ওপার বাংলার কথাশিল্পী সমরেশ মজুমজারের সাথে হুমায়ূন আহমেদের বেশ খাতির ছিল।তিনি ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন, রবীন্দ্রনাথ ও শরতচন্দ্রের পরে বাংলা ভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক ‘হুমায়ূন আহমেদ’।
তবে আমার মত ভিন্ন; আমি মনে করি নিজের জীবদ্দশায় জনপ্রিয়তার নিরিখে হুমায়ূন আহমেদের অবস্থান রবীন্দ্রনাথের পরেই।কেউ কেউ এই জনপ্রিয়তার বিষয়টা স্বীকার করে নিলেও তাঁর সাহিত্যমান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
হুমায়ূন আহমেদ কিজন্য এত জনপ্রিয় হলেন- কিংবা তাঁর এই বিপুল জনপ্রিয়তার রহস্য কি?
এর উত্তরঃ সম্ভবত সহজ সাবলীল ভাষা ও কথা এবং মানুষের মন ও মগজে ঢুকে যাওয়া।
বিবিসি থেকে তাঁকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল ‘হিমু’ নিয়ে- তাঁর উত্তরে উনি কি বলেছেন দেখেন;
হুমায়ূন আহমেদঃ যে হিমু আমি লিখি ঐ হিমু হওয়া খুবই জটিল ব্যাপার তো বটেই। আমি মানুষের অনেক আশা –ইচ্ছা পূরণের ব্যাপার আছে মানুষ অনেক কিছু করতে চায় কিন্তু করতে পারে না। মানুষের যে ইচ্ছাপূরণের যে বিষয়গুলো আছে সেগুলো আমি হিমুর মাধ্যমে ঐ ইচ্ছাপূরণের ব্যাপারগুলো ঘটাই। যে কারণেই আমার ধারণা পাঠক এটাকে এতো পছন্দ করে। এরা হতে চায়। এরা করতে চায়। এরা চায় প্রত্যেকেই যে আমার একটা আধ্যাত্বিক ক্ষমতা থাকবে। মানুষের ভুত-ভবিষ্যত বলে দিতে পারব। সবার ভেতরে এটা একটা গোপণ বাসনা। ওদের গোপন বাসনা আমি পথে ঘাটে হেটে বেড়াবো- কেউ আমাকে কিছু বলবে না। আমাকে চাকরি করতে হবে না। কোন কিছুই করতে হবে না। আমার জীবন চলবে জীবনের মতো। কোন বাড়ির সামনে গিয়ে যদি দাড়াই ওরা আমাকে খাবার দিবে। এই যে গোপন ইচ্ছেগুলো যেগুলো থাকে সেই ইচ্ছেগুলি আমি পূরণ করি হিমু উপন্যাসে।
তিনি এভাবেই সাধারণ মানুষের পালস ধরেছেন। আসলে যে যতই ভাব-ভঙ্গী করি না কেন, পণ্ডিতি ফলাই না কেন- দিন শেষে আমরা ওই সাধারণের কাতারেই পড়ি।
পৃথিবীর অল্প কিছু ভাগ্যবান লেখকদের মধ্যে তিনি একজন যার, সাহিত্যিক হবার জন্য স্ট্রাগল করতে হয়নি। তাঁর প্রথম উপন্যাস ছাপা হয়েছে ছাত্র অবস্থায়। যেটা ছাপার জন্য রাত দিন নিজের কাজ ফেলে উদ্ভ্রান্তের মত ছুটোছুটি করেছেন আহমেদ ছফার মত একজন বিখ্যাত মানুষ।
পি এইচ ডি করে আসার পরে দেশে ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি লেখালেখি ছিল তাঁর নেশা। এ কাজ না করলেও দিব্যি তাঁর জীবন চলে যেত। তিনি চাইলে দেশের বাইরের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরি নিয়ে চলে যেতে পারতেন।
