somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তুলি নেই, তাই আঁকতে পারি নি

২৭ শে ডিসেম্বর, ২০০৭ সন্ধ্যা ৭:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সনি এরিকসনের ফোন ক্যামেরায় মর্ত্যের পৃথিবীর অপার্থিব সৌন্দর্য ধরার চেষ্টা করতে দু:সাহস লাগে। সেই দু:সাহস অনেক দেখিয়েছি। কিন্তু এবার, বাসার সবার দু'দিনের প্রকৃতির সাথে মিশে যাওয়া সময়ে সে দু:সাহস দেখাতে একদমই ইচ্ছা করছিল না। কেবলই মনে হচ্ছিল, একটা ভালো ক্যামেরা যদি থাকতো!

ধরুন, ওই পাহাড়ী রাস্তায় যখন গাড়ি চালাচ্ছিলাম... দু'শ কিলোমিটার কেবল আঁকা বাঁকা রাস্তা। ক্ষনে ক্ষনেই বাঁকের ওপাশটা চোখের আড়ালে। কখনও দু'পাশে ঘন বন, ভর দুপুরকে সন্ধ্যা বলে ভ্রম হয়। গাছের পাতার ছায়ায় পিচ ঢাকা মসৃন রাস্তা ছায়াময়। মাঝে মাঝে শুধু, পাতার ফাঁক দিয়ে অল্প অল্প সূর্য-আলো এসে গাড়ির কাঁচের উপর আলোর কারুকাজ এঁকে যায়। একটা ক্যামেরা যদি থাকতো, আশি কিমি/ঘন্টা বেগে চলা গাড়িটাকে সেখানেই থামিয়ে আলোর কারুকাজগুলোকে ক্যামেরাবন্দী করতাম!

কিংবা, যখন 'সী ক্লীফ ব্রিজ' এ গাড়ি চালাচ্ছিলাম। এক পাশে আকাশ ছোঁয়া পাহাড়, এর পরে কয়েক কিমি লম্বা ঝুলন্ত এঁকে বেঁকে চলা ব্রিজখানি কয়েকটা থামের উপর দাঁড়িয়ে আছে অশান্ত সাগরের উপর। অনেক নিচে বড় বড় ঢেউগুলো আছড়ে পড়ছে পাহাড়ের পায়ে। জানালার কাঁচ নামিয়ে তীব্র বাতাসে উড়তে উড়তে যখন গাড়ি চালাচ্ছিলাম সে রাস্তায়, তখন মনে হচ্ছিল, ওই দূর পাহাড় থেকে রাস্তাটার ছবি তুললে ঠিক ভিউকার্ডের ছবির মত দেখাতো।

কিংবা কিয়ামাতে, সাগর তীরে বাঁধাই করা জায়গার পাশের তীব্র সবুজ ঘাসে আমরা গা এলিয়ে বসে ছিলাম। সাগরের পাশে পাথুরে জায়গাটায় মাঝে মাঝেই গাংচিলদের আড্ডা বসছিল। হঠাৎ 'হুশ' বলে দৌঁড়ানি দিলে ওদের আসর ভংগ হয়। সবগুলো গাংচিল এক সাথে ডানা ঝাপটে উড়ে যায় নানা দিকে। সাগরের ব্যাকগ্রাউন্ডে, কয়েকটা বসা, কয়েকটা আধা বসা আর অনেক উড়ন্তগুলো গাংচিলদের এলোমেলো ডানা মেলা অবস্থার গতিময়তাকে ধরে রাখার জন্য হাতটা বড় নিশপিশ করছিল!

কিংবা পরের দিন, যখন মেঘলা দিনটায় আকাশ আর সাগর পাল্লা দিয়ে অভিমান করছিল, এক অজানা অন্ধ রাগে উদ্ভ্রান্ত হচ্ছিল, ঠিক সেই সময় এক আধা পাগলা লোক, সরু পাথুরে, পিচ্ছিল জায়গাটায় গিয়ে বড়শি ফেলে মাছ ধরছিল পাগলা সাগরে। বড় বড় ঢেউগুলো কয়েক মিটার উঁচুতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে ছুঁয়ে দিতে চাইছিল। তখন, ঠিক তখন যদি ক্যামেরাটা হাতে থাকতো!

কিংবা অন্য পাশে... সে এক বিশাল ব্যাপার। পাইরেটস অফ ক্যারিবিয়ানের মত সাগরের পাশের কালো পাথুরে পর্বতটার মাঝখানে আস্তে আস্তে সুবিশাল, অন্ধকার, রহস্যময় গুহা হয়ে গিয়েছে। সেদিকে কখনও সূর্যের আলো যায় না। তাকাতেই গায়ে শির শির করে উঠে। সাগরের ঢেউগুলো সেখানে আছড়ে পড়তেই ভেঙে অসংখ্য ছোট টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। দেখে মনে হয়, বাষ্প উড়ছে, রহস্যময়তাকে বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে। আরেকটু পিছনে গিয়ে, সাগরের একদম তীর ঘেষে মাথা উচু করে রাখা পাহাড়টার একদম চূড়ায় উঠে, পায়ের আংগুলে ভর করে চেষ্টা করলেই পুরা রহস্যময়তাটা ক্যামেরায় ধরে ফেলা যেত...

