ইরানে সম্প্রতি হত্যা মামলায় অভিযুক্ত যে নারীকে ফাঁসিতে ঝোঁলানো হয়েছে রোববার তার একটি মর্মস্পর্শী চিঠি প্রকাশিত হয়েছে। ইরানের মানবাধিকার কর্মীরা এটি প্রকাশ করেছেন। ২৬ বছরের রেয়হানে জাব্বারি গত এপ্রিল মাসে তার মা শোলেহ পাকরাভিকে জেল থেকে ওই আবেগঘন চিঠিটি লিখেছিলেন।
প্রিয় শোলেহ,
আজ জানতে পারলাম এবার আমার ‘কিসাস’ (ইরানের আইন ব্যবস্থায় কর্মফল বিষয়ক বিধি)য়ের মুখোমুখি হওয়ার সময় হয়েছে। আমি আমার জীবনের শেষ পাতায় যে পৌঁছে গিয়েছি, তা তুমি নিজের মুখে আমায় জানাওনি ভেবে খুব কষ্ট পেয়েছি। তোমার কি মনে হয়নি যে এটা আমার আগেই জানা উচিত ছিল? তুমি দুঃখে ভেঙে পড়েছ জেনে ভীষণ লজ্জা পাচ্ছি। ফাঁসির আদেশ শোনার পর তোমার আর বাবার হাতে চুমু খেতে দাওনি কেন আমায়?
দুনিয়া আমায় ১৯ বছর বাঁচতে দিয়েছে। সেই অভিশপ্ত রাতেই তো আমার মরে যাওয়া উচিত ছিল, যেদিন আমি হত্যা করেছিলাম। আমার মৃতদেহ ছুড়ে ফেলার কথা ছিল শহরের কোনও অজ্ঞাত কোণে। কয়েক দিন পর পুলিশ তোমাকে ডেকে নিত তাদের অফিসে। তখন তুমি আমার লাশ সনাক্ত করতে।সঙ্গে এটাও জানতে পারতে যে হত্যার আগে আমাকে ধর্ষণও করা হয়েছিল। হত্যাকারী কখনোই ধরা পড়ত না, কারণ আমাদের না আছে অর্থ, না ক্ষমতা। তারপর বাকি জীবনটা সীমাহীন শোক ও অসহ্য লজ্জায় কাটিয়ে কয়েক বছর পর তোমারও মৃত্যু হত। এটাই তো হওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু কীভাবে যেন গল্পটা বদলে গেল। শহরের কোনও গলি নয়, আমার শরীরটা প্রথমে ছুড়ে ফেলা হল এভিন জেলের নিঃসঙ্গ কুঠুরিতে, আর সেখান থেকে কবরের মতো এই শাহর-এ রায় কারাগারের সেলে। কিন্তু এ নিয়ে অনুযোগ কর না মা, এটাই নিয়তির বিধান। আর তুমি তো জানো যে মৃত্যুতেই জীবন শেষ হয়ে যায় না।
মা, তুমিই তো শিখিয়েছ পৃথিবীতে অভিজ্ঞতা লাভ ও শিক্ষা পাওয়ার জন্যই মানুষের জন্ম হয়। প্রতিটি মানুষই নিজের দায়িত্ব নিয়েই পৃথিবীতে আসে। আমি আরো শিখেছি, মাঝে মাঝে লড়াইও করতে হয়। তুমি আমাকে আরো শিখিয়েছ, সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে হলে অধ্যবসায় প্রয়োজন। তার জন্য যদি মৃত্যুও আসে, তাকেই মেনে নিতে হয়।