তাঁর লেখা চরিত্র হিমু, শুভ্র, মিসির আলী যেন সারা যব সমজকে একবারে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। তাঁর লেখা ভৌতিক আধি ভৌতিক গল্পগুলো যেন আমরা নিজের অজান্তেই বিশ্বাস করে ফেলেছি। পড়ব না পড়ব না করে খুব তাচ্ছিল্যভরে তাঁর একটা বইয়ের দু’পাতা উলটে পুরো বইটা এক নিঃশ্বাসে শেষ করে দারুণ একটা অসম্ভব সমাপ্তিতে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে অন্য এক ঘোরের জগতে হারিয়ে গিয়ে ফের আড্ডায় গিয়ে ‘হুমায়ূন আহমেদ’ একটা ফালতু লেখক বলে গালি দিয়েছি।
একই গল্প যেন বার বার পড়ছি; তাঁর প্রতিভা শেষ হয়ে গেছে, জাতিকে দেবার আর কিছু নেই। এর থেকে অবসরে যাওয়া উচিৎ , এমন খিস্তি খেউড় করেও পুরো বইটা শেষ করেছি।
হুমায়ূন আহমেদের নাটক সিনেমা কিচ্ছু হয়নি কিচ্ছু হয়নি করেও দু-বার তিনবার দেখেছি। কত গুণীজন হিতোপদেশ দিয়েছেন তাঁর মোটেও এসব লাইনে আসা ঠিক হয়নি; প্রতিভার অপচয় করছেন মাত্র। তাঁর উচিৎ সিরিয়াস লেখালেখিতে মনোযোগ দেয়া।
পলিমার রসায়নের মত কঠিন সাবজেক্টে পি এইচ ডি করা একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যখন সহজিয়া ভাষায় আবজাব গল্প লিখে সাধারণ পাঠকের বুক আর মগজের মধ্যে সেধিয়ে যাচ্ছে তখন ঋদ্ধ পণ্ডিত অতি জ্ঞানীগুণী সাহিত্যজন ভাষা ও শিল্প সাহিত্যের কাণ্ডারিরা ভয়ানক হতাশায় মুষড়ে পড়লেন! তাঁর লেখাকে অখাদ্য কুখাদ্য বলে গালি দেয়া হোল- তাঁকে আখায়িত করা হোল বাজারি লেখক বলে। বহুভাবে নানা দিক থেকে সমালোচনার বানে তাঁকে বিদ্ধ করা হল, বলা হল; তাঁর লেখায় শিক্ষণীয় কিছু নাই। বাংলা সাহিত্য উচ্ছন্নে গেল এবার। বাংলা ভাষা ও শিল্প সাহিত্যের গৌরব ভুলণ্ঠিত হল এবার এই কু-সাহিত্যেকের হাতে।
আমার 'ভাষা তুমি কার'-এর আজকের এই পর্ব আমি উতসর্গ করছি কালজয়ী সাহিত্যিক আপামোর বাঙ্গালী জনগনের জন্য সহজিয়া ভাষার লেখক ‘হুমায়ুন আহমেদকে’।
এই ভদ্রলোক তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলা প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেছেন অতি সাবলীলভাবে। নিজের সন্মন্ধে অতি উচ্চ-ধারনা কোনদিন তাঁর ছিল না। তথাকতিথ বাংলা ভাষার পণ্ডিত শ্রেণী ও শিল্প সাহিত্যের রক্ষকদের একের পর এক সুতীক্ষ্ণ ধারালো প্রশ্নবানে তিনি ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন হয়তোবা কিন্তু মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে অতি বিনয়ের সাথে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেছেন।
(হুমায়ূন আহমেদ আমার সবচেয়ে প্রিয় লেখক নন- কিন্তু স্বাধীনতাত্তোর বাংলা সাহিত্য তাঁকে ছাড়া কল্পনা করা যায় না। এই লেখাটা এক পর্বে হবে না, তাই দুই কিংবা তিন পর্বে দিতে হবে। )
নীচের লেখাগুলো পড়তে থাকুন; আপনার প্রশ্নের অনেক উত্তর পেয়ে যাবেন।
এডগার এলেন পোকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, একজন বড় লেখক হতে হলে কী লাগে?
