somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্মৃতিকথা

২৪ শে মে, ২০২৩ বিকাল ৩:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ছোট বেলায় স্কুলে যাওয়া আসার পথে এই কবরস্থানটা পেরিয়ে যেতে হত। তখন আমার বাড়ি থেকে এটা মাত্র মিনিট তিনেকের পথ ছিল।
খুব কাছে তবুও এদিকে আসতাম না। কবরস্থানের পাশেই একটা খাল মত ছিল তারপরে উঁচু ঢিবি- বড় অবহেলিত ছিল জায়গাখানা। কোন গোছানো কবরস্থান নয়। জানাজা করে কোন মতে মাটি চাপা দিয়ে আসা। কবরস্থান জুড়ে ছিল জংলা গাছ আর লতা। একেবারে সামনের দিকে ছিল বড় বড় ধুতরা ফুলের গাছ- কাঁটাযুক্ত ধুতরা ফল ছিল আমাদের কাছে ছিল আতঙ্কের।! এ ফল খেয়ে নাকি হর হামেশাই লোকে পাগল হয়। গোরস্তানের পাশ দিয়ে একাকী বাড়ি ফিরতে গিয়ে গা ছম ছম করত। সন্ধ্যের ছায়া নামলে তো কথাই নেই- দোয়া দরূদ পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে চোখ বন্ধ করে দিতাম ভোঁ দৌড়। সন্ধ্যে হলেই কবরস্থান বা গোরস্থান জুড়ে বসত শেয়ালের আড্ডা। ওদের হুক্কা-হুয়া রবে আতঙ্ক আরো বেড়ে যেত।
সদ্য দাফন করা লাশ ওরা নাকি গর্ত খুড়ে টেনে নিয়ে যেত। সচক্ষে কতবার দূর থেকে এমন খোঁড়া কবরের পাশে টাটকা কফিনের কাপড় পড়ে থাকতে দেখেছি। কেউ কেউ কবর পাহারা দেবার ব্যবস্থা করত। কেউবা ঘন করে অনেক গভীর অব্দি বাঁশ পুতে রাখত, যাতে গর্ত খুড়ে লাশ নিয়ে যেতে না পারে।
***
এবার দেখি সেই কবরের চেহারা পালটে গেছে বহুখানি। চারপাশে কোমর সমান দেয়াল। ভিতরে সু-উচ্চ গাছের সারি। একেবেঁকে গেছে হাটার পথ। চারিদিকে সুসজ্জিত বাঁধানো কবর। ভিতরে ঢুকে ছিম ছাম পরিবেশ দেখে মনটা ভাল হয়ে গেল। কবরস্থানের চারপাশ ঘিরে দেখি অনেক পাকা বাড়িও হয়ে গেছে।
কিন্তু মনটা খারাপ হল অন্যখানে। প্রতিটা কবরের সামনেই এক বা একাধিক নাম ঝোলানো। কোনটায় স্থায়ী এপিটাফ। প্রতিটা কবরের গায়ের নাম পড়ি আর নস্টালজিক হই। এরা প্রায় সবাই আমার ছোট বেলার পরিচিতজন। এদের নিয়েই ছিল আমার ক্ষুদ্র পৃথিবীর সেই ছোট্ট ভুবন। কেউ এখানকার চেয়ারম্যান, মেম্বার মাতবর, কেউবা মুদী দোকানি, কেউ মাষ্টার। আমার দু’চারজন আত্মীয়, অতি প্রিয় ছোট ভাই, বন্ধু এমনকি অনুজেরাও চিরনিদ্রায় শায়িত আছে। এদের সাথে কত শত স্মৃতি। চারিদিকে শুধু চিরতরে তালাবন্ধ করে রাখা আমার হারিয়ে যাওয়া শৈশব কৈশোরের স্মৃতির বাক্স।
***
সামনেই খাঁ সাহেবের কবর: বেশ ছিমছাম বাঁধানো কবরের সাদা এপিটাফে তাঁর নাম লেখা। ‘ ওস্তাদ কানাই ইসমাইল খাঁ
এই খানদানী ক্লাসিক্যাল গায়ককে।ছোট বেলায় দেখেছি। সেই মফস্বল শহরে যে কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলেই আমন্ত্রণ পত্র না পেয়েও তিনি গরদের পাঞ্জাবী, কাঁধে একটা শাল আর ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খাঁ এর মত কিস্তি টুপি মাথায় হাজির হয়ে যেতেন। বয়স্ক মান্য-গন্য মানুষ। আয়োজকদের মুখ কালো হলেও ‘আমন্ত্রণ পত্র না পাঠাতে পারায়’ তারা ভীষণ লজ্জিত এমন ভাব করে সমাদর করে সামনের সারিতে বসিয়ে দিত।

