মনে কি পড়ে প্রিয়? - (৪)
ঢাকায় পৌছুলাম অনেক রাতে, বাসায় ঢুকেই ঘুম দিলাম। দুপুরের পর আম্মু ডেকে তুললেন। ভাত খেতে দিয়ে জিজ্ঞ্যেস করলেন কি হয়েছে। আমি জানিনা মা কেমন করে যেন টের পেয়ে যান আমার কিছু হলেই। আমি চুপ করে খাচ্ছি, উত্তর দেইনা। কি বলবো মা কে? সারাটা পথ অনেক কিছু ভেবেছি কিন্তু কোন সমাধান পাইনি। এখন আমার হাতে সত্যি কিছু নেই। মা ততক্ষনে বুঝে গেছেন খারাপ কিছু হয়েছে - 'মৌ কেমন আছে রে? আবার ঝগড়া করছিস না কি?'। খেতে খেতে খুব শান্ত ভাবে বললাম - 'ওর বিয়ে হয়ে গেছে গত মাসে'। মা আমার চুপ করে বসে রইলেন কিছুক্ষন। তারপর উঠে এসে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। চিরন্তন মমতার আঁচলে ঢেকে দিলেন তার একমাত্র ছেলেকে।
বিকেলে ছোট বোনটা বাসায় আসে। খুব স্বাভাবিক ব্যাবহার করি সবার সাথে, কিন্তু ওরা বুঝতে পারে ভেতর ভেতর শেষ হয়ে গেছি আমি। সন্ধ্যের পর আমার ঘরে বসে সে জানতে চায় কি ভাবে কি হল। আমি যতটা জানি
বলে গেলাম। শুনে খুবই রেগে গেল সে - 'ওরা কেমন করে পারলো এই কাজ করতে? যেখানে সবাই জানে তোমাদের ব্যাপারটা, আম্মু আব্বু নিজেরা গিয়ে কথা বলেছেন, ওরাও কথা দিয়েছে যে তোমার ফাইনাল ইয়ারের পর তোমাদের বিয়ে হবে, এই অবস্থায় কি করে আমাদের কিছু না জানিয়ে মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে দিলো?'। এই প্রশ্নের উত্তর আমারও জানা ছিলোনা।
ঢাকায় সাতটা দিন কাটিয়ে চলে এলাম রাজশাহীতে। এতদিনে নিশ্চই ওদের প্রেম হয়ে গেছে অথবা হয়নি। কিন্তু আগের মত ঝুলন্ত অবস্থায় নেই নিশ্চই ব্যাপারটা। ভোরবেলা ঘরে ঢুকে শুয়ে আছি, ঘুম আসছেনা। এমন সময় শুভ ঘুম ভেঙ্গে উঠে বসে, তারপর চোখ কচলে বড় বড় চোখ করে দেখে আমাকে, তারপর বলে - "ভাই তুই আসছস। কি যে বাঁচানটা বাঁচাইলি আমারে তুই। তুই কি এখন ঘুমাবি, না ক্যাম্পাস ঘুরে এসে পরে ঘুমাবি?"। আমি রিতিমত হা হয়ে গেলাম, বলে কি এই ছেলে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঘটনা পরিস্কার হয়। আমি চলে যাওয়ার পর সম্পা আর তিথী ব্যাস্ত হয়ে যায় সার্ভে এনালাইসিস নিয়ে। এই সাতদিনে ওদের তেমন কোন কথাই হয়নি। দুদিন পরেই চৌদ্দই ফেব্রুয়ারী, ভালবাসা দিবস। সেদিন সম্পা এমনিতেই আসবে আমাদের এখানে, তার সাথে তিথীকেও দাওয়াত করে খাওয়ানোর প্লান করেছে আমার রুমমেট। কিন্তু ওর ধারনা আমি না বললে তিথী আসবেনা ক্যাম্পাসে। কাজেই আমাকে ফিরে আসতে দেখে বেচারা হাতে স্বর্গ পেয়েছে।
বাইকে বসে শুভকে বলি - 'যদি আমি বললেও তিথী না আসে?' 'আমি জানি তুই বললে সে আসবে। আমি বললে জীবনেও আসবেনা। আমারে তো পছন্দই করেনা, কিন্ত তোরে অনেক পছন্দ করে'। ঘ্যাচ করে ব্রেক করে থামিয়ে দেই বাইক, শুভ সামলে নেয় অনেক কষ্টে। 'এইটা তুই কি বললি?' - জিজ্ঞ্যেস করি। 