তিনি জবাব দিলেন, একটা বড় ডাস্টবিন লাগে। লেখা নামক যেসব আবর্জনা তৈরি হবে, তা ফেলে দেওয়ার জন্যে।
লেখকরা ক্রমাগতই আবর্জনা তৈরি করেন। নিজেরা তা বুঝতে পারেন না। একজীবনে আমি কী পরিমাণ আবর্জনা তৈরি করেছি, ভেবেই শঙ্কিত বোধ করছি। যখন যা মনে আসছে লিখে যাচ্ছি। চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন বোধ করছি না। লেখকের চিন্তা-ভাবনাহীন লেখা পাঠক যখন পড়েন, তখন তারাও চিন্তা-ভাবনা করেন না। এই জাতীয় লেখার ভালো আশ্রয় ডাস্টবিন; পত্রিকার পাতা না।~ ফাউন্টেন পেন সিরিজ নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ
***হুমায়ূন আহমেদের জবানীতে***
আমি যে ফ্ল্যাটে থাকি, তার পাশের ফ্ল্যাটে থাকেন মাজহারুল ইসলাম, অন্যপ্রকাশের মালিক। তিনি হুমায়ূন আহমেদ টাইপ বাজারি লেখকদের বই ছেপে কুখ্যাতি অর্জন করেছেন। তার স্টলের সামনে নাকি ভিড় লেগে থাকে। অপরিপক্ব তরুণ-তরুণীরা মাছির মতো ভিড় করে বাজারি লেখকদের বই কিনতে চায়।
ভালো কথা, বাজারি লেখক বিষয়টি আরো পরিষ্কার করা দরকার। বাজারি লেখক মানে তুচ্ছ লেখক। তেল-সাবান-পেঁয়াজ-কাঁচামরিচ বিক্রেতা টাইপ লেখক। এদের বই বাজারে পাওয়া যায় বলেও বাজারি। যাঁদের বই বাজারে পাওয়া যায় না, তাঁদের বাড়িতে কার্টুন ভর্তি থাকে, তাঁরা মহান লেখক, মুক্তবুদ্ধি লেখক, কমিটেড লেখক, সত্যসন্ধানী লেখক। তাঁদের বেশির ভাগের ধারণা, তাঁরা কালজয় করে ফেলেছেন। এঁরা বাজারি লেখকদের কঠিন আক্রমণ করতে ভালোবাসেন। তাঁদের আক্রমণে শালীনতা থাকে। তাঁরা সরাসরি কখনো আমার নাম নেন না। তবে বুদ্ধিমান পাঠকরা বুঝে ফেলেন কাকে ধরা হচ্ছে। তাঁদের আক্রমণের নমুনা, 'অন্যপ্রকাশের সামনে জনৈক বাজারি লেখকের বইয়ের জন্য তরুণ-তরুণীর সমাবেশ দেখে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতে হয়। এরা সৎসাহিত্য থেকে বঞ্চিত। কষ্টকল্পিত উদ্ভট চরিত্রের গালগল্পে বিভ্রান্ত। বাজারি লেখক এবং তার প্রকাশকের অর্থ জোগান দেওয়া ছাড়া এই তরুণ-তরুণীরা আর কিছুই করছে না।...'
কালজয়ী এসব মহান লেখকের সঙ্গে মাঝে মাঝে আমার দেখা হয়ে যায়। বেশির ভাগ দেখা হয় দেশের বাইরের বইমেলায়। আমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে তাঁরা কিছুটা বিচলিত বোধ করেন। কেন করেন তা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। এমন একজনের সঙ্গে কথোপকথনের নমুনা;
কালজয়ী : কেমন আছেন?
আমি : জি ভালো।
কালজয়ী : ইদানীং কিছু কি লিখছেন?
আমি : একটা সস্তা প্রেমের উপন্যাস লেখার চেষ্টা করছি। যতটা সস্তা হওয়া দরকার ততটা সস্তা হচ্ছে না বলে অস্বস্তিতে আছি। আপনার দোয়া চাই যেন আরেকটা সস্তা লেখা লিখতে পারি।
কালজয়ী : (গম্ভীর)
আমি : আপনি কি মহান কোন লেখায় হাত দিয়েছেন?
