ঐতিহাসিক শ্যামলকান্তি নাথের একটি পুরানো বই পড়তে যেয়ে সহস্রবুদ্বি নামে এর বাঙালির স্মৃতি কথা পেলাম। পড়তে পড়তে বারবার মনে হচ্ছিল আমিই যেন সহস্রবুদ্বি। পড়া শেষ হল কিন্তু এখনও আমি সহস্রবুদ্বির সাথে বসবাস করছি। সহস্রবুদ্বির সাথে আমার বসবাসের মাঝেই শুনুন আমার কথা
আমার নাম সহস্রবুদ্বি। নিবাস বাংলাদেশ। জন্ম ১০০০ খ্রীষ্টাব্দে। এখন আমার ৩৬ বছর বয়স। এ বছর রাজা মহীপালের রাজত্ব শেষ হল। রাজপুত্র ন্যায়পাল সিংহাসনে বসবেন কিছু দিনের মধ্যে। পাল রাজাদের গৌরব সূর্য প্রায় অস্তমিত। রাজা মহীপালের দরবারে আমি এক সামান্য কর্মচারী হলেও অভিজ্ঞতা অনেক। আমার কালের শ্রেষ্ট সঙ্গীত নির্ভর সাহিত্য চর্যাপদ। এ কালের কবিদের সবাই জানে সিদ্বাচার্য বলে। ৯২৫ থেকে ১০০০ সাল পর্যন্ত যারা চর্যাগিতী লিখে নাম করেছিল তাদের মধ্যে আমার প্রিয় দোহা লেখক হলেন কাহ্নপা, তবে গোরখপা, জলন্ধরপা, তিলোপা, নারোপা এবং মৈত্রীপা ও আছে। নামের শেষে “পা” মানে পদ। যেমন মৈত্রীপা মানে মৈত্রীপদ। এমন ভাবেই এ যুগের সিদ্বাচার্যদের নাম লেখা হয়েছে। কাহ্নপার একটা দোহা মনে পরে গেল।
সুন তরু বর গঅণ কুঠার।
ছেবহ সো তরু মূল ন ডাল।
“মানে হলঃ শুন্য গাছ। আকাশ যেন কুঠার। কেঠে ফেল সেই গাছ কান্ড আর ডালপালা না রেখে।“
আমাদের চর্যাগীতির লেখকরা সাধন পুজো করতেন। সন্ধ্যাভাষায় গান বাধতেন নানা রাগরাগিনী অবলম্বন করে। এ দের কেউ কেউ বাঙালী হিসাবে গর্বও করত। যেমন গুর্জরী রাগে একজন গান বেধেছিলেন
বাজ নাব পাড়ী পঊআ খালে বাহিঊ
অদঅ বাঙ্গালে লুড়িঊ।।
আজ ভুসুক বাঙ্গালী হল
আমার জন্মের বছর ১০০০ খ্রীষ্টাব্দে প্রথমবার ভারত আক্রমন করেন সর্বকালের কুখ্যাত লুটেরা সুলতান মাহমুদ। ঠিক তার দুবছর আগে সিংহাসনে বসেন সুলতান। সিংহাসনে বসেই প্রতিজ্ঞা করেন ফি বছর ভারত আক্রমন করবেন। কথা রেখে ছিলেন তিনি। ২০/২১ বছরের মধ্যে ১২ বার লুন্ঠন করেন ভারত। প্রথম অভিযানে পেশোয়ারের কাছে কয়েকটি দুর্গ দখল করে নেন, দ্বিতীয় আক্রমনে দূলিসাৎ করেন সেগুলো। যদিও রাজা জয়পাল খুবই চেষ্টা করেন প্রতিরোধ করার। কিন্তূ মামুদের ১৫ হাজার সৈন্যসামন্তের তোড়ে ভেসে যায় জয়পালের ১২ হাজার অশ্বারোহি, ৩০ হাজার পদাতিক, আর ৩০০ হাতির বিরাট বহর। তবে মামুদ আমার কাছে বিভীষিকা হয়ে আছেন অন্য কারনে। আমার বয়স তখন ১১ বছর। সুলতান বর্বর অভিযান চালালেন থানেশ্বর মন্দিরে, নগর ধবংস করেই থামলেননা, ভাঙ্গলেন মূর্তি, মন্দির, লূট করলেন দেবোত্তর সম্পত্তি, ধনদৌলত মনি মুক্তা।
