সুলক্ষনা
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
(অ)
সমস্যাটা কি?
মেয়েটার চোখ দুটো বেশ সুন্দর, নাকটাও বোঁচা না, ঠোঁটের লিপস্টিকটাও মানিয়ে গেছে, শুধু লিপ লাইনারে আঁকা ঠোঁটের রেখাটা বেমানান লাগছে, লম্বা চুলগুলো নাটোরের বনলতা সেনের কথা মনে করিয়ে দেবার মত না হলেও স্ট্রেট আর সুন্দর। আহামরি টাইপ সুন্দরী না হলেও বেশ ভালই দেখতে মেয়েটা। আমিও কি চন্দন দ্বীপের রাজপুত্র, যে আমার জন্য কোন রাজকন্যেকেই ধরে আনতে হবে? আমার বিয়ে তো এমন একটা মেয়ের সাথেই হওয়া উচিৎ। অথচ আমি মেয়েটাকে ঠিক পছন্দ করতে পারছি না।
একজন ভাল ফটোগ্রাফার হিসেবে আমার চোখে সৌন্দর্য জিনিসটা একটু অন্য ভাবে ধরা দেয়। কৃত্তিমতার মাঝ থেকে ন্যাচারাল সৌন্দর্যটা আমি খালি চোখেই আলাদা করে দেখতে পারি। ক্যামেরা, আমার তৃতীয় নয়নের ফ্রেমে তাই ধরা পরে বিন্দুর মাঝে সিন্ধু। সেই আমাকে আজ পরিচিত রেস্টুরেন্টে একটা অপরিচিত মেয়ের সামনে বসিয়ে দেয়া হয়েছে, যাতে আমি ওকে পছন্দ করতে পারি এবং বিয়েটা সেরে ফেলতে পারি। অবশ্য শুধু আমার কথা ভাবছি কেন? ওরও তো পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার আছে। আমাকেও তো ওর পছন্দ হতে হবে। কিন্তু কেন যেন মেয়েটাকে আমি পছন্দ করতে পারছি না। নিজেকে কোন এক আজব কারণে কিছুটা অপরাধী মনে হচ্ছে।
- "আমাদের বোধ হয় কিছু কথা বলা দরকার।" নিরবতা ভাঙ্গলো দিয়া এবং হেসে ফেললো। ওর হাসিটাও সুন্দর, কথা বলার ভঙ্গিটাও। তবুও কোথায় যেন, কেমন যেন একটা অপুর্ণতা রয়ে গেছে। আমি কি আরও সুন্দর কাউকে মনে মনে এক্সপেক্ট করেছিলাম? বুঝতে পারছিনা কিছু। কিন্তু এমন সময় চুপ করে থাকাটাও নিতান্তই অভদ্রতা। কফির কাপ শেষ হয়ে এসেছে, অথচ আমরা সামনা সামনি বসে আছি মূর্তির মত।
“আপনার কথা বলুন, কোথায় পড়েন, কি পড়েন, কেমন যাচ্ছে দিনকাল, আমি শ্রোতা হিসেবে বেশ ভাল, সবাই বলে” – শান্ত গলায় মুখে হাসি টেনে পরিবেশটা হালকা করতে চেষ্টা করি। মুখচোরা টাইপের বলে আমার যথেস্ট দুর্নাম আছে বন্ধু মহলে, অপরদিকে কথা কম বলা অভ্যাসটা আমাকে একজন ভাল শ্রোতার উপাধীটা এনে দিয়েছে। কিন্তু জীবনের এই বিশেষ মুহুর্তে এসে চুপ করে বসে থাকাটা নিতান্তই অশোভন।
"আমার কথা আর কি? এই তো, খুব সাধারন একটা মেয়ে আমি, এভারেজ টাইপের স্টুডেন্ট, কোন কোন সাবজেক্ট পাশ করতে রিতিমত যুদ্ধ করতে হয়, বানিয়ে লেখা যায় যে সব সাবজেক্টে, ওতে আমি মোটামুটি ওস্তাদ। অজানা বা সামান্য জানা কোন কিছু এমন করে লিখতে পারি, টিচার কনফিউজড হয়ে যায় পড়ে।" হাসতে হাসতে বলে চলে দিয়া। "বাসায় দুটি ভাই আর মা, বাবা চলে গেছেন বছর খানেক আগে। যতদিন বাবা ছিলেন, আগলে রাখতেন আমাকে। এখন আমি ভাইদের গলগ্রহ, আমাকে তাড়িয়ে দিতে পারলেই হাপ ছেড়ে বাঁচে ওরা। সে কারণেই আপনার সাথে এখানে বসিয়ে দেয়া হয়েছে আমাকে।"