স্কুলে যাওয়ার সময় তুমি শিখিয়েছিলে, নালিশ ও ঝগড়াঝাটির মাঝেও যেন নিজের নারীসত্তাকে বিসর্জন না দিই। তোমার মনে আছে মা, কত যত্ন করেই না মেয়েদের খুঁটিনাটি আচার ব্যবহার শিখিয়েছিলে আমাদের? কিন্তু তোমার অভিজ্ঞতা ভুল ছিল, মা। কেননা এই ঘটনার সময় তোমার দেয়া কোনো শিক্ষাই আমার কাজে লাগেনি। আদালতে আমায় এক ঠাণ্ডা মাথার খুনি এবং নিষ্ঠুর অপরাধী হিসেবে পেশ করা হয়। কিন্তু আমি এক ফোঁটা চোখের জল ফেলিনি। তাদের কাছে কোনো করুণা ভিক্ষা করিনি। আমি কাঁদিনি, কারণ আইনের প্রতি আমার গভীর আস্থা ছিল।
সেই আমিই কিনা খুনের দায়ে অভিযুক্ত হলাম। মা, তুমি তো জান, আমি কোনোদিন একটা মশাও মারিনি। আরশোলাদের চটিপেটা না করে শুঁড় ধরে জানলার বাইরে ফেলে দিয়েছি। সেই আমিই নাকি মাথা খাটিয়ে মানুষ খুন করেছি! উল্টে ছোটবেলার ওই কথাগুলো শুনে বিচারপতি বললেন, আমি নাকি মনে মনে পুরুষালি। তিনি একবার চেয়েও দেখলেন না, ঘটনার সময় আমার হাতের লম্বা নখের উপর কী সুন্দর নেল পালিশের জেল্লা ছিল। হাতের তালু কত নরম তুলতুলে ছিল। সেই বিচারকের হাত থেকে সুবিচার পাওয়ার আশা অতি বড় আশাবাদীও করতে পারে কি? তাই তো নারীত্বের পুরস্কার হিসেবে মাথা মুড়িয়ে ১১ দিনের নির্জনবাসের হুকুম দেওয়া হল। দেখেছ মা, তোমার ছোট্ট রেহানা এই ক’দিনেই কতটা বড় হয়ে গিয়েছে?
প্রিয় সোলেহ, এসব শুনে তুমি আবার কাঁদতে বসোনা। প্রথম দিন থানায় এক অবিবাহিত এজেন্ট আমার লম্বা নখ নিয়ে কথা শোনালেন। আমি বুঝলাম, এসব জায়গায় সৌন্দর্য কোনো বিষয় নয়। সৌন্দয় তো অনেক বড় বিষয়। সৌন্দর্য দেখায়, চিন্তায়, সদিচ্ছায়, হাতের লেখায়, সৌন্দর্য চোখের তারায় এমনকি দৃষ্টিভঙ্গিরও তো সৌন্দর্য রয়েছে। এছাড়া মানুষেন কণ্ঠেও তো সৌন্দর্যয় থাকে।
কিন্তু প্রিয় মা, আমার সব মতাদর্শ এখন বদলে গেছে। অবশ্য এজন্য তোমার কোনো ভূমিকা নেই। আমাকে একদিন ফাঁসিতে ঝুঁলানো হবে। তখন তুমি থাকবে আমার কাছ থেকে অনেক দূরে। আমি তোমার জন্য রেখে যাব আমার হাতের লেখা। তোমার জন্য এগুলো হবে আমার স্মৃতি।
এবার আমার অন্তিম ইচ্ছেটা বলি শোনো। কেঁদো না মা, এখন শোকের সময় নয়। আমি চাই তুমি আদালতে যাও এবং তাদেরকে জানাও আমার এই শেষ ইচ্ছা। কারাগারে থেকে আমার পক্ষে তাদেরকে চিঠি লেখা সম্ভব নয়। তাই আমার জন্য আবারও তোমাকে কষ্ট পেতে হচ্ছে। এরপর আর কোনদিন তোমাকে কষ্ট দেব না মা। এর আগে আমি তোমাকে বারবার বলেছি, ওদের কাছে আমার জন্য প্রাণভিক্ষা করোনা।