একদিনের কথা বেশ মনে আছে;
ঘাট এলাকা! আনসার ক্লাবের খোলা মাঠে সামিয়ানা টাঙ্গানো। সামনে কয়েক-সারি গুটিকতক অভিজাত মানুষ আর পেছনে সারি সারি আম জনতা। স্বভাবতই চটুল গানের সমাদর বেশী। একের পর এক গায়ক স্টেজে উঠছে নামছে কিন্তু খাঁ সাহেবের নাম ঘোষণা হচ্ছে না।
খাঁ সাহেব অধৈর্য হয়ে খুঁজছেন আয়োজকদের – কিন্তু ওরা বেমালুম গায়েব! একটারও দেখা নেই। আচমকা আধো অন্ধকারে দুর থেকে কাউকে ঠাহর করে তিনি বজ্র নিনাদে হাঁক ছাড়লেন, কেরামত তুমি এদিকে আসতো।
কেরামতের তখন ঘাম ছুটছে- কাঁচুমাচু ভঙ্গীতে তাঁর কাছে আসতেই, বললেন; এই ব্যাটা আমি গাইব কখন?
কেরামত ভীষণ লজ্জিত কণ্ঠে বলল, চাচা- আর দু’জনের পরেই আপনার পালা। দেখেন না পেছনে ইতর ফাউল লোকজন বসছে- ওরা কি আপনার গানের মর্ম বুঝবে?
খাঁ সাহেব ঘাড় ঘুড়িয়ে পেছনে নজর বুলিয়ে শান্ত হলেন।
দুজন গায়ক তো বটেই, নতুন সিনেমার চটুল গানের তালে ক’জন নটিও নেচে গেল। একজন মেয়েলি কণ্ঠে প্রথম থেকেই কাঁদো কাঁদো স্বরে 'কবর' কবিতাও আবৃতি করে গেল! শুধু কি তাই; একখানা নাটিকাও মঞ্চায়িত হয়ে গেল।
কিন্তু খাঁ সাহেবকে আর ডাকে না।
খাঁ সাহেব বিরাট বিরক্ত। যদিও গান গাওয়াটা মুখ্য বিষয়- মান ইজ্জতের খুব বেশী পরোয়া করেননা তিনি। এবার নিজেই উঠে গিয়ে স্টেজের পেছনে গুলতানি মারতে থাকা আয়োজক কমিটিকে গিয়ে ধরলেন, -কিরে ব্যাটারা আমকে কি আজকে পুরো বেইজ্জতি করবি।
ততক্ষণে আমন্ত্রিত গায়কেরা-তো বটেই, এলাকার আতি-পাতি গায়কও গাইবার বাকি নেই।
প্রায় মাঝরাত তখন। ক্লান্ত শ্রান্ত দর্শক ঘোলা চোখে ঘুমে ঢুলু ঢূলু।
খাঁ সাহেব খুব সাজগোজ করে স্টেজে উঠে হারমোনিয়ামের রিডগুলো পরীক্ষা করে তবলচিকে বেশ খানিক্ষণ নির্দেশনা দিলেন।
এরপরে চোখ বন্ধ করে গভীর ভাবের জগতে চলে গিয়ে হারমোনিয়ামের রিডে আঙ্গুল বোলাতে বোলাতে খাকড়ি দিয়ে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে অবশেষে গানের আঙ্গিনায় প্রবেশের চেষ্টায় আ আ আ করে মিনিট তিনেক রাগ সঙ্গীতের সপ্তম সুরে চড়ে ফের খানা খন্দ দিয়ে গড়াতে গড়াতে নীচে নেমে কাজী নজরুলের সুবিখ্যাত গান,
'বাজল কিরে ভোরের সানাই
নিঁদ মহলার আঁধার পুরে!'
'তিন চারবার একই লাইন রিপিট করে এ এ এ বলেই মুদ্রিত আঁখি আধখানা খুলতেই ভিমড়ি খাবার যোগার।
পেছনের আর মাঝের সারির দর্শক সব হাওয়া! সামনের সারিতে কিছু ভদ্রলোক 'মাছের চোখে' চেয়ে উঠে যাবার জন্য উসখুস করছে। শুধু আয়োজকদের কোথাও যাবার গতি নাই; তারা এদিক ওদিকে গল্প গুজবে ব্যাস্ত আর পান বিড়ি ফুঁকছে।
চান্দিতে আগুন ধরে গেল খাঁ সাহেবের। গান ছেড়ে বাঁজখাই কণ্ঠে তিনি খিস্তি করে বললেন, ‘শালার ছেলেরা গান বোঝেনা- গান শুনতে আসছে’।

