১)
পশ্চিম পাড়ার আকাশ ছেয়ে গেছে কালো ধোয়ায়। দূর থেকে দেখলে মনে হয় আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামবে এখুনি। কিন্তু এ পাড়ার মানুষগুলো সেই কালো ধোয়ার সংকেত বুঝে গেছে বহু আগেই। ঘরবাড়ী ছেড়ে যে যেটুকু সম্বল সাথে নিতে পারছে, নিয়ে পালাচ্ছে। অন্ধ বুড়ী রাবেয়া খাতুন শুধু বসে ছিল তার ভাঙ্গা ঘরের উঠানে। তার পালাবার সামর্থ্য নেই। জমিলা তবুও দৌড়ে যায় তার কাছে।
- নানী, ও নানী, পশ্চিম পাড়ায় মিলিটারি আইছে, সকলে পলাইতাছে, তুমি যাইবা না?
- ক্যাডা? জমিলা? না রে বুবু, আমি কোন দিকে যাইতাম? আমি অন্ধ বুড়ী, আমারে কিছু করতো না, তুই পলা, তাড়াতাড়ি কর।
- নানী গো, অরা জানোয়ার সব, কিচ্ছু মানেনা, তুমি চলো আমার লগে।
- না রে বুবু, আল্লাহ ভরসা, তুই যা, দৌড়া।
চোখ মুছে আগে বাড়ে জমিলা, এখন চিন্তা করারও সময় নেই। মনে মনে দোয়া করে আল্লাহর কাছে, যেন রাবেয়া খাতুনের কিছু না হয়।
ঘণ্টা খানেক দৌড়োবার পর অনেক দূরের একটা গ্রামে ওর গ্রামের অনেকের সাথে দেখা হয় জমিলার। এখান থেকে আর পশ্চিম পাড়ার ধোয়া দেখা যায়না। বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে মায়েরাও আর বেশী দূরে যাবার কথা ভাবতে পারছে না। যে যেখানে পারছে বসে পড়ছে। এই গ্রামের দরিদ্র মানুষগুলোও সাহায্য করছে খুব। যার কাছে যেটুকু খাবার কাছে আছে, তাই নিয়ে সবার কাছে যাচ্ছে, কথা বলছে, কেউ খেতে চাইলে তাকে ভাত, চিড়া মুড়ি খেতে দিচ্ছে। এখন আর কারও নিজস্ব বলে কিছু নেই, বিপদের এই দিনে মানবতা জেগে উঠেছে সবার মনে। এটা যে বাংলাদেশ, আমাদের সবার বাংলাদেশ।
গ্রামের একমাত্র মসজিদটার সামনে পুরুষ মানুষরা বসে আছে। দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে মেয়েরা। ইমাম সাহেব এই গ্রামের মাথা। উনি কথা বলে যাচ্ছেন, সবাই মন দিয়ে শুনছে।
- তোমরা সবাই জানো পশ্চিম পাড়ায় কি হইছে। একটু আগে নবাব আলী আইছে ওইখান থিকা। সব জোয়ান মরদেরে গুলি কইরা মারছে, বৌ ঝি গোরে ধইরা লইয়া গেছে। বাড়িঘর কিচ্ছু রাখে নাই। সব জ্বালাইয়া দিছে। বিকালের দিকে পূর্ব পাড়াতেও না কি ঢুকবো ওরা। আমাগো গেরাম অনেক দূরে, কিন্তু কাইল এক সময় এইখানেও আইতে পারে। কাজেই আমাগো তৈরি থাকতে হইবো। আজকে রাইতে দশ পনেরো জন মরদ গেরাম পাহারা দিবা। আমিও থাকুম সারা রাইত। কিন্তু কথা সেইটা না। এইভাবে মাইর খাইয়া, ধাওয়া খাইয়া গেরাম ছাইড়া, বাড়িঘর ছাইড়া আর কতদূরে যামু আমরা? এইভাবে পইড়া পইড়া আর কত মাইর খামু? শুনছি পূর্ব পাড়ার রহিম শেখ বিরাট লাঠিয়াল। সে আছে না কি আমাগো মধ্যে?
