অনন্ত জাহিদ
‘অন্ধকার রাতে নিজস্ব নক্ষত্রের পাহারায়
অনেক চেনা কবরের অচেনা অন্ধকারে
কংকালের গলা জড়িয়ে ধরি
মা, আমার গায়ে খুব জ্বর!’
এ-ই একজন কবির নিয়তি। প্রত্যেক কবির আছে কবিতার নিজস্ব সংজ্ঞা। আরো সত্য- সারা জীবন সে হয়তো সংজ্ঞার মরীচিকায় তৃষ্ণাতুর - ছায়াহীন, নিঃসঙ্গ। তাই কবিতা বহুরুপা। তাই কবিকে সংজ্ঞার কারাগারে খোঁজা অর্থহীন। তাকে আমরা খুঁজবো কবিতায় এবং শুধুই কবিতায়।
‘স্বজনেরা তাকায় আমার চোখে
খোঁজে আমাকে অর্থাৎ সুমনকে
সুমন তো নেই
বসে আছে সুমনের শবদেহ
চিনতে কি পাও আমায়
আমি! আমি! সুমন
তোমাদেরই ভাই-বোন
আমাকে পেয়ে বসেছে এমন নশ্বরতায়
নিজেকে ছাপিয়ে নিজেই হয়ে উঠি
নিজের স্বজন’ (ফিরে দেখা)
এই স্বতন্ত্র উচ্চারনের স্বজন কবি সুমন প্রবাহন আজ আক্ষরিক অর্থেই সকল নশ্বরতার আড়ালে! স্বরচিত এই না থাকা রচনা করছিলেন তখন, যখন তিনি ছিলেন মুখোশের কোলাহলে। সত্যদ্রষ্টাগণ বন্ধুহীন। আজ তাকে বারবার এবং প্রকৃত উপায়ে কাছে পাবার জন্য খোলা রইল তার কাব্যগ্রন্থ ‘পতন ও প্রার্থনা’। মাত্র ৩২ বছর জীবনের বোধিত্বে, বুকে মহাকাল ধারণ ক’রে, দু’হাত মেলে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ভূতগ্রস্থ মহাশূন্যে। কবি স্বাতন্ত্র্য ধারণ করেন কিন্তু অস্বীকার করেন বিচ্ছিণœতা। তার থাকা এবং না থাকা মানুষের ভীড়ে, কিন্তু একা। জীবন ও সৃষ্টির উম্মাদনায় সুমন প্রবাহন ছিলেন মানুষের অব্যক্ত প্রত্যাশার দলিলে। যে- মানুষের মাঝে জাতি-ধর্ম-রাষ্ট্রের কাঁটাতার নেই। যে মানুষটি স্বীকার করে না কোন বিভেদের মন্ত্র। বিভ্রান্ত বাংলাদেশে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্তিহীন সুমন জেনে গিয়েছিলেন
‘আমি হিন্দু কি মুসলিম সেই প্রশ্ন
আজ আমার কাছে প্রশ্ন নয়
মনে হয় মানুষ আমি
অনেক সংশয় বৃষ্টি আর ঝড়ে হেঁটে
এই সিদ্ধান্তে আমি স্থির’ (বাস)
বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের পর যে-প্রজন্ম অর্থবহ মুক্তির জন্য লড়াই করেছে বা বেড়ে উঠেছে, বুক পেতে মৃত্যুকে পরাস্ত করেছে নূর হোসেনের মতো, পুঁজি শাসিত বিশ্ব ব্যবস্থার সমান্তরালে গণতন্ত্রের আপাত স্বস্তির জন্য, তাদের পিঠেই হাসতে হাসতে ছুরি চালিয়ে দিয়েছে হাড় পাকা রাজনীতিবিদেরা।
‘গঙ্গাঋদ্ধি থেকে বাংলাদেশ’ কবিতায় ইতিহাসের নির্মোহ পাঠক এই কবি ব্যবচ্ছেদে আরো নির্মোহ
‘গণতন্ত্র তুমি আমার
কাছে আর
জনগণের মুখচ্ছবি নও
তুমি গুটিকয় মানুষের আঙ্গুলের ইশারা’
