
✦গ্রিগরি রাসপুটিন: সাধু না পাপী?
গ্রিগরি রাসপুটিনের নাম শুনলেই মানুষের মনে এক রহস্যময়, বিতর্কিত এবং কখনো কখনো ভয়ংকর চরিত্রের ছবি ভেসে ওঠে। কেউ তাকে 'পবিত্র লোক' মনে করে, কেউ 'পাপী', আবার কেউ ইতিহাসের এক ভুল বোঝানো চরিত্র হিসেবে দেখতে চায়। রাশিয়ার শেষ রাজবংশের পতনের আগে তাঁর উপস্থিতি ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত স্থান দখল করে রেখেছে। তবে রাসপুটিন আসলে কে ছিলেন? তিনি কি ক্ষমতালোভী এক ষড়যন্ত্রকারী, নাকি নিছক এক সহজ সরল ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি, যাকে ইতিহাস ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছে?
✦রাসপুটিনের উত্থান: এক সাইবেরিয়ান কৃষক থেকে রাজদরবারে প্রবেশ
রাসপুটিনের শৈশব ছিল দারিদ্র্য ও সীমিত সুযোগের মাঝে বেড়ে ওঠা। সাইবেরিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম নেওয়া এই মানুষটি ধর্ম ও আত্মদর্শনের প্রতি অনুরাগী হয়ে ওঠেন এবং দাবি করেন যে ঈশ্বর তাকে নিরাময়ের ক্ষমতা দিয়েছেন। যদিও প্রথমদিকে তাঁর এ ধরনের দাবি নিয়ে গ্রামের লোকেরা উপহাস করত, সময়ের সাথে সাথে তিনি রাশিয়ার আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে প্রবেশ করতে সক্ষম হন।
জার নিকোলাস দ্বিতীয় ও জারিনা আলেকজান্দ্রার সন্তান আলেক্সি হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পর, রাসপুটিন তার রোগ উপশমে সহায়তা করার দাবি করলে রাজপরিবার তাকে গ্রহণ করে। এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে প্রবেশ।

NEW SATIRICON MAGAZINE ২রা এপ্রিল ২০১৭. রাসপুতিনের ক্যারিকেচার; সাথে আছেন জার, জারিনা ও মিলিটারি অফিসারেরা।
✦ধর্ম, ক্ষমতা ও যৌনতা: এক বিতর্কিত সংমিশ্রণ
রাসপুটিন ছিলেন এক অদ্ভুত চরিত্র—ধর্মীয় ভাবধারায় গভীরভাবে আকৃষ্ট হলেও তিনি নিয়মিত পতিতাদের সঙ্গে যেতেন, অতিরিক্ত অ্যালকোহল পান করতেন এবং সম্ভ্রান্ত শ্রেণির নারীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের অভিযোগ ছিল। কিছু জীবনী বলছে, তিনি মাঝে মাঝে এই আসক্তিগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করতেন, কিন্তু তার আত্মসম্মানবোধের দুর্বলতা তাঁকে বারবার টেনে আনত সেই পুরনো পথে।
রাসপুটিনের চারপাশে গড়ে ওঠে এক রহস্য ও গুজবের বলয়। তাকে নিয়ে বলা হয়, উচ্চ শ্রেণির নারীরা ধর্মীয় নিরাময়ের আড়ালে তার সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হতেন। যদিও এর কোন প্রমাণ নেই, তথাপি এসব গল্প রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রচারণার কাজে ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে, বিপ্লবপূর্ব সময়ে রাজপরিবারের প্রতি জনসাধারণের ক্ষোভকে উসকে দিতে রাসপুটিনকে টার্গেট করা হয়।
✦রাসপুটিন ও রাজনীতি: কে দায়ী?