মেয়েটার হাসির শব্দ শুনতে ভাল লাগছে। মানুষ সম্পর্কে আমি যতটা জানি, তা থেকে বলে দেয়া যায়, এই মেয়েটা বেশ চালাক চতুর। ছোট থেকে নিজেকে সামলাতে শিখে নিয়েছে, বৈরী পরিবেশের নিজেকে মানিয়ে নিতে শিখেছে, যা এখনকার অনেক মেয়ের মাঝের মাঝেই অনুপস্থিত। এক কথায়, এই মেয়ে মোটেও লুতুপুতু টাইপের মেয়ে না।
(আ)
প্রায় হা করে মুভি গিলছিলাম, কঠিন অবস্থা, নায়িকাকে আটকে রেখেছে একটা কাঁচের ঘরে। ঘরটা পানিতে ভরে যাচ্ছে, নায়িকার গলা পর্যন্ত পানি পানি উঠে আসছে, এদিকে নায়কের হাত বাঁধা হ্যান্ডকাফে। এমন সময় মা এসে ঢুকলেন ঘরে। "ওদেরকে তো কিছুই বলা হলো না, তুই ঠিক করলি কিছু? এই দিয়া মেয়েটাকে ভাল লেগেছে তোর, বিয়ে করবি?" জটিল এই প্রশ্নটা এমন সময়েই মায়ের মাথায় এলো? আমি এখন ডুবে আছি মুভির মাঝে, চিন্তা করার সময় কই? এক মুহুর্ত চিন্তা করে বললাম - "না মা, পছন্দ হলে তো বলেই দিতাম। কিছু বলিনি মানেই তো পছন্দ হয়নি"। মা মনে হয় কিছুটা আহত হলেন। আমার ঠিক উলটো দিকে চেয়ার টেনে বসলেন। বুঝে গেলাম, মুভি দেখা মাথায় উঠবে আমার। এবার মা লেকচার দেবেন।
"মেয়েটার বাবা নেই। ভালই তো দেখতে মেয়েটা। কথাবার্তাও ভাল। তোর পছন্দ হলো না কেন? এই নিয়ে তিন চারটা মেয়েকে মানা করে দিলি তুই। তোর কি কোন পছন্দ আছে? কত মেয়ে দেখলি, একটাও তোর ভাল লাগেনি? কি ধরনের মেয়ে চাস তুই? আমরা আর মেয়ে দেখতে পারবো না, এবার তোর পছন্দের মেয়ে তুই নিজেই খুঁজে নিবি"। আসলে এই বিষয়ে মা'র সাথে কথা বলা হয়নি আমার। ফ্যামিলির বড় ছেলে হিসেবে এমন কাউকে পাইনি যাকে আমার পছন্দ অপছন্দের বিষয়গুলো মন খুলে বলতে পারি। মা যখন আজ প্রসঙ্গটা তুললেন, আজকেই বলে ফেলা যায়। লেকচারের জবাবে লেকচার দিতে তৈরী হলাম।
"মা, আমি একটা খুব সাধারন, সংসারী টাইপ মেয়ে চাই। তোমার সাথে সারাদিন কাজকর্ম করবে, তোমার মত করে আগলে রাখবে ঘরের সব কিছু। সোনামুখী সুঁইটা থেকে শুরু করে ইলেক্ট্রিসিটি বিল - সব থাকবে তার নখের ডগায়। তুমি যা বলবে, তাই মেনে নেবে, প্রশ্ন করবেনা, অনুযোগ করবে না কিছু নিয়ে। আমাকে আমার মত থাকতে দেবে। চেহারা হবে এভারেজ, বেশী সুন্দরী মেয়েরা নাক উঁচু স্বভাবের হয়। বড়লোক ফ্যামিলির মেয়েরা ডমিনেটিং হয়। বেশী এক্টিভ মেয়েরা ঘর সামলাতে পারে না। গরীব ঘরের মেয়েদের চাহিদা বেশী থাকে। বেশী ফর্সা মেয়েরা নিজেদের রাজকন্যা আর বাকি সবাইকে তার প্রজা ভাবে। বেশী ভাল ছাত্রীরা ক্যারিয়ার সচেতন হয়, সংসারী হয় না। বেশী চালাক মেয়েরা সংসারে প্যাঁচ লাগায়। আমি