- দাদন, ও দাদন
- কিরে দাদু ভাই?
- এবার গল্প শুনাবে না? গতবার তো গল্প শেষই করতে পারলে না, গল্প বলতে বলতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলে, কত্তদিন পর আবার এলাম, আমি কিন্তু এবার গল্প না শুনে কিচ্ছুতেই যাবই না।
ছোট্ট রাফি একা একাই বিড়বিড় করে চলে,
- জানো দাদন, আমাকে আব্বু আম্মু নতুন স্কুলে দিয়েছে ওখানে সব্বাইকে বলেছি যে তুমি কত্ত সুন্দর গল্প বলতে পার
- “তাই দাদু ভাই?” মুখে এক চিলতে হাসি নিয়ে সেলিম সাহেব
কথাটা বলেন।
- আচ্ছা দাদন, তুমি আমাদের সাথে থাকলে কি হয়? আমি প্রতিদিন কত্ত সুন্দর সুন্দর গল্প শুনতে পারতাম!!
নাতির কথাটা শুনে তার মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকেন সেলিম সাহেব। মাত্র ৭ থেকে ৮ বছরে পরেছে রাফি, অথচ কথা শুনলে মনে হবে কত বড় ছেলেই না সে! সেলিম সাহেব নিজেকে সামলে নাতিকে বলেন,
- হয়েছে কি দাদু ভাই, তোমরা যে বাসাটাতে থাক সেটাতো অনেক ছোট, তাই আমি তোমাদের সাথে থাকি না, বুঝলে?
- কোথায় ছোট? আমরা তো কয়েকদিন আগেই নতুন বাসাতে উঠলাম, আগেরটা থেকে তো এটা অনেক বড়। আব্বু-আম্মু কেউ তোমাকে বলেনি?
সেলিম সাহেব একটু অবাক হন, তার ছেলে যে নতুন বাড়িতে উঠেছে তা তিনি জানতেন না। নাতি না বললে হয়ত জীবনেও জানতেন পারতেম না। তার চোখের কোনাটা জলে ভরে উঠে, তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন,
- নারে দাদু ভাই, তোদের উঁচু উঁচু বাড়িঘর আমার ভাল লাগেনা, আর এখানে আমার মত কত মানুষ আছেরে দাদু ভাই, ওদের সাথে ঘুরাঘুরি করতে ভালোই লাগে, তাই এখানেই থাকতে ভাল লাগেরে দাদু ভাই।
- আচ্ছা, আচ্ছা, হয়েছে। এখন তোমার গল্প বল, না হলে আবার ঘুমিয়ে যাবে, আর আম্মু আসলে তো আমিও চলে যাব।
- বলছি বলছি, তার আগে এই আপেলটা খাও দাদু ভাই।
নাতির মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকেন সেলিম সাহেব, আজ দেড় বছর হল তার ছেলে তাকে এই বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গেছেন। মাঝে মাঝে এসে কিছু টাকা দিয়ে যান, তখন বৃদ্ধ সেলিম সাহেব নাতিকে দেখতে চাইলে উনার ছেলে তার ছেলের স্ত্রীকে দিয়ে সেলিম সাহেবের কাছে নাতিকে পাঠান। মাসে এই একটা দিন সেলিম সাহেবের ঈদের দিন, সারাটাদিন নাতি আর দাদা একসাথে কাটায়, তারপর বিকেলে আবার নাতি চলে যায় সেলিম সাহেবের পুত্রবধুর সাথে। আপেল খেয়ে সারলে সেলিম সাহেব তার নাতিকে গল্প বলতে শুরু করেন,
- আজ থেকে অনেক বছর আগে এক দেশে ছিল এক রাজা আর রানী
- দাদন, রাজা আর রানীর গল্প তো অনেক শুনিয়েছ!
