somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নতুন বাড়ী

২১ শে আগস্ট, ২০০৯ রাত ৮:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বিদ্যুৎ চমকটা চারপাশ দিনের মতো আলোকিত করে দিলো। গাছগুলোর চেহারা কেমন যেন সবুজ না অন্য একটা রং ধারণ করলো। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, প্রচন্ড বৃষ্টি। অথচ চলন্ত গাড়ীর ভিতরে অত শব্দ আসছে না। গাড়ীটা হোন্ডা সিভিক, শিমুলের প্রিয় গাড়ী। পাশে বসে আছে তুলি। ওর স্ত্রী। বিয়ে করেছে ওরা বেশিদিন হয়নি। এতদিন ছিলো ধানমন্ডির এক বাড়ীতে। কিন্তু বাসাটা বেশি পছন্দ হয়নি তুলির। তাই নতুন বাসা নিতে হচ্ছে।

গাড়ীটা মোড় ঘুরলো। সামনে হলুদ একটা সাইনবোর্ড। উওরা ৪ নং সেক্টর। কাছে পিঠেই আছে বাড়ীটা। খালি এখন নাম্বার খুঁজে বের করা। সামান্য যেতেই বায়ে একটা লেন পড়লো। বাড়ীর নাম্বার দেখে বুঝলো এই লেনেই বাড়ীটা আছে। হঠাৎ হাত তুলে তুলি দেখালো বাড়ীটা- ওই যে ওই দোতলা বাড়ীটা।

বাড়ীটার সামনে এসে গাড়ী থামালো শিমুল। নাম্বার দেখলো, হ্যা এটাই। আড়চোখে তাকালো তুলির দিকে। দেখলো মিটিমিটি হাসছে ও। যেন বাড়ীটা খুঁজে বের করে সে সবচেয়ে বেশি খুশি।

বাড়ীটার দোতলায় আলো জ্বলছে। নিচে গেটটা আটকানো। দুবার হর্ণ দিলো শিমুল। দরজা খুলে উকিঁ দিলো এক দাড়োয়ান। তারপর ঘরঘর করে দরজা খুলে দিলো। কে জানে মনে হয় আগে থেকেই ব্যাটাকে কেয়ারটেকার বলে রেখেছে। গ্যারেজে গাড়ী ঢোকাতে ঢোকাতে সি ডি টা অফ করলো শিমুল। তারপর তুলির দিকে তাকিয়ে বললো, চলো নামি। তুলি বললো, ইয়েস বস।

প্রত্যেকটা ঘর নতুন রং করা। তাই কেমন যেন নতুন একটা গন্ধ নাকে আসছে। কেয়ারটেকার মহা বাঁচাল। সেই তখন থেকে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে ভ্যাদর ভ্যাদর করে যাচ্ছে। সব রুমেই লাইট জ্বলছে। শেষ বেডরুমটা দরজায় তালা মারা। ভ্র“ কুঁচকে তাকালো শিমুল কেয়ারটেকারের দিকে।

ও হ্যা স্যার তালা মারা। মানে এই আর কি। আসুন অন্যান্য রুম গুলো দেখি। দেখুন বাড়ীর বারান্দায় মনের মতো আকাশ দেখার সুযোগ পাবেন।
আরে ধ্যত্তেরি। সব দেখেছি এবার বেডরুম দেখান। ভীষণ বিরক্ত হয়ে হাত নাড়লো তুলি। ওর ইচ্ছে হচ্ছিলো ওর চাপড়ে ব্যাটার মাথার সব কাঁচা চুল পাকিয়ে দিতে। মানুষ এত বাঁচাল হতে পারে।