চাই এমন একটা মেয়ে, যে হবে তোমার প্রতিবিম্ব, তোমার মত করে ঘর বাহির, সংসার সন্তান আগলে রাখবে। নিয়ন্ত্রন নেবে সব কিছুর, কিন্তু সেটা জোর করে নয়, বরং যোগ্যতায়।" - নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিনা আমি। কি সুন্দর গুছিয়ে নিজের চাওয়া গুলো মা'কে বলে দিলাম। আমার মনে যে এই সব কথা ছিল, আমি নিজেই জানতাম না। অথচ আজ এই সময়ে সব কথা বেড়িয়ে এলো।
মা কিছুক্ষন চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন - "দেখ বাবা, আসলে সময় পাল্টেছে। আমাদের সময় আমরা ছোট বেলা থেকেই এভাবে মানুষ হয়েছি, সংসারের বাইরে কিছু চিন্তা করতাম না। ক্লাস নাইন টেনে পরার সময়েও পুতুল বিয়ে দিতাম। চিন্তা ভাবনা সংসার কেন্দ্রীক ছিল। এখনকার মেয়ের তো এমন না। ওদের জীবনটা অনেক পালটে গেছে। ওরা এখন এত সংসারী টাইপ হয় না। আমাকে দেখ, আমি ঘর সামলাতে জানি। কিন্তু বাইরের অনেক কিছুই জানি না। জানতেও চাইনি কখনও। এখন তুই এমন সংসারী মেয়ে, আর তোর মনের মত মেয়ে পাবি না। সবার মাঝে সব গুণ থাকে না। আর বিয়ের পর একটা ভাল মেয়ে এমনিতেই সংসারী হয়ে ওঠে। সময় সবাইকে পালটে দেয়। ভাল ফ্যামিলির ভাল একটা মেয়ে নিয়ে আসি, দেখবি তোর ইচ্ছে গুলো পূরণ হয়ে যাবে।"
(ই)
দিয়ার সাথে আবার দেখা হবে ভাবিনি। কিন্তু এবারের পরিবেশ আলাদা। আমি বসে ছিলাম অফিসে। এক গাদা ফাইলপত্র সামনে। হালিম ভাই, মানে আমার বস এক সপ্তাহের ছুটিতে গেছেন। তার সব কাজ আমার করে দিতে হচ্ছে। হিমসিম খাচ্ছি সামলাতে গিয়ে। এমন সময় রিসেপশন থেকে ফোন করে বললো কে একজন দেখা করতে চায়, আসতে বললাম। রুমে এসে ঢুকলো দিয়া। ওকে দেখে বেশ হকচকিয়ে গেছি ভেতর ভেতর। লজ্জাও পাচ্ছি। মেয়েটাকে মানা করে দিয়েছিলাম দুদিন আগেই। দিয়াও অপ্রস্তুত, কিন্তু সামলে নিয়েছে।
- "কেমন আছেন? আমি আসলে হালিম ভাইয়ের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। ওরা বললো হালিম ভাই ছুটিতে, তাই আপনার সাথে কথা বলতে বললো"
- "হ্যাঁ, হালিম ভাই সপ্তাহ খানেক ঢাকার বাইরে। বসুন না। চা দিতে বলছি" - সপ্রতিভ হবার চেষ্টা করি। ফোন তুলি দু'কাপ চা দিতে বলতে।
- "আমার জন্য লেবু চা বলেন প্লিজ। আমি দুধ চা খাই না সব সময়। বাইরে যা গরম, লেবু চা খেতে ইচ্ছে করছে"
ডোমিনেটিং টাইপের মেয়ে। সাধারনত কেউ এই সময় বলবে - না, চা লাগবে না। আর এই মেয়ে কি না ফ্রি চা টাও নিজের পছন্দ মত খেতে চায়। ভালই করেছি মানা করে দিয়ে। বিয়ের পর তো এই মেয়ে হাড় জ্বালিয়ে খাবে। এটা দাও, ওটা লাগবে, এটা এভাবে কর, ওটা করো না - জীবন শেষ। বিব্রত ভাবটা কেটে যেতে থাকে। দু কাপ লেবু চায়ের অর্ডার দেই।
- তারপর, কেমন চলছে দিন কাল?
