১
নীল নাকি অনেকের প্রিয় রং। রং নিয়া এত রং ঢংয়ের কি আছে বুঝি না, বিশেষ করে নীল রং। বেশিরভাগ বাথরুমের বদনা বালতির রংও নীল। অনেক খ্যাত বিখ্যাত তারকা, লেখক, গুণীজনের সাক্ষাতকারেও প্রিয় রং কি জিজ্ঞেস করা হলে উত্তর আসে নীল। বদনার কালার নিয়া এত লাফালাফির কিছু নাই। জহিরের নীল রংয়ের উপর ক্ষিপ্ত হওয়ার কারণ বেশ কয়েকটা। যুবা বয়সে তন্বী নামক এক বালিকারে নীল খামে চিঠি পাঠাইছিল। চিঠিতে তেমন কিছু লিখা ছিল না। কবিগুরুর দুইটা চরণ লিখা ছিল মাত্র। চরণদ্বয় নিম্নরুপ
"প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস
তোমার চখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ"
ঐ দুইচরণও লিখা হয়েছিল নীল কালিতে। ফাউন্টেন পেনের নীল কালি। দুই লাইনের চিঠি। তার জবাব আসছিল এক লাইনে,
জুতা চিনস জুতা? আবার পুণশ্চও লিখা ছিল। পুণশ্চ অংশ চিঠির চেয়ে বড়।
পুণশ্চঃ যে লোক দুই লাইনের চিঠিতেও বানান ভুল করে তার শুধু সর্বনাশ না আরো কিছু হওয়া উচিত।
জহিরের লিখায় প্রায়ই বানান ভুল হয়। চোখ লিখতে গিয়ে লিখেছিল 'চখ'। কিন্তু জহিরের ধারণা, ভুল টুল না নীল রংই যত গুবলেট হবার কারণ।
এই মুহূর্তে নীলের উপর ক্ষিপ্ত হবার কারণ, আকাশ ঘন নীল। মাঝে মধ্যে দুই এক টুকরো সাদা মেঘ থাকে আজকে তাও নাই। ঘামানোর মত আর্দ্র আবহাওয়াও না তবে চামড়ায় জ্বলুনি হচ্ছে। আজকের দিনে বের হওয়ার সিদ্ধান্তটাই বোধহয় ভুল ছিল। বেরুনোর পর আবার ফেরত যাওয়ারও কোন মানে হয় না। তার গন্তব্য জামতলা নামক একটা জায়গা। সেখানে এক বিরাট ভদ্রলোক থাকেন।
ভদ্রলোকের নাম কাজী নাজিম। কাজী বংশের লোকজনের বেশীর ভাগেরই কোন কাজ থাকে না। প্রচুর জমিজামা থাকে এগুলো বাগা দিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকাই কাজী বংশের লোকদের একমাত্র কাজ। আরও কিছু টুকটাক কাজ অবশ্য তারা করে থাকে। কাজ না বলে অকাজ বলাই ভালো।
যেমন, গ্রামের জমিজামা সংক্রান্ত মামলার সাক্ষী হওয়া।
বিকালে পাড়ার বাজারে চায়ের দোকানে আড্ডা দেয়া।
বিভিন্ন গ্রাম্য সালিশে চেয়ারে বসে অতি গম্ভীর মুখভঙ্গি করে আবুল বিড়ি টানা।
এখনকার সালিশ অবশ্য একটু অন্যরকম। যারা চেয়ারে বসবে তাদের হাতে থাকে সিগারেট। কাজী নাজিম এসবের কোন কিছুতেই নেই। গ্রামের লোকজনকে এড়িয়েই চলেন বলা চলে। তার সম্পর্কে কিছু গুজবও বাজারে বহুল প্রচলিত। তার মধ্যে একটা হল, তিনি পরী বশ করেছেন। পরী হল জ্বীনের স্ত্রী লিঙ্গ। তার বাড়ির ছাদে গভীর রাতে প্রায়ই সাদা শাড়ী পরা কাউকে হাটতে দেখা যায়। শাড়ি পরা মেয়ের চুল খোলা, চোখে কাজল দেয়া। পরীরা কখনোই শ্যামলা বা কৃষ্ণ বর্নের হয় না। তারা সর্বদাই অনিন্দ্য সুন্দরী।
