায়েত করেন দরবেশ বাবার আখড়ায়।

~সমাপ্ত
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০২২ রাত ১১:১৩
২৮টি মন্তব্য ২৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেনারসী রঙে সাজিয়ে দিলাম চায়ের আসর=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫২



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনে কি পড়ে সেই স্মৃতিময় সময়, সেই লাজুক লাজুক দিন,
যেদিন তুমি আমি ভেবেছিলাম এ আমাদের সুদিন,
আহা খয়েরী চা রঙা টিপ কপালে, বউ সাজানো ক্ষণ,
এমন রঙবাহারী আসর,সাজিয়েছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজ্ঞানময় গ্রন্থ!

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪২

একটু আগে জনৈক ব্লগারের একটি পোস্টে কমেন্ট করেছিলাম, কমেন্ট করার পর দেখি বেশ বড় একটি কমেন্ট হয়ে গেছে, তাই ভাবলাম জনস্বার্থে কমেন্ট'টি পোস্ট আকারে শেয়ার করি :-P । তাছাড়া বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

অস্ট্রেলিয়ার গল্প ২০২৪-৪

লিখেছেন শায়মা, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৫


চলে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছিলো। ফুরিয়ে আসছিলো ছুটি। ছোট থেকেই দুদিনের জন্য কোথাও গেলেও ফিরে আসার সময় মানে বিদায় বেলা আমার কাছে বড়ই বেদনাদায়ক। সেদিন চ্যাটসউডের স্ট্রিট ফুড... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসের নায়িকাকে একদিন দেখতে গেলাম

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৫

যে মেয়েকে নিয়ে ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম, তার নাম ভুলে গেছি। এ গল্প শেষ করার আগে তার নাম মনে পড়বে কিনা জানি না। গল্পের খাতিরে ওর নাম ‘অ’ ধরে নিচ্ছি।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

×