মনে কি পড়ে প্রিয়? - (৩)
হলে ফিরে আমি আর রানা কঠিন ঝাড়ি দেই শুভকে - 'তিথী ভার্সিটিতে পড়া একটা মেয়ে। প্রয়োজনের সময় বন্ধুর হাত ধরে সাহায্য নিতে ওর দ্বিধা থাকার কথা, কারন এ ছাড়া অন্য কোন উপায়ও ছিলো না। তুই ব্যাটা আজাইরা লজ্জা কইরা গাধার মত দাড়ায় ছিলি। এই সাহস নিয়া গেছস প্রেম করতে?' । শুভ করুণ চোখ মুখ করে কথা গুলো শোনে। তারপর উল্টোদিকে মুখ করে ঘুমিয়ে পরে।
পরদিন আবার সেই সার্ভে। জায়গাটা ওদের পরিচিত হয়ে গেছে, তাই ওদের গ্রামে নামিয়ে দিয়ে হলে ফিরে আসি আমি। সারাদিন ঘুমিয়ে বিকেল বেলায় আবার যাই ওখানে। আসলে কেমন যেন একা একা লাগছিলো আমার। কেমন আজব একটা শুন্যতা, একটু টেনশনও হচ্ছিলো ওদের জন্য। গিয়ে দেখি ওরা তেমন কিছুই করতে পারেনি, গ্রামের যেদিকটায় ওদের যাবার কথা, সেদিকে দুই গ্রামের লোকদের মধ্যে গন্ডগোল চলছে, পুলিশ দিয়ে ভরে গেছে এলাকা। কি আর করা, সেদিনের মত ফিরে এলাম আমরা। চলে আসার সময় আবারও রাস্তায় আমার পাশে পাশে হাটে তিথী। অস্বস্থি লাগে আমার একটু, কিন্তু কিছু বলিনা, টুকটাক গল্প হয়, আর কথায় কথায় হাসিয়ে দেই ওকে। শুভও আমার আরেক পাশে হাটছিলো, সেও যোগ দেয়ার, মজা করার চেষ্টা করে। বন্ধুদের আড্ডায় শুভ অনেক মজা করে কিন্তু নিজের লিমিট বজায় রেখে সব জায়গায় সে মজা করতে পারেনা, সেটা আবারও প্রমান করে সে।
পরের দিন আবার যাই ওদের সাথে। তিথীকে শুরু থেকেই কেমন যেন ক্লান্ত মনে হয়। জিজ্ঞ্যেস করি - অসুস্থ কি না। তিথী এড়িয়ে যায় আমার প্রশ্নটা, উত্তর দেয়না। আমি আঁচ করতে পারি কি ঘটেছে। হয়তো সম্পা কিছু বলেছে ওকে গতকালকের ব্যাপারে। আমার পাশে এসে পড়ার ব্যাপারটা যেমন আমি খেয়াল করেছি, তেমনি ওরাও নিশ্চই খেয়াল করেছে। কেমন যেন জেদ লাগে, একটা মেয়ের ইচ্ছা অনিচ্ছার মুল্য অন্তত আমার কাছে অনেক বেশী। শুভ ওকে পছন্দ করে বলেই যে ওকেও শুভকেই পছন্দ করতে হবে, এমন কোন কথা নেই। হয়তো সেই কারনেই সে আমার পাশে চলে আসে বারবার। আর আমি নিজেই তো জানি শুভর পক্ষে তিথীকে ছোঁয়া অথবা ধরে রাখা সম্ভব না। শুভর নাগালের অনেক বাইরের মেয়ে তিথী। সবসময় খুব সিম্পল থাকে বলে বোঝা যায় না। কিন্তু আমার ক্ষেত্রেও কি একই ঘটনা না? মৌ'এর স্মৃতি মন থেকে মুছে যায়নি আমার আজও। আমার প্রথম ভালবাসা, আমার মৌ, যে আমার প্রেমিকার চাইতেও বেশী বন্ধু ছিল, আমি তার জায়গায় অন্য কাউকে কি করে বসাই? আমার কলেজের প্রতি ইঞ্চি জায়গাতে মৌএর স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত আমি একটা সেকেন্ড ওকে ভুলে থাকতে পারিনা এখনও।