আরও দক্ষিনে ড্রাইভ করে যখন আউটব্যাকে পৌঁছলাম? মাইলের পর মাইল খালি জায়গা, কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। কোন প্রানের দেখাটি নেই, শুধু উঁচু উঁচু সবুজ ঘাস আর অসংখ্য ছোট ছোট হলুদ ডেইজি, বাতাসের তালে তালে দুলছে। সেখানে হাঁটু গেড়ে বসে, ডেইজিগুলোর সমতলে এসে, কাছের ডেইজিগুলোকে ফোকাস করলে মনে হতো অসীম জুড়ে কেবল কিছু সুখী ডেইজি দুলছে। কিংবা ছোট্ট কোন মেয়ে এক পিঠ চুল দুলিয়ে যদি দৌঁড়ে যেত মাঠের মাঝখান দিয়ে!

নভেম্বর ডিসেম্বর নিয়ম ভেঙে খুব বৃষ্টি হলো। সেই বৃষ্টি পেয়ে অভুক্ত পাহাড়গুলো নরম সবুজ ঘাসের চাদরে নিজেদের ঢেকে নিয়েছে। গত বছরই একই সময়ে এসব রাস্তার চারপাশে কেবল ধুধু মরুভূমির মত পাহাড় ছিল। এখন দেখলে মনে হয়, ডানো দুধের বিজ্ঞাপনে ঢুকে গিয়েছি ভুল করে।

খুব নির্জন, ছোট্ট কাঠের বাড়িটায় যখন পৌঁছলাম, তখন বাড়ির পিছনের উঠোনে কনে দেখা আলোয় বিশাল, ছায়াময় বৃক্ষটাকে বড় রোমান্টিক লাগছিল। খুব সুন্দর গাছটা, গাছের নিচে চাদর বিছিয়ে, মোটা কান্ডে হেলান দিয়ে সারা দিন পার করে দেয়া যায় প্রিয় মানুষদের সাথে। কি আশ্চর্য, মাঝে মাঝেই লাল টকটকে আর গাঢ় নীল রঙের অদ্ভূত সুন্দর টিয়া পাখিগুলো বাগানের ঘাসে এসে কি যেন খুঁজছে। পাশের বাড়ির পেয়ারা গাছটায় হলুদ ঝুটির বড় সাদা আটটা কাকাতুয়া এক সাথে বসে ছিল। খুব ভোরে যখন পাখিদের গান শুনতে শুনতে দেখেছিলাম, চুপি চুপি মীরাকেও ডেকে আনলাম এক ফাঁকে, তখন সবগুলো কাকাতুয়া এক মনে পেয়ারা খাচ্ছিল। আমার বেরসিক হাঁচিটাকে তখনই আসতে হলো। বিকট শব্দে মুহূর্তেই সবগুলো কাকাতুয়া ডানা ঝাপটে উড়ে গেল। শরীরের ওভারসেনসিটিভ হিস্টামিনগুলোকে বকে দিতে দিতে মনে হলো, ঠিক সেই মুহূর্তটাকে যদি ধরে রাখতে পারতাম!

তাছাড়া সাগরের নানা রূপ তো ছিলোই। কখনও সূর্যের আদর পেয়ে গাঢ় নীল, আবার কখনও আকাশের সাথে পাল্লা দিয়ে কালো, ক্ষ্রিপ্ত, উত্তাল সমুদ্র। এখানে সেখানে আবার উজ্জ্বল সবুজাভ পানি। প্রতিটা ঢেউ একেবারে আনকোরা নতুন মনে হয়। প্রতিবারই সাদা ফেনাগুলো যেন ছড়িয়ে পড়ে একদম নতুন ভাবে। ক্লান্তি আসে না তাকিয়ে থাকায়। আমরা সবাই সাগরের নির্জন তীরে বসে থেকে, শুয়ে থেকে, সূর্যকে ভ্রমন করতে দিলাম আকাশের এ মাথা থেকে সে মাথা। শেষ মেষ হলুদ সূর্যের বর নিয়ে বাড়ি ফিরে প্রথমবারের মত আয়না দেখে চমকে উঠলাম। মুখের হিজাবের প্রান্ত দিয়ে ঢাকা অংশটা কেউ যেন দাগ টেনে আলাদা করেছে, তারপরে, খোলা অংশে নিখুঁত ভাবে কয়েক পোচ কালো কালি মেখেছে। এভাবে কবজি পর্যন্ত হাত, আর পায়ের পাতা--অদৃশ্য কালো মোজায় ঢাকা। চুড়ান্ত রকমের হাস্যকর দেখাচ্ছিল। মনে হলো, একখানা ভালো ক্যামেরা থাকলে বেশ কিম্ভুত একটা সেল্ফ পোট্রেট পাওয়া যেত নির্ঘাত!

------------------------
সংযুক্ত ছবিটা 'সী ক্লীফ ব্রিজ' এর। এখান থেকে নেয়া।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০০৭ সন্ধ্যা ৭:৩৭
১৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×