তারপরেই ফের গানে মশগুল হলেন!
আ আ আ বাজলো –বাজলো-আ আ আ বাজলো কিরে- এ এ এ ভো-রের সানাই…
ইজ্জতের কুছ পরোয়া নেহি- তাঁকে আজ গাইতেই হবে।

***
এখানেই এক কবরে শায়িত আছেন এলাকার সবার প্রিয় শিক্ষক আমিনুল হক। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম তাঁর কবরের সামনে দুটো নাম বাঁধানো!!

বরের উল্টোদিকেই খানিকটা এগিয়ে গেলেই আমার এক বাল্য বন্ধুর বাড়ি। আমিনুল স্যার ছিলেন ওরই বড় ভাই।
অবশ্য আমি তাঁকে ভাইজান বলেই ডাকতাম। উঁনার আরেক ভাই একটু ছোট বেলা থেকেই ছিল উড়নচণ্ডী-ভবঘুরে। সারাদিন দুনিয়ার বখাটে ছেলেদের সাথে টই টই করে ঘুরে বেড়াত। এই নিয়ে ওদের দুঃখের অন্ত ছিল না। বিশাল বারোয়ারি বাড়ি ছিল তাদের -পঁচিশ ত্রিশ জনের থালা পড়ত প্রতি বেলা।
তাঁর সেই ভবঘুরে ভাইয়ের বেশ কিছু গুন ছিল; কোনদিন কারো সাথে বেয়াদপি করেনি আর তাঁর মুখে কেউ গালি শুনেনি। রাত গভীর হলেই সে তাঁর কাচারি ঘরে টেপ রেকর্ডারে হেমন্ত সতিনাথ, মান্নাদে শ্যামলমিত্র আর তালাত মাহমুদের গান বাজাত। গভীর রাতে( মফস্বলে গভীর রাত মানে ১০টা সাড়ে দশটা) অনেকেই উৎকর্ণ হয়ে সেই গান শুনত। চাঁদনী রাতে আমি লক্ষ্য করেছি; এলাকার অনেক মেয়েই বাতি নিভিয়ে জানালার কাছে বসে নিবিষ্ট মনে চাঁদের দিকে উদাস চেয়ে সেই গান শুনত।
‘তোমারে লেগেছে এত যে ভাল চাঁদ বুঝি তা জানে’ ~ গানের সুরে তারা হারিয়ে যেত কোন সুদূরে কোন এক ফ্যান্টাসির জগতে।
কিন্তু তাদের এই ফ্যান্টাসির জগতে নিয়ে যাওয়া সেই ভবঘুরে ছেলকেকে কোন মেয়ের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে দেখিনি কোনদিন। যে কেউ দু’কথা জিজ্ঞেস করলে, সে মাটির দিকে তাকিয়ে কথা বলত।