সুমনের কবিতায় নিজের বাস্তবতা দেশের বাস্তবতার অভিন্ন। এমনকি প্রাণ-প্রাঞ্জল নিঃসঙ্গ এই গ্রহটির বাস্তবতাও যেন তার ব্যক্তিগত জীবনেরই বাস্তবতা। ধনিকের তালিকায় ফিদেল ক্যাস্ত্রো এলে, ক্যামোফ্ল্যাশে মিকাইল সুমনকে পাকড়াও করলে, যে রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে সংশয়ের দোলা-কে আপন কে পর-সেখানে দাবি নিজেই এসে হাজির হয় নবী মোস্তফার কাছে। এমন বহুকোণ ইঙ্গিতের মূলেও কবি বিশ্বাসে অবিচল তিনিই আছেন কেন্দ্রে। অথবা কেন্দ্রে সেই ‘আমি’ যে সৃষ্টি ও স্রষ্টায় একাকার। ‘যেন আমিই ছিলাম’ কবিতাটির মতো আরো ক’টি কবিতায় ইসলামিক পুরাণ ও প্রসঙ্গ ব্যবহৃত হয়েছে কুশলী প্রজ্ঞায়।
বারবার পাঠ করার মতো ‘ইমাম’ শিরোনামের কবিতাটি বাংলার ভাটিয়ালি, নবাণ্নসহ সকল দেশজতা আত্মস্থ ক’রে, দেশে দেশে যুদ্ধের তান্ডব পেরিয়ে সুমনকে পৌঁছে দেয় পুনরুত্থানের দিকে। পিতা যীশুর প্রতীক্ষা যেন শান্তি সন্ধানের উপায়। যে কোনো মহত কবিতার মতো এ-কবিতাটি খন্ডিত রূপে উপস্থাপনের সুযোগ নেই। প্রতি পাঠে নতুন ভাবনার দিশারী। সকল হতাশা যে আশার সধৈর্য অপেক্ষা হ’তে পারে এবং সর্বকালকে ধারণ করতে পারা বিশ্বাসী উচ্চারণই যেহেতু ধর্মশ্লোকে
রূপান্তরিত হয় এবং এ-কবিতাটি যেহেতু প্রবাহনের প্রার্থণার স্পষ্ট রূপায়ন, সেহেতু উদ্ধৃতি সংস্কৃতিতে সংযত থাকাই শ্রেয়। গ্রন্থের নাম-কবিতা দু’টোও সে পর্যায়ভুক্ত।
কবিতার কাছে এলে বেশি ক’রে মনে পড়ে কে-না ভালবাসার কাঙ্গাল। সে-কাঙ্গালপনায়ও ভাণহীন সুমন। এ-ভালোবাসা সার্বজনীন। কিন্তু যারা সৃষ্টি করেন, যারা মিশে থাকতে চান সৃষ্টির উৎসবে, তাদেরও আশ্রয় চাই। তারাও তো হল্লায় ভাসতে চান বন্ধুত্বের সবুজ জলাশয়ে। কিন্তু কই সেই নির্মল জলাধার - নিসর্গের ঢেউয়ে একান্ত সুজন। আজ স্রষ্টা সমাজও ঈর্ষার এঁদো ডোবায় অহেতুক পাথরের ঢেউ। সৃষ্টি নয়, স্রষ্টাই যেন সকল অস্ত্রের নিশানা। কিন্তু বিচলিত ছিলেন না সুমন প্রবাহন। কবিতা-যাপনে তিনি সকল ঈর্ষার উর্দ্ধে নিজেকে স্থাপন করতে পেরেছিলেন। একই সঙ্গে নিজের কালখন্ডে নিজের উপস্থিতি সম্পর্কে ছিলেন সচেতন। দুই সহস্রাব্দের সংক্রান্তিতে তাই উচ্চারণ করতে পারেন - ‘কবিতায় ঈর্ষা আমি প্রত্যাখ্যান করেছি
মেনেছি শূন্য অতিক্রম করবে
গত সহস্রাব্দ
প্রতিশ্র“তি দেবে
নতুন সহস্রাব্দ
আমরা সুন্দরের উপাসক
ঋণ গত শতাব্দীর
ফেলে আসা শতাব্দী তোমাকে ভালবাসি।,
(আমি আসছি)
সর্বময় প্রেম যুগলের মধ্যেই প্রকাশিত- প্রত্যাশায়, প্রত্যাখ্যানে; অথবা চাওয়া না-চাওয়া পেরিয়ে কোনো নির্লিপ্ত ধ্যানে। ধ্যানী সুমনের মানসপ্রতিমা যেন ‘বন্ধু শেতপদ্ম’। দু’চার শব্দের প্রতীকে সুমন যে প্রেম চিত্রিত করেছেন তা মোহময়। ‘শ্বেতপদ্ম’ কবিতাটি এ গ্রন্থের বাকি কবিতার মেজাজ থেকে আলাদা। এ-কবিতাটির সূত্রেই বলা নেয়া যাক সুমন প্রবাহনের কবিতা অলঙ্কারের ভারে মোটেই জর্জরিত নয়। যে উপমা-প্রতীক-চিত্রকল্প-ছন্দে কবিতাকে আবিস্কারের ধারা বিদ্যমান, তা থেকে সতর্ক দূরত্বে