কালজয়ী : আপনার রসবোধ ভালো। আচ্ছা পরে কথা হবে।
কালজয়ীরা আবার স্তুতি পছন্দ করেন। তাঁরা নিজেদের গ্রহ মনে করেন বলেই উপগ্রহ নিয়ে ঘোরাফেরা করতে পছন্দ করেন। গ্রহদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ কখনোই থাকে না, কিন্তু উপগ্রহের সঙ্গে থাকে। উপগ্রহরা উপযাজক হয়েই টেলিফোন করেন। তাঁদের টেলিফোন পেলে আতঙ্কিত বোধ করি। কেন আতঙ্কিত বোধ করি তা ব্যাখ্যা করছি_
উপগ্রহের টেলিফোন এসেছে, কণ্ঠ উত্তেজিত। উত্তেজনার ভেতর চাপা আনন্দ।
হুমায়ূন ভাই! আপনাকে তো শুইয়ে ফেলেছে।
কে শুইয়েছেন?
বদরুদ্দীন উমর।
কোথায় শোয়ালেন?
সমকাল পত্রিকার সেকেন্ড এডিটরিয়েলে। উনি বলেছেন, আপনার লেখায় শিক্ষামূলক কিছু নাই।
এটা তো উনি ঠিকই বলেছেন। আমি তো পাঠ্যবই লিখি না। আমার বই শিক্ষামূলক বই হবে কেন? জীবনে একটাই পাঠ্যবই লিখেছিলাম_ কোয়ান্টাম রসায়ন । সম্ভবত ওনার চোখ এড়িয়ে গেছে।
না হুমায়ূন ভাই, আপনি জিনিসটা হালকা দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। একটা বাদানুবাদ হওয়া উচিত। আপনি একটা কাউন্টার লেখা দিন। এটা আমার রিকোয়েস্ট।
আমি টেলিফোনের লাইন কেটে দিলাম। রাতের আড্ডায় আমার সমকাল-এর পাতায় শুয়ে পড়ার ঘটনা বললাম। বন্ধুরা আনন্দ পেল। আমার যেকোনো পতন আমার বন্ধুদের কাছে আনন্দময়।
এখন শিক্ষা বিষয়ে বলি। অতি বিচিত্র কারণে বাংলাদেশের মানুষ সব কিছুতেই শিক্ষা খোঁজে। গল্প-উপন্যাসে শিক্ষা, নাটক-সিনেমায় শিক্ষা। একসময় ঈদে প্রচারিত হাসির নাটকের শুরুতেই আমি লিখে দিতাম_ 'এই নাটকে শিক্ষামূলক কিছু নেই।'
সাধারণ মানুষ এবং অসাধারণ সমালোচকরাই শুধু যে শিক্ষা খোঁজেন তা নয়, দেশের প্রধানরাও শিক্ষা নিয়ে আগ্রহী। তাঁরাও একে অন্যকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য নানান ব্যতিক্রমী কর্মকাণ্ড হাতে নেন।
শিক্ষা নিয়ে এত উদ্বেগের পরও জাতি হিসেবে আমরা ক্রমেই মূর্খ হচ্ছি কেন কে বলবে?
***
তাকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল অতীতের অনেক তুমুল জনপ্রিয় লেখক কালের গর্ভে হারিয়ে গেছেন। আপনার ব্যাপারে কি মনে হয়?