মাদের ছোট্ট আধা-শহরটাকে কাঁদিয়ে একদিন তাঁর বড়ভাই সেই অমায়িক,নিরহঙ্কার অতি আমুদে শিক্ষকটা (পারিবারিক ব্যবসাও সামলাতেন) মারা গেলেন – বয়স তখন তাঁর চল্লিশ ছুঁয়েছিল কিনা সন্দেহ আছে। এইতো তাঁর কবরখানা- তাঁর সেই অকাল মৃত্যুটা কেউ মেনে নিতে পারেনি। শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছিল ছেলে বুড়ো সবাই।
***
মিনুল স্যার যদিও ছিলেন গার্লস স্কুলের শিক্ষক তবুও পুরো মহকুমা জুড়ে তাঁর শিক্ষকতার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। তিনি নাকি একবার ফেরিঘাটে এক সাদা চামড়ার বিদেশীর সাথে ইংরেজিতে কথোপকথন করেছিলেন। কাছে দূরে দাঁড়িয়ে বহু মানুষ অবাক দৃষ্টিতে অবলোকন করেছিলে সে দৃশ্য! মুহুর্তেই মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল সে কথা; সেই থেকে তিনি সবার সমীহের পাত্র হন।
সবার ধারনা ছিল তিনি ইংরেজির বিশাল পণ্ডিত ( তবে ইংরেজীতে বেশ দখল ছিল তাঁর- বিটিভিতে অডিশন দিয়ে তিনি ইংরেজী খবর পাঠক হিসেবে যোগদানের আমন্ত্রন পেয়েও উপেক্ষা করেছিলেন)। দলে দলে ছাত্র ছাত্রী এসে তাদের পড়ানোর আবদার করতে থাকল। তিনি বড্ড লাজুক, নিরহঙ্কার সাধা-সিদে মানুষ ছিলেন- কাউকে না করতে পারতেন না। ঘরের বারান্দায় বসে পড়াতেন তিনি, ছাত্র ছাত্রীরা উঠন জুড়ে বসত। কারো সাথে রেগে কথা বলেননি কখনো। সারাক্ষণ পান চিবুতেন আর হেসে হেসে আদর করে পড়া শিখাতেন। এমনিতেই তিনি ভয়ানক ব্যস্ত মানুষ ছিলেন-কিন্তু কাউকে বুঝতে দিতেন না।
বাজারে বাপের তেলের ব্যবসা ছিল। তেল বলতে পেট্রোলিয়াম-জাত তেল। কখনো কখনো মধ্যরাতে তেলের লরি আসত। লরি থেকে তেল বুঝে নিয়ে দোকানে সাজিয়ে রাখতেন তিনি। এলাকায় পত্রিকার ব্যবসাও ছিল তাদের। ফজরের নামাজ সেরেই বাস-স্ট্যান্ডে চলে যেতেন দৈনিক ঢাকার বাইরের সংস্করণ টাটকা পত্রিকা আনার জন্য। পত্রিকা এনে সাজিয়ে গুছিয়ে বাঁধা হকারকে বুঝিয়ে নিজে একগাদা পত্রিকা কাঁধে নিয়ে বাজারের দোকান ও এলাকার গণ্যমান্য মানুষের বাড়িতে বিলি করে বাসায় ফিরতেন।
সেই ছোটবেলায় দেখেছি, বাড়িতে ফেরার পথে তাঁর মাথায় কখনো এক বস্তা চাল কিংবা উনুন জ্বালাবার খড়ি। মাথায় বোঝা নিয়ে হাটা অবস্থায় তিনি হাসিমুখে পথচারীদের সাথে কুশল বিনিময় করছেন।
বাড়িতে ঢুকেই দেখতেন; সেই সাত সকালেই তাদের উঠোন জুড়ে ছাত্র ছাত্রীরা বসে আছে। ফের একগাল হাসি দিয়ে সবাইকে প্রবোধ দিতেন, তোমরা দুই মিনিট বসো আমি আসতেছি।
কোন মতে নাকে মুখে একটু গুঁজে তিনি এক খিলি পান মুখে দিয়ে বারান্দায় বসে যেতেন পড়াতে। পড়ানোর মাঝেই এক-ফাঁকে গোসল সেরে পোশাক পাল্টে নিতেন।
ছাত্র-ছাত্রীদের বিদায় দিয়েই ছুটতেন তাঁর কর্মস্থল গার্লস স্কুলে। দুপুরের টিফিন টাইমে প্রায় দৌড়ে আসতেন দোকানে। বাপকে দুপুরের খাবার খেতে বাড়িতে পাঠিয়ে নিজে খালি পেটে একখান পান মুখে দিয়ে পত্রিকায় মুখ গুঁজতেন। এর মাঝেই খদ্দের এলে ড্রাম থেকে পাইপ চুষে তেল নামাতেন( এ বিষয়টা হয়তো অনেকের জানা নেই; তেলের বড় ড্রাম-তো কাত করা যায় না। কেউ তেল কিনতে আসলে নীচে গ্যালন ধরে ড্রামের মধ্যে পাইপ ঢুকিয়ে জোরে টান দিলেই পাইপ দিয়ে গল গল করে তেল বের হত)- তাঁর মুখ দিয়ে তখন কেরোসিন আর পেট্রোলের গন্ধ ভুরভুর করত।
স্কুল ছুটির পরেও তাঁর বিশ্রাম নেই। ফের ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ানো- সংসারের টুকি টাকি কাজ করা, বাজার সদাই করা ছোট ভাই-বোনদের খোঁজ খবর নেয়া। কত দিকেই না নজর ছিল।
ছোট বেলা থেকেই তাঁর বাড়িতে ছিল আমাদের অবাধ যাতায়াত। কতদিন তিনি আমাকে কাঁধে চড়িয়ে ঘুড়িয়ে বেড়িয়েছেন। তাঁর ভাইবোন সবাই তাঁকে 'মিয়া ভাইজান' বলে ডাকত। সেই সুবাদে আমরাও তাঁকে ভাইজান সন্মোধন করতাম।
