ভোর হয়ে এসেছে । দুই একটা মোরগ বাগ দিয়ে উঠল । কামার পাড়া জেগে উঠছে । কল তলে থালাবাটির ঝনঝনানি, উঠোনে ঝাঁটার শরশর আওয়াজের সাথে এক দুইখানা ঘর থেকে হাতুড়ীর ঠুকঠাক শব্দ ভেসে আসছে । হারান একটা হাইসো হাতে নিয়ে ধার পরখ করে, নাহ ভাল ধার হয়নি । আরেকবার ফাইলে দিতে হবে । ও পাড়ার মজিদ মিয়া দুই খানা হাইসো গড়তে দিয়েছিল হারান সাথে আরও তিনখানা বাড়তি করে রেখেছে । সামনে কোষ্টা কাটার গোণ, হাটে তুললে বেচা হয়ে যাবে ।
ন্যাও দুটো মুড়ি খেয়ে পানি খাও দিকিনি । রাইত ভোর এত খাটা খাটনি করলি তুমি বাঁচপা?
নীলিমা বেতের টুকরীতে মুড়ির সাথে একগ্লাস পানি সামনে রাখে ।
না খাটলি খাবি কি ? ওগেরে পড়াবি কি কইরে ? আমার ছাওয়ালেরা যেদিন পাশ দে বেরুবে । চাকরী কইরে ঘরে পয়সা আনবি সেদিন আর আমার কাজ করা লাগবিনে । বুঝিছিস পাগলী ?
তাই বলে এইরাম মহিষের খাটনি খাটতি হবি ?
কিসের খাটনি ? যা তো প্যাঁচাল পারিসনে । ওগেরে ঘুমিত্তে তুলে পড়তি বসা । আর শোন হাইত্নে ভাল কইরে ঝাঁট দিস । মাস্টার আসবি ।
সে আমি করে রাখবানি । তুমার চিন্তা করতি হবি নে ।
ব্রাহ্মণ ঘরের ছেলে নবদ্বীপ কুমার হারানের দুই ছেলে অমল বিমলকে একবেলা করে পড়িয়ে যায় । হারানের মুখে সূক্ষ্ম হাসির রেখা দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল । নিম্ন জাতীর শূদ্র বলে এই ব্রাহ্মণদের কাছে তারা অস্পৃশ্য ছিল । বাপ-ঠাকুরদাকে মাটিতে বসে কলাপাতায় প্রসাদ খেতে দেখেছে । ছোঁয়া বাঁচিয়ে দূর থেকে লুচি লাবড়া ছুঁড়ে দিত । সে নিজেও এভাবে খেয়েছে । মোসলমানের টিউবকলে পানি নিতে গেলে তাড়িয়ে দিয়েছে । কখনো পিপাসার পানি চাইলে ঘটির নীচে কোষ পেতে ধরলে দূর থেকে পানি ঢেলে দিত । সেসব দিন হারানের নেই । শানবিলের মাঠে এক বিঘা ক্ষেতি জমি কিনেছে । জবেদ আলী সে জমি বর্গা করে । নবদ্বীপ কুমার পড়াতে এলে নীলিমা মুড়ির সাথে চা করে দেয় । খায়, নিচু জাত বলে অসম্মান করে না । তবুও চাপা অপমান বোধ ভেতরে ভেতরে হারানকে পোড়ায় ।
ছেলেরা এ গাঁয়ে থাকবে না । আরও পাশ দিয়ে বড় হবে, শহরে যাবে । শহরের কেউ জানবে না ওরা হারান কর্মকারের ছেলে । হারান বেঁচে না থাকুক নীলিমা বেঁচে থাকবে । ছেলেদের দালানে আরাম করবে পাখার বাতাস খাবে, বিজলী বাতি, ঠাণ্ডা পানি কত কি !