জি ম্যাডাম। দেখাচ্ছি। চাবি নিচে, এখনই নিয়ে আসছি। ব্যাটা দ্রুত নেমে গেলো।

ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেললো শিমুল। ওর বাড়ীটা তেমন বেশি পছন্দ হয়নি। তাছাড়া এ রাস্তাটা কেমন যেন নিরিবিলি। বাড়ীর ঠিক উল্টোদিকে বিশাল জায়গা নিয়ে গাছের বাগান। এত দামী জায়গা এভাবে ফেলে রেখেছে ! তাছাড়া এই বাড়ীর দুপাশে দুই জমি ফাঁকা পড়ে আছে। তারপর থেকে আবার বাড়ী। তবে বাড়ীটা মনে হয় তুলির পছন্দ হয়েছে। তুলি মনে মনে খুশি হলেও শিমুল বুঝতে পারে।

কেমন যেন একটা হাসি হাসি চেহারা হয়ে যায়। আবার ভয় পেলেও বোঝা যায়, তখনও পাগল মেয়েটা হাসে। তবে তখন হাসি দেয় দাঁত বের করে। আশে পাশে বাড়ীতে কুত্তা নেই তো !

এই প্রভুভক্ত জানোয়ারটাকে তুলি ভীষণ ভয় পায়। কেমন ভয় পায় তার কোন তুলনা নেই। খালি অলিম্পিকে ওর পিছনে একটা কুত্তা ধরিয়ে দিলেই হবে। ফাষ্ট প্রাইজ ঠেকায় কে। প্রমাণ হয়ে যাবে বাঙ্গালী নারীও ফাষ্ট হতে পারে অলিম্পিকে।

তুলি স্লাইডিং জানালার গ্রিলে নাক ঠেকিয়ে বাইরে বৃষ্টি দেখছে। সোডিয়াম লাইটের হলুদ আলোয় কেমন যেন লাগছে পানির ফোঁটা গুলোকে। গুমগুম শব্দে মেঘ ডাকলো। চমকে দ্রুত শিমুলের কাছে চলে এলো তুলি। দাঁত বের করে চমৎকার একটা হাসি দিলো।

কেয়ারটেকার পাঁচটা চাবি চেক করে ছ নম্বর দিয়ে তালা খুললো। সবার আগে ঢুকলো তুলি। ভিতরে অন্ধকার। এমন সময় বিদ্যৎ চমকে আকাশ ফালা ফালা করলো। উজ্জ্বল সাদা আলোয় ঘরটা দিনের আলোর মতো সাদা হয়ে উঠলো। জেরে একটা চিৎকার দিলো তুলি এবং শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তুলিকে।

আরে আরে কি হলো ?
কেয়ারটেকার দ্রুত সুইচ টিপে লাইট জ্বালালো। কি হয়েছে ম্যাডাম ? তার মুখে একধরণের চাপা হাসি।

শিমুল দেখলো তুলি থরথর করে কাঁপছে। চকিতে একবার চাইলো সিলিংয়ে। ও অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলো ফ্যান লাগানোর হুকের কাছে কতকগুলো ইলেকট্রিকের তার কিছুটা বের হয়ে আছে। সে তো থাকবেই, ফ্যান লাগাতে হবে না !

ও কিছু নয় যে তুমি ভয় পাবে বোকা মেয়ে। ও তো তার, সাপ টাপ কিছু নয়। এ কথা শুনে তুলি একটু শান্ত হলো। তুলির বেশ পছন্দ হলো ঘরটা। বের হবার সময় আবার চকিতে তাকালো সিলিংয়ের দিকে। তারপর বের হয়ে এলো। শিমুল নামার সময় দেখলো যে ব্যাটা কেয়ারটেকার ও একটু কম কথা বলছে। আর গম্ভীর একটু। মনে মনে একটু হাসলো ও। বেচারা বোধহয় তুলি ঝাড়ি খেয়ে হার্ট হয়েছে। ঠিকই আছে। শালা বাচাল। গাড়ীতে উঠার সময় কেয়ারটেকারকে বললো, বাড়ীটা আমরা নেবো।