- "এই তো। চলে যাচ্ছে। আমি আসলে এসেছিলাম বাবার ইনসুরেন্সের টাকাটা তুলতে। এক বছর তো হয়ে গেল। এখনও পাইনি টাকাটা। গত মাসে হালিম ভাই বলেছিলেন এই মাসে হয়ে যাবে। তাই খবর নিতে আসা।" - হলুদ একটা খাম বাড়িয়ে দেয় দিয়া আমার দিকে।
- আচ্ছা। দেখছি আমি।
জয়নাল আবেদিন সাহেবের ফাইলটা খুঁজে বের করি। সিম্পল লাইফ ইন্সুরেন্স। দ্রুতই হয়ে যাবার কথা। কিন্তু কেন হয়নি সেটাও বুঝতে পারছি। নীচের লেভেল থেকে ফাইল আসতে ঠেলা ধাক্কা দিতে হয়। আমাদের কাছে এলে আর সময় লাগে না বেশী। দিয়া মনে হয় সেই ধাক্কাটা দিতে পারেনি। এই দেশে টাকা খরচ না করে কে কবে টাকা পেয়েছে? এই অনিয়মটাই এখন নিয়মে পরিনত হয়ে গেছে। দিয়াকে পরের সপ্তাহে খবর নিতে বলে দেই। চলে যায় সে হাসি হাসি মুখ নিয়ে। এর পর জামাল সাহেবকে ডেকে ফাইলটা ধরিয়ে দেই। ব্যাজার মুখে মাথা চুলকে ফাইলটা হাতে নেন উনি। বেশ কয়েক হাজার টাকা হাতের ফাঁক গলে ফসকে গেল দেখে ইতস্তত করেন। ইচ্ছে হয় অনেক্ষণ ধরে বেশ কিছু লেকচার ঝেড়ে দেই। সৎ ভাবে কাজ করবার উপদেশ বা আদেশ দেবার মত যথেষ্ট কারণ আছে। কিন্তু আমি জানি এই অসাধু লোকগুলোর পেছনে বিরাট লম্বা চেইন আছে। ঘুসের টাকাটা সে একলা খাবে না, ভাগ দিয়েই খাবে। একটা বিষবৃক্ষের চাড়া উপড়ে ফেলা যত সহজ, একটা মহিরুহের মূলোৎপাটন ততটাই কঠিন। আমার বস্ হালিম ভাইকে রিপোর্ট করা যায়, হয়তো হালিম ভাই নিজেও এই টাকার ভাগ পান। বেশী কিছু বলতে গেলে হয়তো এই জবটাই চলে যাবে আমার। একটা করাপ্ট সিস্টেমের কোন একটা পার্টস কাজ না করলে সেই পার্টসটা বদলে ফেলা হয়, গোটা সিস্টেমটা না। কিছুই করার নেই আসলে।
(ঈ)
মাস খানেক চলে গেছে এর মাঝে। মা কেন যেন আর কোন নতুন মেয়ের ছবি এনে আমার টেবিলে রেখে যায়নি। মনে হয় আমার পছন্দ মত সুলক্ষনা মেয়ে খুঁজে পাননি এখনও। সেদিন ছিল ছুটির দিন, বসে বসে গান শুনছিলাম, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে যেতে ইচ্ছে করছিল না। মা'কে ডেকে চা দিতে বলবো, এমন সময় মা নিজেই চা হাতে ঢুকলেন। বললেন - "তোর গেস্ট এসেছে, শার্টটা পড়ে দেখা করে যা"। অবাক হলাম, বললাম - কে? মা একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে চলে গেলেন, কিছু না বলেই। বেশ অনেক্ষন থেকে মা যেন ড্রয়িংরুমে কার সাথে কথা বলছিলেন, দেখিনি আমি। কিন্তু সেটা যে আমার গেস্ট, এমন কোন আলামত পাইনি। বেশ ধাঁধায় পড়লাম। কে হতে পারে? আর মা এমন রহস্যময় হাসিই বা কেন দিলেন?