উঁনার মা ছিল দু'জন( এই গল্প অন্যসময় হবে ফের)। দু’জনে দুই বাড়িতে থাকতেন। ছোট মায়ের কোন সন্তানাদি ছিল না। তিনি দুই মায়েরই যত্ন-আত্বি করতেন সমান তালে। ছোট মা মানে তাঁর সৎ মা একা থাকত বলে প্রতিদিন যাওয়া আসার পথে দু’তিনবার তিনি তাঁর তত্ত্বতালাশ করতেন।
সন্ধ্যের পরে ফের চলে যেতেন দোকানে। বিদ্যুৎ বিল বেশী আসবে বলে তাঁর বাবা দোকানে বিদ্যুতের লাইন নেন নি তখনো। হারিকেন দিয়েই কাজ সারতে হোত। একবার-তো হারিকেন দিয়ে পেট্রোল ঢালতে গিয়ে তাঁর মুখটাই ঝলসে গেল! সে ব্যাপারটা সেই ছোট্ট মফঃস্বল শহরে ভীষণ আলোড়ন তুলেছিল তখন।
নিজে মাসিক,পাক্ষিক, ত্রৈয় মাসিক আর দৈনিক পত্রিকার ব্যবসা করেন বলে- প্রতিদিন ঘাটে হকারেরা পত্রিকা বিক্রি শেষে যে উদ্বৃত্ত্ব থাকত।সেগুলো ডাঁই করে রাখতেন দোকানে। সন্ধ্যের পরে হারিকেনের আলোয় মুখ গুঁজে পড়তেন রাজ্যের খবর। তাঁর বাবা ভীষণ বদমেজাজি ছিলেন বলে দিনের বেলা কেউ খুব একটা দোকানের কাছে ঘেঁষত না। কিন্তু ভাইজান বসলেই আশে পাশের সবাই এসে ভীড় জমাত। কেউ দোকানেই দাঁড়িয়ে বা বসে ম্যাগাজিন বা পত্রিকা পড়ত কেউবা নিজের দোকানে নিয়ে গিয়ে পড়া শেষে ফেরত দিয়ে যেত। কাউকে তিনি না করতেন না।
আমরা একটু বড় হয়ে ভাইজানের কাছ থেকে চেয়ে চিত্রালী, বিচিত্রা বাসায় নিয়ে আসতাম। সবার পড়া শেষে কখনো ফেরত দিতাম, কখনো দিতাম না। ছেঁড়া- ফাটা তরকারির ঝোল লাগানো ম্যাগাজিন দেখেও তিনি কখনো গোস্যা করতেন না। এলাকার মা-বোনেরাও সুযোগ মত তাঁকে বিশেষ কোন ম্যাগাজিন বা পত্রিকা এনে দিতে অনুরোধ করলে, তিনি যেভাবেই হোক খুঁজে এনে দিতেন।
তবে সেই মহকুমা শহরের সবচেয়ে, অমায়িক-সদা লাস্যময়, নিষ্কলুষ চরিত্রবান সবার আদর্শ সেই তরুণ শিক্ষক মাঝে মধ্যে দুই তিনদিনের জন্য উধাও হয়ে যেতেন। কোথায় যেতেন কেন যেতেন এবিষয়ে কিছু মানুষ জানলেও মুখে কুলুপ এঁটে রাখত। তিনি ফিরে আসার পরে ছাত্র-ছাত্রীদের কেউ জিজ্ঞেস করলে ভীষণ লজ্জা পেয়ে শুধু প্রতিউত্তরে বলতেন, বর্ডারে গিয়েছিলাম।
সবাই নিশ্চিত যে উনি চোরাচালানীর সাথে জড়িত নন তবে কেন তিনি মাঝে মধ্যে দু-চারদিনের জন্য বর্ডারে যান। আমাদের কাছে বিষয়টা ভীষণ রহস্যজনক মনে হোত। এ বিষয়ে কৌতুহল মেটাতে বড়দের কাছে জিজ্ঞেস করলেই ধমক খেতাম।
অবশেষে তাঁর ছোট ভাই, যে আমাদের জিগার দোস্ত ছিল সে-ই খুলে বলল ব্যাপারটা। ওর বাবা একসময় ভয়ঙ্কর মাদকাসক্ত ছিল। যৌবনে সময়ে এমন কোন নেশা দ্রব্য নেই যেটা তিনি গ্রহণ করেনি(৫০-৬০ এর দশকে)। একসময় আফিমে আসক্ত হয়ে পড়লেন।দ্বিতীয় বিয়ে করার পরে তিনি ধীরে ধীরে সব ছেড়ে দিলেও আফিম ছাড়তে পারলেন না। নিয়মিত আফিম সেবন না করলেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমার বন্ধুর কথায় আফিমের বিষক্রিয়ায় তাঁর রক্ত এতটাই বিষাক্ত হয়ে গেছে যে, কোন সাপ বিচ্ছু কামড়ালে তাঁর কিছুই হয় না উল্টো যে দংশন করে সেটারই মরণদশা হয়।
আফিম এর স্টক শেষ হয়ে গেলে ভাইজানের দায়িত্ব ছিল সেটা সংগ্রহ করে। আফিম মজুত ও বিক্রি করা ছিল অবৈধ। বাংলাদেশে আফিমের তেমন চাহিদা না থাকায় কেউ এ মাদক গোপনেও বিক্রি করত না। তাই ভারতের বর্ডারে গিয়ে কোন এক উপায়ে চোরাচালানীদের কাছ থেকে উচ্চমূল্যে আফিম সংগ্রহ করতেন তিনি। আমাদের স্থানীয় থানাও বিষয়টা অবগত ছিল- তারাও মানবিক কারনে বিশেষ ছাড় দিত।
(বার উনার বাবা মোরাই চাচার গল্পটা একটু করি; ভীষণ বদরাগী আর স্বল্পভাষী মানুষ ছিলেন তিনি। হাতে গোনা কয়েকজন গণ্যমান্য লোক ছাড়া আর কারো সাথে খুব একটা কথা বলতেন না। তিনি কৃপণ ছিলেন না কিন্তু খুব হিসেবী মানুষ ছিলেন। লুঙ্গী পরে জামাটা সবসময় কাঁধে ঝুলিয়ে উদোম গায়ে চলাফেরা করতেন। এর খানিক ব্যাত্যয় হত শুধু শীতকালে।
আমার বন্ধুকে তাঁর জামা কাঁধে রাখার কারনটা জিজ্ঞেস করলে বলত; আফিম খাবার জন্য গায়ে নাকি সারাক্ষণ জ্বালা করে।