- না রে দাদু ভাই, এটা শুনাইনি, শুনে দেখ।
- আচ্ছা ঠিক আছে, শুনাও।
- তো সেই রাজা আর রানীর মধ্যে ছিল অনেক ভালোবাসা, তারা একজন আরেকজনকে ছাড়া থাকতেই পারত না। তাদের সংসার পূরণ করতে তাদের ঘরে জন্ম নিল ফুটফুটে এক রাজপুত্র। রাজপুত্রকে পেয়েতো রাজা-রানী বেজায় খুশি। তাদের দিনগুলো সুখে শান্তিতে কাটতে লাগল। রাজপুত্র বড় হতে লাগল, রাজপুত্র ছিল পড়ালেখায় বেজায় ভাল, তাই রাজা রাজপুত্রকে ভাল পড়াশুনার জন্যে পাশের রাজ্যে পাঠালেন। রাজপুত্র পাশের রাজ্যেই পড়াশুনা করতে করতে অনেক যশ-খ্যাতি অর্জন করল, রাজা-রানী তো পুত্রের কথা শুনে খুবই খুশি। এদিকে রাজপুত্র এক রাজকন্যাকে পছন্দ করে তার মা-বাবাকে না জানিয়েই নিজের বিয়ে নিজেই করে নিল। রাজা রাজপুত্রের এমন কান্ডে কষ্ট পেলেও তা মেনে নিল, শুধুমাত্র রাণীর বোঝানোর জন্যে। রাজপুত্র রাজকন্যাকে বিয়ে করে পাশের রাজ্যেই থাকতে শুরু করল। রাজা যতই খোঁজ পাঠায় রাজপুত্রকে আসতে, রাজপুত্র তবুও আসেনা। অবশেষে রাজপুত্রের দুশ্চিন্তায় রাণী পৃথিবী ছেড়েই চলে গেলেন। তখন রাজপুত্র তার স্ত্রী আর সন্তান নিয়ে রাজ্যে উপস্থিত হল। রাজপুত্র রাজাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে রাজ্য বিক্রি করে রাজাকে নিয়ে পাশের রাজ্যে চলে গেল। এখানে এসে দেখেন রাজপুত্রই এখন বিরাট রাজা। তবে কিছুদিন
যেতে না যেতেই রাজপুত্র বুড়ো রাজাকে রাজ্যের বাইরে বনের মাঝে একটা ছোট ঘড়ে একা পাঠিয়ে দিল।
এতটুকো বলেই সেলিম সাহেব কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন, তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। রাফি তার দাদাকে কাঁদতে দেখে তার চোখের পানি মুছে দিতে লাগল। রাফির ছোট হাতের স্পর্শ পেয়ে সেলিম সাহেব তার কান্না থামিয়ে নাতির হাতে চুমু খেতে থাকলেন।
- দাদন, তারপর কি হল?
- তার আর পর নেইরে দাদু ভাই, তার আর পর নেই।
- কেন দাদন? সেই বুড়ো রাজার কি হল?
- সেই বুড়ো রাজা এখন তার মৃত্যুর জন্য দিন গুনছে রে দাদু ভাই।
কথাটা শেষ করতে না করতেই রাফির মা সেলিম সাহেবের বৃদ্ধাশ্রমের ছোট ঘরটায় ঢুকেন। ঢুকেই বলেন,
- “বাবা, আজ আর থাকতে পারব না, আমার আবার কিছু কাজ আছে, তাই রাফিকে নিয়ে এখনই যেতে হবে”
- এত তাড়াতাড়ি বউমা?
- “জ্বী বাবা। রাফি, দাদাকে bye বলে চলে এস।”
রাফি বলে উঠে, “না, আমি যাব না, তুমি না বিকেলে যাও?”
- “না, এখনি যেতে হবে, না হলে তোমার বাবা রাগ করবে”
রাফি নাছোড়বান্দার মত চিৎকার করতে থাকে, এই দেখে রাফির মা রাফির গালে একটা চড় মেরে বসে। সেলিম সাহেবের সহ্য হয় না, তিনি রাফিকে বলেন, “দাদু ভাই, মায়ের কথা শুনতে হয়। আজ চলে যাও, অন্য একদিন এস দাদু ভাই।”
রাফির মা রাফিকে নিয়ে গাড়িতে চড়ে বসেন, রাফি জানালা দিয়ে মুখটা বের করে তার দাদার দিকে তাকিয়ে থাকে। সেলিম সাহেবও নাতিকে যতদূর দেখা যায় তার পিছে পিছে যেতে থাকেন। এক সময় তাদের গাড়িটা দৃষ্টির অগোচরে চলে যায়। সেলিম সাহেব তার চোখ মুছতে মুছতে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে দোয়া করেন, “আল্লাহ, তুমি আমার ছেলে, বউমা আর নাতিকে সবসময় সুখে রেখ আল্লাহ।”
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০১৫ সকাল ১১:৫৯