somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দুই নারী দুই নদী (ছোট গল্প ) ম্যারিনা নাসরীন

০৪ ঠা মার্চ, ২০১৫ সকাল ১১:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


চাচার বাসায় দরজা খোলার শব্দ হল। বৃদ্ধের কাশির মত খনখনে আওয়াজ। তিথিদের ঘরের অবস্থাও একই। দাদার আমলের বাড়ি । চৌকাঠগুলো ঘুনে খেয়ে বড় বড় ছিদ্র করে ফেলেছে। তিথি একটা ছিদ্রে চোখ রাখে। চাচী বের হচ্ছে। সে দৌড়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়।
চাচীর পরনে আজ কচি কলাপাতা রঙের মিহি সিল্কের শাড়ি। ধূসর সরু পাড় গ্রাম দেশের ধার ঘেঁষে বয়ে যাওয়া খালের মত শরীর পেঁচিয়ে ধরেছে। ভি কাট ব্লাউজের পেছনে পাড়ের রঙয়ের শো বোতাম। তামা রঙের পিঠের খোলা অংশে বিকেলের নরম রোদ পড়ে পিতলের মত চিকচিক করছে। চুলগুলো চুড়ো করে তুলে পাঞ্চ ক্লিপ লাগানো। কিছু চুল কাঁধের উপর লতার মত দুলছে।
চাচী যখন হেঁটে যায় তখন তার শরীর জুড়ে তরঙ্গ ওঠে। পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্নার মত রিনঝিনে ছন্দ। আজকের হাঁটার গতি কিছুটা সর্পিল। তিথির হঠাৎ লাউতাড়া সাপের কথা মনে হল। ছোট বেলায় একবার বড় মায়ের সবজি মাচানে লাউয়ের সাথে জড়িয়ে থাকতে দেখেছিল। সবুজ রঙের, লাউয়ের লম্বা ডগার মত। না বুঝে হাত দিতেই সড়সড় করে উঠল। তিথির চিৎকারে বড় মা জড়িয়ে ধরে বলেছিল,
ভয় নেই মা, ওটা লাউতাড়া সাপ, কামড়ায় না।
পেন্সিল হিলের খটখট আওয়াজ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে চাচীর অবয়বটাও গলির বাঁকে হারিয়ে গেল। বাঁকের ওপাশে হয়ত এক্স করোলাটি অপেক্ষা করছে। গভীর রাতে গাড়ীটি চাচীকে নিয়ে শেখেরটেকের এই ঘিঞ্জি গলিতে আবারো ফিরে আসবে। ততক্ষণে জীবনের খণ্ডকালীন দায়ভারে তার সমস্ত সাজ সরঞ্জাম হয়ে যাবে এলোমেলো আর অগোছালো।
তিথি.........
বাবা ডাকছেন। এই হয়েছে আর এক জ্বালা! যতদিন চাকরীতে ব্যস্ত ছিলেন, ভাল ছিল। অবসরে যাবার পর তাঁর সময় কাটে না। পেপার পড়তে পড়তে ত্যানা করে ফেলেন। তার উপর এই চা দাও, চশমাটা খুঁজে দাও, পান সাজিয়ে আনো। এখন হয়ত চায়ের নেশা লেগেছে।
তিথি ধীর পায়ে বাবার পাশে এসে দাঁড়ায়।
চা দেব বাবা ?
নারে মা। বলছিলাম ওরা কি আর ফোন করেছিল ?
‘ওরা’ কারা তিথি জানে। গত কবছরে অসংখ্যবার এই ‘ওদের’ সামনে তিথিকে পরীক্ষায় বসতে হয়েছে। কখনো রেস্টুরেন্টে, কখনো কোন শপিং মলে কখনোবা বাসাতেই। তিথি নিজেকে যথা সম্ভব সাজিয়ে গুজিয়ে উপস্থাপন করে। শাড়ির নীচে ছয় ইঞ্চি উঁচু হাইহিল পরে। নানা প্রশ্নের জবাব দেয়। কিন্তু প্রায় প্রতিবারই তারা সার্কাস দেখার অনুভূতি নিয়ে ফিরে যায়।
গত সপ্তাহে যে পাত্রটি এসেছিল তার উচ্চতা চার ফুট পাঁচ ছয় ইঞ্চি হবে। উচ্চতায় তিথির চেয়ে খুব বেশী যে লম্বা সেটা নয়। বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক। সাথে দুজন বন্ধু ছিল। বের হবার সময় সে তার ঘটক বন্ধুকে চাপা স্বরে বলল,
তুই যে আমাকে বনসাই দেখাতে আনবি সেটা তো আগে বলিসনি।
তিথি নিজের দিকে তাকায়। বাচ্চাদের মত ছোট্ট গোটা গোটা হাত পা। বনসাই কেমন তিথি জানে না, তবে শুনেছে বড় বড় ডালওয়ালা গাছকে নানা কৌশলে খর্বাকৃতি করে রাখা হয়। এই সম্পর্কে একটা গল্প পড়েছিল নাম ‘বামন বটবৃক্ষ’। স্কুলে পড়ার সময় বন্ধুরা তাকে বামন পীর বলে ডাকত। কান্নায় তিথির দুচোখ উপচে পড়ে বুক ভেসে যেত । একদিন বাবা ওর কান্না দেখে ফেললেন তারপর আর স্কুলে যেতে দেননি। পরে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং এইচএসসি পাশ করেছে। ইচ্ছে ছিল স্নাতক কমপ্লিট করবে কিন্তু মায়ের মৃত্যু ভাইয়ের সংসারে তিথির পড়ালেখায় ফুলস্টপ দিয়ে দেয় ।
বাবার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তিথি চলে আসে। অনেক কাজ বাকি। অর্ণবকে আনতে কোচিং সেন্টারে যেতে হবে । রাতুল আর রিমা অফিস থেকে ফিরবে। তাদের জন্য নাস্তা রেডি রাখা করা দরকার। সবকিছু ঠিকঠাক না পেলে রিমা রাগে কেশর ফুলিয়ে রাখবে।