এদিক ওদিক তাকিয়ে উঠে দাঁড়ায় রহিম শেখ। দশাসই শরীর তার,তাগড়া জোয়ান,পেটানো শরীরের প্রতিটা মাংস পেশীতে শক্তির ঝিলিক। হাতে তার প্রিয় লাঠিটা। সবাই চোখ তুলে রহিম শেখকে দেখে।
- রহিম শেখ,সারা জীবন তো লাঠির খেলাই খেললা, এইবার সময় আইছে লাঠির আসল শক্তি দেখানির। পারবা না এই লাঠি দিয়া কয়ডা মিলিটারির মাথা ফাডাইতে? রহিম, গেরামের সাহস আছিলা তুমি। তুমার ডরে গেরামে ডাকাইত পড়তো না। তুমার দলবল কই? খাড়াইতে কও। দেহি কয়জন আছে। আর আমাগো গেরামের জওয়ানেরাও খাড়াও। যতক্ষণ সময় পাওন যায়,রহিমের দলের লগে লাডি চালান শিখো। শুনো মিয়ারা,ঐ যে অসুইক্ক্যা কুত্তাডা আছে না, অরে একটা ঢিল মারো,কুই কুই কইরা উইঠা যাইবো গা,আরেকটা ঢিল মারো,আর কুই কুই করবো না,আরেকটা মারলে তুমারে কামড়াইতে আইবো। একটা অসুইক্ক্যা কুত্তা যদি মাইর সহ্য না করে,আমরা মানুষ হইয়া এই অত্যাচার সহ্য করুম কেন? পুরুষ মানুষ হইয়া পইড়া পইড়া মাইর খামু কেন? তুমাগো রক্তে আগুন নাই? শইলে ত্যাজ নাই? বেজন্মাগুলার সর্বনাশ করার সাহস নাই? যারা আমাগো মা বইনের সর্বনাশ করছে,আমাগো বাড়িঘরে আগুন দিছে, আমাগো ভাইয়েরে গুলি কইরা মারছে,তাগো বিচার ক্যাডা করবো? কও মিয়ারা। তোমার ভাইয়ের খুনিরে কি অন্য কেউ মারবো,না তুমি মারবা? তুমি বাঁইচা থাকতে তুমার ভাইয়ের রক্তের বদলা নিবা না?
জনা বিশেক মানুষ উঠে দাঁড়ায়। রক্তে তাদের খুনের নেশা,চোখে আগুন। এর মাঝে বৃদ্ধ হামিদ আলী কথা বলে ওঠে।
- ইমাম সাব,এরা লাডি লইয়া বন্দুকের গুলি ঠেকাইবো কেমনে? বেঘোরে মরবো তো। খামাখা পুলাডিরে মারতে চাইতাছো কেন? এগো হাতে বন্দুক থাকলে না কথা আছিল।
ইমাম সাহেবের চোখ জ্বলে ওঠে ভাটার মত। এদের মত কিছু লোক সব সময়েই থাকে,যারা প্রতিটা কাজে একটা খারাপ দিক বের করে কাজের উদ্যমটা নষ্ট করে দিতে চায়।
- হামিদ মিয়া,তাইলে আমি কি কইলাম এতক্ষণ? এমন কইরা বইয়া বইয়া মাইর খাইবা? পলাইয়া কত দূর যাইবা? মিলিটারি চতুর্দিকে। একদিকে না একদিকে ধরা খাইবাই। সেই জন্য মরার আগে যদি একটা মিলিটারিও মাইরা যাইতে পারি,সেইটাতেই আমার দেশের দায় শোধ হইবো,আমার ভাইয়ের,মায়ের,বইনের রক্তের ঋণ শোধ হইবো।
বিকেলের আগেই রহিম শেখের দল কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে গ্রামের জোয়ান ছেলেদের লাঠি চালানো শেখানো শুরু করে দেয়। এক খণ্ড বাংলাদেশ তৈরি হয় প্রতিরোধের জন্য।
২)
গভীর রাতে গ্রামের পথে শাল দিয়ে মাথা ঢেকে আসতে দেখা যায় এক যুবককে। গ্রাম পাহারায় থাকা মানুষগুলো দূর থেকে হাঁক ছাড়ে –
- ওই, কে যায়?
