somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

❑ আনন্দঅশ্রু

২২ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ১১:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বসুন্ধরা সিটিতে ঘুরছিলাম, ভালো একটা শার্ট কিনতে হবে। সাথে ছিল আমার বন্ধু রবি। রবি আমার ছোট বেলার বন্ধু। পড়ালেখা শেষ করে দুজন এক সাথেই একটা কোম্পানীতে ফিন্যান্সে কাজ করছি। সেদিন ছিল শুক্রবার, অর্থাৎ সাপ্তাহিক ছুটির দিন। সুতরাং বাকি ছয়দিন যে যেখানেই থাকিনা কেন, এই দিনটা দুজনে একসাথে কাটাই। আজকেও বেরিয়েছি দুজনে। বিলবোর্ডে দেখেছিলাম রিচম্যান শোরুমে আমার প্রিয় চেকে একটা শার্ট, সেটাই নিতে এসেছি মূলত। শোরুমে একটু ভিড় ছিল, ঠেলেঠুলে পেছন দিকটায় যেয়ে খুঁজছিলাম আকাশি আর কালো চেকের শার্টটা। হঠাৎ করেই চোখ পরলো কমলা সেলোয়ার কামিজের একটি মেয়ের দিকে। পেছন থেকে দেখতে মেয়েটার চুলগুলো কেমন যেন চেনা লাগল, আগে কোথাও দেখেছি মনে হচ্ছে।

মেয়েটি আমার দিকে ঘুরতেই অবাক হয়ে গেলাম। মেয়েটির হাতে আমার পছন্দের সেই শার্ট। আসলে অবাক হওয়ার কারন শার্ট নয়, চুলগুলো আমি ঠিকই চিনেছি। রিন্তি! রিন্তি আর আমি একসাথেই পড়তাম। আমি ছিলাম ভার্সিটির সুপারম্যান আর রিন্তি সাধারন মোটা ফ্রেমের চশমা পরা চুপচাপ একটা মেয়ে। গায়ের বর্ন হলদে সাদা আর ছিপছিপে শরীর। চেহারার মাঝে অন্যরকম একটা মাধুর্য। আমি কোনদিনই ওর কাছে বিশেষ পাত্তা পাইনি। দুইবার প্রপোজ করেছি, দুইবারই ভয়ে কেঁদে দিয়েছে। সে কি কান্ড। বাংলা সিনেমার ভিলেনের সামনেও নায়িকা ইজ্জত ভিক্ষা চেয়ে এতখানি কাঁদে না। নিরিহ এই মেয়েটাকে জ্বালাতন করতেই আমার কেমন যেন ভালো লাগতো।

আমি সবসময় ওর ঠিক পেছনের চেয়ারের ডানপাশে বসতাম। এতে করে ওকে দেখতে আমার ভালোই সুবিধা হতো। মাঝে মাঝে চিরকুটে প্রেম প্রেম মার্কা কথাবার্তা লিখে ওর টেবিলে রাখতাম। এই মেয়ে আমার সব জ্বালাতন চোখবুজে সহ্য করতো বলেই ওকে আমার অনেক বেশী ভালো লাগতো। আমি যখন ওর দিকে রোমান্টিক দৃষ্টিতে তাকাতাম, আর ভুলে যদি ওর চোখ আমার চোখের দিকে পরতো তাহলে বেচারী ভয়ে পাংশু বর্ণ ধারন করতো। আমার সব রোমান্টিকতা বৃথা।

একবার ওর চুলে চুইংগাম লাগিয়ে দিলাম। সেই গাম ছুটাতে যেয়ে সমস্ত চুল জট পাকিয়ে ফেললো। ভাবলাম এবার নির্ঘাত বিচার যাবে আমাদের ক্লাস মনিটর টিচারের কাছে। নাহ, অবলা মেয়েদের আদর্শ এই মেয়েটি সেবারও চুপচাপ কেঁদে গেলো। আরেকদিন আমি পেছনে বসে আছি। ওর পানির বোতল এসে পরলো আমার পায়ের কাছে। ও যখন বোতল তুলতে হাত দিলো, আমি বলে উঠলাম, "থাক সালাম করতে হবে না, আজকাল স্বামীকে কয়জন মেয়েই বা সালাম করে! আমি এমনিতেই তোমার উপরে সন্তুষ্ট আছি।" লজ্জা ভরা চোখে সেদিন ভয় ছিল না। ঠোঁটের কোনে চাপা হাসির ঝিলিক ছিল।