শার্টটা সবে মাত্র পড়া হয়েছে, মা আর দিয়া এসে ঢুকলো ঘরে। আমার মা'র আক্কেল বুদ্ধি হলো না কোনদিন। ব্যাচেলার ছেলের ঘরে একটা অচেনা মেয়েকে নিয়ে এভাবে চলে আসে কেউ? আর আমি অন্তত দিয়াকে এক্সপেক্ট করিনি এখন। বিব্রতকর অবস্থা। মা এদিকে মিটিমিটি হাসছেন। জিজ্ঞেস করলাম
- "আরে দিয়া যে, কেমন আছেন? আপনার বাবার টাকাটা পেয়েছেন?"
- "সে জন্যই আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে আসা" - সপ্রতিভ উত্তর দিয়ার
- "বাহ ... ভাল তো" - বিব্রত হাসি দেই আমি
আমাদের রুমে রেখে মা চলে গেলেন এমন সময় "তোমরা কথা বলো, আমি দেখি দরজায় কে"। কলিংবেলের কোন শব্দ পাইনি আমি, বুঝলাম মা কি চাচ্ছেন।
- "আপনার ঘরটা তো বেশ সুন্দর। ব্যাচেলার ছেলের ঘর এত গোছানো, ভাবাই যায় না"- দিয়ার হাসিটা আসলেও সুন্দর
- "আমার আর ক্রেডিট কোথায়, মা সারা দিন ঘর গুছান, ময়লা করলে এখনও পিঠের উপর দু' ঘা বসিয়ে দেন সময় অসময়ে" - হেসে ফেলি আমিও।
- "হু, বুঝতে পারছি, মা'কা বাচ্চা আপনি"
খোঁচাটা হজম করে হাসলাম। হাড় জ্বালানি মেয়ে একটা, বোঝাই যাচ্ছে।
- "পরে আর সমস্যা হয়নি তো টাকাটা পেতে?" প্রসঙ্গ পাল্টাই আমি
- "নাহ, আপনি বলে দেবার পর দ্রুতই হয়ে গেল কাজটা। থ্যাঙ্কস। আপনাকে ধন্যবাদ দিতে অফিসেই যেতাম, কিন্তু কে আবার কি ভেবে বসে, তাই বাসায় চলে এলাম। আপনি আবার কিছু মনে করেন নি তো?"
- "আরে না, ভালই করেছেন। বসে বসে বোর হচ্ছিলাম আমিও। আপনার কাজটা হয়ে গেছে শুনে ভাল লাগছে।"
- "চা নিন, ঠাণ্ডা করে ফেলছেন তো চা টা"
চায়ে চুমুক দিয়ে বুঝলাম এটা মা'র হাতের চা না। দিয়া বানিয়েছে? ভালই হয়েছে তো।
- "চায়ে চিনি ঠিক আছে? মা দিয়েছেন চিনি। এত চিনি খান কেন আপনি?"