বেশিরভাগ ইতিহাসবিদ একমত যে, রাসপুটিন নিজে কখনো রাজনীতিবিদ ছিলেন না, তবে তিনি কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে নিজ অনুগামীদের বসাতে সাহায্য করেছেন। এটি রাজপরিবারের নৈতিক ও দক্ষতাজনিত প্রশ্নের জন্ম দেয়। জারিনার উপর রাসপুটিনের প্রভাব, বিশেষ করে যুদ্ধকালীন সময়ে, তাকে রাজনীতিতে এক অদৃশ্য শক্তিতে পরিণত করে তোলে। অনেকে মনে করেন, এই প্রভাবই রাজপরিবারের পতনের এক প্রকার অনুঘটক হয়ে দাঁড়ায়।
✦মৃত্যু ও পরবর্তী পৌরাণিক রূপ
রাসপুটিনের মৃত্যু ছিল নাটকীয় এবং রহস্যে মোড়ানো। গুজব আছে যে তাকে বিষ দেওয়া হয়েছিল, গুলি করা হয়েছিল, তারপরও সে বেঁচে ছিল, শেষে তাকে নদীতে ফেলে ডুবিয়ে মারা হয়। পরবর্তী ময়নাতদন্তে দেখা যায়, তার মৃত্যুর প্রকৃত কারণ ছিল ডুবে যাওয়া। এই সব নাটকীয়তা তাকে এক পৌরাণিক চরিত্রে পরিণত করে।
মৃত্যুর পর রাসপুটিনকে নিয়ে বিতর্ক থেমে যায়নি। সোভিয়েত আমলে তাকে উপহাসের বস্তু বানানো হয়, এবং তার চরিত্রে অতিরঞ্জিত নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য আরোপ করা হয়। আবার সোভিয়েত পতনের পর কিছু অর্থোডক্স খ্রিস্টান সম্প্রদায় রাসপুটিনকে "স্টারেটস" বা আধ্যাত্মিক পুরুষ হিসেবে দেখতে শুরু করেন।
✦আধুনিক রাশিয়ায় রাসপুটিন: এক বিভক্ত দৃষ্টিভঙ্গি
আজকের রাশিয়ায় রাসপুটিনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি মিশ্র। কেউ তাকে "রাশিয়ার শেষ সাধু" বলে, আবার কেউ "রাজনৈতিক ব্যর্থতার প্রতীক" মনে করে। আধুনিক পপ কালচারেও রাসপুটিনের উপস্থিতি লক্ষণীয়—চলচ্চিত্র, গান (যেমন বনি এম-এর বিখ্যাত “Rasputin”), এমনকি মিম কালচারে তিনি স্থান করে নিয়েছেন।
তবে অনেক রাশিয়ানই তাকে নিয়ে নির্লিপ্ত। তারা মনে করেন, রাসপুটিন একটি অতীত ইতিহাস—একইসঙ্গে অতিপ্রাকৃত কল্পনার এবং রাজনৈতিক চক্রান্তের ফল। তার সম্পর্কে যারা এখনও আগ্রহী, তারা হয় ইতিহাসপ্রেমী, ধর্মীয় মহলের অনুসারী অথবা কেবল রহস্যপ্রিয়।
✦রাসপুটিন—একটি মানবিক চরিত্রের প্রতিচ্ছবি
গ্রিগরি রাসপুটিনকে হয়তো নিছক "ভালো" বা "মন্দ" বলা যায় না। তিনি ছিলেন এক ত্রুটিপূর্ণ, আত্মসম্মান-সংকটে ভোগা, কিন্তু আত্মবিশ্বাসী এবং ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি, যিনি নিজেকে ঈশ্বরের কাজে নিয়োজিত মনে করতেন। তার জীবনের বিভিন্ন অধ্যায়ে তিনি কখনও নিরাময়কারী, কখনও উপদেষ্টা, আবার কখনও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়েছেন।
তার গল্প আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—ইতিহাস কেবল ঘটনাবলীর পুঞ্জ নয়, বরং মানুষ, তাদের ত্রুটি, প্রেরণা, এবং পরিণতির জটিল মেলবন্ধন।

✦বিভ্রান্তির রাজনীতি: পুতিন ও রাসপুটিনের ছায়া
"Путин всех запутал" – "পুতিন সবাইকে বিভ্রান্ত করলেন"।
এই বাক্যটি কেবল আধুনিক রাশিয়ার রাজনৈতিক কৌশলের ব্যঙ্গাত্মক চিত্রই নয়, বরং নামের সাদৃশ্য দিয়ে প্রাচীন 'রাসপুটিন' এবং আধুনিক 'পুতিন'-এর মধ্যে একটি মনস্তাত্ত্বিক সেতুবন্ধনও নির্দেশ করে।
পুতিন একটি স্বৈরতান্ত্রিক, নিয়ন্ত্রিত ন্যারেটিভ তৈরির মাধ্যমে সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছেন – যেমনটা একসময় রাসপুটিনের বিরুদ্ধেও রটানো হয়েছিল নানা গুজব, যা ছিল রাজতন্ত্রের পতনের কৌশলগত অংশ।
✦ রাসপুটিন: সাধু না শয়তান?