জহির অবশ্য পরী দেখতে যাচ্ছে না। গ্রামে গন্জে গিয়ে পরী দেখার কিছু নাই। পরী দেখার এখন নানান ব্যবস্থা আছে। ইন্টারনেট নামক এক বস্তুর কল্যাণে বিভিন্ন পরীরা অতি সহজেই বর্ণণা সহকারে হাতের মুঠোয় চলে আসে। জহিরের কাজ হল কাজী সাহেবের ছোট্ট একটা ইন্টারভিউ নেয়া। যদি কাজী সাহেব সম্মত হোন তো।
লক্কর ঝক্কর টাইপের বাস। পা সোজা করে বসতে পারা যায় না এমন সিট। স্থানীয় ভাষায় এর নাম মুড়ির টিন। যদিও বাসের গায়ে লেখা মায়ের দোয়া পরিবহন। বাস ছাড়ব ছাড়ব করেও ছাড়ছেনা। যাত্রীসংকট, সব মিলিয়ে দশজনও হবে না। আর দুই একজন যদি পাওয়া যায় এই চিন্তা করে ড্রাইভার বাস ছাড়ছে না। ভ্যাপসা গরমে বাসের ভেতরের পরিবেশ মোটামুটি অসহনীয় পর্যায়ের। তবে যাত্রীরা মনে হল নির্বিকার। তারা বোধহয় এমন দেখে দেখেই অভ্যস্ত।
বিরক্তির তৃতীয় স্তর পার হবার কিছুক্ষণ আগে বাস ছাড়ল। বাসের গতির সাথে শম্বুকগতির মিল আছে। এরমধ্যে ছোটখাট বাজার দেখলেতো দাড়ায়ই রাস্তায় কোন দোকান দেখলেও বাস দাড়িয়ে পড়ছে। এসব জায়গা থেকে যাত্রী উঠছে না। উঠছে হকার, যৌনশক্তিবর্ধক বটিকা বিক্রেতা। বিভিন্ন ভদ্রাশ্লীল ভাষায় বটিকার গুনগান চলছে। প্রত্যেকের কাছে গিয়ে আবার একটা করে স্যাম্পলও রেখে আসা হচ্ছে। জহিরের কানে হেডফোন, তারদিকে একটা স্যাম্পল এগিয়ে দিতে গিয়েও দিল না। কানে হেডফোন থাকা কোন ব্যাক্তিতে স্যম্পল দেয়ার বোধহয় নিয়ম নাই।
ইচ্ছে হলে এখন তুমি নাইতে পারো
বৃষ্টি জলে নুপুর পরে গাইতে পারো
এখানে সবাই স্বাধীন
বাধনহারা
এখানে সবই নতুন, অন্যরকম
অন্যধারা
জহিরের কানে বৃষ্টির গান বাজছে। এই গরমে বৃষ্টির গান শোনার কোন অর্থ নাই। তবুও বাজছে। সবকিছুর অর্থ থাকতে হবে এমন কোন ব্যাপারও নাই।
কিছুক্ষণের মধ্যেই জহিরের ঘুম চলে আসল। ঘুমের মধ্যে একটা স্বপ্নও দেখল। স্বপ্নে জহির একটা ডায়নোসরের পিঠে চড়ে বেড়াচ্ছে। ডায়নোসরের রং নীল, মুখ হাসি হাসি। জহিরকে পিঠে নিয়ে বোধহয় সে লজ্জা পাচ্ছে। টুকটাক কথাও বলছে, জহির আপনার বৃষ্টি দেখতে কেমন লাগে?
-ফালতু, বৃষ্টি মানেই রাস্তার কাদা টাদা জমে। ধুর!
ডায়নোসরের বোধহয় আন্সারটা ভালো লাগে নাই। তাকে একটু আহত মনে হল।
-আচ্ছা বৃষ্টিতে ভিজতে কেমন লাগে?