একমাস হলো এখানে এসেছি আমরা। কাল বুধবার। আমাদের একমাস পূর্ণ হবে। বেশ ভালো লাগছে বাড়ীটা। চারিদিকে কেমন যেন শান্তি শান্তি ভাব। বারান্দায় বসে সামনের গাছগাছালিতে ভরা জায়গাটা দেখতেও ভালো লাগে। অবশ্য দুপাশেই একটু ফাঁকা দেখে কেন যেন মনে হয় বাড়ীটা একদম আইসোলেটেড। রাতে দেখেছি ডানদিকের বাড়ীটার আলো জ্বলে না। তারমানে কেউ থাকে না ওখানে। বাম পাশের বাড়ীটায় একদিন থাকে একদিন থাকেনা। কে জানে মালিক কই যায়। গাড়ীও কম চলে এই রাস্তা দিয়ে।

বাড়ীটা পাহাড়া দেয় ষাটোর্দ্ধ এক বৃদ্ধ, মানে দাড়োয়ান। লোকটা বেশ ভালো, কথা শুনে বুঝেছি। প্রথম দিনই মজার ব্যাপার হলো, গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম- এ বাড়ীতে যেন কখনও কুকুর না ঢুকতে পারে। আমি একদম সহ্য করতে পারিনা। শুনে মাথা নিচু করে হাসলো বুড়ো। ম্যাডাম, আপনি আসার আগে বিশটা কুকুর এনেছিলাম পালতে। কিন্তু একটাও থাকলো না।

কেন থাকলো না ? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করতে বুড়ো মাথা চুলকালো। না থাকলে আমি কি করবো বলুন !

সুন্দর বারান্দা আর লোকেশনটা পছন্দ বলে বাড়ীটা নিয়েছি আমরা। বাসা পছন্দ করার রাতে তো আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। অবশ্য এমনিতেও বেশ ভীতু আমি। কুত্তা ভয় পাই, সাপ ভয় পাই। তবে কি দেখে ভয় পেয়েছিলাম সেটা শিমুলকে বলিনি আমি। শুনে আবার ঠাট্টা করে রাগাবে আমাকে। তবে আমি যেন সত্যিই দেখলাম একটা ফাঁসির দড়ি সিলিং থেকে ঝুলছে। কি জানি চোখের ভূল হয়তো। এখন আর সেই তার বেরিয়ে নেই। মিস্ত্রি ঠিক করে দিয়ে গেছে।

মিষ্টি শব্দে ওয়ালক্লক দুটো বেল দিলো। দ্রুত উঠে দাড়ালাম। টেবিল সাজাতে হবে। এখনই শিমুল চলে আসবে অফিস থেকে। ও হ্যা... আমার এক ধরনের শুচিবায়ুর মতো আছে তাই বাসায় সব কাজ আমি নিজেই করি। কাজের লোক রাখিনা। অবশ্য কাজ করা তেমন কষ্টের না। বাসা ভর্তি ইলেকট্রনিক্সের যন্ত্রপাতি। ওয়াশিং মেশিন থেকে শুরু করে যা যা দরকার...

ওভেনে খাবার গরম করে টেবিল সাজাতে বসলাম। এই যে টেবিলে খাবার সাজানো এতেও আমার নিজের মনমত সাজাই। পারমুটেশন, কম্বিনেশন করে যত সুন্দর করে পারি খাবারগুলো বিন্যস্ত করি। যেই মাত্র সাজানো হলো এমন সময় টুং টাং করে দুবার বেল বেজে উঠলো। দ্রুত উঠে দাড়ালাম। শিমুল এসেছে।

খেতে বসে তাকালো সাজানো খাবারের দিকে। তুমি যে কিনা। মাথায় খালি পাগলামী।

এই যাবে বেড়াতে রানাদের ? সারা বিকাল বেরিয়ে রাতে খেয়ে চলে আসবো।

শুনে আমারও খুশি লাগলো। রানা ভাই আজব এক চিড়িয়া। তার চেয়ে আজব তার চার বছরের বাচ্চাটা। ওয়ান টু খুব ভালো মতো বলতে পারে। কিন্তু থ্রি স্পেল করতে দিলে বলে টু এন্ড থ্রি। আমি রাজি হতেই শিমুল বললো তাহলে দ্রুত রেডি হও। আমি তেল নিয়ে আসি। গাড়ীর তেল শেষ। শিষ বাজাতে বাজাতে সিড়ি দিয়ে নেমে গেলো ও। একটু পরেই গাড়ী বের হয়ে গেলো জোরে। পাগলটার জন্যে ভয় হয়। যেভাবে গাড়ী মাঝে মাঝে টান দেয়... ও হাসে আর আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে বসে থাকি।