"রাসপুটিন শয়তানের জালকে অচল করে দিয়েছে"
– распутал сети беса
এই উক্তিটি একটি আধ্যাত্মিক রূপকের মাধ্যমে রাসপুটিনকে একজন সাধু ও রক্ষক হিসেবে উপস্থাপন করে। আধুনিক কিছু রুশ অর্থোডক্স গোষ্ঠী রাসপুটিনকে ‘স্তারেতস গ্রিগরি’ নামে ডাকেন, যা আধ্যাত্মিক জ্ঞানীর উপাধি (Hazboun, The Historical Society)।
✦ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে:
অনেক খ্রিস্টান রাসপুটিনকে ঈশ্বরের অনুগ্রহধন্য বলে মনে করেন, বিশেষ করে সারেভিচ অ্যালেক্সির হিমোফিলিয়া উপশমের প্রেক্ষিতে।
রাসপুটিনের জীবনে ধর্মীয় পুনর্জন্ম ঘটেছিল সাইবেরিয়ায় নির্বাসনের পর (Ivanov, Russian State University for the Humanities)।
✦রাসপুটিন ও জার পরিবার: সম্পর্কের বাস্তবতা
গুজব বনাম বাস্তবতা:
গুজব ছিল যে রাসপুটিন জার পরিবার, বিশেষ করে সম্রাজ্ঞী আলেকজান্দ্রা এবং রাজকন্যাদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক ছিল।
কিন্তু প্রায় সকল ঐতিহাসিক ও গবেষক এই দাবিকে উড়িয়ে দিয়েছেন:
ফুট নোটঃ অনেকেই না জেনে জার নিকোলাস ২ এর স্ত্রীর নাম জারিনা বলে উল্লেখ করেন। আসলে সম্রাট এর স্ত্রী যেমন সম্রাজ্ঞী ঠিক তেমনি জারের স্ত্রীদের জারিনা বলে উল্লেখ করা হোত। প্রকৃতপক্ষে; জার নিকোলাস ২-এর স্ত্রীর নাম ছিল আলেক্সান্দ্রা ফিওদোরোভনা ।তিনি জার্মানিতে জন্মগ্রহণ করেন এবং তাঁর জন্মগত নাম ছিল প্রিন্সেস ভিক্টোরিয়া আলিক্স অব হেসে । তিনি ব্রিটিশ রানি ভিক্টোরিয়ার নাতনি ছিলেন।
Lara Vogel লিখেছেন:
“রাসপুটিন যদি রাজকন্যাদের সঙ্গে এমন কিছু করতেন, তিনি এক ঘণ্টার মধ্যেই মৃত অথবা নির্বাসিত হতেন।”
John McLaurin, Jr., একজন সাবেক বিচারক, বলেন:
“আমাদের হাতে কোনও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ নেই যে রাসপুটিন অভিজাত কোনও নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক রেখেছিলেন।”
Boris Ivanov উল্লেখ করেন, এসব গুজব ছিল রোমানভদের (জার) বিরুদ্ধে জনমত তৈরির সামাজিক অস্ত্র।
✦রাসপুটিনের মৃত্যু: ইতিহাস না পৌরাণিক কাহিনী?
