অভীক সোবহান
'আমি তোমার সাথে একমত নই। অ্যালেনের প্রয়োজন ছিল চিৎকারের তাই সে 'হাউল' লিখেছে। আমরা কেন লিখব ? এটা অন্য সময় অন্য যুগ'। কুমার নদীর ধারের ক্ষীণতনু ব্রীজের রেলিং এ বসে সুমন আমাকে বলছিল। আমি তখন অ্যালেন, বিট আর হাংরি জেনারেশের ইতিহাস পড়ে মুগ্ধ। দিন নাই রাত নাই কবিতা কবিতা করে মাথা নষ্ট । প্রিয় শ্লোক - প্রচারবিমুখ মুক্তিযোদ্ধা কবি মুস্তফা আনোয়ারের (১৯৪৩-২০০৬) 'আগামী দিন কবিতার দিন। নিরেট, শক্ত, ঘন কবিতা আমরা পাব ! সে আশাতেই আজও পথে পড়ে আছি।'
সে সময়টা নতুন মিলিনিয়ামের শুরু, ১৯৯৯ হতে থেকে পরবর্তী কয়েকটা বছর। ফরিদপুরের গুড়বচাজার এলাকায় 'ভূমিজ'র সাপ্তাহিক অড্ডা কিংবা চরকমলাপুর ব্রীজ - আমাদের প্রিয় বিকেল বা সন্ধ্যা। আমাদের অর্থাৎ আমি, প্রমোজ হাসান, আবু তাহের সরফরাজ, সিদ্ধার্থ সংকর ধর, বদরুন নাহার কিংবা আমাদের সবুজ শহরের নিয়মিত অথিতি - আকরাম খান, বরকত উল্লাহ মারুফ এবং উজ্জল দুটি নাম - তৌহিদ এনাম (১৯৭৮-২০০৪) আর সুমন প্রবাহন (১৯৭৬-২০০৮)। মনে আছে সুমনের সাথে তৌহিদের প্রথম পরিচয় করিয়ে দেই শাহবাগে। মনে আছে পরিচয়ের মুহূর্তে তৌহিদ সুমনকে স্বাগত জানিয়েছিল সুমনেরই লেখা থেকে 'ভাবছি দিয়াশলাইয়ের প্রথম কাঠিতে আগুন জলে ক'জনার'। ওরা দুজনই এখন কেবল স্মৃতি, কেবল মলাট বন্দী কবিতার বই। ১৯৯৭ হতে ২০০১ দিকে আজিজের বাঁ-দিকের সিড়িটাতে তরুনদের আড্ডাটা বেশি হত। দোতলা-তিনতলার হাফ ল্যান্ডিং এ। ১৯৯৯ পর হতে কালনেত্ররা অর্থাৎ সুমন প্রবাহনরা খুব সরব। তখনও কফিল আহমেদ আর আবু হাসান শাহরিয়ার তরুনদের সাথে নিয়ে মহা আড্ডায় ব্যস্ত। তখনও রিফাত চৌধুরীকে শুধু আজিজ সুপারমার্কেট আর কাটাবন চেনে, টিভির দর্শক নয়। তখন কালনেত্র সহ বেশ কিছু লিটল ম্যাগকে ঘিরে তরুন কবিদের দুরন্তপনায় একটা নতুন প্রজন্মের আগাম বার্তা - শূন্য দশক। আমরা যারা রাজধানীর বাইরে থেকে লেখালেখি করতাম, তাদের সাথে শাহবাগের কবিদের সখ্যতা-পরিচিতি কম ছিল। সেটাই স্বাভাবিক। যদিও পরিধিবাসী হবার কারনে খুব আগ্রহ নিয়ে খোজ খবর রাখতাম ঢাকায় নতুন কি পত্রিকা এল, কারা লিখছে। ইতোমধ্যেই কোন এক ছোট কাগজে শামসুর রাহমান বলেছেন, তরুনদের মাঝে সুমন প্রবাহনের কবিতা তার ভাল লাগে। সে যাই হোক সুমন ব্যতিক্রম অন্য অর্থে - সে খুঁজে বের করেছিল আমাদের। এ ভাবেই সুমনের সাথে ছোট কাগজ 'দ' (খুলনা) ও 'ভূমিজ' (ফরিদপুর) এর লেখকদের অসম্ভব আন্তরিক একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে, পুরোপুরি বন্ধুত্বে রূপ নেয় । আসলে ঢাকা থেকেও জীবনানন্দের দেশে বেড়ে ওঠা সুমন প্রবাহিত হতে চেয়েছিল নতুন দশকে নিজ শহর শুধু নয়, এমনকি দৈশিক পরিমন্ডল ছেড়ে মহাবিশ্ব জুড়ে। ওর লেখা পড়লে এ বিষয়টা সহজেই চোখে পরে। সব সময়ই বলত ঢাকার চেয়ে ফরিদপুর কিংবা বরিশাল কত নির্ভার, কত সহজ - গলা খুলে গান গাইতে ইচ্ছে করে। ওর কন্ঠটা ছিল বেশ জোড়াল, তবে একটু ভাঙা ধরনের। কফিল ভাইয়ের গানগুলো সুমনের গলায় পারফেক্ট ছিল। একের পর এক সিগারেট পোড়াবার ফাকে শুনেছি বুক টান করা গান কুমার নদীতীরের প্রিয় কবিতা পাঠশালায়। সুমনকে খুব পছন্দ করলেও ব্যক্তিগত ব্যস্ততা- বিশেষত একাডেমিক ব্যস্ততার কারনে একনাগারে অনেক সময় কাটানো হয়নি। নানা ঝামেলায় ওর প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বেশ আগেই। কিন্তু তথাকথিত এন্টি-স্ট্যাবলিশমেন্ট এর নামে একাডেমির ওপর বিরূপ মনোভাব দেখিনি ওর মাঝে। বিশেষত এডুকেশনের ব্যাপারে খুব উৎসাহ দিত, অন্তত আমাকে ।
সবই ঠিক, তবুও কোথায় যেন সুর কেটে যাচ্ছিল সুক্ষভাবে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষে ঢাকায় চলে এলাম। কথা ছিল নিয়মিত দেখা হবে সুমনের সাথে। প্রথম প্রথম ফোনে কথা হত। কিন্তু হঠাৎ আজিজে কিংবা বইমেলা ছাড়া সময় হত না সামনা-সামনি। এরই মাঝে ফরিদপুরের এক বন্ধু বলল সুমন বেশ কয়েকবার ওখানে গিয়েছে। হয়ত খুব ভোরে কিংবা মধ্যরাতে। কোথাও নিজেকে মেলাতে পারছেনা নাকি। শুনে মন খারাপ হল খূব। সে পর্যন্তই, বাস্তবতা বড় কঠিন। আমাদের ওকে সময় দেওয়া দরকার। কিন্তু ঠিক উল্টো করলাম আমি এবং আমরা। ও খুব একটা আসে না আর শাহবাগে। তবু হঠাৎ হঠাৎ দেখা হয় আজিজ সুপার মার্কেটে। । দেখা হলে বলে বই কিনতে এসেছিল। হাতে থাকে বই। হঠাৎ বলে ওঠে 'চল তোমার বাসায় যাব, অনেক কথা আছে ' কিংবা 'প্রমোজের ফোন নম্বরটা দাও, ওকে দেখি না বহুদিন'। হয়ত আমার বাসায় তখন আড্ডা দেবার পরিবেশ থাকে না, হয়ত পরদিন সকালে জরুরী কাজ থাকে তাই বাড়ি ফিরে অনেক প্রস্তুতি। ও বুঝতে চায়না। সরাসরি না করতে খারাপ লাগে, নানা রকম কথা বলি। তার পর সুমনকে বাদ দিয়ে বাড়ি ফিরি। মনে জমে থাকে পাপ, জমে থাকে ব্যথা। এমনই একদিন আজিজ সুপার মার্কেটের সামনে দেখা, হাতে বই। জিজ্ঞাসা করতেই বলল 'টেড হিউজ'। ওর পছন্দ সব সময়ই আমার উল্টো । আমার ভাল লাগে 'সিলভিয়া প্লাথ'র কাব্যিক মৃতুভয়, কনফেশন আর রোমাঞ্চকর স্বেচ্ছা মৃত্যু। আমি যখন বলি এ্যালেনের 'হাউল'। ও তখন শুনিয়ে ছিল 'কফিল আহমেদে'র প্রাণময় গান। জীবন ও ভাল বাসত। আমাকে আর বদরুনকে এক সাথে দেখলে বলত, 'দু'জন কবি মিলে সংসার ! তোমাদের দেখে অবাক হই!' আমি ওর একাকিত্বটা বুঝে তাড়াতাড়া বলতাম বদরুন তো আর কবিতা তেমন লিখে না, সে এখন গল্পকার। সুমন সে কথায় গা