প্রথম অভিযানের স্মৃতি হিসাবে সাত বছর পর সুলতান মামুদ তার বিজয় কৃতির স্মারক হিসাবে চালু করলেন “দিনার” নামে স্বর্নমুদ্রা। তবে আমরা আশ্চর্য হলাম যখন “দিরহাম” মূদ্রাগুলো প্রবর্তন করেন। এই তো কয়েক বছর আগে হিজরি ৪১৮-১৯ বা ১০২৮ খ্রীষ্টাব্দে। লাহোর জয় করে তিনি এর নাম দেন মামুদপুর। সেখান কার টাকশাল থেকে রুপোর মুদ্রা ছারলেন বাজারে, দুই ভাষায় দুই লিপিতে। এর এক পিঠে উপনিষেদের একশ্বর বন্দনা, অন্য পিঠে কুরান এর দুয়া। আরবি ভাষার কুফিক লিপিতে লেখা কোরান থেকে ইসলামি কলেমা ছাড়াও মূদ্রা প্রবর্তক, টাকশালের নাম এবং তারিখ। “আমিন-ঊদ-দ্দৌলা ওয়া আমিন উল মিল্লত বিসমিল্লাহ আল দিরহাম জরব বে মাহমুদ পুর সনহ ৪১৮। অপর পিঠে দেবনাগরী ভাষায় লিখা আছে “অব্যক্তমেকম মুহাম্মদ অবতার……নৃপতি মাহমুদঃ।“
ওদিকে আমার জন্মের বছর খানেকের মধ্যে পূর্বী চালুক্যদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি হয়ে রাজ্যটা টুকরো টাকরা হয়ে যাচ্ছিল। সেই সময় হাল টেনে ধরেন দার্ণাবের ছেলে শক্তিবর্মন। ফিরে আসে শান্তি ও শৃঙ্খলার বাতাবরন। তবে দক্ষিন্যাত্যর সব চেয়ে বড় ঘটনা হল ১০০০ সালেই। চোলরাজ রাজারাজ, যিনি ইতিমধ্যেই নিজেকে একছত্র অধিপতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।, জয় করেছেন, কলিঙ্গ, মালদ্বীপ এমন কি সিংহল। তার এক মহান কৃতি তাঞ্জাবুরের এক মনোমুগদ্বকর শিবমন্দির নির্মান। তার নামেই পরিচিত হয় এই কারুকাজ করা মন্দিরটি। পরে নাম পালটে হয় বৃহদীশ্বর।
মন্দিরের কথা যখন ঊঠল তখন খাজুরাহোর দেয়ালয়ের কথা কিভাবে ভূলি।খাজুরাহো গ্রামে এই মন্দিরগুলো তৈরী করেন চান্দেল্লা রাজারা। বিষ্ণূর বৈকুন্ঠরুপী মুর্তি যে মন্দিরে এখনো পুজো হচ্ছে তার নাম লক্ষন মন্দির।রাজা যশোবর্মন তৈরী করেছেন এটি ৯৫০-৫৫ খ্রীষ্টাব্দে। ১০০২ সালে অন্য এক চন্দ্রেল্ল নৃপতি ধঙ্গ তৈরী করেন বিশ্বনাথ মন্দির। মন্দিরের গায়ে যেমন দেবদেবীদের মূর্তি আছে তেমনি আছে সুর সুন্দরীদের ছবি কেউ কেউ আয়নায় প্রসাধনে ব্যাস্ত, কারো পায়ে কাটা ফুটে যাওয়ায় কাটা তুলতে ব্যাস্ত, এমন অপরূপ ছবি আমি কোথাও দেখিনি।