রাসপুটিনের মৃত্যু ঘিরে রয়েছে গভীর রহস্য ও নাটকীয়তা:
বিভিন্ন বার তাকে বিষ প্রয়োগ, গুলি, পেটানো হয়।শেষমেশ তাকে নদীতে ফেলে দেওয়া হয় – কিন্তু বলা হয়, সে তখনও জীবিত ছিল।
ময়নাতদন্তে দেখা যায় মৃত্যুর কারণ ছিল পানিতে ডুবে যাওয়া – গুলির চিহ্ন স্পষ্ট নয়।এই ধরণের মৃত্যু একটি পৌরাণিক ইমেজ সৃষ্টি করেছে – একজন ‘অমর সাধু’, যাকে সহজে হত্যা করা যায় না।
✦ রাসপুটিন ও আধুনিক রাশিয়ার জাতীয়তাবাদী পুনরুজ্জীবন
সোভিয়েত পতনের পর রাসপুটিনের ভাবমূর্তির রূপান্তর:
সোভিয়েত আমলে রাসপুটিনকে লোভী, ব্যভিচারী, ধোঁকাবাজ হিসেবে দেখানো হতো।
কিন্তু ২০০০-এর দশকে, বিশেষ করে পুতিনের শাসনামলে, এক জাতীয়তাবাদী পুনর্জাগরণের অংশ হিসেবে রাশিয়ার ইতিহাস পুনর্নির্মাণ শুরু হয়।
Kevin Hazboun এর মতে:
“পূর্বতন জার ও তাঁর পরিবারের প্রতি সহানুভূতি বাড়ে, এবং অর্থোডক্স চার্চ তাদের ক্যানোনাইজ করে।”
এই পুনর্মূল্যায়নের ছায়া পড়ে রাসপুটিনের উপরেও – কিছু গোষ্ঠী তাকে ভবিষ্যতের সাধু হিসেবে বিবেচনা করছে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় রয়েছে রাসপুটিনকে উৎসর্গিত গ্রুপ।
সাইবেরিয়ার তার পুরনো বাড়ি এখন জাদুঘর।
মস্কোর অর্থোডক্স পিতৃতন্ত্র তাকে শহীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে বলে গুজব রয়েছে।
✦রাসপুটিন – বিভক্ত বিশ্বাসের প্রতীক্রর
রাসপুটিন আজও রাশিয়ার সমাজে একটি দ্বৈত প্রতীক:
একদিকে তিনি ঈশ্বরের দূত, অন্যদিকে ষড়যন্ত্রকারী।
একদিকে সাধু, অন্যদিকে "খ্রিস্টশত্রু"।
রাসপুটিন সাধু না পাপী—এই প্রশ্নের কোনো সরল উত্তর নেই। ইতিহাস তাকে দুইভাবেই দেখেছে, এবং হয়তো সময়ের প্রবাহে সেই দৃষ্টিভঙ্গিও বারবার পরিবর্তিত হবে। তবে একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, রাসপুটিন ছিলেন ইতিহাসের অন্যতম রহস্যময় চরিত্র—যার জীবনী পড়লে আমরা শুধু তাকে নয়, বরং নিজেকেও নতুনভাবে বুঝতে পারি রাসপুটিন ও আধুনিক রাশিয়ায় তাঁর ভাবমূর্তি।আধুনিক রাশিয়ার এই দ্বিধা, রাসপুটিনকে ঘিরে গঠিত ধর্ম, রাজনীতি, ও সংস্কৃতির জটিল সম্পর্ককে স্পষ্ট করে দেয়।
*** প্রথম পর্ব শেষ***
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:২৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