- "আপনি বানিয়েছেন চা? ভালই তো লাগছে।"
- "থ্যাঙ্কস, আমি এই একটা কাজই ভাল পারি, চা বানাতে আর খেতে" মেয়েটার হাসি রোগ আছে মনে হয়, সারাক্ষন হাসছে।
- "আমার মা যেন কেমন। মেহমানকে দিয়ে চা বানিয়ে নিলেন"
- "আরে না, আমি নিজেই জোর করে বানিয়েছি। আন্টি কিছুই বলেন নি। আসলে একটা অপরাধ বোধ কাজ করছিল।"
- "কি ধরনের?" অবাক হই আমি, অপরাধ বোধ কিসের?
- "আপনার সাথে প্রথম দিন কথা হবার কয়েকদিন পর আন্টি গিয়েছিলেন আমাদের বাসায়। হয়তো আমাকে আপনার পছন্দ হয়েছিল, সেই কথাটা বলতে। কিন্তু আমি বাসায় মানা করে দিয়েছিলাম। আন্টি মন খারাপ করে চলে এসেছিলেন সেদিন। ভেবেছিলাম দেখা হবে না আপনার সাথে আর। কিন্তু কেমন করে যেন দেখা হয়ে গেল।"
অবাক হবার পালা আমার। একটা মেয়ের কাছে রিজেক্ট হয়ে গেলাম আমি, ছেলে হিসেবে ইগোতে লাগলো একটু। মা কিন্তু কিছুই বলেনি আমাকে।
- "আমিও না করেই দিয়েছিলাম, মা মনে হয় সেটাই বলতে গিয়েছিলেন।"
- "তাই! বাঁচালেন আমাকে।"
- "হু, আমিও বাঁচলাম মনে হয়। আরষ্ট হয়ে ছিলাম আমি সেদিন অফিসে এই কারণেই"
- "আমরা বিয়ে করার জন্য কেউ কাউকে পছন্দ করিনি আসলে। আমার মনের মত না আপনি। আপনার মনেও যে ছবিটা আছে, সেটা আমার সাথে মেলে না। ভালই হলো।"
- "আমার চাই একটা সংসারী টাইপ মেয়ে, অনেক লক্ষ্ণী টাইপ" - হাসতে থাকি আমি
- "আমি মোটেই সংসারী টাইপ না, লক্ষ্ণী টাইপ তো না'ই। অথচ, ভেতর ভেতর বড্ড বেশী রোমান্টিক আমি। আমিও ভেবেছি এমন একটা ছেলে আমার বব হবে, যে আমার সব টমবয় টাইপ কাজ কারবার হাসি মুখে মেনে নেবে, আমার পেছন পেছন ঘুরবে সব সময়। আপনি মোটেই সেরকম কেউ না। আপনার ইগো অনেক বেশী, চুপচাপ থাকেন, কথা কম বলেন। এই যেমন এখন, আমি যদি আপনাকে বলি, বাইরে চমৎকার মেঘ করেছে, চলেন বারান্দায় গিয়ে বসি, আপনি মোটেও যাবেন না। কখনই বলবেন না - দিয়া, একটা গান করো তো, তোমার গান শুনতে ইচ্ছে করছে। বরং বলবেন - নাহ, ঠাণ্ডা লেগে যাবে। জানালাটা বন্ধ করে দাও। তোমার ঠাণ্ডার ধাত বেশী, গলায় মাফলার পড়ে বসে থাকো।" হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে দিয়া।
(উ)
অফিস শেষে বসুন্ধরার সেই কফি শপে বসে আছি। দিয়ার আসার কথা আধ ঘন্টা আগে। এখন আসছে না। ওকে কেন ডেকেছি জানিনা। তবুও ইচ্ছে করছিল ওর সাথে কথা বলতে।
- "স্যরি স্যরি, দেরী করে ফেললাম, আপনি বোধ হয় রেগে গেছেন, আপনার অনেকক্ষন সময় লস করলাম।" - সামনের চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল দিয়া
- "নাহ, ঠিক আছে। অফিস করে এসেছি তো, বিশ্রাম হচ্ছিল আমার"
- "আমি আসলেই কি আপনার বিশ্রাম হারাম হয়ে যায়?" কাঁচ ভাঙ্গা সেই হাসি।
- "কি যে বলেন। কেন যেন ক'দিন থেকে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল আপনার সাথে। শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললাম। আপনিও আসতে চাইলেন অপছন্দের এই ছেলেটার সাথে কথা বলতে"
- "বাপ রে, এতই হার্ট হয়েছে আপনার ইগো? একটা মেয়ে পছন্দ করেনি বলে ছেলে হিসেবে মেনে নিতেই পারছে না?"