'দেখ বন্ধু, আমি বুকা কিন্তু পাগল না। আমি কয়েকদিন মিশাই বুঝছি যে আমি যেমন চাই তিথী সেই রকম মেয়ে না। তুই তো জানস আমার কি দরকার। ওই সব প্রেম ভালবাসার তেনা তেনা ডায়লগ আমারে দিয়া হবে না, আমার দরকার একটা মেয়ে মানুষ, যে আমারে সব কিছু দিবে'। ইচ্ছে করে কানের ওপর কষে একটা চড় লাগাই, বলি -'তুই বাইক থিকা নাম, এক্ষুনি'। শুভ আমাকে জড়িয়ে ধরে পেছন থেকে। বাইক ঘুরিয়ে ফেলতে গেলেও বাঁধা দেয় সে। বলে - 'বন্ধু, আমি আর কোনদিন ওর পিছে ঘুরুমনা, খালি ওরে একবার দাওয়াত দিয়া খাওয়ামু, তারপর কমু যে আমার ভুল হইছে, এখন থিকা আমি তুমার ভাই'। ওর কন্ঠে এমন একটা কিছু ছিল যা আমাকে বাধ্য করে ওর কথাগুলো বিশ্বাস করতে, বাইক স্টার্ট করে চলে যাই ক্যাম্পাসে। চারুকলার অসাধারন সুন্দর এলাকাটা পেড়িয়ে রাস্তাটা গিয়ে ওঠে তাপসী রাবেয়া হলের পেছন দিকে। রাস্তা থেকেই দেখা যায় হলের পেছনের দিকের রুমগুলো। শুভ ওখানেই একটা জায়গায় আমাকে বাইক থামাতে বলে, তারপর নেমে গিয়ে দাঁড়াতেই কিছুক্ষন পর একটা জানালা দিয়ে কেউ একজন হাত নেড়ে ইশারা করে, শুভ ফিরে এসে উঠে বসে বাইকে, গেইটের দিকে যেতে বলে আমাকে। কল দেয়ার এই অভিনব পন্থা দেখে মজা লাগে।
আমরা হলের সামনে পৌছানোর একটু পর তিথী আর সম্পা বেড়িয়ে আসে। জানিনা কেন তিথীকে অন্য দিনের চাইতে একটু বেশী সুন্দর লাগে আজকে। সম্পার একগাদা অভাব অভিযোগ আবদার শোনার পর আমি কথা বলার সুযোগ পাই। ওদের দাওয়াতের কথাটা বলে রাজি করাই। এমন সময় শুভ আর সম্পা একটু দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল - তিথী আমাকে জিজ্ঞ্যেস করে 'পালিয়েছিলেন কেন?'। আমি নির্বাক, শুধুই হাসি ওর কথার জবাবে।
চৌদ্দই ফেব্রুয়ারী খুব সকালে উঠে আমি যাই বাজার করতে। রানা আর শুভ ক্যাম্পাসে যাবে ওদের নিয়ে আসতে, তাই আমার সাথে যায়না কেউই। বাজারের টাকার বাইরেও নিজের টাকা দিয়ে কিছু জিনিস কিনি, যা দিয়ে আরও দুটো আইটেম বেশী করা যাবে। ফিরে এসে রান্না করতে দেই বাবুর্চিকে। তারপর রুমে ঢুকে চমকে যাই। চমৎকার করে গোছানো প্রতিটা জিনিস। শুভ যাবার আগে গুছিয়ে গেছে রুম । বিছানায় উঠে শুয়ে পড়ি, ভাল লাগেনা কেন যেন। খুব অস্থির অস্থির লাগে, মন খারাপ হয়ে যায় অকারনেই। শ্রীকান্ত আচার্যর গানের ক্যাসেট চালিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ি। "বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও " গানটা যেন বুকের মধ্যে ঢুকে পরে, গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যাই।
দুপুরের দিকে ঘুম ভেঙ্গে যায়, উঠে গোসলে যাই, পুকুর থেকে গোসল করে এসে বারান্দায় ভেজা কাপড় নেড়ে দিচ্ছি, এমন সময় আমার সামনে এসে দাঁড়ালো গোলাপী একটা পরী। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি ওর দিকে। গোলাপী একটা শাড়ী পড়েছে তিথী, সেজেছে খুব সুন্দর করে। তিথীর কথায় মগ্নতা ভাঙ্গে আমার - 'আপনাকে ঝাড়তে আসছি, দাওয়াত দিয়ে নিয়ে এসে আপনি কোথায় গিয়ে বসে আছেন?'। 'কি দিয়ে ঝাড়বেন?' - নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করি। 'আমার হাতই যথেষ্ঠ' - স্মিত হাসি তিথীর মুখে। মনে মনে ঢোক গিলি দুইবার, মেয়ে বলে কি? দাঁড়াও, তোমারে সাইজ দিতাছি, বলি - 'আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে আজকে'। দুহাতে মুখ ঢেকে ফেলে তিথী। কান পর্যন্ত লাল হয়ে ওঠে ওর। এমন সময় সম্পা পাশের ঘর থেকে ডাকে তিথীকে, তিথী যেন পালিয়ে বাঁচে। আমিও হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকে যাই।
