somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলার ইতিহাসে প্রথম নারী অভিনেত্রী বিনোদিনী দাসীর কথা

২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১২ বিকাল ৫:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

“ইহা কেবল অভাগিনীর হৃদয়- জ্বালার ছায়া, পৃথিবীতে আমার কিছুই নেই শুধুই অনন্ত নিরাশা, শুধুই দুঃসময় প্রানের কাতরতা! কিন্তু তাহা শুনিবার লোক নাই। মনের ব্যাথা জানাইবার লোক জগতে নাই। কেন না আমি জগত মাঝে কলঙ্কিনী পতিতা। আমার আত্নীয় নাই, সমাজ নাই, বন্ধু নাই, বান্ধব নাই আমি ঘৃনিত বারনারী।“ বলছিলাম বাংলার ইতিহাসে প্রথম নারী অভিনেত্রী বিনোদিনী দাসীর কথা। যার অভিনয় প্রতিভায় আজকের বাংলা এই পর্যায়ে এসেছে তাকে আমরা ক’জনাই বা চিনি? ক’জনা তার নাম জানি? আমার এ লেখা আজ তার জন্মসার্ধশতবৎসরে তার প্রতি আমার বিন্ম্র শ্রদ্বা নিবেদন।

প্রথম অভিনয় ১২ বৎসর বয়সে ১৮৭৪ সালের ২রা-১২ ডিসেম্বর, আর ১২ বৎসর বাদে ১৮৮৭ সালের ১লা জানুয়ারী তার শেষ অভিনয়ের দিন “স্টার” রঙ্গমঞ্চে অভিনীত নাটকের সংখ্যা ৮১টি।

উপেক্ষা ছিল সমকালে উপেক্ষা আছে এ কালেও, অমরেন্দ্রনাথ দত্ত অভিনয় শিল্পীদের জীবনি গ্রন্থ “অভিনেত্রী কাহিনী” বলে একটা বই ১৯১৫ সালে প্রকাশ করেন, সেখানে বিনোদিনীর একটি ছবি ও সামান্য মন্তব্য আছে, অথচ সে গ্রন্থেই তারাসুন্দরী, তিনকড়ি, সুশীলাবালা, নরীসুন্দরী, কুসুমকুমারী, বনবিহারী, রানীসুন্দরী, হরিসুন্দরীর কথা যেভাবে স্থান পেয়েছে বিনোদিনীর গুরুত্ব আনুযায়ী সে ভাবে পায়নি। ঊল্লেখ্য উপরোক্ত অভিনেত্রীরা প্রায় সবাই বিনোদিনীর হাত ধরে বাংলা নাট্য মঞ্চে প্রবেশ করে। এর পিছনে কি নাট্য জগতের কোন রাজনীতি কাজ করত? আমি বলব অবশ্যই। কারন বিনোদিনীর সঠিক মূল্যায়ন করতে গেলে সে কালে অনেক রথী মহারথীর নাম এতভাবে পাদ প্রদীপের নীচে আসে না।

একজন বারবনিতা যে কিনা টাকার কাছে বিক্রি হতে অভ্যস্ত, অথচ থিয়েটার কে ভাল বেসে গুর্মূখ রায়ের ৫০০০০ টাকা ও পায়ে দলে যায়। বিত্তশালী গুর্মূখ চেয়েছিল বিনোদিনী নাটকে না এসে শুধু তার বাধা মেয়ে মানূষ হিসাবে থাকবে। ১৮৮৩ সালের দিকে গিরিশ ঘোষ স্টার থিয়েটার গড়ে তুলেছিলেন।কারণ গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের মালিক ছিলেন একজন অবাঙ্গালী ব্যবসায়ী প্রতাপচাঁদ জহুরী, যিনি থিয়েটারকে ব্যবসা হিসেবেই দেখতেন। তাই তাঁর অধীনে কাজ করা গিরিশ ঘোষ এবং বিনোদিনী কারও পক্ষেই সহজ ছিল না। থিয়েটার গড়ে তোলার জন্য যে রকম টাকা পয়সা দরকার ছিল , তা গিরিশ ঘোষের ছিল না। একজন ২০-২১ বছরের ব্যবসায়ী গুরমুখ রায় অর্থ সাহায্য প্রদান করেন।থিয়েটারের চেয়ে তার বিনোদিনীর প্রতিই বেশি আকর্ষণ ছিল। গুরমুখ রায় বিনোদিনীকে ৫০ হাজার টাকায় কিনে নিতে চেয়েছিল যাতে সে অভিনয় ছেড়ে দেয়।বিনোদিনী আংশিক রাজী হন সে প্রস্তাবে কারণ তিনি অভিনয় ছাড়তে রাজী ছিলেন না। গুরমুখ রায়ের রক্ষিতা হন বিনোদিনী।এই ঘটনায় তাঁর পূর্ববর্তী মালিক ধনী জমিদার ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং তিনি লাঠিয়াল দিয়ে নতুন থিয়েটার ভেঙ্গে দিতে চেষ্টা করেন।সেই ধনী জমিদার তলোয়ার হাতে বিনোদিনীর শোবার ঘরে প্রবেশ করে তাকে খুন করতে উদ্যত হন। কিন্তু বিনোদিনী উপস্থিত বুদ্ধির জোরে সে যাত্রা বেঁচে যান। বিনোদিনী তার আত্নকথায় কখন ও নিজের বারবনিতা পরিচয় গোপন করার চেষ্টা করেন নি। কিন্ত অভিনেত্রী হিসাবে তো নয়ই, লেখিকা হিসাবেও নয় হয়ত মানুষ হিসাবেও তার মূল্যায়ন হয়নি। উল্লেখ্য বিনোদিনী ৪০ বৎসর কাল বেশ কিছু লেখা লিখছেন হয়ত সাহিত্যের মান দন্ডে উচু মানের কিছু না কিন্তু তার থেকেও অনেক কাচা হাতের লেখা এ সমাজে প্রতিষ্টা পেয়ে গেছে।