- আমি কমল,জমির মাঝির পোলা।
- আরে কমল,ক্যামন আছোস ভাই?
এগিয়ে যায় পরিচিত কেউ একজন। কমল তাদের গ্রামেরই ছেলে। শহরে মাছের ব্যবসা করতো। মাঝখানে মাস খানেক তার কোন খোঁজ খবর ছিল না।
- ভাল আছি,তোমরা কেমন আছো?
- আমরা এখনতরি ভাল আছি রে। তুই আছিলি কই এত দিন?
এদিক ওদিক তাকায় কমল,বুঝতে চেষ্টা করে কি ঘটছে। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে একজন বলে ওঠে
- আমরা গেরাম পাহারা দিতাছি। রহিম শেখের কাছ থিকা লাডি চালান শিখতাছি।
- ক্যাডা? ইনসান ভাই না?
- হ, আমি ইনসান।
- খুব খুশী হইলাম ইনসান ভাই। আমি তো মুক্তি বাহিনীতে যোগ দিছি।
- মুক্তি বাহিনী আবার কি?
সবাই এগিয়ে আসে ওর দিকে। সেখানে দাঁড়িয়ে সংক্ষেপে মুক্তি বাহিনী সম্পর্কে বলে যায় কমল। আশার আলোয় চকচক করে ওঠে সবার চোখ।
- তাইলে ভাই,তুই এখন থিকা আমাগো নেতা। রহিম শেখ কমলের সামনে এসে দাঁড়ায়।
- না রহিম ভাই,আমি বেশীক্ষণ থাকুম না,আইজ রাইতেই ফেরত যামু। আব্বা আম্মা আর জরীরে এক নজর দেখতে আইছিলাম।
-না,তরে আমাগো লগে থাকতে হইবো। তুই আমাগো যুদ্ধ শিখাবি।
- রহিম ভাই,যুদ্ধ কেউ কাউরে শিখায় না। যখন থিকা তুমি মিলিটারিগো মারনের লাইগা লাডি হাতে নিছো,সেই সময় থিকাই তুমি যুদ্ধ শুরু করছো। মানুষের ঘুইড়া দাঁড়ানোটাই যুদ্ধ। তয় আমি তুমাগোরে কিছু বুদ্ধি দিয়া যামু। তুমরা দুই তিনটা দিন গেরামটা সামলাও,এরপর আমরা আইতেছি অস্ত্র নিয়া। শুনছি পশ্চিম পাড়ার স্কুল ঘরে ওরা ক্যাম্প করছে। অইখানে একটা অপারেশন করতে পারলে সবার জন্য অস্ত্র যোগার হইয়া যাইবো।
কমলের কথায় ভরসা পায় সবাই। হটাত গ্রামের দক্ষিণ দিক থেকে শোরগোল শোনা যায়,সবাই দৌড়ে যায় সেখানে। মসজিদ লাগোয়া ছোট্ট ঘরটার সামনে পড়ে আছে ইমাম সাহেবের নিথর দেহ। তার গলায় আমূল বিদ্ধ গরু জবাই করার ছুড়ি। একটু দূরে মুয়াজ্জিন মোস্তাককে ধরে রেখেছে কয়েকজন লোক। মোস্তাক চিৎকার করে বলছে – “পাকিস্তান জিন্দাবাদ, পাকিস্তান জিন্দাবাদ”। রহিম শেখের চোখ অন্ধকারেও জ্বলে ওঠে। তার হাতের লাঠি বেশ কয়েক ঘণ্টার জন্য স্তব্ধ করে দেয় মোস্তাককে। এমন সময় কমল চিৎকার করে বলে – “জয় বাংলা”, তার স্বর ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকে দিকে দিকে।
৩)