ঠিক এই সময় মালব দেশের ধারায় রাজ্যভিষেক হল ভোজরাজার। এই সময় বলতে আমি কিন্ত আমার জন্ম সময়কেই উল্লেখ্য করছি। তিনি কিন্ত অনেক শক্তি রাখতেন তার বাব সিন্ধুরাজের চেয়ে। অভিষেকের আট বছর পর তিনি সাহাযা করেন শাহিপালকে সুলতান মাহমুদের বিরুদ্বে। এরা কিন্ত ছিলেন পরমার বংশের রাজা। ভোজরাজা ছিলেন সাহিত্যপ্রেমী। অলঙ্কারশাস্ত্র, ব্যাকরন, চিকিৎসাশাস্ত্র, জোত্যিবিদ্যা, যোগশাস্ত্র ছাড়াও ধর্মশাস্ত্র ছাড়াও অনেক বই লিখছেন। এমন কি বঙ্গালদেশের দুজন ধর্মশাস্ত্র লেখক জিতেন্দ্রিয় এবং বালক তার মন্তব্য নিয়ে বই লিখছেন।
এবার আমার প্রিয় সিদ্বাচার্য কাহ্নপার গল্প বলি। কাহ্নপার আসল নাম আচার্য কৃষ্ণচারী। দেশ সোমপুর, রাজা দেবপালের প্রতিষ্টিত সোম্পুর বিহারের ভিক্ষু ছিলেন। জলধারপা ছিলেন তার গুরু। বার বছর সাধনা করার পর এক ভূমিকম্পের দিনে তার মনে হল সে বজ্র দেবতার সাক্ষাতকার পেয়েছেন।তার মা ডাকিনি বললেন খোকা, “ভূমিকম্প অশুভ লক্ষন। তাই উল্লসিত হোয়না দেবতার সাক্ষাতকার পেয়েছ বলে”।
কাহ্নপার গর্ব আর বিনাশ নিয়েও কিছু গল্প আছে, একদিন পাথরে পা রাখা মাত্র পাথরটি ডুবে গেল, কাহ্নপার মনে হল আমি চুড়ান্ত সিদ্বি লাভ করছি, তার মনে গর্ব এল। তার পর যখন পা তুললেন দেখলেন তার পা মাটির এক হাত ঊপর, তখন তার আগের চেয়েও গর্ব হল, তারপর আকাশে সপ্তছত্র দেখা দিল, সাত ডমড়ুর ধবনি আপনা থেকে বেঝে ঊঠল, এই সব দেখে কাহ্নপা ভাবল তার সিদ্বিলাভ হয়ে গেছে। শিষ্যদের ডেকে বললেন তিনি সিদ্বি লাভ করছেন। সমুদ্রতীরে এসে শিষ্যদের রেখে তিনি সমুদ্রের উপর দিয়ে হাটতে লাগলেন। প্রচন্ড অহ্ঙ্কারে ভাবলেন আমি যা করতে পারি আমার গুরু জলন্ধারপা ও তা পারেনা।এ কথা ভাবতেই সমুদ্রের জ্বলে ডুবে গেলেন। জলের অতলে তলিয়ে যেতে যেতে দেখলেন তার গুরু জলন্ধরপা তার সামনে এসে হাজির। গুরু জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে তোমার? কাহ্নপা বুজতে পারলেন অহঙ্কার তার সমস্ত কিছু হরন করছে। গুরু জলন্ধরপা একটু হেসে বলেন অহঙ্কার আর ঈর্ষা মানুষের সব গুন নষ্ট করে। এই বলেই জলন্ধরপা মিলিয়ে গেলেন।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ১২:০৬