-আরো ফালতু, ঠান্ডা ঠুন্ডা লাগতে পারে।
এই পর্যায়ে লোকজনের চেচামেচিতে ঘুম ভাঙল। ঘুম ভাঙার পর ব্যস্ত হয়ে বাসের জানালা বন্ধ করতে হল। শার্টের একপাশ বৃষ্টির পানিতে মোটামুটি ভিজে গেল।
জামতলায় যখন বাস পৌছল তখন সূর্য ডুববে ডুববে এমন অবস্থা। আবহাওয়ার পরিবর্তন আগে থেকে টের পাওয়া বড়ই মুশকিল। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এখনও আবার বৃষ্টি নামবে। আশেপাশের দোকানে খোজ নিয়ে জানা গেল কাজী সাহের বাড়ি কাছেই।
জহির আয়েশী ভঙ্গিতে একটা সিগারেট ধরাল, সাথে চা। গুড়িগুড়ি বৃষ্টিও শুরু।
জহিরের শুধু বানান ভুল হয় তা না আজকে দেখা গেল রাস্তাও ভুল করেছে। বাড়ীর সামনের রাস্তা দিয়ে না এসে এসেছে পিছনের রাস্তায়। পায়ে হাটা পথ।
প্রায় সন্ধ্যা। রাস্তার একপাশে কৃষ্ণচূড়া ফুলের গাছ। তার পাশেই একটা মেঠো পথ ধরে গেলেই কাজী বাড়ি। কৃষ্ণচূড়ার অল্প কিছু আগুন রঙা পাপড়ি রয়ে গেছে এখনো। বর্ষার কদমফুলও উকি মারবে এমন একটা সময়। নতুন প্রেমিক প্রেমিকাদের জন্য খুব ভালো একটা আবহাওয়া কিন্তু জহিরের জন্য তা না। তার জন্য আছাড় খাওয়ার ভালো পরিবেশ। এরমধ্যেই কয়েকবার পায়ের তলার মাটি এবং স্যান্ডেল একযোগেই প্রতারণার চেষ্টা চালিয়েছে। সফল হয় নি, তবে একটু সতর্ক করতে পেরেছে জহিরকে।
সঙ্গতকারণেই কয়েকটা গালি কাজী সাহেবের প্রাপ্য। এত ঝামেলার পরে দু একটা অর্থহীন শব্দ মন চাঙা করে দেয় অতি সহজেই।
২
কাজীর বাড়িতে পৌছেই প্রথম যে লোকটির সাথে দেখা তার নাম সামাদ। সামাদের দায়িত্বটা কি ঠিক বুঝা গেল না। দায়িত্ব যেমন বুঝা গেল না তেমনি তার বয়সও বুঝা গেল না। কাজী সাহেব কোথায় জিজ্ঞেস করতেই একটা ঘরের দিকে আঙুল তুলে ইশারা করল।
জহির কোন প্রকার ভদ্রতার ধারে কাছে দিয়ে গেল না।
-আমি ঢাকা থেকে আসছি।
-অজিত বলসিল তোমার কথা।
কাজী সাহেবের সাথে এতটুকুই কথাবার্তা। এরপরই তিনি সামাদকে ডেকে কি কি বুঝিয়ে দিলেন।
সামাদের দায়িত্ব এখন বুঝা গেল। খুব ব্যস্ত ভঙ্গিতে তাকে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখা গেল। আধাঘন্টার মধ্যে একটা রুম পরিষ্কার করে ফেলল। মেস বাড়ির মত ছোট খুপরি রুম না। বেশ বড়সড়, মাঝামাঝিতে একটা খাট তোশক বালিশ কিছুই নাই শুধু একটা চাদর বিছানো। এক কোনায় একটা ডিভান। ডিভানের সোজাসুজি একটা জানালা। অন্ধকারে কিছুই চোখে পড়ল না। আজরাতটা ডিভানেই কাটাতে হবে এমন মনে হল।
ব্যাগটা কোনমতে ছুড়ে ফেলে ঘুমিয়ে পড়া প্রয়োজন। কিন্তু সেটা সম্ভব না। আজকের দিনলিপি ডায়েরীতে উঠাতে হবে। একটু ফ্রেশ হয়েই ডায়েরী খুলে লিখতে বসলো।
১৮ মে, ২০১১
রাশিফল পড়া হয় না। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে পেপার হাতে নিতেই রাশিফল পড়ার কথা মনে হল। আজকে সবই শুভ ছিল, অর্থভাগ্য শুভ, যাত্রা শুভ, প্রেম রোমান্স কোন কিছুতেই অশুভের ছোয়া নাই।
কাজী সাহেবের চেহারা যেমন চিন্তা করসিলাম তার ধারে কাছেও নাই। মুখভর্তি খোচাখোচা দাড়ি, শেইভ করার সময় পাচ্ছে না নাকি নতুন দাড়ি রাখতেসে ঠিক বুঝা গেল না। যারা দাড়ি রাখে তাদের গোফ ছাটা থাকা। এই লোকের তাও না। বয়স আন্দাজ করা কঠিন এমন চেহারা। চুল ছোট ছোট, কদমছাটের মত। দেখে মনে হয় এই লোক কিছুদিন পরপর মাথা কামায় ফেলে। স্বল্পভাষী মনে হল।
এই লোকের কাছ থেকে ইনফরমেশন নেয়া টাফ হবে। সবচেয়ে ভালো হয় যদি উনার কোন ম্যানেজার থাকে। একটা প্রজেক্টের কাজে বেশ কিছু তথ্য দরকার।
এই বাড়ির দোতলায় আমার যাওয়া নিষেধ। আজ সকালে একবার দীপা ফোন করেছিল।
-তুই কোথায়?