ভীষণ খাতির যত্ন করলেন আমাদের ভাবী। ভীষণ রসিক। প্রচুর কথা বলেন। কিন্তু তার প্রেজেন্টেশন এতো ভালো যে মনে হয় আরো শুনি, আরো...

ভাবীর মেয়ের নাম তিন্নি। ওকে কোলে নিয়ে গিয়েছি বারান্দায়, রাস্তার উল্টোপাশে একটা টকটকে লাল কার দাড়িয়ে আছে। তিন্নির তো ভীষণ পছন্দ হলো গাড়ীটা। বললো, আন্টি আমাকে ওই গাড়ীটা দাওনা।
আমি বললাম, ওটা তো আমি দিতে পারি না আম্মু। ওটার মালিক বকবে যে !

কেন দেবে না ? যদি আমি তাকে আমার সবচেয়ে সুন্দর কবিতাটা শোনাই, তবুও দেবে না ?

ভীষণ মজা লাগলো আমার। বললাম, হ্যা তবে তো দেয়ার কথা।

বিদায় নিয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত এগারটা বেজে গেলো। রুমের টিউব লাইট অন করতেই সাথে সাথে জ্বললো না। স্টার্টার কিছুণ খোঁচালো বাল্বটাকে। তারপর যেন বিরক্ত হয়ে একসময় জ্বললো। শিমুল দেখলাম মহা বিরক্ত। বিড়বিড় করে গালি দিচ্ছে ইলেকট্রিশিয়ান কে। শালার ভাই শালা। শয়তানের নাতি। দামীটা দিতে বলেছি তারপরও যদি ঝামেলা করে...

পরদিন। দুপুর একটা বাজে। এমন সময় শিমুল ফোন করে জানালো দুপুরে আজ আসতে পারবে না। বড় একটা মিটিং আছে শেরাটনে। ফিরতে একটু রাত হবে। গলায় মধু জড়িয়ে বললো, লী সোনা, তুমি একা খেয়ে নাও। আমি মিটিং শেষ হলেই সুড়ুত করে উল্কার বেগে চলে আসবো। শুনে কড়া গলায় আমিও বললাম, উল্কার বেগে আসার দরকার নেই। নরমাল স্পিডে আসবে।

আমার কথাটা শুনে ও হা হা করে হাসতে লাগলো। গা জ্বালানো হাসি। যেন আমি মস্ত একটা রসিকতা করেছি।

তার আধাঘন্টার মধ্যে আকাশে মেঘ জমে গেলো। বারান্দায় গিয়ে বসলাম। বেশ ভালো বাতাস বইছে। আকাশে কতো মেঘ। সবগুলোর যেন খুব তাড়া। দ্রুত সরে যাচ্ছে। সামনে দিয়ে মিনিট দশেক পরপর দু একটা দামী গাড়ী যাচ্ছে। কি মনে হতে ইচ্ছে হলো ভিডিও গেম খেলি। এই একটা বাচ্চাদের খেলা এখনও আমি খেলি। আলমারি থেকে বাক্সটা নামালাম। মূল ইউনিটটাকে সেফ রাখার জন্যে উপরে নিচে খবরের কাগজ দিয়ে রেখেছি। উপরের কাগজগুলো সরিয়ে বের করলাম ওটা। জ্যাক লাগিয়ে মাত্র দাড়িয়েছি এমন সময় কেউ বেল দিলো। শিমুল নয় তাহলে কে এলো ! পেপারগুলো হাতে নিলাম। একটা আবার পড়ে গেলো হাত থেকে। বাকীগুলো নিয়ে এগুলাম। কাগজগুলো বিনে ফেলে দরজার আই হোলে দেখলাম দাড়োয়ান। দরজা খুলতে মুখ কাচুমাচু করে বললো, ম্যাডাম আমি একটু কেরানীগঞ্জে যাবো। আমার এক আত্নীয় ভীষণ অসুস্থ। আজ রাতে ফিরতে পারবো না মনে হয়। যাবো ম্যাডাম ?