এই গ্রামের প্রথম শহীদ ইমাম আবদুল কাদেরকে কবর দেয়া হয়েছে মসজিদের পাশেই। কমল চলে গেছে ভোর হবার আগেই। ওদের শিখিয়ে দিয়ে গেছে কি করে বাঙ্কার খুঁড়ে নিজেদের লুকিয়ে রাখতে হয়। চলছে বাঙ্কার খোঁড়ার প্রস্তুতি। সবার রক্তে আজ আগুনের হলকা বয়ে চলেছে। যে মানুষটা পথ দেখালো,সাহস দিলো,আগুন জ্বালাল,তাকেই নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়েছে এখানে। আস্তিনের ভেতর লুকিয়ে থাকা সাপ ছোবল হেনেছে রাতের আঁধারে। এই সব জানোয়ারদের জন্যই আজ সবার এত দুর্ভোগ,চারিদিকে লাশের গন্ধ,বারুদের ধোঁয়া। এরাই মিলিটারিদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় গ্রামে গ্রামে,তাদের মনোরঞ্জনের জন্য তুলে আনে মেয়েদের,নির্বিচারে হত্যা করে মানুষ। মোস্তাককে বেঁধে রাখা হয়েছে গাছের সাথে। অনেকেই চেয়েছিল তাকে মেরে ফেলতে,কিন্তু গ্রামের মানুষেরা এখনও এতটা নির্মম হতে পারেনি বলে মোস্তাক বেঁচে আছে এখনও।
দুপুরের দিকে পূর্ব পাড়ায় মিলিটারির ধ্বংসলীলার খবর এসে পৌঁছায়। পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়া হয়েছে শূন্য গ্রামটা। আর ওরা এগিয়ে আসতে পারে এদিকেও। গ্রামের উল্টোদিকেও বেশ কিছুটা দূরে আমাকে কালো ধোয়া উঠতে দেখে সবাই বুঝে ফেলে হামলা হয়েছে সেদিকেও। পালাবার পথ আর নেই। এত দ্রুত বাঙ্কার খুঁড়ে শেষ করা যায়নি। তবুও এক দল প্রশিক্ষিত মিলিটারিকে রুখতে চোখে আগুন আর রক্তে দেশপ্রেম নিয়ে অপেক্ষা করছে কয়েকজন মানুষ। কয়েকজন নারী,শিশু ও বৃদ্ধকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে গ্রামের একদম পেছন দিকে। জমিলা এবং আরও অনেক মেয়ে অপেক্ষা করছে গ্রামের কচুরিপানায় ভর্তি পুকুরটার পাশে। বিপদের মুহূর্তে পানিতে নেমে নাক পর্যন্ত ডুবিয়ে মাথায় কচুরিপানা দিয়ে নিজেকে লুকিয়ে ফেলার বুদ্ধিটা জমিলারই বের করা। জীবন বিপন্ন হলে মানুষ অনেক কিছুই করতে পারে।
হাসান বসে আছে কমলদের বাড়ীর পেছনের সুপারি বাগানের ভেতর,তার হাত রাইফেলের বাটে। তাকে ঘিরে আছে গ্রামবাসী আর মুক্তিযোদ্ধারা। সেদিন আর মিলিটারিরা এগিয়ে আসেনি এই গ্রামের দিকে। সন্ধ্যের পর কমল সহ মুক্তিযোদ্ধাদের এই ষোল জনের দলটি এসে পৌঁছেছে গ্রামে। গ্রামের লোকজন মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে নতুন উদ্যমে মেতে উঠেছে। দলের সাথে আছে বেশ কিছু অস্ত্র। এর মধ্যেই শুরু হয়ে গেছে অস্ত্র চালনার শিক্ষা। সময়ের বড্ড অভাব এই বিপদের মুহূর্তে। হাসানের মাথায় একের পর এক যুদ্ধ পরিকল্পনা আর তা বাস্তবায়নের সম্ভাব্য উপায় ঘুরছে। এক সময় মৌনতা ভাঙ্গে সে -
- আজকে রাতেই ওদের ঘাটি আক্রমণ করবো আমরা। ওদের আর এগুতে দেয়া যাবেনা।