বিনোদিনীর নাট্য গুরু গিরিশ চন্দ্রর প্রচ্ছন্ন প্রতিদ্বন্দ্বীতা এ ক্ষেত্রে বিনোদিনীকে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করেছে। গিরিশ্চন্দ্র এ অভিযোগ থেকে কোন দিন রেহাই পাবেনা। বিনোদিনী ধনী যুবক গুর্মুখ রায়ের ৫০০০০ টাকার প্রলোভন ত্যাগ করেন । বরং বাংলা থিয়েটারের উন্নতির জন্য তিনি নতুন থিয়েটার খুলতে রাজি হন এবং গুর্মুখ রায়ের রক্ষিতা হতেও রাজি হন । বিনোদিনীর ইচ্ছা ছিল যে নতুন থিয়েটার তৈরি হবে তা বিনোদিনীর নামে বি-থিয়েটার হবে । কিন্তু কিছু মানুষের প্রতারনার শিকার তিনি হন । যাঁদের মধ্যে তাঁর নিজের অভিনয় গুরু গিরিশচন্দ্রও ছিলেন । বিনোদিনীর ত্যাগ স্বীকারে যে নতুন থিয়েটার তৈরি হয় বিনোদিনীর নাম তাতে থাকেনি । এই নতুন থিয়েটারের নাম হয় স্টার থিয়েটার । অবশ্য অভিনেত্রী হিসাবে বিনোদিনীর প্রসংশা করতে কার্প্যন্য করেন্নি গিরীশচন্দ্র।

এ ক্ষেত্রে স্বপনবুড়োর “শতবর্ষের আলোকে আমার দেখা নাট্য রথী মহারথী” থেকে উল্লেখ্য করা গেল, তখন আমার কৈশর কাল বলা চলে। স্কটিশ বিদ্যালয়ের নিচু ক্লাশে পড়ি, থাকি ভাড়া বাড়িতে ১৪৫ কর্নোয়ালিশ ষ্ট্রিটে। এই বাড়ীর মালিক গিরীশচন্দ্রের মন্ত্র শিষ্যা সেকালের নাট্য সম্রাজ্ঞী শ্রীমতি বিনোদিনী দাসী। বিনোদিনী তখন সবে রঙ্গালয় থেকে অবসর গ্রহন করেছেন। প্রতিদিন একটি কমন্ডুল নিয়ে আমাদের বাসা বাড়ীর সামনে দিয়ে গঙ্গাস্নান করতে যেতেন। গায়ের রং তখনও পাকা মর্তমান কলার মত। বড়দের কাছে গল্প শুনতাম এই বিনোদিনীর গিরীশ চন্দ্রের “চৈতন্যলীলায়” চৈতন্যের ভূমিকায় অভিনয় করে সারা বাংলাদেশকে মাতিয়ে তুলছিলেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ চৈতন্য লীলায় অভিনয় দেখে এই বিনোদিনীর মাথায় হাত রেখে আর্শীবাদ করে ছিলেন, তোমার চৈতন্য হোক। আরো শুনছিলাম এই ষ্টার থিয়েটার তার নাম করনে হবার কথা ছিল কিন্ত গীরিশচন্দ্রের আপত্তিতে তা হয়নি।“


বিনোদিনী যখন দ্বিধাহীন চিত্তে বলেন –‘ জ্ঞানী গুনী বিজ্ঞ ব্যাক্তিরা লেখেন লোক শিক্ষার জন্য, পরোপকারের জন্য, আমি লিখিলাম আমার নিজের স্বান্তনার জন্য, হয়তো প্রতারনা বিমুগ্ব নরক পথে পদবিকোর্পোদ্যতা কোন অভাগিনীর জন্য। কেননা আমার কোন আত্নীয় নাই, আমি ঘৃনিত, সমাজ বর্জিতা, বারবনিতা, আমার মনের কথা বলিবার বা শুনিবার কেহ নেই। তাই কালি কলমে লিখিয়া আপনাকে জানাইলাম। আমার কলূষিত কলঙ্কিত হৃদয়ের ন্যায় এই নির্ম্মল সাদা কাগজকে ও কলঙ্কিত করলাম। কি করিব! কলঙ্কিনীর কলঙ্ক ব্যাতীত আর আছে কি?

আছে- অনেক কিছু আছে- যন্ত্রনার, বঞ্ছনার, উপেক্ষার বিস্মৃতির জাল সরাইয়া একটি সৃজনশিল সত্ত্বা আবিস্কারের আমার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা তো থাকতে পারে

বিখ্যাত মঞ্চ অভিনেত্রী শিমুল ইউসুফ বিনোদিনী চরিত্রকে মূল্যায়ন করেন এভাবে বিনোদিনী দাসী নিজেই তো নেচে-গেয়ে অভিনয় করে যান, আমি তো নিমিত্ত মাত্র। আজ জীবনের অন্য পার থেকে শ্রীমতি বিনোদিনী দাসী আপনি অন্তত এটুকু জানুন ভালোবাসায় ভাগ্য ফেরে না যদিও, ভালোবাসা গড়ে দেয় পূজ্য শিল্পপ্রতিমা। আজ এই মঞ্চায়ন আপনার নামেই সম্মান বহন করবে, যে সম্মান নিরন্তর বহন করে চলেছেন শিমুল ইউসুফ।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মার্চ, ২০১৩ ভোর ৬:৩২
১৮টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×