পড়াশুনা করলে ছেলেরা বিগড়ে যাবে, সাহেব হবে বাপের কথা শুনবে না সেজন্যই তিনি ছেলে মেয়েদের উচ্চ শিক্ষিত করার বিপক্ষে ছিলেন। ম্যাট্রিক পাশ করলেই খতম। ভাইজান তাঁর মতের বিরুদ্ধে গিয়ে পড়াশুনা করেছেন বলে তিনি বেশ খাপ্পা ছিলেন তাঁর উপরে। পদে পদে তাঁর ভুল ধরতেন আর শিক্ষিত হওয়ার জন্যই এমন করছেন বলে গালি দিতেন! তাঁর মতে; সমাজের সব অনাচার অজাচারের মুলেই হল উচ্চশিক্ষা। এত করার পরেও তিনি কোনদিনও ভাইজানের উপর খুশী হতে পারেননি। সামান্য ভুলচুক হলেই ভীষণ বকতেন। ভাইজান কোনদিনও তাঁর সামনে গলা উঁচিয়ে কথা বলেননি। তাঁর সবচেয়ে ক্ষোভ ছিল ভাইজানের 'ফুল প্যান্ট' পরা নিয়ে সম্ভবত।
এ প্রসঙ্গে একটা কথা মনে পড়ছে; তাঁর ছোট ভাই আমার বন্ধু যখন ম্যাট্রিক পাশ করে বাপের মতের বিরুদ্ধে ভাই এর সহযোগিতায় কলেজে ভর্তি হলে বাপের চক্ষুশূল হল। জেলা শহরে কলেজ। সেখানে তো লুঙ্গি পরে যাওয়া যায় না- তাই সে বাপের কাছে একদিন আর্জি করল একটা ফুল প্যান্ট বানানোর।
কথা শুনেই ওর বাপ কষে দিল এক থাপ্পড়, তাঁর পর কান ধরে বলল, 'ব্যাটা প্যান্ট পরে আমিনুলের মত সাহেব হবা? তুই পড়বি পায়জামা, তুই প্যান্ট বড়বি ক্যান?
আমারে ক তুই কি আমিনুল হইতে চাইস?
আমার সেই বন্ধু গ্রাজুয়েশন মাস্টার্স করেছিল সার্টের নীচে পায়জামা পরে। ভাগ্যের ফেরে এক সময় পুরো ব্যবসা তাঁর হাতে চলে এসেছিল- তখনই সে ফুল প্যান্ট পরা শুরু করেছিল।)
দা হাস্যময় সুদর্শন মাটির মানুষ ভাইজান বিয়ে করে আনলেন এক কর্কশ চেহারার শুষ্ক মহিলাকে। পুরো এলাকার মানুষ সেই বউ দেখে হতাশ!
সবার এক কথা ‘আমিনুল এইডা কি বিয়া করল’!! কেউ কেউ বলল, আহারে কি সুন্দর ছাওয়ালডারে সহজ সরল পাইয়্যা এট্টা বুইড়্যা বেটিরে ধরায় দিল। ( আসলে তিনি বেটি নন –তরুণীই ছিলেন, কাঠ খোট্টা চেহারার কারনে বয়স্ক লাগত তাঁকে)। চারিদিকে ফিসফাস হচ্ছে; তাঁকে নাকি পাত্রী দেখাতে নিয়ে গিয়ে এক ধুরন্ধর ঘটক এলাকার লোকদের সহায়তায় জোড় করে বিয়ে পড়িয়ে দিয়েছেন। নিপাট ভদ্রলোক ভাইজান লজ্জায় না করতে পারেননি।
বে এ বিয়েতে আমাদের একটা লাভ হয়েছিল। ভাবির ছোট ভাই ছিল আমাদের বয়েসী। তাঁর সাথে আমাদের দারুণ সখ্যতা হয়ে গেল। একসময় সবাই আমরা হরিহর আত্মা হয়ে গেলাম। ছুটিতে সে বুবুর বাড়িতে বেড়াতে এলে দিন-রাত আড্ডায় মেতে থাকতাম।
নতুন বউ বাড়ির উঠোনে পা দিয়েই তাঁর কারিশমা দেখাতে শুরু করল ফলে মাসখানের মধ্যেই আলাদা চুলো আর ছ’মাসের মধ্যে গৃহান্তর!
ভাইজান ভীষণ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে চলে এলেন ঠিক আমার বাড়ির সামনেই তাঁর ছোট মায়ের পাশে। সেখানেও শান্তি নেই। সেই মহিলার এলাকার কারো সাথেই সদ্ভাব হয় না। শিক্ষিত ভদ্রমহিলা উচ্চস্বরে ঝগড়া করেননি তিনি কখনো কিন্তু তাঁর কাষ্ঠ-কঠিন আচার ব্যাবহারে প্রতিবেশীর পিত্তি জ্বলে যেত।
ভাইজান কিন্তু তাঁর বৌকে প্রচণ্ড ভালবাসতেন। সে যা চাইত তা এনে হাজির করার প্রানন্ত চেষ্টা ছিল তাঁর। প্রথম সন্তান হবার পরে মায়ের বুকের দুধ পেত না। বৌয়ের আদেশে ঢাকা থেকে কৌটার দুধ কিনে নিয়ে যেতেন। কাঁথা আর ইজের ছাড়া বাচ্চার জন্য অন্য কিছু ভাবতে পারেনি তখ। কিন্তু তিনি বাচ্চাকে ডায়াপার পরাতেন।
মেয়েটাকে যে কি আদর করতেন তিনি- সারাক্ষণ তাঁকে কোলে বসিয়ে ছাত্র পড়াতেন আর বাবুটাকে চকাস চকাস করে চুমু খেতেন। বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও ভিতরে ভিতরে হয়তো ক্ষয়ে যাচ্ছিলেন। তবে স্কুল শেষে কলেজে ভর্তি হয়ে ঢাকায় চলে আসায় চাক্ষুষ দেখা হয়নি তাঁকে।
পর পর দুটো মেয়ে হবার পরে তাঁর ভীষণ সখ ছিল একটা ছেলের।তার স্ত্রী তখন সন্তান সম্ভবা। আচমকা তিনি সবাইকে কাঁদিয়ে পরপারে চলে গেলেন।