আমি আপত্তি করলাম না। দরকার যখন যাক। গ্যারেজের দরজা শিমুলই খুলতে পারবে।

বাইরে দেখলাম বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়ছে। তারই মধ্যে দিয়ে দাড়োয়ান দ্রুত হাটতে লাগলো। নিচে নেমে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ফিরে এলাম। বাপরে দাড়োয়ান এতো আত্নীয়ের চিন্তায় পাগল যে এই প্রবল বৃষ্টিতেও হেটে চলে গেলো। আমার একটা রেইনকোট দিয়ে দিলেও হতো।
মাথায় হঠাৎ চিন্তা এলো নিচের গেটে কি তালা কি ভালোমতো লাগিয়েছি ? আমি একলা মানুষ যদি ডাকাত ঢুকে পড়ে। ওর অবশ্য একটা লাইসেন্স করা পিস্তল আছে। সিড়ির লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে গেটের কাছে গেলাম। অলরেডি অন্ধকার হয়ে গেছে। গেটে তালা ঠিক মতোই লাগানো হয়েছে। দোতলায় উঠতে উঠতে মনে হলো বৃষ্টির বেগ আরও বাড়লো। ঘরে ঢুকতেই একটা গন্ধ নাকে ধাক্কা দিলো। আরে এতো নতুন রঙের গন্ধ। এটাতো একমাস আগে ছিলো। এতো দিন পরে হঠাৎ গন্ধ, আগে তো টের পাইনি। কি ব্যাপার ! একটু ভয় আমার মনে ঢুকে গেলো।

প্রায় অন্ধকার চারপাশ। ঘরের প্রত্যেকটা লাইট জ্বালিয়ে দিলাম। এমনকি বারান্দার লাইট ও। বেডরুমে ঢুকে আরেকটা ধাক্কা খেলাম। গন্ধ আরও তীব্র এই ঘরে। লাইট ব্যাটা আবার গোয়ার্তুমি করছে। অবশ্য গাইগুই করে ব্যাটা জ্বললো। মেঝেতে পেপারটা পড়ে আছে। আবার তোলার জন্যে ঝুকলাম, বেশ বড়সড় একটা রিপোর্ট-"স্যার মাহমুদ রোডে অস্বাভাবিক মৃত্যু।"

এইসব রিপোর্ট আমি পড়িনা। অসহ্য লাগে। কাগজটা বিনে ছুড়ে ফেলে দিতে যাবো তখন খটকা লাগলো। আরে আমাদের এই লেনের নামও তো এটাই। একবার চোখ বুলালাম প্রথম লাইনে। কতো রোডই তো আছে, আমাদের এটা নাও হতে পারে। নাহ্, উত্তরা চার নং সেক্টরের এই রোডই। বিছানায় বসলাম, লেখা-

স্টাফ রিপোর্টার: গতকাল উওরার স্যার মাহমুদ রোডে ২৪/২ নং বাড়ীর মালিক শফিউদ্দিন আলমের মৃতদেহ পাওয়া যায় তারই বাড়ীর দোতলায় বেডরুমে। ঘরের সিলিং থেকে তার লাশ ঝুলছিলো...