কয়েকজন গ্রামবাসী কথা বলে উঠতে গেলে তাদের হাত তুলে থামিয়ে দেয় কমল। সে জানে,মনে মনে প্ল্যান করা শেষ হাসানের। এখন সে শুধু বলে যাবে, ওর কথা মত কাজ করে যেতে হবে বাকিদের।
- পশ্চিম পাড়ার স্কুল ঘরে মিলিটারিরা ক্যাম্প করছে। আমার হিসেব মত জনা পঁচিশেক মিলিটারি আর কিছু রাজাকার আছে সেখানে। আমরা আছি ওদের প্রায় সমান সমান। কাজেই খুব একটা কঠিন হবেনা অপারেশন। দিনের আলো ফোটার সাথে সাথেই ওরা এদিকে চলে আসবে। সেই সুযোগটা ওদের দেয়া যাবে না। আজ রাতেই যা করবার করতে হবে।
মাটিতে ছক কেটে চললো যুদ্ধ পরিকল্পনা। রক্তের নেশায় অন্ধকারেও চকচক করছে অসম সাহসী প্রতিটি মানুষের চোখ। খুব দ্রুতই শেষ হলো পরিকল্পনা। যে যার পরিবারের সাথে কিছুটা সময় কাটাতে চলে গেল গ্রামের লোক গুলো। অপারেশন শেষে কে কে ফিরে আসবে,তা বলার কোন উপায় নেই। তবুও নিজের পরিবার পরিজন,নিজেদের মাটি, নিজের এই দেশটাকে বাঁচাতে আজ সবাই মরনপণ লড়াই করতে প্রস্তুত।
অন্ধকারে শ্বাপদের মত এগিয়ে চলছে এক দল মুক্তিযোদ্ধা। তিনটা আলাদা আলাদা দলে ভাগ হয়ে আক্রমণ করবে ওরা। পরিকল্পনা মত সব এগুলে মিলিটারির ঘাটি ধ্বংস করা তেমন কঠিন কিছু হবে না। কিন্তু যুদ্ধ এমন একটা জিনিস,যেখানে সব কিছু পরিকল্পনা মত হয় না। বার বার প্ল্যান বদলাতে হয়,অবস্থা বুঝে পালটে ফেলতে হয় অবস্থান আর কৌশল।
৪)
- জনাব, আপ লোগোকে লিয়ে লারকী লে আয়া,দেখ লিজিয়ে।
পান খাওয়া কালো কালো দাঁত কেলিয়ে হাসি দিলো রাজাকারটা। ওর পেছনে আরও কয়েকজন,কয়েকটা মেয়েকে শক্ত করে ধরে রেখেছে ওরা। মেয়েগুলো কাঁদছে আকুল হয়ে। ওদের এই কান্নায় ক্যাপ্টেন ইরফানের মন গলে না। লোলুপ দৃষ্টিতে মেয়েগুলোকে দেখতে লাগলো সে। কমান্ডিং অফিসার হিসেবে বেছে নেবার প্রথম সুযোগটা সেই পায়। তের চোদ্দ বছরের একটা মেয়ের দিকে এগিয়ে গেল সে। মেয়েটা ভয়ে জমে গেছে যেন,ভয়ার্ত অপলক চোখে তাকিয়ে আছে ইরফানের দিকে। ওদের ঘিরে রেখেছে মিলিটারির দলটা,অশ্লীল হাসি আর রসিকতা করছে। ইরফান এগিয়ে গিয়ে হাতের উলটো পিঠ দিয়ে মেয়েটার গাল স্পর্শ করে। সেই হাত নেমে যায় নীচে,মেয়েটা ছাড়া পাবার জন্য, পালিয়ে যাবার জন্য ছটফট করছে। মিলিটারিরা চরম মজা পাচ্ছে দেখে। ক্যাম্প পাহারায় থাকা রাজাকার গুলোও ওদিকে ঘুরে মজা দেখছে।