- "জানিনা, হয়তো তাই। আবার নাও হতে পারে।"
- "এরকম কনফিউজড মানুষ আমার পছন্দ নয়। আপনিও তো আমাকে পছন্দ করেননি। আন্টির কাছে শুনেছি আপনার পছন্দের কথা। সেগুলোর কোনটাই আমার সাথে যায় না। আর আপনার এই সব সময়ের সিরিয়াসনেসটাও আমার ভাল লাগেনি। কাজেই কাটাকাটি। এতে আহত হবার মত কিছুই নেই।"
- "স্কুল কলেজে আপনি মেয়েদের লিডার ছিলেন, না?" হাসতে হাসতে বলি আমি
- "লিডার না, বলেন বস্ ছিলাম"
- "হুম ... বুঝতে পারছি। আপনার বরের কপালে দুঃখ আছে"
- "আপনি বেঁচে গেছেন" বলেই আবার হাসলো দিয়া।
মানুষের জীবনে কিছু কিছু মুহুর্ত আসে, যখন প্রকৃতি মানুষের উপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। আমার বোধ হয় এমন একটা অবস্থা চলছে। আমি বসে বসে দিয়ার হাসি দেখছি আর ভাবছি, এই হাসি সারা জীবন ধরে দেখলেও আমি কখনই ক্লান্ত হবো না।
- "আচ্ছা, অনেক কথা হলো, আমি উঠি এখন? আমার বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে, বৃষ্টির মাঝে রিক্সায় করে ঘুরতে ইচ্ছে করছে। আপনি তো আবার এসব পছন্দ করেন না।" - দিয়া ওর ছোট্ট হ্যান্ড ব্যাগটা হাতে নেয়। আমার খুব ইচ্ছে করছে ওর সাথে রিক্সায় করে ঘুরতে। কিন্তু সে তো আমাকে যেতে বললোনা ওর সাথে। বলবেই বা কেন? এমনি এমনি একটা ছেলের সাথে রিক্সায় করে ঘোরে কেউ? আমি ওর কথার জবাবে শুধু হাসলাম। দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল। আমি বিল মিটিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। দেখি দিয়া তখনও রাস্তার অপর পাশে দাঁড়িয়ে। সবে মাত্র রিক্সা পেয়েছে বোধ হয়। আমি রাস্তা পেড়িয়ে ওর কাছে গিয়ে দাঁড়াই। দিয়া হাসি হাসি মুখ করে চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে থাকে। অবাক হয়ে শুনলাম, আমি বলছি -
- "দিয়া, আমাকে নেবে তোমার সাথে?"
- "আপনি ভিজে যাবেন তো। আমি রিক্সার হুড ফেলে দেবো। বৃষ্টিতে ভিজবো।"
- "আমিও ভিজবো। অবশ্য তুমি যদি এই অপছন্দের ছেলেটার সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে চাও।"
হেসে ফেললো দিয়া। মেয়েটা এত সুন্দর করে হাসে কেন? প্রতিবার হাসার সময় ওর চোখ হাসে।
- "হঠাত আপনার এই অপছন্দের মেয়েটার সাথে নিয়ম ভেঙ্গে বৃষ্টিতে ভেজার শখ হলো যে আজ?"