মাথায় যেন কিছু ঢুকছিলো না আমার। এই বাড়ী ? এই বেডরুম ? পত্রিকার তারিখ দেখলাম। এক বছর আগের। উফ্ ! কি ভয়ংকর। ভয়ে চারপাশ যেন দুলতে লাগলো আমার। সামান্য শব্দেও চমকে উঠছি। এর মধ্যে বাইরে প্রচন্ড শব্দে বাজ পড়লো।

হঠাৎ মনে পড়লো আমার ! একমাস আগে এই দিনে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছিলো। ঠিক এইরকম। সবকিছু কেমন যেন ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। দৌড়ে টিভিটা ছাড়লাম। কিন্তু কিছুই আসছে না, শুধু ঝিরঝির, লাইন নেই। ভয়ে আতঙ্কে আরো শুকিয়ে গেলো। দু সেকেন্ড পরে বুঝলাম গেমসের জ্যাক লাগিয়েছি তাই টিভি আসছে না। দ্রুত জ্যাক চেঞ্জ করে টিভি ছাড়লাম। বিজ্ঞাপন হচ্ছে। অনেকটুক বাড়িয়ে দিলাম ভলিউম। যাক নিঃশব্দ তো দূর হলো। হ্নদপিন্ড ভীষণভাবে লাফাচ্ছে। বুঝতে পারলাম এখান থেকে বেরুতে না পারলে একটা কিছু সর্বনাশ হয়ে যাবে। ফোনটা তুলে নিলাম। হাত এমন কাঁপছে যে দুবার চেষ্টা করে তারপর ফোন করলাম শেরাটনে। কিন্তু তারা জানালো এখন ডাকা যাবেনা। তারপর গেলো লাইন কেটে। এমনিই কেটে গেলো না কাটলো বুঝলাম না। এরপর ফোনে কেমন যেনো শো শো শব্দ শুরু হলো।
মার কাছে ফোন ঘুরালাম। কিন্তু লাইন বিজি। ফোন রেখে উঠে দাড়ালাম। এখান থেকে এই মুহুর্তে চলে যেতে হবে। আবার চোখ গেলো পত্রিকার দিকে। বড় করে নাম লিখা পত্রিকার,তার নিচে ডেট: ৯-৫-৯৬। কাঁপতে কাঁপতে বিছানায় এসে বসলাম। আজও সেই ৯ তারিখ। মে মাস।

আলমারি খুলে পিস্তলটা বের করলাম। সেফটি ক্যাচ অন করে তাকালাম সিলিংয়ের দিকে। প্রচন্ড জোরে ফ্যান ঘুরছে। ওটার ঘুরা দেখে আমার মাথা আরো ঘুরতে লাগলো। রেইনকোট টা বের করবো। এখানে আর এক মুহুর্তও না। আলমারির হ্যান্ডেল ধরে টান দিলাম। কি আশ্চর্য্য, খুলছে না। কেউ যেন প্রচন্ড শক্তিতে ভিতর থেকে ধরে রেখেছে। বুদ্ধি যেনো গুলিয়ে গেলো। বিছানায় বসে হাঁপাতে লাগলাম। তখন মনে হলো, আরে আমিতো তালা খুলিনি। দ্রুত চাবি ঘুরিয়ে খুললাম। বের করলাম আমার রেইনকোট টা। আতঙ্কে আমার কান্না আসতে লাগলো।

হাতে ব্যাগটা নিয়ে তুলি দৌড়ে নিচে নামলো। দরজায় এসে থমকে গেলো। দরজার চাবি রয়ে গেছে বেডরুমে। কিন্তু ওখানে আবার ফিরে যাবার সাহস হলোনা। দরজার সামনে মাটিতে বসে পড়লো ও।

মিনিট পাঁচেক পরে ওর প্রান আরো শুকিয়ে গেলো। কেমন যেনো হ্যালোসিনেশনের মতো হচ্ছে। ও বুঝতে পারলো মস্তিস্কে অক্সিজেন কম যাচ্ছে। কিন্তু তবুও মাথা ঝাড়া দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস টেনে ভয় তাড়ানো গেলোনা। ও শিওর যে উপরে কিছু একটা ঘটছে। কে যেন ডাইনিং টেবিলের চেয়ার সরালো বেশ জোরে। টুংটাং করে ঝাড়বাতি দুলতে লাগলো। তারপর কেমন যেনো চড়চড় শব্দ। মনে হচ্ছে যেন দেয়াল ফেটে যাচ্ছে।