এসব কারনে আমার মনে হতো এই মেয়ে আমাকে ভালোবাসে বলেই চুপচাপ সব সয়ে যায়। কিন্তু প্রপোজ করলেই বিপদ। এমন এক সমস্যা যে এর প্রতিকার চেয়ে বন্ধুদের কাছে সার্কুলার দিলেও সবগুলা হাসাহাসি করবে। বলবে,"মোটা ফ্রেমের চশমা, চশমা খুললে রাতে তোকে চোখে দেখবে তো?" কিন্তু এই সহজ সরল আধাদৃষ্টির মেয়েটিকে যে আমার কত ভালো লাগে সেটা কিভাবে বুঝাবো ওদের?

একদিন ক্লাস থেকে যাওয়ার সময় পেছন থেকে ওর ওড়নাতে চেপে ধরলাম। বেচারী উস্টা খেয়ে বসে পরলো, তারপর ছেঁড়া ওড়না হাতে নিয়ে চুপচাপ হাঁটতে লাগলো। ওর এমন সয়ে যাওয়াটাই এক সময় আমার অপরাধবোধ জাগিয়ে তুলতে শুরু করেছিল। সেদিন এভাবে হতবম্ভের মত ওকে হেঁটে যেতে দেখে নিজের মাঝেই কষ্ট লাগছিলো। আমি ওর পিছু হাটতে লাগলাম। পেছন ফিরে যখন দেখলো আমি ওর পেছন পেছন আসছি ও হাটার গতি বাড়িয়ে দিলো। আমি যত জোড়ে হাটি ও তার দ্বিগুণ জোরে দৌড় দিলো। আশেপাশের মানুষ দেখলাম তাকিয়ে আছে, সবার সন্দেহজনক দৃষ্টি। গনধোলাই থেকে বাঁচতে সেদিনের মত ক্ষান্ত দিলাম।

সেদিন ক্লাস শেষে বৃষ্টিতে একা রাস্তায় দাড়িয়েছিলো ও। আমি মোটসাইকেল ঘুরিয়ে যখন ওর সামনে গেলাম তখন মনে হচ্ছিলো ২ ইঞ্চির মোটা ফ্রেম ভেদ করে ওর চোখ বেরিয়ে আসবে।
- তুমি আমাকে এত ভয় পাও কেন?
আমার প্রশ্নের পরে দেখি এবার চোখ ছলছল করছে। বুঝলাম এই মেয়ের চোখে ঐ মেঘের চেয়ে বেশি জল লোড দেয়া আছে। এমন মেয়ে নিয়ে তো বিশাল বিপদ।
- রিন্তি! একেবারে কাঁদবে না বলছি। এদিকে তাকাও। সাফা বললো তুমি নাকি আমাকে বিড়িখোর গুন্ডা পোলা বলো?
- স্যরি, আমি আর কোনদিন বলবো না।
- বাইকে উঠো।
- না, আমি রিক্সায় যাবো। বাইকে চড়ার অভ্যেস নেই। আমি পরে যাব বাইক থেকে।
এইবার ধমক না দিয়ে পারলাম না। সাদাসিধে বোকা মেয়েদের ধমক দিলে দারুন সুফল পাওয়া যায়। রিন্তি চুপচাপ উঠে বসলো। এবার সুযোগ বুঝে বললাম, "আমাকে ধরে বসো, নইলে সত্যি পরে যাবে কিন্তু।"

গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে রিন্তি পেছন থেকে জড়িয়ে আর শহরের পথ চিরে চলতে থাকা দুজন, অন্যরকম একটা অনুভূতির দিন ছিলো সেদিন। ইচ্ছে হচ্ছিলো এই পথে চলতে থাকি অবিরাম। ওকে চিরদিনের জন্য এভাবে কাছে রাখি। ও শুধু আমার হয়ে থাকুক। কিন্তু সব আশা সবার জন্য নয়। আমার জন্যও হয়ত ছিলো না, কারন আধাঘন্টার মাথায় ওদের বাসার কাছাকাছি চলে এসেছি।
এরপর হঠাৎ করেই ওর ক্লাসে আসা বন্ধ হয়ে গেলো। কেউ ঠিক ভাবে কিছু বলতে পারছিলো না। ওর সবথেকে কাছের বান্ধবী সাফাও আসছে না যে কিছু একটা খবর নেবে।