-বাসে।
-বাসটা কোথায়?
-রাস্তায়।
-রাস্তা কোথায়?
-এত কিছু বলতে পারব না ফোন রাখ।
-আর জীবনেও আমারে ফোন দিবি না।
আমি কিছু বলার আগেই ফোন কেটে গেল।
সামাদ এসে খাবার দিয়ে গিয়েছে কিছুক্ষণ আগে। খাবারের গন্ধ বিরক্ত লাগতেসে, বমিই করে দিব নাকি বুঝতেসি না।
এটুকু লিখেই ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসলো। জহির ডিভানটাতে গিয়ে শুয়ে পড়লো।
সকালে ঘুম থেকে উঠে ঠিক বুঝা গেল না কটা বাজে। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। অন্ধকার অন্ধকার একটা পরিবেশ। ঘুমানোর পক্ষে চমত্কার আবহাওয়া।
শুয়ে থেকেই একটা পুকুর চোখে পড়ছে। পুকুরের এক পাড়ে চাপা ফুল গাছের সারি আরেকপাশে কৃষ্ণচূড়ার সারি। বৃষ্টিতে কৃষ্ণচূড়ার আগুন রঙ আরো বেশী করে চোখে লাগছে। জহিরের মনে হল বাহ মন্দ না তো।
ভালো মন্দ ছাপিয়ে হঠাত করেই নিরের কথা মনে পড়লো। কাল থেকে একবারও কথা হয় নি মেয়েটার সাথে। সেলফোন হাতে নিয়ে দেখল ফোন অফ। অন করতেই দুটো মেসেজ। এরমধ্যে একটার ভাষা অতি কুত্সিত আরেকটাতে লিখা আপনি আর আমাকে ফোন দেয়ার প্রয়োজন নাই। তার মানে রাগের নবম পর্যায়ে আছে।
"আচ্ছা কল দিব না, এখন থেকে শুধু মেসেজ দিব।"
এটুকু লিখে পাঠিয়ে আবার ফোন অফ করে দিল জহির। ইদানিং মেয়েটা বড্ড জ্বালাতন করছে। কিছু শিক্ষা হোক, ফোন অফ করে রাখা শিক্ষা দেয়ারই একটা অংশ।
আজকে কাজে নামা দরকার। একটু ফ্রেশ হয়ে এসেই দেখল টেবিলে নাশতা দেয়া হয়েছে। নাশতার আইটেম সুবিধার না। জেলী পাউরুটি আর সিদ্ধডিম। ডিমের সাইজ টিকটিকের ডিমের মত। তার উপর টেবিলে পানি দেয়া হয় নাই।
সামাদকে ডেকে দুই একটা কড়া কথা অবশ্যই বলা উচিত। কিন্তু সেটা সম্ভব কিনা কে জানে। চেয়ারম্যান বাড়ির কুত্তাও চেয়ারম্যান হয় আর সেতো কাজের লোক তার মধ্যেও কাজি কাজি ভাব ঢুকে যাওয়ার কথা।
কোনমতে পাউরুটি চালান করে দিয়ে বেরুনো উচিত।
টু বি কন্টিনিউড.............