গ্রিলের ফাঁকা বাইরের রাস্তা দেখলো ও। কেউ কোথাও নেই। এমনকি একটা গাড়ী পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। তারপর চোখ গেলো ওপাশের বাগানে।
গাছগুলো সব যেন এক তালে তালে ডানে বায়ে মাথা ঝাকাচ্ছে। শো শো শব্দ। ওর যেনো মনে হলো গাছগুলো যেন আনন্দে নাচছে। হঠাৎ শব্দ করে একটা ডাল ভাঙলো। প্রচন্ড পানি পিপাসা পেলো ওর। ও যেনো কোথায় শুনেছে কেউ অপঘাতে মারা গেলে তার আত্না সহজে সেই জায়গা ছাড়ে না। আর সেই জায়গা নাকি আরও মানুষ মারার জন্যে ডাকে। সেইজন্যে গ্রামে দেখা যায় কেউ যদি গাছে ফাঁসি নেয় সেই গাছ বা সেই ডাল কেটে ফেলে।

কড়ড়... শব্দে দোতলার দরজা আস্তে আস্তে খুলে গেলো। চমকে ও তাকালো উপরে। ও দ্রুত চিন্তা করার চেষ্টা করলো, এই শব্দ হতে পারেনা। ওর দরজায় কোন শব্দ হয়না।

বাইরে যেন কেন হঠাৎ করে বাতাস থেমে গেলো। ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বুঝতে পারলো কিছু একটা অতিপ্রাকৃত জিনিস ঘটতে চলেছে। দরজার কাছে কিছু একটা আছে। কারণ ড্রয়িং রুমের লাইট পড়ছে। সেই লাইটের যে আভাটা এতণ দেখা যাচ্ছিলো এখন তা আর দেখা যাচ্ছেনা। পাপোশটা সরে গেলো। কি যেনো একটা নামছে নিচের দিকে। সমস্ত রক্ত যেনো চলে আসতে চাইলো মুখে আতঙ্কে।

একটা লোক। হেটে নয় হামাগুড়ি দিয়ে নামছে। গলায় বাঁধা একটা দড়ি। দড়িটাকে টেনেই নামছে। একধাপ একধাপ করে নেমে নিচে নেমে এলো ওটা। আর দুটো সিড়ি বাকী তারপর গ্যারেজে নেমে আসবে।

থামলো ওটা। তারপর আস্তে আস্তে মুখ তুললো ওর দিকে। চকচকে কাঁচের মতো চোখ। মুখে পাথুরে কাঠিন্য। আবার নামতে লাগলো ওটা। দুটো ধাপ নামার পরে হঠাৎ করেই গলার দড়িটা টানটান হয়ে গেলো। আরো একটু এগিয়ে এলো। আরো একটু। স্থির চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। তারপর ওটার মুখটা একটা বিভৎস হাসিতে ভরে গেলো।

আরেক পা এগুতে গিয়ে থেমে গেলো। দড়ি একদম টান টান হয়ে আছে। প্রচন্ড হিংস্র একটা গর্জন করে সামনে এগুতে চাইলো কিন্তু পারলো না। দড়িটা আর এগুতে দিচ্ছে না তাকে। হাত দুটো সামনে বাড়িয়ে দিলো ওকে ধরার জন্য। তুলি তখনও বেশ দূরে। সম্মোহিতের মতো ও চেয়ে আছে সামনে। ওকে ধরতে না পেরে ওটা বারবার মাটি খামচাতে লাগলো। তুলি দেখলো তিন হাত দূরে প্রচন্ড চেষ্টা করছে জানোয়ারটা। কেমন যেনো আধাঁর হয়ে এলো চারপাশ। আধাঁরে হারিয়ে যাবার সময় ও শুনতে পেলো- শব্দ করে দড়িটা ছিড়ে গেলো।