না করে বলত একদিন বাসায আসবে দেখতে কেমন সংসার করছি আমরা। আসলে জীবনের প্রতি সুমনের ছিল সুতীব্র পিপাসা। খুব বেশি কিছু চায়নি। এই তো ২০০৮ এর বইমেলার একমাস আগে দেখা হল আজিজে আর এপ্রিলে সব শেষ। ওর মৃত্যুর মাস খানেক আগে, সামাজিক-সাংসারিক ভাবনা-দূর্ভাবনার মাঝে বদরুনকে শোনাচ্ছিলাম খুব প্রিয় কিছু লাইন - 'নাগালহীন হাওড়ে তবু কিছু পোড়া পাখি জেনে যায় / ভালো থাকা সেতো- / ডানার নিচে ঠোঁট গুজে এক পায়ে ডাহুক দুপুর'(এক পায়ে ডাহুক দুপুর-সুমন প্রবাহন)। কবিতায় লিখেছিল এমন সব - সরল জীবনের মাদকতা। শেষ পর্যন্ত দেখে যাবার একটা লোভ ওর ছিল। তাইতো দীর্ঘ বিরতিপর এই বইমেলার আগে চেষ্টা করেছিল পান্ডুলিপিটাকে ছাপার রূপ দেবার। হঠাৎ ওর লেখা দেখা গেল কোন এক দৈনিকের সাময়িকীতে। চেষ্টা করেছিল জীবনকে আর একবার গুছিয়ে নেবার, অন্তত একজন কবির মত করে কিংবা লেখকের, একজন বোধ সম্পন্ন মানুষের। সুমনের রেখে যাওয়া 'পতন ও প্রার্থনা' পান্ডুলিপির নাম কবিতা 'পতন ও প্রার্থনা ১ ও ২' এর ঠিক আগের প্রস্তুতিমূলক কবিতা 'হার্ড টক' এ দেখি কনফেশনের দায় ও পূর্ববর্তী সমষ্টিগত কবি জীবনের মূল্যায়ন। ব্যর্থতা স্বীকার করে নেওয়া কিন্তু হতাশা নয়। ও লেখে 'মুক্ত থাকতে যেয়ে আজ বন্দি/.. নেত্রের লেখক...[কালনেত্র] /কুমার নদী ! [ফরিদপুর] তোমার সাথে দেখা হল না /. . . কেমন আছে অম্বিকাপুর [ফরিদপুর]/ আমি তার মানবিক সাহায্যপুষ্ট/. . . কীর্তনখোলা [বরিশাল] নদীতে/ আমাদের স্নান/ - বৃথা নয়।/. . .এখনও রোডে গল্প চলে/ আমি অনুপসি'ত/. . .আমি তোমাদের জানাতে চেয়েছিলাম / সহজ সৌন্দর্যের ঐশ্বরিক গুন/. . .বুকটানে আমাদের [ছোট কাগজ বুকটান, কফিল আহমেদের গানের অ্যালবাম] / যৌথতা কী করে অস্বীকার করি। / কী করে অস্বীকার করি / আমার পতন / যত প্রার্থনা ।”
আসলে খুব বেশী কিছু নয়। ও চেয়ে ছিল সহজ সৌন্দর্যের ঐশ্বরিকতা . . .আপন কবিতার খাতা কিন্তু আমাদের ব্যর্থতা, আমাদের ব্যস্ততা . . . আমরা ওকে দিতে পারিনি কিছুই। এমনকি সাত দিনে একটা ঘন্টা, এক মাসে একটা দিন কিংবা ছ'মাসে একটা মিনিট ! ও লিখেছিল 'বন্ধু তুমি পৌছুলে কী / জানার অপেক্ষায় আমি / আজও আজও হিসেব রাখিনি দিন' (সাপ দুপুরে ডুমনি-সুমন প্রবাহন)। কিন্তু আমার বেঁচে গেছি জীবনের তরে কেননা 'একজন বেঙারিং যুবক হারিয়ে পালিয়েছে' (নিঁেখাজ বিজ্ঞপ্তি-সুমন প্রবাহন)।
কবিতা সূত্র: লাস্ট বেঞ্চ, মে ২০০১(ছোট কাগজ)। ভূমিজ, সেপ্টেম্বর ২০০৩ (ছোট কাগজ)। পতন ও প্রার্থনা (কাব্যগ্রন্থ)- সুমন প্রবাহন।
বি:দ্র: কবি অভিক সোবহানের দেয়া ফেইসবুকের পোস্ট থেকে তুলে দেয়া হল- সুমন প্রবাহন স্মরণ প্রয়াস।