আমার দয়ালু মা, প্রিয় শোলেহ, তুমি আমার জীবনের চাইতেও প্রিয়। আমি চাইনা মৃত্যুর পর আমার এই দেহ মাটিতে পচে যাক। এটাও চাইনা আমার চোখ বা তাজা হৃদয় ধুলোয় মিশে যাক। তাই অনুরোধ, আমার হৃদপিণ্ড, কিডনি, চোখ, হাড্ডি এবং অন্যান্য অঙ্গ প্রতিস্থাপণের ব্যবস্থা কর। যাতে এ পৃথিবীর অন্য কোনো মানুষ এগুলো থেকে উপকৃত হয়। তাদের জন্য এগুলো হবে আমার উপহার। তবে আমি যাদের দেহে এসব অঙ্গ প্রতিস্থাপিত হবে তাদের কাছে যেন আমার নামটি গোপন রাখা হয়। আমি চাই না এর জন্য আমার সমাধিতে কেউ ফুলের তোড়া রেখে আসুক। কিংবা গোরস্থানে গিয়ে প্রার্থনা করুক। এমনকি তুমিও নয়। আমি চাই না আমার কবরের সামনে বসে কালো পোশাক পরে কান্নায় ভেঙে পড় তুমি। বরং আমার দুঃখের দিনগুলো তুমি ভুলে যেও। সেসব স্মৃতি ভাসিয়ে দিও হাওয়ায়।
এই পৃথিবী আমাদের ভালোবাসেনি, মা। চায়নি আমি সুখী হই। এখন আমি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চলেছি। তবে ঈশ্বরের আদালতে আমি সুবিচার পাবই। সেই আদালতে দাঁড়িয়ে আমি অভিযোগ করব পুলিশ ইন্সপেক্টর শামলোউ, আদলতের বিচারক এবং দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকদের বিরুদ্ধে। তারা আমাকে নিষ্ঠুরভাবে প্রহার করেছে এবং নানাভাবে হয়রানি করতেও পিছুপা হয়নি।
আমি আরো অভিযোগ করব আদালতের স্রষ্টা ডা. ফারবেন্দি এবং কাসেম শাবানির বিরুদ্ধেও। কারণ তারা আমার অধিকার বুটের নিচে পিষে দিয়েছে, বিচারের নামে মিথ্যা ও অজ্ঞানতার কুয়াশায় সত্যকে আড়াল করেছে। একবারও বোঝার চেষ্টা করেনি, চোখের সামনে যা দেখা যায় সেটাই সর্বদা সত্যি নয়।
আমার নরম মনের শোলেহ, মনে রেখো সেই দুনিয়ায় তুমি আর আমি থাকব অভিযোগকারীর আসনে। আর ওরা দাঁড়াবে আসামীর কাঠগড়ায়। দেখিই না, ঈশ্বর কী চান! মাগো, মৃত্য হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি তোমাকে জড়িয়ে রাখতে চাই। মা, আমি যে তোমায় খু-উ-ব ভালোবাসি!
প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সকল আবেদন উপেক্ষা করে শনিবার সকালে তেহরানের এক কারাগারে রেয়হানে জাব্বারির ফাঁসি কার্যকর করা হয। ইরানের গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক কর্মকর্তা মোর্তুজা আবদুল আলি সারবান্দিকে হত্যার ঘটনায় ২০০৭ সালে গ্রেপ্তার হন জাব্বারি। আদালতে এই হত্যার কথা স্বীকার করে তিনি বলেছিলেন, নিজের ইজ্জত বাঁচাতেই তিনি ওই ব্যক্তিকে ছুরি চালিয়ে হত্যা করেছিলেন। এ ঘটনায় ২০০৯ সালে তার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড রায় দিয়েছিলেন তেহরানের এক ফৌজদারি আদালত ।
সূত্র- বাংলামেইল ২৪ডটকম