অনেকদিন এমন বৃষ্টি দেখেনি শিমুল। বেশ দ্রুত মহাখালি পার হয়ে এলো ওর গাড়ি। ভেজা পথ একটু আস্তে চালানো উচিত। কিন্তু ওর মন যেন কেমন করছে। বেচারা মেয়েটা বাড়িতে একা। সাই করে স্যার মাহমুদ রোডে ঢুকলো ওর গাড়ী। প্রচন্ড বৃষ্টির জন্যে ওয়াইপার চলছে পুরোদমে। ঘ্যাচ করে বাড়ীর সামনে থেমে টানা হর্ন দিলো। কিন্তু কেউ খুললো না। সবগুলো রুমের লাইট জ্বলছে। শেষে বেশ বিরক্ত হয়েই দৌড়ে গাড়ী থেকে নেমে দরজা ধাক্কা দিলো। ওমনি আস্তে করে দরজা খুলে গেলো। দ্রুত ভিতরে ঢুকে সিড়ি দিয়ে উঠতে লাগলো। বেশ ভয় পেয়েছে ও। দরজা খোলা কেন ? সবদরজা খোলা। জোরে একবার ডাকলো-তুলি।

বেডরুমে ঢুকতেই ধপ করে কারেন্ট চলে গেলো। ঘর নতুন একটা গন্ধে ভরা। কেমন যেন একটা শব্দ হতে ও তাকালো উপরের দিকে। বিদ্যুত চমকালো তখন। দেখলো, ইলেকট্রিকের কতকগুলো তার একটা ফাঁসের মতো হয়ে নেমে আসছে। আরেকবার ও ভাঙা গলায় ডাকলো- তুলি...

অবশেষঃ
খুব তদন্ত হলো ব্যাপারটা নিয়ে। এরকম একটা সুখি দম্পতি এভাবে আত্নহত্যা করবে কেন। পত্রিকার রিপোর্ট শেষ হলো এভাবে,"... এখানে উল্লেখ্য যে এই বাড়ির মালিকও একইভাবে মারা গেছেন। তাহলে কি বলা যায়না, এই দুই ঘটনার মধ্যে একটা যোগসুত্র আছে ?"

***
অনেকদিন পরের কথা। স্যার মাহমুদ রোডে একটা গাড়ী ঢুকলো। হালকা টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে তখন। গাড়ীর ভেতর এক নতুন দম্পতি। মেয়েটা বললো, উফ্, কি সুন্দর রোডটা তাইনা ? এই থামো থামো, এই বাড়িটাই তো আমরা খুঁজছি ২৪/২, তাইনা ? ? ? ?
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে আগস্ট, ২০০৯ রাত ৮:৩৩
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাম গাছ (জামুন কা পেড়)

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

মূল: কৃষণ চন্দর
অনুবাদ: কাজী সায়েমুজ্জামান

গত রাতে ভয়াবহ ঝড় হয়েছে। সেই ঝড়ে সচিবালয়ের লনে একটি জাম গাছ পড়ে গেছে। সকালে মালী দেখলো এক লোক গাছের নিচে চাপা পড়ে আছে।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনির্বাণ শিখা

লিখেছেন নীলসাধু, ০৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



রাত ন’টার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।

আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ইয়াম্মি খুব টেস্ট=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৪



©কাজী ফাতেমা ছবি
সবুজ আমের কুচি কুচি
কাঁচা লংকা সাথে
ঝালে ঝুলে, সাথে চিনি
কচলে নরম হাতে....

মিষ্টি ঝালের সংমিশ্রনে
ভর্তা কি কয় তারে!
খেলে পরে একবার, খেতে
ইচ্ছে বারে বারে।

ভর্তার আস্বাদ লাগলো জিভে
ইয়াম্মি খুব টেস্ট
গ্রীষ্মের... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিরোনামহীন দুটি গল্প

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৫

গল্প ১।
এখন আর দুপুরে দামী হোটেলে খাই না, দাম এবং খাদ্যমানের জন্য। মোটামুটি এক/দেড়শ টাকা প্লাস বয়দের কিছু টিপস (এটা আমার জন্য ফিক্সড হয়েছে ১০টাকা, ঈদ চাদে বেশি হয়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

এশিয়ান র‍্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান !!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:২০

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।তালিকায় ভারতের ৪০, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×