হাসানের রাইফেলের প্রথম গুলিটা এসে লাগে দাঁত কেলিয়ে থাকা রাজাকারটার গলায়,গলা চীরে বেড়িয়ে যায় তপ্ত বুলেট। রক্ত ছিটকে পড়ে ইরফানের মুখে। মিলিটারিরা মুক্তি মুক্তি বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাটিতে। রাজাকারগুলো কলে পড়া ইঁদুরের মত ছুটোছুটি করতে থাকে। শুরু হয় গুলির নিশানা লক্ষ্য করে পালটা গুলি বর্ষণ। মেয়ে গুলোও ছুটে পালায় দিক্বিদিক জ্ঞ্যান শূন্য হয়ে।
ক্যাম্পের পেছন দিকে খুব কাছেই এমবুশ করে ছিল কমলের নিয়ন্ত্রণে থাকা দলটি। কয়েকজন মিলিটারিকে ক্রল করে এদিকে এগিয়ে আসা দেখে ওরা বুঝে যায় এখানেই কোথাও আছে ওদের রেডিও ট্রান্সমিটার। ক্যাম্পের পরিস্থিতি এখনই জানিয়ে দেবে হেড কোয়াটারে আর সাহায্য চাইবে। মুক্তিযোদ্ধাদের নির্ভুল নিশানা একে একে মাটিতে শুইয়ে দেয় ওদের সব ক’টাকে।
চারিদিক থেকে অতর্কিত আক্রমণে দিশেহারা হয়ে রাজাকারের দল পালিয়ে যায় নদীর দিকে। সেখানে তৈরি হয়েই ছিল রহিম শেখের দলবল। আস্তিনের ভেতরকার সাপগুলোকে লাঠির আঘাতে মাটিতে শুইয়ে দিতে ওদের বেশী সময় লাগে না।
হাসানের লক্ষ্য ছিল অস্ত্রাগারটার দিকে। প্রচণ্ড লড়াই বেধে যায় সেদিকটাতে। মিলিটারিদের দামী সব অস্ত্র ও ট্রেনিং থাকতে পারে,কিন্তু সাহস আর মনোবলের দিক দিয়ে ওরা অনেক নিচু শ্রেণীর। আট দশজন খান সেনা লুটিয়ে পড়তেই ওরা পালানোর পথ খোঁজে।
ক্যাপ্টেন ইরফান বা হাতে গুলি খেয়েও কোন এক ফাঁকে পালাতে গিয়ে পড়ে যায় ভীত সন্ত্রস্ত মেয়েগুলোর সামনে। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। মেয়েগুলো এলোপাথাড়ি পেটাতে থাকে ইরফানকে। আজ সবার রক্তে স্বাধীনতার আগুন।
ঘণ্টা দুই যুদ্ধের পর ক্যাম্প থেকে আর গুলির শব্দ শোনা যায় না। অসম সাহসী মুক্তিযোদ্ধারা দখল করে নেয় মিলিটারিদের ক্যাম্প। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার আত্মদান আর কয়েকজন আহতের রক্তে অর্জিত হয় বিজয়। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে নিজ গ্রামে ফিরে আসে পূর্ব পাড়ার মানুষগুলো। পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া ভিটে মাটিতে বসে থাকে বিজয়ের আনন্দে উজ্জ্বল মানুষগুলো।
মুক্তিযোদ্ধার দলটি হাসানের নেতৃত্বে নতুন পরিকল্পনায় নামে। মিলিটারিদের বড় একটি দল হামলা চালাতে পারে এদিকে। ওদের রুখতে হবে যে। স্বাধীন করতে হবে বাংলার প্রতি ইঞ্চি মাটি। বদলা নিতে হবে স্বজন হারানোর। আকাশে বাতাসে এখন স্বাধীনতার সুবাস।
-------------------( সমাপ্ত )-------------------
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই আগস্ট, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:৫৬