কিছুক্ষন পর খাবার জন্য ডাকতে আসে শুভ, আমি যাইনা। ঘরেই একা একাই খেয়ে নেই। মন থেকে অস্বস্তিটা যায়না, কেমন যেন খুব কষ্ট লাগে, আবার কেমন কেমন লাগে। কি যেন নেই, কোথায় যেন একটা শুন্যতা। উঠে গিয়ে বাইক নিয়ে বেড়িয়ে যাই। বেশী দূর যেতে পারিনা। কি যেন একটা পেছনে টেনে ধরে রাখে আমাকে। মোড়ের চা'র দোকানে বসে চা খাই। চা শেষ করে বাইক স্টার্ট দেই, দেখি ওরা সবাই এসে বসেছে কলেজের পুকুরটার পাশে। অজানা কোন শক্তি আমাকে টেনে নিয়ে যায় ওখানেই। ওদের ঘিরে কয়েকটা চক্কর দেই। সবাই বসতে বলে, কিন্তু বসিনা। আসলে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রন পুরোপুরি হারিয়েছি তখন। হঠাৎ তিথীর পাশে গিয়ে বাইক থামাই। কোন কিছু চিন্তা করার শক্তি ছিলোনা আমার। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলি - 'চলো ঘুরে আসি'। তিথীও যেন এ জন্যই অপেক্ষা করছিলো, কোন কথা না বলে আস্তে করে উঠে বসে আমার বাইকের পেছনে। মুহুর্তে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রন ফিরে পাই, অস্বস্তি ভাবটাও দূর হয়ে যায় ম্যাজিকের মত। তিথী আমার কাঁধের ওপর হাত রাখে। ওকে বলি - 'আমি কিন্তু খুব জোরে ড্রাইভ করি'। তিথী কিছু বলে না, হাসে শুধু, আমার ঘাড়ের ওপর ওর হাতের চাপটা বাড়ে একটু। আমরা প্রায় উড়ে বের হয়ে আসি ক্যাম্পাস থেকে।
আমার বাইকে বসলে স্পীডের কারনে ছেলেরা পর্যন্ত চিৎকার শুরু করে। অবাক হয়ে লক্ষ্য করি তিথী কিছুই বলছেনা, বরং মজা পাচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। প্রথমে উদ্দ্যেশ্যবিহীন ভাবে বেড়িয়ে আসলেও পরে ঠিক করি এয়ারপোর্টের দিকে যাব। তাই ওকে নিয়ে রানওয়ের শেষ প্রান্তে গিয়ে বাইক থামাই। তারপর পেয়ারা বাগান থেকে বেঁছে বেঁছে দুটো পেয়ারা দেই ওর হাতে। এমন সময় আমাদের খুব কাছে দিয়ে দিয়ে প্রচন্ড শব্দ করে টেকঅফ করে একটা বিমান। তিথী অনেক্ষন চেয়ে থাকে বিমানটার দিকে। তারপর ধন্যবাদ দেয় আমাকে, এমন দৃশ্ব সে আগে কখনও দেখেনি। আমরা আবার বাইকে উঠে বসি। ফিরে আসার সময় রাস্তার পাশে এক জায়গায় শুকিয়ে যাওয়া রক্তের কালচে ধারা দেখে তিথী জানতে চায় কি হয়েছে এখানে। ওকে বলি গত রাতের ভয়াবহ বাইক এক্সিডেন্টার কথা, বলি একজন লোক বাইক নিয়ে ট্রাকের সাথে এক্সিডেন্ট করে মারা গেছে কাল রাতে এই জায়গাটায়। তিথীর মুখটা করুণ হয়ে ওঠে কথাটা শুনে। রাজশাহী বাইপাস সড়কের ওপর উঠে পুরোনো অস্বস্থিটা আবার ফিরে আসতে থাকে। বাইকের গতী বাড়িয়ে দেই অনেক, তারপর হঠাৎ করে কমিয়ে দেই আবার। কলেজের যত কাছাকাছি চলে যাচ্ছি, আমার মন খারাপ ভাবটা ততই বাড়ছে। একসময় তিথীকে জিজ্ঞ্যেস করি - 'এখন একটা ট্রাক এসে যদি আমাকে চাপা দিয়ে যায়?'। 'আমি অপেক্ষা করবো আরেকটা ট্রাকের জন্য' - যেন স্বপ্নের ওপার থেকে ভেষে আসে তিথীর কন্ঠ। আমি আলতো করে ছুয়ে দেই আমার কাঁধ ছুয়ে থাকা তিথীর হাতটা। তিথী আরও একটু চেপে আসে আমার দিকে, আমি আমার সমস্ত স্বত্বা দিয়ে অনুভব করি তিথীর অস্থিত্ব।
তারপর? ... ছবিতে দেখুন :#> :#> :#>
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০০৯ দুপুর ১:৫৫