গত ৩১.১০.২০০৮ তারিখ দৈনিক জনকন্ঠ পত্রিকায় সুমন প্রবাহনের কাব্যগ্রন্থ "পতন ও র্প্রাথনা" নিয়ে মামুন রশীদ এর একটি আলোচনা প্রকাশিত হয়।বই আলোচনাটি নীচে দেয়া হলো।
সময়ের চেয়ে এগিয়ে 'পতন
ও প্রার্থনার' ভাষা
একবার কাছাকাছি দাড়াঁতে পারলে/ আর দূরত্বের ভয় থাকতো না। সুমন প্রবাহনের এই কবিতার মতোই পাঠকের কাছাকাছি দাঁড়ানোর আকুলতা সব কবিরই। তবে তা সবার কপালে জোটে কী-না, এ নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে। পাঠককে নিজের অন্তর্বেদনা অন্তগর্ত বোধ অনূভূতি জানানোর তাগিদ থেকেই শিল্পকর্ম সৃষ্টির প্রয়াস। নিজেকে ব্যক্ত করার তাগিদ থেকে নিজের কথাকে অনেকের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার লক্ষ্য নিয়েই শিল্পকর্ম। তবে সবার লক্ষ্য যেমন এক নয় তেমনি সবার জানানোর মাধ্যমও এক নয়। আর ভিন্নতা নিয়েই শিল্পকর্মের ভূবন। এ ভূবনেরই বাসিন্দা কবি সুমন প্রবাহন। যদিও শরীরী অবস্থান তথা পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছেন তিনি স্বেচ্ছায়। পৃথিবীতে স্বল্পকালীন সময় অবস্থান করে তিনি জীবনের যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন, জীবনের জটিলতা মানবীয় ইতিহাসের যে বৈচিত্র্যময়তা খুঁজে পেয়েছেন আর সেগুলোর বহির্প্রকাশ যেভাবে কবিতায় তুলে এনেছেন তাতে করে তাঁকে কবি বলতে দ্বিধা থাকবে না কারও। তাঁর কবিতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে নিজের ভেতরের এককিত্ব সমাজের চলমানতা ফুটিয়ে তুলেছেন অসম্ভব শৈল্পিক মমতায়।সর্বমোট ৬৪ টি কবিতায় সাজানো সুমন প্রবাহনের প্রথম এবং শেষ কাব্যগ্রন্থ নতুন কোন কবিতা। আর আলোর মুখ দেখবে না। লেখার টেবিলের কাগজ কলম নতুন কোন কবিতা রচনায় কাব্যর যন্ত্রনাকাতরতা অথবা পরিতৃপ্তির ভাষা পড়তে পারবে না। সুমনের প্রতিটি কবিতায় ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর একাকিত্ব। নিজের ভেতরে ক্রমশ একা হয়ে যাওয়া অন্য এক সুমন প্রবাহন। তাই তাঁর কবিতায় বারে বারে ফিরে এসেছে অসঙ্গতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধাচরণ, মৃত্যু চেতনা, নগর জীবনের অসংলগ্ন, ব্যক্তি মানুষের অভিঘাত এসব কিছুই তাঁর কবিতায় মূর্ত হয়ে ওঠে একজন শক্তিমান কাব্যর মতো। তাই কবি বলে ওঠেন, ‘যে আমার রোদ বিকেলের/শান্তি কেড়ে নেয়/ যে আমার বিচ্ছিন্ন করে/ ভাই থেকে বোন থেকে/ এমনকি পিতা / দোযখের কসম/ আমার কিরিচে অগ্নিময়/ হবে কিছু মানুষের লাশ/ আর আমি হাসতে হাসতে/ পৃথিবীর/ কাছে নিজেকে/ খুনি প্রমাণ করে/ বলবো গুডবাই পৃথিবী।’ (চলে যাবো দূর বলয়ে)। সুমন প্রবাহনের কাব্যতায় এই অন্তরঙ্গতা তাঁর এই জ্বলে ওঠার প্রয়াস হতাশা ক্রমশ একা হয়ে যাওয়াই কি তবে তাঁকে আত্মহননের দিকে ঠেলে দিয়েছিল? তবে যে হতাশ বোধ রাজনীতি ও সমাজ সচেতনা সুমন প্রবাহনকে বিচ্ছিন্ন করেছে সেই সব অনুষঙ্গই তাঁকে তাঁর সময় থেকে এগিয়ে দিয়েছে। শূন্য দশকের কবিতার যে ভাষা বিষয় ও বক্তব্য তাঁর থেকে অনেকটাই এগিয়ে সুমন। তাই শুধু কল্পনার রঙিন পাখা নয় বাস্তবতার জমিনে নেমে এসে বলতে পারেন, জেরুজালেমে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলে/ পৃথিবিতে শান্তি ফিরবে কিনা/ এ নিয়ে আমি কোন কর্তকে যাবো না/ শুধু জানি/ জেরুজালেমে ইতিহাস চিরকালে অশান্ত/ যেন চিরকাল কান্না/ সেই ঢেউ পৌছে যায় পৃথিবির কানায় কানায়...।(ইমাম)। সুমন প্রবাহনের কাব্যভাষা কাব্যবোধই তাকেঁ এগিয়ে দিয়েছে সময়ের থেকে। তাই শূন্য দশকের কবি হয়েও সুমন পাঠক বিচ্ছিন্ন নন পাঠককে কাছে টানার মন্ত্র শিখিয়ে দিলেন তাঁর সাথীদের। এই অগ্রগামিতাই সুমন প্রবাহনকে পাঠাকপ্রিয় করে তুলবে এই আশা।
পতন ও প্রার্থনা: সুমন প্রবাহন, প্রকাশক : সুমন প্রবাহন স্মরণ প্রয়াস, প্রকাশকাল: জুন ২০০৮, প্রচ্ছদ: সুমন প্রবাহনের ড্রইং অবলম্বনে, মূল্য: ১০০ টাকা।
মামুন রশীদ
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০০৮ সকাল ১১:০৯