মোরাই চাচা ছেলের মৃত্যুতে ভীষণ ভেঙ্গে পড়েছিলেন। অল্প ক'দিন বাদেই তিনি শয্যাশায়ী হন। শুনেছি গভীর রাতে ‘আমার আমিনুল- আমার আমিনুলরে’ বলে চিৎকার করে তিনি কাঁদতেন। চাচা মারা যাবার পরে তাঁকে তাঁর বড় ছেলের কবরেই শায়িত করা হয়। এই ভুবনে পুত্র বাবার স্নেহের পরশ না পেলেও অন্য ভুবনে চিরনিদ্রায় তাঁরা পরম মমতায় জড়াজড়ি করে শুয়ে আছেন!!

শেষ কথাঃ আমি আমার ক্ষুদ্র জীবনে ভাইজানের মত আর একটা মানুষের দেখা পাইনি যাকে একজন মানুষও অপছন্দ করে। তাঁর মৃত্যুতে আমার সেই ছোট্ট শহরটা শোকে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। শত শত ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষক কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল সেদিন। আমিনুল স্যার বা ভাইজানের বর্ণাঢ্য জীবনের গল্প ও তাঁর সাথে জুড়ে থাকে মানুষদের কথা পরিপূর্ণভাবে এত স্বল্প পরিসরে লেখা সম্ভব নয়। তিনি তো বটেই তাঁর ছোট মায়ের ( আমার ‘নটি’ নামে দু’পর্বের এক স্মৃতিকথায় তাঁর গল্প আছে) জীবনকথা নিয়েই একটা উপন্যাস হয়ে যায়। তাই লেখাটা এখানে শেষ করতে মন চাইছিল না- অনেক কথা অব্যক্ত রয়ে গেল।


সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুন, ২০২৩ রাত ১১:২৩
৪৮টি মন্তব্য ৪৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অনির্বাণ শিখা

লিখেছেন নীলসাধু, ০৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



রাত ন’টার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।

আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ইয়াম্মি খুব টেস্ট=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৪



©কাজী ফাতেমা ছবি
সবুজ আমের কুচি কুচি
কাঁচা লংকা সাথে
ঝালে ঝুলে, সাথে চিনি
কচলে নরম হাতে....

মিষ্টি ঝালের সংমিশ্রনে
ভর্তা কি কয় তারে!
খেলে পরে একবার, খেতে
ইচ্ছে বারে বারে।

ভর্তার আস্বাদ লাগলো জিভে
ইয়াম্মি খুব টেস্ট
গ্রীষ্মের... ...বাকিটুকু পড়ুন

অণু থ্রিলারঃ পরিচয়

লিখেছেন আমি তুমি আমরা, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৭


ছবিঃ Bing AI এর সাহায্যে প্রস্তুতকৃত

১৯৪৬ কিংবা ১৯৪৭ সাল।
দাবানলের মত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে।
যে যেভাবে পারছে, নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। একটাই লক্ষ্য সবার-যদি কোনভাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিরোনামহীন দুটি গল্প

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৫

গল্প ১।
এখন আর দুপুরে দামী হোটেলে খাই না, দাম এবং খাদ্যমানের জন্য। মোটামুটি এক/দেড়শ টাকা প্লাস বয়দের কিছু টিপস (এটা আমার জন্য ফিক্সড হয়েছে ১০টাকা, ঈদ চাদে বেশি হয়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

এশিয়ান র‍্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান !!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:২০

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।তালিকায় ভারতের ৪০, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×