নিজেকে ব্যক্ত করেছেন সুমন প্রবাহন। চেষ্টা তাড়িত, সজ্জা ক্লান্ত কবিতার ভূবনে ‘পতন ও প্রার্থনা’ উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। কবিতা বিমুখ পাঠকও যদি সুমনের মুখোমুখি হন তাহলে তাকে সম্পূর্ণ নিরাশ হ’তে হবে না। আবার ‘চলে যাবো দূর বলয়ে’ কবিতায় ‘আগুন কিরিচ সকালে’র দৃশ্য ধারাবাহিক পাঠকের জন্য তোলা রইল। এ-কবিতার শেষ ঘোষণা পন্ডিতকে তুষ্ট না - করলেও এ-কথা জানিয়ে রাখি - শ্রেষ্ঠতম কবিরও সবটুকু প্রশ্নহীন নয়। ভালোয়-মন্দে মিলিয়ে যেমন মানুষ, কবিতা ও তাই - যেহেতু কবিতা মানুষেরই জন্য।
কবি শিল্পীগণ চয়ন করেন আকাশকুসুম - ঐ ব্যক্তি মানুষটিকে নিয়ে কী পাঠক কী সাধারণের যে অলীক আগ্রহ বা উপেক্ষা তার জবাবে ‘পতন ও প্রার্থনা’ মেলে ধ’রে সোজাসুজি বলা যায় Ñ প্রকৃত কবি’র জীবনই কবিতা; কবিতাই তার জীবন। কালই চিহ্নিত করবে কালজয়ীকে। তবু, একই কালের সহযাত্রী হিসেবে পক্ষপাত আড়ালের চেষ্টা ছাড়াই সবিনয়ে বলি - সুমন প্রবাহন সকল ভনিতা ও আড়ালের খোসা ছাড়িয়ে ফলের মতো, বীজের মতো বাংলা কবিতায় রেখে গেছেন নিজেকে। সেটা তার নিকোটিন তৃষ্ণা হোক অথবা স্মিত পরিহাসে পায়ের বীমা করতে চাওয়াই হোক না কেন। ... আর আছে তার গ্রাম। যে গ্রাম বাংলার পাঁজরে-প্রান্তরে। যে গ্রাম কুমার কীর্তনখোলার পাড়ে পাড়ে - মায়ায়, মাধুর্যে অবিকল বাস্তবতায়।
‘সাদা বক ওড়ে সাত আকাশের বাঁকে
দুধ-ভাত
হোগলা পাতার মাদুরে
মা যদি ডাকে।’
মাত্র চার লাইনের এই ‘মা’ কবিতার প্রসঙ্গে পাঠককে জানাই - মায়ের আকস্মিক মৃত্যুকে ‘আক্ষরিক’ অর্থেই মেনে নিতে পারেননি সুমন। অবিশ্রাম জীবন যন্ত্রণা ও দুর্ঘটনার পাশাপাশি এই শূন্যতা মানসিক বিপর্যয়ের পথ ভেঙ্গে কবি সুমন প্রবাহনকে পৌছে দেয় ১৯শে এপ্রিল, ২০০৮ এ। এ-দিন দুপুরে নিজ ঘরে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন কবি।
(কবি অনন্ত জাহিদের সাথে আমার পরিচয় সুমন প্রবাহনের মৃত্যু পরবর্তী সময়ে। শূন্যমাতাল’র কবিতা সংগ্রহের জন্য অভিজিৎ দাস আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন অনন্ত জাহিদের সাথে। তাঁর সাথে আমার কখনও দেখা হয়নি, এরমধ্যে একবার ঢাকা এসে আমাকে ফোন করেছিলেন কিন্তু তখন একটা কাজে বরিশাল ছিলাম। ফোনে সুমনের স্মারক গ্রন্থ এবং শূন্যমাতাল নিয়ে কথা হতো এবং এ বিষয়ে বিভিন্ন পরামর্শ দিতেন। শূন্যমাতালের সম্পাদনা করতে আমি তাঁকে প্রস্তাব দিলে বলেন, আমি করব কিন্তু আমার মতো করে; এটা ছিলো তার মৃত্যুর তিন চারদিন আগে। অনন্ত জাহিদ নিজ ঘরে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন ৩০ মার্চ, ২০০৯ এ। তাঁর সাথে কথা বলবার সময়ে তাঁকে আমার কখনও অস্বাভাবিক মনে হয়নি।)- তসলিম মুস্তাফিজ