একসপ্তাহ পরে সাফা ক্লাসে এসে আমাকে খুঁজে বের করলো। আমার হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিলো। বললো রিন্তি নাকি আমাকে দিতে বলেছিলো। খুলে দেখলাম ছোট ছোট অক্ষরে লেখা, "আমিও তোমাকে ভালোবাসি, কিন্তু আমার তোমার সামনে গেলে ভয়ে হাত পা কাঁপে। তাই বলতে পারি না। আমি বাইরে চলে যাচ্ছি। হয়তো আর কোনদিন দেখা হবে না।"

রিন্তির মামা ওকে নিয়ে গিয়েছিলো তার পছন্দ করা ছেলের সাথে বিয়ে দেয়ার জন্য। সাফার কাছে জেনেছিলাম। তারপর কি হয়েছে জানি না, কিন্তু আমার ভেতরে ভেতরে একটা পরিবর্তন এসেছিলো। আমি জ্বালাতন করার মানুষটিকে হারিয়ে একা হয়ে পরি। সব কিছুতে আনন্দ হারিয়ে ফেলি। একসময় "কি জ্বালা দিয়ে গেলা মোরে......" টাইপের গান শোনা শুরু করি। জীবন চলছিলো। প্রতিরাতে রিন্তির কথা মনে পরলেও এখন অনেকটা ভুলে গিয়েছিলাম।

ঠিক এই সময়ে রিন্তি আবার আমার সামনে। তাও আবার আগের থেকে সুন্দর হয়ে গেছে। চোখে সেই মোটা ফ্রেমের চশমা নেই, ল্যাসিক করিয়েছে। গালদুটো ভরে গেছে, ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে। আর আপাত দৃষ্টিতে দেখতে ইন্ডিয়ান নায়িকাদের ছাড়িয়ে গেছে। শুনেছি বিয়ের পরে নাকি মেয়েরা সুন্দর হয় বেশি।
- জনি, তুমি এখানে?
- জ্বি, আপনি রিন্তি না?
- হ্যাঁ আমি রিন্তি, কিন্তু তুমি আমাকে আপনি করে বলছো কেন?
- না মানে দেশে এলে কবে? শার্টটা কি তোমার স্বামীর জন্য নিচ্ছো? ভদ্রলোক কেমন আছেন?
- মানে কি? আমিতো এখনো বিয়ে করিনি। সাফাকে বলেছিলাম তোমাকে এটা বলতে। যেন তুমি আমার জন্য অপেক্ষা না করো। যাইহোক, কোন এক গাধার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু গাধা পেলেও সেই মনের মত গাধাটাকে পাচ্ছিলাম না। তাই এখনো কুমারী আছি। আর তার জন্যে মাঝে মাঝে ছেলেদের পোষাক দেখি। তাকে কল্পনা করি আরকি।
- তুমি আগে থেকে অনেক স্মার্ট হয়ে গেছো।
- আর তুমি সত্যি সত্যি গাধা হয়ে গেছো।


এর পর থেকে রিন্তির সাথে নিয়মিত দেখা হতো। আমি অবাক হয়ে ওকে দেখতাম। আমার অত্যাচারে চুপ করে থাকা মেয়েটি এতটা স্মার্ট হয়ে গেছে! এখন আমার ক্ষেত্রে উল্টোটা হয়েছে। রিন্তির সামনে গেলে আমার কেমন যেন লজ্জা লাগে। কথা বলতে গেলে খেই হারিয়ে ফেলি। কিন্তু রিন্তি ঠিকই সব বুঝে নেয়।
আমার এই লজ্জায় অতিষ্ট হয়ে একদিন রিন্তিই আমাকে প্রোপোজ করে ফেললো। আমার চোখ গড়িয়ে অশ্রু আসছিলো। কিন্তু সেটা সেই পুরনো রিন্তির মতো ভয়ে নয়, আনন্দঅশ্রু। আমি সত্যিই আমার ভালোবাসাকে পেলাম।
রিন্তি আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসতো। সেটা তখন বুঝেছি যখন দেখলাম আমার দেয়া প্রতিটা চিরকুট ও সযত্নে রেখে দিয়েছে।

লেখাঃ Mustafa Anwar (স্বপ্নবাজ শাওন)
লেখকের ফেইসবুক আইডিঃ http://www.facebook.com/nabeel.sjc
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ১১:১০
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৫



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩


বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন

×