- "আমি জানিনা কেন। ইচ্ছে করছে, তাই বললাম।"
- "হুম ... বুঝলাম। কিন্তু লোকে দেখলে কি ভাববে?"
- "লোকের ভাবা ভাবিতে কি এসে যায়?"
- "এই তো, লাইনে এসেছেন"
- "মানুষ তার চাওয়া গুলো সব সময় প্রাধান্য দিতে চায়। নিজের চারপাশের গণ্ডীটা ভেঙ্গে বের হতে ভয় পায়। সব কিছু মনের মত করে পেতে চায়। তাতে হয়তো একটা একঘেয়েমী চলে আসতে পারে এক সময়। তোমার সাথে আমার মনের মাঝে গড়া ক্যারেক্টারটার হয়তো মিল নেই। কিন্তু তোমার মাঝে এমন কিছু আছে, যা আমি চাইনি, অথচ কেন যেন তোমাকে আমার ভাল লাগছে। তোমার সাথে আরও কিছুটা সময় থাকতে ইচ্ছে করছে। তোমারও যদি আমার সাথে আরও কিছুটা পথ চলার, আমাকে আরও একটু জানার ইচ্ছে হয়, তবে আমাকে সাথে নিতে পারো।"
- "হুম ... ইচ্ছে তো করছে। চলে এসো, দেখি গাধা পিটিয়ে ... আই মিন গাধা ভিজিয়ে মানুষ করতে পারি না কি।"
দিয়া রিক্সার সিটের বা' পাশে সরে বসলো, আমি অনেক আনন্দ নিয়ে ওর পাশে গিয়ে বসলাম ...
-- সমাপ্ত --
১৮টি মন্তব্য ৭টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প কি পুরোপুরি ভারতের উপর নির্ভরশীল?
অনেক ভারতীয় দের দেখি কেবল পেয়াজ, আলু, কাঁচা মরিচ এসবের উদাহরন দিয়েই সোশাল মিডিয়ায় বাংলাদেশি দের আক্রমন কে প্রতিহত করে! তাই আমরা বাংলাদেশে কি কি পন্য রপ্তানি করি সেই বিষয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন
একটি অরাজনৈতিক গল্প.....
এক অন্ধ ভিখারি ভিক্ষা করতে করতে একদিন রাজপ্রাসাদে
ঢুকে পড়লো। রাজার মনে দয়া এলো।
রাজামশাই মন্ত্রী-কে ডেকে বললেন-
"'জানো হে, এই ভিক্ষুক জন্মান্ধ নন, একে চিকিৎসা করানো হোক। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন
হিন্দু ধর্মের মানুষদের নোৗকায় ভোট না দিতে হুশিয়ারী দিয়েছে সার্ভিস আলম
ঠাকুরগাওয়ে হিন্দু ধর্মের মানুষদের নোৗকায় ভোট না দিতে হুশিয়ারী দিয়েছে সার্ভিস আলম। এবং তাদের ওপরে যে হামলা হয় তার জন্য হিন্দুরাই দায়ী। কারন হিন্দুরা নৌকায় ভোট দেয়। যার ভোট সে... ...বাকিটুকু পড়ুন
মিঠাই লাগাইন্যা শয়তান!! # ২
গাজিয়াবাদের গোপন এক ডেরায় আপার মুখোমুখি বসে মিঠাই লাগাইন্যা শয়তান' বসে মিচকি মিচকি হাসিতেছে।
আপা তারে জিগাইল, 'হাসতে কিউ হু?' (আপার হিন্দী এই রকম, কেউ ভুল ধরিয়েন না)
মিঠাই... ...বাকিটুকু পড়ুন
আরাফাতের ড্রাগ তত্ত্ব বিশ্লেষন
আওয়ামীলীগের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন আরাফাত বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় নিহত রংপুরের শহীদ আবু সাঈদের বিষয়ে মন্তব্য করতে যেয়ে বলে “ আন্দোলনকারীদের অনেকে ড্রাগড ছিল।... ...বাকিটুকু পড়ুন