উত্তরে তিনি বলেছিলেন: আমি অত্যন্ত ভাগ্যবান। লেখক হিসেবে আমার আজ প্রায় ৪০ বছর হয়ে গেল। অথবা আরেকটা ব্যাপার হতে পারে, এত দিনে আসলে আর কোনো লেখক তৈরি হয়নি।
আমি নিজেকে মনে করি নতুন লেখকদের জন্য একটা বিভীষিকা। কথাটা বুঝিয়ে বলি। বিভীষিকা এই অর্থে যে, পাঠক বই কেনে লাইব্রেরি থেকে। বইয়ের বিক্রেতারা যেসব বই বিক্রি হবে, সেগুলো সাজিয়ে রাখে। যেগুলো বিক্রি হয় না, সেগুলো রাখে না। তারা তো সাহিত্যসেবা করতে আসেনি। তারা চায় বই বিক্রি করতে। আমার নতুন বই বের হবে, আমি জায়গা দখল করব। দখলকৃত জায়গার পরিমাণ বাড়তেই থাকবে। অন্যদের বই প্রদর্শন করারই সুযোগ নেই। এই অর্থে আমি একটা বিভীষিকা।
আরেকটা ভুল কথা আমার সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে। আমি নাকি বইয়ের পাঠক বাড়িয়েছি। আমি কিন্তু পাঠক বাড়াইনি। পাঠক বাড়ালে তো সবার বই-ই বেশি বেশি বিক্রি হতো। আমি শুধু আমার নিজের পাঠক বাড়িয়েছি। পাঠক যদি বাড়াতাম, তাহলে তো সব বইয়ের বিক্রি বাড়ত।
পড়ার ব্যাপারটা খুবই ব্যক্তিগত একটা বিষয়। যে বইটা তুমি পড়তে চাও না, সেটা তোমাকে বিনা পয়সায় উপহার দিয়ে সঙ্গে ২০০ টাকা দেওয়া হলেও তুমি বইটা পড়বে না। জোর করে আর যা-ই হোক, কখনো বই পড়া হয় না।
***
একজন লেখকের লেখা কারো অপছন্দ হতেই পারে কিন্তু তাঁর লেখা যদি যদি কোন ধর্ম গোষ্ঠী জাতির জন্য অহিতকর না হয় তবে তাঁকে কিংবা তাঁর বই পরিত্যাগ করতে পারেন বা এড়িয়ে চলতে পারেন। ধরুন আপনার লেখা পছন্দ নয় বলে কেউ আপনার সামনাসামনি মৃত্যু কামনা করছে; লেখক হিসেবে আপনার অনুভুতিটা কেমন হবে?
হুমায়ুন আহমেদের জবানীতে এমন একটি ঘটনার কথা শুনুন;
আমাদের আশপাশে বিকৃত মানসিকতার মানুষের সংখ্যা কি বাড়ছে? মনে হয় বাড়ছে। একজনের কথা বলি, সে আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য হাস্যকর কাণ্ডকারখানা শুরু করল। একটা পর্যায়ে গেটের সামনে স্ট্রাইক করার মতো অবস্থা। মহা বিরক্ত হয়ে তাকে আসতে বললাম। ২৩-২৪ বছরের যুবক। কঠিন চোখমুখ। আমি বললাম, এখন বলো, আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য এত ব্যস্ত হয়েছ কেন? বিশেষ কিছু কি বলতে চাও?
চাই।
তাহলে বলে ফেলো।
আপনার লেখা আমার জঘন্য লাগে।
এই কথাটা বলার জন্য এত ঝামেলা করেছ?
হ্যাঁ! কারণ সরাসরি এই কথা আপনাকে বলার কারোর সাহস নাই। সবাই আপনার চামচা।
আমি বললাম, আরও কিছু কি বলবে?
হ্যাঁ।
বলে ফেলো।
সে ইংরেজিতে বলল, আই ওয়ান্ট ইউ টু ডাই সুন।
আমি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম (ইংরেজিতে), আই হোপ অ্যান্ড প্রে ইউ হ্যাভ আ লং অ্যান্ড মিনিংফুল লাইফ।
***
প্রশ্ন: কাঠপেন্সিল বা বলপয়েন্টে অনেক ঘটনা আপনি লিখেছেন। এর বাইরে বলার মতো কোনো ঘটনা কি এই মুহূর্তে মনে পড়ছে, যেটা লেখা হয়নি?