অর্ণবকে নেবার জন্য যখন তিথি বের হচ্ছে তখন সন্ধ্যা হয় হয় । চাচার ঘর থেকে বেহালার করুন সুর ভেসে আসছে। এই সুর শুনলে তিথির বুকের জমাট বেদনা তার সীমা অতিক্রম করে যেতে চায়। মন বলে, আমি ভাল নেই, আমি ভাল নেই ।
চাচা নাজ টেক্সটাইল মিলের সিনিয়র কেমিস্ট ছিলেন । উত্তরায় চমৎকার একটি ফ্ল্যাটে তিন ছেলে মেয়ে আর চাচীকে নিয়ে ছিমছাম সংসার। প্রায়ই ছুটির দিনে চাচার বাসায় বন্ধুবান্ধবের আড্ডা বসে। সকাল দশটার মধ্যেই তিথি আর রাতুলকে নিতে তার অফিসের গাড়ী শেখেরটেক চলে আসত। চাচার বেহালায় সে সময় তিথি দুঃখের কোন সুর শোনেনি। একদিন নাজ টেক্সটাইল মিলে আগুন লেগে কয়েকজন কর্মী মারা গেল । সৌভাগ্যবশত তিনি বেঁচে গেলেন কিন্তু হাসপাতাল থেকে চাচাকে যখন বাড়িতে আনা হল তখন তাঁর দৃষ্টিতে রুপান্তরহীন কালো পর্দা ঝুলছে। বগলে ক্র্যাচ। চাচার বেহালার তারে এখন অনন্ত বর্ষা।
অর্ণবের কোচিং সেন্টারে হেঁটে যেতে মিনিট দশেক লাগে । আশে পাশের চা পুরীর দোকান থেকে দুই একটা টুকরো কথা, ফিচেল হাসি ছুটে আসছে। তিথি যখন হেঁটে যায় তখন পথচারীদের অনেকেই তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। যেন মানুষ নয় বিশেষ কোন জীব। অর্ণবও বোধ হয় আজকাল বনসাই ফুপির সাথে যাওয়া আসা করতে লজ্জা পায়। আগের মত রাস্তায় হাত ধরে থাকে না। একটু দূরত্ব রেখে চলে।
অর্ণবকে নিয়ে বাসায় ফেরার কিছুক্ষণের মধ্যে অফিস থেকে রিমা ফিরল । মুখ অসম্ভব রকম গম্ভীর । ছেলে বৌয়ের মেজাজ না বুঝে বাবা প্রশ্ন করে বসেন,
বৌমা, ছেলে পক্ষ কোন যোগাযোগ করেছে ?
আচ্ছা বাবা আপনি কি কিছুই বুঝেন না ? আপনার বামুন মেয়েকে কে বিয়ে করবে বলুন তো ?
রিমার রূঢ় জবাবে বাবার মুখে পাণ্ডুর ছায়া পড়ল। মিন মিন করে কৈফিয়তের সুরে বললেন,
না, ভেবেছিলাম ছেলেটাও তো অনেক খাটো, এবার হয়ত বিয়েটা হয়ে যাবে।
ছেলে খাটো হলে কি হবে? ওই ছেলে দেখবেন ওর চেয়ে তিন হাত লম্বা মেয়েকে বিয়ে করে আনবে।
তিথি একটু আড়ালেই ছিল কিন্তু সেখান থেকে স্পষ্টভাবে দেখল বাবার চোখ টলমল করছে ।
বাবা রাতে আজ ভাত খাননি । তিথির পেটেও ক্ষুধা ছিল না। ভাইয়ের গলগ্রহ হয়ে বেঁচে থাকার গ্লানি মাঝে মাঝে পাহাড়সম মনে হয় ।
রাত দ্বিপ্রহর অতিক্রম করে তৃতীয় প্রহরে হাঁটতে শুরু করেছে। বাসার সবাই ঘুমুচ্ছে। তিথি বারান্দায় বসে আকাশের বুকে মেঘ বালিকার ওড়াওড়ি দেখে।
পাশের ব্যালকনি থেকে চাপা কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। চাচীর অস্তিত্ব চিরে বেরিয়ে আসা এই দুঃখী নদীটির সাথে তিথির পরিচয় বহুদিনের। বিকেলের দেখা লাস্যময়ী নারীর সাথে রাতের এই ক্রন্দসী নারীর কোন মিল নেই।
তিথির চোখেও শতচ্ছিন্ন বর্ষায় থইথই করা একটা নদী আছে । চাচী কি তিথির নদীটির খবর জানে ? হয়ত জানে, হয়তবা না।
তিথি বাতাসে কান পাতে। রাতের বুক জুড়ে উড়ছে দুই নদীর দীর্ঘশ্বাস।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মার্চ, ২০১৫ সকাল ১১:৪০
২টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইসলামে পর্দা মানে মার্জিত ও নম্রতা: ভুল বোঝাবুঝি ও বিতর্ক

লিখেছেন মি. বিকেল, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ১:১৩



বোরকা পরা বা পর্দা প্রথা শুধুমাত্র ইসলামে আছে এবং এদেরকে একঘরে করে দেওয়া উচিত বিবেচনা করা যাবে না। কারণ পর্দা বা হিজাব, নেকাব ও বোরকা পরার প্রথা শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৯

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।

কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।

ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।

যা-কিছু পায় হারায়ে যায়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×