ওদের কাজ শুরু হয়ে গেলে আমি আম বাগানের বাঁশের টং'এর উপর বসে এসব কথাই ভাবতে থাকি। নিজেকে অপরাধী লাগে, আমি নিজেও কি প্রশ্রয় দিচ্ছিনা তিথীকে? মেয়েটা আমাকে ভালবেসে ফেললে পরে আমি মানা করে দিলে ভীষন কষ্ট পাবে। সেটাও মানতে পারছিনা আমি। কাজেই এখন একমাত্র উপায় - আমার হাওয়া হয়ে যাওয়া। সিদ্ধান্তটা নিয়ে শান্তি শান্তি লাগে। সম্ভাব্য বিব্রতকর একটা পরিস্থিতি এড়াতে এর চাইতে ভাল কোন সমাধান খুঁজে পাইনা আমি। এইসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেছিলাম কখন, নিজেই টের পাইনি। কানের মধ্যে কিসের যেন খোঁচা খেয়ে চমকে উঠে বসি। দেখি ছোট্ট দুটো বাচ্চা আমার পাশে, দুষ্টুমি করে খিলখিল করে হাসছে। মনটা খুব ভাল হয়ে যায়। আমি বাচ্চাদের খুব বেশী পছন্দ করি, কেন যেন ওরাও আমাকে পছন্দ করে অনেক। ওদের সাথে দুস্টুমিতে মেতে উঠি। এক ফাঁকে ব্যাগ থেকে মুড়ি চানাচুর বের করে মাখিয়ে দেই, ওরা খায়, কি যে ভাল লাগে দেখতে। হঠাৎ একটা বাচ্চা দৌড়ে চলে যায় ওদের বাড়ীতে। একটু পরে ফিরে আসে হাতে করে দুটো ছোট পেয়ারা নিয়ে। পেয়ারা গুলো খাওয়ার উপযুক্ত হয়ে ওঠেনি এখনও, কিন্তু এই দেবশিশুদের নিস্পাপ ভালবাসা মাখানো পেয়ারা দুইটা দেখে চোখে পানি চলে আসে আমার। মনে মনে বলি - এটাই তো আমি। সবার ভাল লাগার, ভালোবাসার মত একটা মানুষ। নিজেকে সবার মাঝে বিলিয়ে দিয়েছি আমি, আমার ভালবাসাটাও। আমি কোন ভাবেই আর নিজের সুখের দাবী করতে পারিনা। ভাবতে গিয়ে চমকে উঠি। তাহলে অবচেতনে আমিও কি চাইছি তিথীকে? না হলে নিজের সুখের চিন্তাটা মাথায় এলো কি করে? নাহ, আমাকে উধাও হয়ে যেতেই হবে এখান থেকে।
বিকেলের দিকে ওরা ফিরা আসে। আমার চারপাশে তখন গোটা বিশেক পিচ্চি। সবাই মিলে ক্রিকেট খেলছি। আমাকে দেয়া ফর্ম গুলো পূরন করা হয়নি দেখে সম্পা ক্রিকেটের স্ট্যাম্প তুলে দৌড়ানি দেয় আমাকে তারপর সবাই যোগ দেয় সেই খেলায়, মেয়ে গুলোও। বেশ মজায় কাটে সেই বিকেলটা। তারপর ওদের রিক্সায় তুলে দিয়ে আমি একা ফিরে আসি হলে। ব্যাগ গুছিয়ে রাতের বাসেই কাউকে কিছু না বলে ঢাকা চলে যাই।
ক্রমশ ...
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০০৯ বিকাল ৩:৩৭