হুমায়ূন আহমেদ: সেবার চট্টগ্রামে একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। আমাকে খুব আদরযত্ন করে নিয়ে যাওয়া হলো। গিয়ে বুঝলাম, জীবনে যত বোকামি করেছি, তার মধ্যে এটা অন্যতম। একজন বক্তা মঞ্চে গেলেন আমার সম্পর্কে বলতে। ভদ্রলোক যা বললেন তার সারবস্তু হচ্ছে, হুমায়ূন আহমেদের পাঠকদের সবাই ‘পোলাপান’ এবং এই লেখক শুধু মধ্যবিত্তদের নিয়ে লেখেন। উনি মাঝিদের নিয়ে কিছু লেখেননি। খেটে খাওয়া মানুষদের নিয়ে কিছু লেখেননি।
যিনি বলছেন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। একসময় আমার বন্ধুমানুষ ছিলেন। অকস্মাত্ এই কঠিন আক্রমণে আমি যাকে বলে হতবাক। তার চেয়ে বেশি অবাক হলো অনুষ্ঠানে আগত দর্শকেরা। দেখলাম, তারা এই মন্তব্য নিতে পারছে না।
আমি বক্তৃতা দিতে উঠে অতি বিনয়ের সঙ্গে জানালাম—এই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ লেখক যাকে বলা হয় তিনি সারা জীবন রাজা-বাদশা-রাজকন্যা ছাড়া অন্যদের নিয়ে কিছুই লেখেননি। আমি তো তাও মধ্যবিত্ত নিয়ে লিখি। উনি তো রাজা-বাদশার নিচেই নামেননি। তাঁর নাম উইলিয়াম শেক্সপিয়ার। লেখকের যদি ক্ষমতা থাকে তিনি যেকোনো বিষয় নিয়ে ভালো লিখতে পারেন। কোন বিষয় নিয়ে লিখছেন সেটা নয়। লেখকের ক্ষমতা কতটুকু সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। লেখক হতে হলেই শুধু মাঝি-মল্লা গরিব খেটে খাওয়া মানুষদের নিয়ে লিখতে হবে, এই যুক্তি ভুল যুক্তি। মানুষের সম্পর্কটা আসলে গুরুত্বপূর্ণ। এ সম্পর্ক রাজা-রানির বেলায় যা মধ্যবিত্তদের বেলায়ও তা।
***
আরেকটি সাক্ষাতকারের খণ্ডিত অংশঃ
হু।আ। এখন এক ধরনের সাহিত্যচর্চা শুরু হয়েছে, অর্থহীন কিছু শব্দ_ শব্দের পর শব্দ কয়েক পাতা জুড়ে লেখা হয়। টানা তিন চারপাতা পড়েও তার একবিন্দু অর্থ আমি বুঝি না। এই গল্পহীন শব্দচর্চার কোনো মানে হয় না। অথচ একশ্রেণীর কাগজ আর কিছু লোকজন সেই অর্থহীন প্যাচালকেই মহাসাহিত্য বলছেন। এটা সাহিত্যের জন্যই শেষ পর্যন্ত ক্ষতিকর।
প্রশ্নঃ কিন্তু ওই ধরনের শব্দচর্চা তো জনপ্রিয় হচ্ছে না?
হু।আ। জনপ্রিয় বা অজনপ্রিয় সাহিত্য বলে কোনো ব্যাপার নেই। লেখাটি বোঝা গেল কিনা, লেখক বলতে চাচ্ছে কী_ সেটা একজন পাঠক হিসেবে আমার তো বুঝতে হবে। নাকি নিজেরা লিখলাম, নিজেরা বুঝলাম, আর যারা বুঝলো না; তাদের মেধাহীন বললাম, সেটা কী ধরনের সাহিত্য, আমি বুঝি না।
প্রশ্নঃ এই ধরনের সমালোচকরাই জনপ্রিয় লেখামাত্রই শিল্পমানশূন্য- এমন বলে থাকেন?
হু।আ। লেখা মানেই পাঠকের পড়ার জন্য। নইলে একজন লেখক নিজের লেখাটি লিখে বালিশের নিচে লুকিয়ে রাখতেন। তিনি প্রকাশ করতেন না।
***
ব্লগে সম্ভবত মন্তব্যের বেশ আকাল যাচ্ছে। আমি সেটা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাচ্ছি না। আমার লেখা আমি লিখে যাচ্ছি, যার ইচ্ছে হয় পড়বেন যার ইচ্ছে না হয় পড়বেন না। মন্তব্য করা না করা ব্লগারদের মর্জি।যারা হুমায়ূন আহমদকে সস্তা দরের বাজারী লেখক কিংবা নিচুমানের সাহিত্যিক মনে করে আত্মতৃপ্তি অনুভব করে নিজেদের সাহিত্য ও ভাষার রক্ষাকর্তা ভাবেন তাদের জন্য এ লেখাটা গত্রদাহের কারন হবে। হলে হবে তাতে কি? তবে আমি ঘুমাতে যাই-শুভরাত্রি সবাইকে।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ রাত ১১:২৭