অবশেষে চলে গেলেন আমাদের ঘোর লাগা দুরন্ত কিশোর বেলায় ডুয়ার্সের চা বাগানের আবলুস কাঠের গড়নের দুর্দান্ত দেহবল্লভীর মদেশিয়া মেয়েদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া আর দুই বাংলার তাবৎ নারীদের সপ্নের চরিত্র ‘দীপাবলী’ সৃষ্টির নায়ক সমরেশ মজুমদার। দীপাবলী চা বাগান আর জঙ্গলের কত গল্প শুনেছি আপনার কাছে। দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়ে কিংবা হবেওনা কোনদিন আপনার চোখে দেখেছি তা কৈশোর আর যৌবনে। আরো গোয়েন্দা কাহিনী আর কিশোর উপন্যাসে সপ্নের ঘোরে বুঁদ হয়ে থেকেছি আমরা। একে একে হারিয়ে ফেলছি বন্ধু প্রিয়জন আর সপ্নের সব মানুষদের। না সপ্নের মানুষ নয় সপ্ন দেখানো এই সব মানুষদের। ওপার বাংলার যে তিন মহারথী আমাদের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল; সুনীল,শির্ষেন্দু আর সমরেশ তাঁদের দু’জন আজ চির প্রয়াণে। সশ্রদ্ধা প্রিয় লেখক। আপনি চিরদিন আমাদের অন্তরে থাকবেন...।
***
(এক প্রগতিশীল সংস্কারমুক্ত নারী চরিত্রের নাম দীপাবলি। তিনিই সমরেশ মজুমদার রচিত সাতকাহন উপন্যাসের কালজয়ী চরিত্র। কি করুণ ট্র্যাজেডি থেকে উঠে এসে দীর্ঘকাল ধরে একাকিনী পাখির মতো সংগ্রাম করে যেতে হয়েছিল তাকে!)
প্রয়াত সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার। গত কয়েক দিন ধরেই অসুস্থতার সঙ্গে লড়াই করে চলেছিলেন তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই লড়াইয়ে জিততে পারলেন না ‘কালপুরুষ’। সোমবার বিকেলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি।
ফুসফুস ও শ্বাসনালীর সংক্রমণ নিয়ে গত কয়েক দিন ধরেই ভুগছিলেন তিনি। ২৫ এপ্রিল কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। রক্তে কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রাও বেড়ে গিয়েছিল। তবু চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছিলেন কখনও কখনও। রবিবার পরিবারের সূত্রে জানানোও হয়, কিছুটা ভালো আছেন তিনি। কিন্তু তার পরেও শেষরক্ষা হল না।
গত দশ বছরের বেশি সময় ধরেই নাকি ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজের (সিওপিডি) সমস্যা ছিল তাঁর। সেই সমস্যার চিকিৎসাও হত। কখনও কখনও বাড়াবাড়িও হয়েছে। শনিবার সন্ধ্যায় সমরেশ মজুমদারের মেয়ে দোয়েল সংবাদমাধ্যমকে জানান, তার আগের দু’দিন কেবিনে রাখা হয়েছিল প্রখ্যাত সাহিত্যিককে। কিন্তু শনিবারই বিকেলে তাঁকে আইসিইউতে পাঠানো হয়। চিকিৎসকরা পরের ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণে রাখবেন বলেছিলেন। তার মধ্যেই ঘটে গেল অঘটন।
হাসপাতাল সূত্রে জানানো হয়েছে, বেশ কয়েকটি স্ট্রোক (multiple right-sided embolic infarcts) হয়েছিল তাঁর। এছাড়াও বালবার পালসি (speech and swallowing impairment)-তে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। এর কারণেই ফুসফুস বিকল হয়ে যায় তাঁর। দীর্ঘ দিন সিওপিডি, অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া এবং myasthenia gravis-এর মতো সমস্যাও ছিল তাঁর। সব ক’টি সমস্যা একসঙ্গে এই কঠিন পরিস্থিতি ডেকে আনে।
সোমবার বিকাল ৫টা ৪৫ মিনিটে তাঁর জীবনাবসান হয়।
৭৯ বছর বয়সি এই সাহিত্যিকের অসুস্থ হওয়ার পর থেকেই বাংলার সাহিত্যিক মহলে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত উদ্বেগই ঠিক প্রমাণিত হল। ‘কালবেলা’, ‘কালপুরুষ’, ‘সূর্য ঢলে গেল’র শ্রষ্টা পাড়ি দিলেন অনন্তের পথে।
জি নিউজ থেকে জানা যায়, সমরেশ মজুমদারের ২০১২ সালেও একবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সেসময়ও তাকে ভেন্টিলেশনে দেওয়া হয়েছিল। এই মুহূর্তে তাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় সমস্ত পদক্ষেপ নিচ্ছেন চিকিৎসকরা।
১৯৪২ সালে উত্তরবঙ্গের গয়েরকাটায় জন্ম এই বিখ্যাত লেখকেরা প্রাথমিক শিক্ষা জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলে। তাই হয়তো তাঁর লেখায় ঘুরে ফিরে এসেছে জলপাইগুড়ির কথা।
ষাটের দশকের গোড়ায় তিনি কলকাতায় এসেছিলেন। ভর্তি হয়েছিলেন স্কটিশ চার্চ কলেজের বাংলা (সাম্মানিক) স্নাতক বিভাগে। এর পর স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে৷
সমরেশ মজুমদারের উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলির মধ্যে সাতকাহন ( বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিমান নারীচরিত্র দীপাবলীর জন্ম হয় এখানেই), তেরো পার্বণ, স্বপ্নের বাজার, উজান, গঙ্গা, ভিক্টোরিয়ার বাগান, আট কুঠুরি নয় দরজা, অনুরাগ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
তার ট্রিলজি 'উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ বাংলা সাহিত্য জগতে তাঁকে বিশেষ খ্যাতির অধিকারী করেছে সেই সাথে বাংলা সাহিত্যকে করেছে দারুনভাবে সমৃদ্ধ। এই 'কালবেলা' নিয়ে সিনেমা তৈরি করেন পরিচালক গৌতম ঘোষ। সাহিত্যকৃতির জন্য সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার-স একাধিক সম্মান পেয়েছেন তিনি৷
পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০১৮ সালে সমরেশ মজুমদারকে 'বঙ্গবিভূষণ' সম্মান প্রদান করে। এছাড়া তিনি সাহিত্য অকাদেমি অ্যাওয়ার্ড, আনন্দ পুরস্কার বিএফজেএ পুরস্কারসহ অজস্র সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। সমরেশ মজুমদারের প্রয়াণে সাহিত্য জগতের এক অপূরণীয় ক্ষতি হল।
***
সুত্রঃ হিন্দুস্থান টাইমস, কালের কন্ঠ, আজ তক বাংলা, উইকি সহ অন্যান্য মিডিয়া।
* তাড়াহুড়োয় কিছু ভুল ভ্রান্তি রয়ে গেল পরে এডিট করে দিব।